চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
পনের
আজ যেমন বাংলাদেশে নট-বৃত্তি সামাজিক নিন্দার অন্ধকার-স্তরে নেমে গিয়েছে, সেদিনের বাংলাতে কিন্তু তা ঘটেনি। সেদিনকার বাংলায় নটবৃত্তি ছিল সামাজিক গৌরবের বস্তু এবং শুধু পুরুষ নয়, নারীও এই নটবৃত্তি সগৌরবে গ্রহণ করতো।
লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় চলেছে রসের উৎসব। সুবিখ্যাত নট গাঙ্গো তাঁর পুত্রবধূ বিদ্যুৎপ্রভাকে নিয়ে এসেছেন সেই গুণী-সভায় । গাঙ্গো নিজে প্রতিভাশালিনী পুত্রবধূকে সঙ্গীতে ও নৃত্যে শিক্ষা দিয়েছেন। রাজসভায় বিদ্যুৎপ্রভা আলাপ করছেন সুহই রাগ।
রাজসভার পাশেই ছিল রাজ-নির্ম্মিত এক কূপ। চারদিককার পুরললনারা সেই কূপ থেকে জল নিয়ে যেতেন। বিদ্যুৎপ্রভা যখন সঙ্গীত আলাপ করছিলেন, সেই সময় এক গৃহস্থ বউ কোলে শিশুপুত্রকে নিয়ে কূপ থেকে জল নিতে এসেছিল। বিদ্যুৎপ্রভার গান শুনে বিমুগ্ধ হয়ে সেই নারী কাঁখের কলসীর বদলে কোলের শিশুকে কূপের জলে অন্যমনস্কভাবে নামিয়ে দেয়।
বিদ্যুৎপ্রভার গান শেষ হলে গাইতে আরম্ভ করলেন বুঢ়ন মিশ্র……উড়িষ্যা থেকে নিমন্ত্রিত হয়ে লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় এসেছেন, ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক। বুঢ়নমিশ্র ধরলেন পটমঞ্জরী রাগ। গানের সুর আগুনের হল্কার মতন বাতাসে ভেসে বেড়ায়। গান শেষ হলে দেখা গেল, রাজসভার দ্বারে যে সব শোভা-বৃক্ষ ছিল, তার পাতা সব ঝরে গিয়েছে। রাজসভার মধ্যে ধন্য ধন্য রব উঠলো। সকলে একবাক্যে বলে উঠলেন, বাংলাদেশে এঁদের যোগ্য শিল্পী আর নেই, সুতরাং এঁদের দুজনকেই জয়পত্র দেওয়া উচিত।
সেই সময় পদ্মাবতী পথ দিয়ে স্নানে যাচ্ছিলেন, তিনি শুনলেন বাংলার বাইরে থেকে দুজন গায়ক এসে রাজার হাত থেকে জয়পত্র নিয়ে যাচ্ছেন। পদ্মাবতী রাজসভায় প্রবেশ করে রাজাকে শ্রদ্ধাসহকারে নমস্কার করে বল্লেন, রাজা, সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গায়ক বা গায়িকার জন্যে আপনার জয়পত্র। বাংলাদেশে এদের চেয়ে যোগ্যতর গায়ক আছে!
সকলেই অবাক হয়ে পদ্মাবতীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
লক্ষ্মণ সেন জিজ্ঞাসা করেন, হে কল্যাণী, কে সে গায়ক বা গায়িকা?
তখন পদ্মাবতী বলেন, বাংলাদেশ থেকে জয়পত্র নিয়ে যেতে হলে আমি ও আমার স্বামী কবিশ্রেষ্ঠ জয়দেবকে সঙ্গীতে পরাজিত করতে হবে!
তখনি মহাসমাদরে রাজা পদ্মাবতীকে গানের আসরে আহ্বান করলেন। পদ্মাবতী গান্ধার রাগ ধরলেন। সেই সুরের আকর্ষণে গঙ্গার অপর তীর থেকে নৌকো সব এ-তীরে এসে লাগলো। তখন সভাসদেরা বল্লেন, পদ্মাবতীর সুরের মায়াই বেশী, কারণ সম্পূর্ণ নির্জীব নৌকোকে তা আকর্ষণ করে নিয়ে এসেছে। জয়পত্র পদ্মাবতীরই পাওয়া উচিত।
তাতে বুঢ়ন মিশ্র রেগে গিয়ে বল্লেন, স্ত্রীলোকের সঙ্গে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাই না।
ইতিমধ্যে রাজার আহ্বানে কবি-শ্রেষ্ঠ জয়দেব রাজসভায় উপস্থিত হলেন। সমস্ত ব্যাপার শুনে বল্লেন, বুঢ়ন মিশ্রের এমন কিছু কৃতিত্ব তো আমি দেখতে পাচ্ছি না, বসন্তকালে এমনিই তো গাছের পাতা ঝরে যায়।
বুঢ়ন মিশ্র প্রতিবাদ করেন, কিন্তু একই সময় সব পাতা ঝরে পড়ে না। দিনে দিনে, প্রহরে প্রহরে ঝরে পড়ে। আমার গানে তা নিমেষেই সাধিত হয়েছে।
জয়দেব বলেন, তাহলে উনি গান গেয়ে ঐ ঝরা-পাতা-গাছে আবার নতুন পাতাকে নিয়ে আসুন!
বুঢ়ন মিশ্র বলেন, তা অসম্ভব!
জয়দেব তখন বীণা তুলে নিয়ে বসন্তরাগ ধরলেন। বসন্তরাগের আলাপের সঙ্গে সঙ্গে শুকনো গাছের ডালে আবার নতুন সবুজ পাতার অঙ্কুর জেগে উঠলো।
বুঢ়ন মিশ্রের মাথা হেঁট হয়ে গেল। লক্ষ্মণ সেন সিংহাসন থেকে নেমে এসে কবি জয়দেবের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন জয়পত্র। বল্লেন, হে শিল্পী, হে কবি, আজ থেকে লক্ষ্মণ সেনের সভা তোমাকে পেয়ে ধন্য হলো!
অবশ্য এই সব হলো কাহিনী। কিন্তু এই কাহিনী থেকে বোঝা যায়, জয়দেব আর পদ্মাবতী কত বড় শিল্পী ছিলেন। জয়দেব গান গাইতেন আর পদ্মাবতী তাঁর সঙ্গে মৃদঙ্গ বাজাতেন। জয়দেব-পদ্মাবতীর প্রেম সঙ্গীত আর কাব্যের মধ্যে তাই অমর হয়ে আছে। তাই জয়দেব তাঁর অমর কাব্যে বারেবারে নিজেকে পদ্মাবতীচরণ-চারণ কবি বলে পরিচয় দিয়ে ধন্য হয়েছেন।
বাংলার রস-লোকে তাই গীত-গোবিন্দ-রচয়িতা কবি জয়দেব মন্দার সৌরভে বিরাজ করছেন। তাঁর অন্তরে ছিল যে নিবিড় প্রেম, রাধাকৃষ্ণের প্রেম-লীলার বর্ণনার ভেতর দিয়ে তা মূর্ত্ত হয়ে উঠেছে। এবং এমন ভাবে মূর্ত্ত হয়েছে যে, গীত-গোবিন্দের মত রসাল কাব্য জগতে দুর্লভ বল্লেই হয়।