চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ছয়
অজয়ের ধারে কেন্দুবিল্ব গ্রাম। একমাস পথশ্রমের ফলে ব্রাহ্মণ-কন্যা পদ্মাবতীকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে কেন্দুবিল্ব গ্রামে উপস্থিত হলো। এবং এক ব্রাহ্মণ গৃহস্থের বাড়ীতে অতিথি হয়ে উঠলো। পদ্মাবতীর সেই অলোকসামান্য রূপলাবণ্য দেখে গৃহস্থ নিজের কন্যার মতন সমাদর করে তাকে গ্রহণ করলেন। সেইখানে থেকে ব্রাহ্মণ স্বপ্ন-বর্ণিত জয়দেব গোস্বামীর অনুসন্ধান করবার মনস্থ করলে।
ব্রাহ্মণের ধারণা জয়দেব গোস্বামী নিশ্চয়ই কোন বিশেষ ধনী ও সম্ভ্রান্ত কোন বংশের সন্তান হবে, নইলে দেবতার এতখানি অনুগ্রহ-দৃষ্টি কেন তার ওপর থাকবে? কিন্তু প্রথম অনুসন্ধান করতে গিয়েই ব্রাহ্মণ হতাশ হয়ে পড়লো, জয়দেব গোস্বামী বলে কোন পরিচিত ব্যক্তিরই খবর কেউ দিতে পারে না। আশ্রয়দাতা গৃহস্থ যখন ব্রাহ্মণের মুখে শুনলেন যে পদ্মাবতীর সঙ্গে সেই জয়দেব গোস্বামীর বিয়ে দেবার জন্যে তিনি এসেছেন, গৃহকর্ত্তা অবাক্ হয়ে গেলেন। এরকম অসামান্য রূপলাবণ্যবতী কন্যার সঙ্গে নামহীন পরিচয়হীন যুবকের বিয়ে হবে? রাজরাণী হবার যোগ্যা এ কন্যা! নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণের সংবাদে কোন ভুল আছে!
কিন্তু ব্রাহ্মণ নিজের মনে জানে, তার সংবাদে কোন ভুলই থাকবার উপায় নেই। বিশ্বচরাচরের সব সংবাদের যিনি বিধাতা, এ সংবাদ এসেছে তাঁর কাছ থেকেই।
ক্রমশঃ খুঁজতে খুঁজতে ব্রাহ্মণ সন্ধান পেলো জয়দেব গোস্বামীর। বিভিন্ন লোকের মুখ থেকে টুকরো টুকরো যে সব সংবাদ পেলো, তা একত্র করে জয়দেব গোস্বামীর চরিত্র যা দাঁড়ালো, সেই রূপলাবণ্যময়ী কন্যার ভবিষ্যৎ স্বামীরূপে তাকে কল্পনা করা ব্রাহ্মণের পক্ষে দুরূহ হয়ে উঠলো।
অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত লোকই জয়দেবের পরিচয় জানেন না। নীচ জাতীয় লোকদের কাছ থেকেই তার পরিচয় পাওয়া গেল। কে তার বাবা, কে তার মা, কোন্ বংশের ছেলে, তা কেউ জানে না। চাল নেই, চুলো নেই, পথে ঘাটে, নদীর ধারে, গাছতলায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।
ব্রাহ্মণের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়লো। থাকবার মত যার সামান্য কুঁড়েঘরও নেই, তার হাতে কন্যা তুলে দেবার জন্যে সে এই দীর্ঘ পথ এত কষ্ট স্বীকার করে এসেছে? হায় জগন্নাথ, এ কি তোমার খেয়াল?
কন্যার ভবিষ্যৎ স্বামীর চরিত্র সম্বন্ধেও যে বিবরণ সংগ্রহ করলো, তা অনুরূপই ভয়াবহ। কেউ বলে পাগল, কেউ বলে ভিখারী, কেউ বলে লম্পট। কেউ বলতে পারে না সঠিকভাবে কোথায় সে থাকে, বা কি করে। কিন্তু সকলের কথা থেকে যে কথাটি সুস্পষ্ট হয়ে’ ওঠে, তাহলো, পদ্মাবতীর স্বামী হবার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত এই লোক। এই লোকের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া আর কন্যাকে হাত-পা বেঁধে সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া একই জিনিস, হয়ত সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া অধিকতর শ্রেয়ঃ, কেন না সে-যন্ত্রণা এক নিমেষের। দুশ্চিন্তায় ব্রাহ্মণের আহার-নিদ্রা ঘুচে গেল।