চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সাত

 যার জন্যে এই দুশ্চিন্তা সে তখন অজয়ের ধারে, জনতা থেকে জনসমাজ থেকে দূরে একা একা ঘুরে বেড়ায়। কোন ঘর নেই তার, কোন ঘরের মায়া নেই তার। অজয়ের জলকল্লোলে শুষ্ক পাতায় কৃষ্ণ-নাম লিখে সে ভাসিয়ে দেয়। বনে বনে গাছের গায়ে গায়ে লেখে কৃষ্ণ-নাম। উন্মাদের মতন হাওয়ায় হাওয়ায় কাঁদে, কৃষ্ণ হে, কৃষ্ণ হে, কবে দেবে প্রেম…যে-প্রেমে লিখবো তোমার অমর-কাহিনী। যেদিকে যায়, সে দিকেই দেখে সেই নবজলধর শ্যামের শ্যামল ছায়া, যে-নারীর দিকে চায় সেই খানেই দেখে কৃষ্ণ—অন্তর-বাসিনী রাস-রঙ্গিণী শ্রীমতী রাধা। লোকে তাকে উন্মাদ বলে, ভিখারী বলে, তাতে তার কিছু যায় আসে না। সে তো লোককে চায় না, সে তো সমাজকে চায় না, সে চায় অ-লোক আলোককে……রূপকে নয়, সে চায় অরূপকে ধরতে, আকাশকে ধরতে। তার দেহের প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কে বাজিয়ে চলেছে অপরূপ এক প্রেমের সুর, সেই প্রেমের সুরে মশগুল হয়ে তার দিন চলে যায়। সে তার সমস্ত চৈতন্য দিয়ে ধরতে চায় সেই প্রেমের উৎসকে, সেই নিত্য-প্রেমের অনন্ত রাস-লীলায় সে হতে চায় সঙ্গী।

 যেদিন থেকে তার জেগেছে চেতনা, সে দেখেছে তার চারদিকে, বাংলার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলেছে নারীর দেহকে নিয়ে এক বীভৎস কামলীলা, আখড়ায় আখড়ায়, মোহন্তের সেবাশ্রমে সেবাশ্রমে, তান্ত্রিকদের আড্ডায় আড্ডায়, বৈষ্ণবদের কুঞ্জে কুঞ্জে, ধনীদের উপবনে, সর্ব্বত্র চলেছে প্রেমের নামে কামের নির্লজ্জ ব্যভিচার। বাংলা দেশ ভুলে গিয়েছে প্রেমের স্বর্গীয় বিভব, ভুলে গিয়েছে দেহজয়ী আত্মজয়ী দেহাতীত প্রেমের ঐশ্বর্য্যকে, দেহ-রতি নিয়ে মত্ত হয়ে সে ভুলে গিয়েছে আনন্দ-রতি……গোপিনীদের দেহকে ছাড়িয়ে তারা আর দেখতে পায় না গোপিনীবল্লভ বৃন্দাবন-শ্যামকে।

 তাই সেই উন্মাদ তরুণ করেছে চরম-পণ, নিজের জীবনে সে করবে সেই প্রেমের সাধনা। একদিন সর্ব্বস্ব হারিয়ে অশ্রুজলে গোপ-ললনারা যেমন পেয়েছিল সেই প্রেমময়কে সর্ব্বময়-রূপে, তেমনি সে আজ করবে সর্ব্বস্ব হারিয়ে সেই সর্ব্বময়কে পাওয়ার প্রেমসাধনা। যাকে পেলে সব পাওয়া হয়, যাকে ভোগ করলে সব ভোগ করা হয়, সে কি পাবে না তাকে? তাকেই যদি না পাওয়া যায়, তাহলে অন্য সব কিছু পেয়েই বা কি লাভ? তাই তরুণ জয়দেব প্রেমের উন্মাদনায় অজয়ের কূলে কূলে ঘুরে বেড়ায়, অহরহ জপ করে প্রিয়নাম, কৃষ্ণনাম। আর কোন চিন্তা নেই তার, নেই তার আর কোন ভাবনা। তাই প্রতিদিনের জগতের লোক চেনে না তাকে, জানে না তাকে। চিনলেও, চিনে পাগল বলে, ভবঘুরে বলে।