চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
চৌদ্দ
সেকালের রীতি-অনুযায়ী রাজা লক্ষ্মণ সেনও বহুবল্লভ ছিলেন। তাঁর অনেকগুলি মহিষী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন প্রিয়মহিষী ছিলেন বল্লভা। রাণী বল্লভার এক ভাই ছিল, নাম কুমারদত্ত।
কুমারদত্ত যেমন অত্যাচারী, তেমনি ছিল লম্পট। বহু বিধবার, বহু তরুণীর অভিশাপ সে জীবন ভরে কুড়িয়ে বেড়ায়। প্রিয়মহিষীর ভ্রাতা বলে, কেউ আর সাহস করে রাজদ্বারে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারতো না। রাণী বল্লভা স্নেহান্ধ হয়ে এই দুর্বৃত্ত ভ্রাতার সমস্ত অপরাধকে ঢেকে রাখতেন।
কিন্তু একদিন বিপর্য্যয় কাণ্ড ঘটে গেল। কুমারদত্ত মাধবী নামে এক বণিকপত্নীর ওপর অত্যাচার করতে যায়। কিন্তু মাধবী জোর করে সেই দুর্বৃত্তের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় এবং চীৎকার করে লোকজনকে ডাকে। সেই চীৎকারে রাজপ্রহরীরা সেখানে এসে উপস্থিত হয়। মাধবী তাদের সামনে কুমারদত্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। কিন্তু রাজপ্রহরীরা কুমারদত্তকে ধরবার কোন চেষ্টাই করলো না। কুমারদত্ত মাধবীকে শাসিয়ে বীরদর্পে চলে গেল।
মাধবী কিন্তু নীরবে এই অপমান সহ্য করলো না। অভিযোগ নিয়ে স্বয়ং রাজসভায় গিয়ে উপস্থিত হলো এবং রাজাকে আহ্বান করে বল্লো, আপনি রাজা, দেশের রক্ষক। আমি আপনার কাছে বিচার-প্রার্থী।
ওধারে কুমারদত্ত গিয়ে রাণী বল্লভাকে খবর দিতে, রাণী বল্লভা পর্দ্দার আড়ালে রাজসভার পেছনে এসে দাঁড়ালেন।
মাধবী সর্ব্বসমক্ষে কুমারদত্তের অত্যাচারের সমস্ত বিবরণ দিলো। সেই অত্যাচারের কাহিনী শুনে ব্রাহ্মণ গোবর্দ্ধন আচার্য্য ক্রোধে অগ্নিশর্ম্মা হয়ে উঠলেন।
রাণী বল্লভা পর্দ্দা সরিয়ে রাজসভায় এসে মাধবীকেই উল্টে দুশ্চরিত্রা বলে গালাগালি দিয়ে উঠলেন এবং সর্ব্বসমক্ষে মাধবীর চুল ধরে টানতে টানতে তাকে ভেতরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন।
গোবর্দ্ধন আচার্য্য তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হাতের দণ্ড তুলে রাণীর পথ আগলে দাঁড়ালেন এবং রাজাকে সম্বোধন করে বল্লেন, আপনি যদি এই মুহূর্ত্তে পাপিষ্ঠ কুমারদত্তের উপযুক্ত শাস্তির বিধান না করেন, তা হলে আমি অভিশাপ দিতে দিতে আপনার এই পাপ-সভা পরিত্যাগ করে চল্লাম।
রাজা লক্ষ্মণ সেন তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণের হাত ধরে তাঁকে প্রতিনিবৃত্ত করলেন এবং তদ্দণ্ডেই কুমারদত্তের নির্ব্বাসন-দণ্ড বিধান করলেন।
অপর দুজন কবির মধ্যে ধোয়ী কবির একখানি সমগ্র কাব্য এখনও প্রচলিত আছে। কালিদাসের অনুকরণে তিনি পবনদূত লেখেন।
কিন্তু লক্ষ্মণ সেনের রত্নসভার উজ্জ্বলতম রত্ন ছিলেন জয়দেব কবি। তাঁর এবং তাঁর সুযোগ্যা পত্নী পদ্মাবতীর সঙ্গীত ও কাব্য-প্রতিভা সম্বন্ধে একটী অপরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে। কাহিনী হলেও, তা থেকে বোঝা যায়, এই কবি-দম্পতী কি অসাধারণ প্রতিভারই অধিকারী ছিলেন। জয়দেব তাঁর কাব্যে প্রকাশ্যভাবে যেভাবে পদ্মাবতীর জয়গান গেয়ে গিয়েছেন, যেভাবে পৃথিবীর কাছে নিজের নামের সঙ্গে পত্নীর নামকে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে গিয়েছেন, তার ভেতর থেকে যেমন ফুটে উঠেছে কবি-পত্নীর প্রতি কবির অসাধারণ প্রেম, সেই সঙ্গে ফুটে উঠেছে পদ্মাবতীর অসামান্য প্রতিভার স্বীকৃতি। জগতের শ্রেষ্ঠ কবিদের পত্নীরা স্বামীর প্রতিভার সমভাগিনী ক্বচিৎ হন। কিন্তু কবি জয়দেবের ভাগ্যে যে পত্নীলাভ ঘটেছিল, সে-নারী ছিলেন সে-যুগের বর-নারীদের মধ্যে সঙ্গীতে নৃত্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠা। পদ্মাবতীর জীবন ও চরিত্র থেকে বোঝা যায়, সে-যুগে বাংলাদেশে নারীর স্থান ছিল কতখানি অকুণ্ঠ। নারী ছিল সমাজের সৌন্দর্য্য ও রসবোধের প্রধান উৎস। তার হাতে তখন খুন্তী আর হাঁড়ি ছিল না শুধু, ছিল বীণা। তার স্থান ছিল না শুধু রান্নাঘরে আর অন্তঃপুরে, তার স্থান ছিল সমাজের হৃদ্-কেন্দ্রে। রস-চর্চ্চার ক্ষেত্রে সেদিনও নারী ছিল বাংলার পুরুষ-প্রতিভার সহযাত্রী।