চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/দশম পরিচ্ছেদ

দশ

 অজয়ের তটে রাধাশ্যামের মন্দিরে জয়দেব নবপরিণীতা বধূকে নিয়ে শুরু করেন এক অপরূপ প্রেম-সাধনা। সারাদিন চলে যায় রাধাশ্যামের অর্চ্চনায়, পদ্মাবতী সঙ্গীতে নৃত্যে নিত্য করে রাধাশ্যামের আরতি, নৃত্যে সঙ্গীতে ভরিয়ে রাখে স্বামীর অন্তর। জয়দেব রচনা করতে বসেন, শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দ কাব্য। এক একটী পদ রচনা করেন আর পদ্মাবতীকে পড়িয়ে শোনান। পদ্মাবতী আবার সঙ্গীতে সেই পদকে মুখর করে তুলে কবিকে শোনায়। সমস্ত জগৎ বাইরে পড়ে থাকে, কবি জয়দেব তাঁর নিজের মনে রচনা করেন নব-বৃন্দাবন, সেখানে অনুক্ষণ প্রেম-লীলা করে চলে রাধামাধব। অন্তরের সেই নিবিড় অনুভূতি ফুটে ওঠে লেখনীর মুখে। কৃষ্ণ-ধ্যান, কৃষ্ণ-জ্ঞান, কৃষ্ণ-চিন্তা, কৃষ্ণ-দর্শন, কৃষ্ণ-কথাতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে কবি জয়দেবের অন্তর। অজয়কে মনে হয় যমুনা বলে, অজয়ের কূলে প্রস্ফুটিত কদম্ব-বৃক্ষকে দেখে মনে পড়ে কেলিকদম্ব; সন্ধ্যারতির সময় পদ্মাবতী যখন সঙ্গীতে নৃত্যে নিজেকে নিবেদন করে রাধাশ্যামের বিগ্রহের কাছে, জয়দেবের চোখের সামনে ফুটে ওঠে, পদ্মাবতীকে আশ্রয় করে স্বয়ং শ্রীরাধিকা। আবেশে আবেগে কবি পদ্মাবতীর চরণে নিজেকে লুটিয়ে দিয়ে বলেন, হে দেবী, আমি তোমারই চরণচারণ-চক্রবর্ত্তী!

 এইভাবে এগিয়ে চলে শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দ কাব্য, রাধাকৃষ্ণের মিলন-বিরহ লীলা। চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে রাত কাটিয়ে সর্ব্ব-অঙ্গে নখক্ষত নিয়ে প্রভাতে এসে দাঁড়িয়েছেন কৃষ্ণ-অভিমানিনী শ্রীমতীর কুঞ্জে। সারারাত প্রিয় আগমন প্রতীক্ষায় বিনিদ্র কেটে গিয়েছে শ্রীমতীর রাত্রি। প্রভাতে তাই কৃষ্ণ যখন এসে দাঁড়ালেন, শ্রীমতী দেখেন রাত্রির কেলি-উন্মত্ততায় শ্রীকৃষ্ণের পরণে রয়েছে পর-নায়িকার বসন, সর্ব্ব-অঙ্গ পর-নায়িকার সঙ্গে প্রেমবিহারের নখক্ষত চিহ্ন তখনও কুরুবককলির মতন রক্তিম হয়ে রয়েছে। নিদারুণ অভিমানে শ্রীমতী একটীও কথা না বলে দিলেন প্রিয়তমকে বিদায়। তারপর শুরু হলো বিদগ্ধ মাধবের অনুশোচনা। নানাভাবে তিনি শ্রীমতীর মান ভাঙ্গবার জন্যে মিনতি করেন। ক্রমশঃ শিথিল হয়ে আসে শ্রীমতীর মান। উপযাচিকা হয়ে শ্রীমতী সখীদের নিয়ে উপস্থিত হন আবার কৃষ্ণের কুঞ্জদ্বারে। অপগত-মান শ্রীমতীকে দেখে আনন্দ-রসে উদ্বেল হয়ে ওঠে শ্রীকৃষ্ণের অন্তর। শ্রীমতীকে আলিঙ্গন করে বলেন, তুমি আমার, আমি তোমার, তোমার আমার মধ্যে কোথাও নেই বিচ্ছেদ!

 তখনও শ্রীমতীর মুখে কোন কথা নেই। তখন শ্রীকৃষ্ণ সঙ্কল্প করেন, নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে শ্রীমতীর চরণে আত্মসমর্পণ করতে। লিখতে লিখতে কেঁপে ওঠে কবির লেখনী। অশ্রু-জলে ঝাপসা হয়ে আসে পুঁথির অক্ষর। কবি লিখছেন, স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং, তার পরের কথাটী ভক্তকবি আর লিখতে পারেন না। আবেগে চীৎকার করে ডাকেন, পদ্মাবতী, পদ্মাবতী!

 পদ্মাবতী পুঁথির সামনে এসে বসে।

 অশ্রু-বিধৌতকণ্ঠে কবি পড়ে শোনান……জগতের সব প্রাণী যাঁকে চায়, তিনি আজ আকুল হয়ে চাইছেন আর একজনকে…নদী ছুটে আসে সাগরের বুকে, আজ সাগর ছুটে চলেছে নদীর কাছে।

 “ওগো প্রিয়ে, দূর কর ঐ অকারণ মান। কথা বল, যে তোমার বুকের ভেতর রয়েছে, আলিঙ্গনে তাকে টেনে নাও বুকে।”

 আবেগকম্পিতকণ্ঠে কবি পড়েন, স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং…অশ্রুতে রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠ, কবি আর পড়তে পারেন না।

 পদ্মাবতী, পদ্মাবতী, কেমন করে আমার এই লেখনী দিয়ে লিখবো সে-কথা, বিশ্ব যার চরণে প্রণত, সে আজ চাইছে চরণ ধরতে…

 উদ্বেল হয়ে ওঠে ভক্তের অন্তর। লেখনী ফেলে দিয়ে ওঠে পড়েন কবি।

 বেলা দ্বিপ্রহর।

 পদ্মাবতী বলে, প্রভু, দ্বিপ্রহর হয়ে গিয়েছে, আপনি স্নান সেরে আসুন। তারপর আহার আর বিশ্রামের পর আবার লিখতে চেষ্টা করবেন।…

 কবির মনে পড়ে, তাই তো, পদ্মাবতীও অভুক্ত রয়েছেন। তাই নদীতে স্নানের জন্যে বেরিয়ে পড়লেন।

 পদ্মাবতী আহারের আয়োজন করতে লাগলো। অল্পক্ষণ পরেই পদ্মাবতী দেখে, স্নান সেরে স্বামী ফিরে এসেছেন।

 তাড়াতাড়ি আহারের আয়োজন করে। আহার-অন্তে জয়দেব বলেন, পদ্মাবতী, আমার পুঁথিটা নিয়ে এসো, অসমাপ্ত পদটী সমাপ্ত করে বিশ্রাম করবো।

 পদ্মাবতী আনন্দে পুঁথি নিয়ে আসে। জয়দেব অসমাপ্ত পদটী সম্পূর্ণ করে লিখলেন,

স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং
দেহি পদপল্লবমুদারম্।

 তারপর বিশ্রাম করবার জন্যে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন।

 পদ্মাবতী স্বামীর ভুক্তাবশিষ্ট নিয়ে তখন নিজে খেতে বসলো।

 এমন সময় দরজায় পদধ্বনি জেগে উঠলো।

 পদ্মাবতী সবিস্ময়ে দেখে কৃষ্ণনাম গাইতে গাইতে স্নানান্তে বাইরে থেকে জয়দেব আসছেন!

 বিস্ময়ে পদ্মাবতী হতবাক হয়ে যায়। এইমাত্র তো স্বামী স্নান সেরে আহার-অন্তে ঘরে বিশ্রাম করতে ঢুকলেন, কোথা থেকে আবার কি-ভাবে তিনি বাইরে থেকে এলেন?

 জয়দেবও অবাক্ হয়ে গেলেন কারণ তিনি অভুক্ত থাকতে, পদ্মাবতী কি করে খেতে বসলো?

 পদ্মাবতী ছুটে বিশ্রাম কক্ষে গিয়ে দেখে, ঘরশূন্য, সমস্ত ঘর ভরে শুধু উঠছে পদ্মের আর চন্দনের সৌরভ।

 উন্মাদিনীর মতন স্বামীর চরণ-প্রান্তে পড়ে বলে, প্রভু, ধন্য, ধন্য তুমি! তোমার স্পর্শে ধন্য আমিও!

 বিস্ময়ে জয়দেব বিহ্বল হয়ে যান।

 তখন তাড়াতাড়ি পদ্মাবতী শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দের পুঁথি এনে দেখে, স্পষ্ট অক্ষরে সেখানে লেখা রয়েছে সেই সমাপ্ত পদ, দেহি পদপল্লবমুদারম্!

 পদ্মাবতী সমস্ত ঘটনা জয়দেবকে জানায়।

 শুনতে শুনতে জয়দেবের সর্ব্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। তিনি বুঝতে পারেন, ভক্তবৎসল কৃষ্ণ ভক্তের মর্ম্ম-ব্যথা বুঝতে পেরে, নিজের হাতে লিখে গিয়েছেন, যেকথা লিখতে ভক্তের অন্তর ব্যথিত হয়ে উঠেছিল।

 অজয়ের তটে সেদিন মানুষের প্রেমের আকর্ষণে ভগবান্ সশরীরে এসেছিলেন নেমে, তার চিহ্ন রয়ে গেল নিত্যকালের জন্যে গীতগোবিন্দ কাব্যে। মানুষের তৈরী এই মহাকাব্যের ভেতরে তাই আছে অমানুষী দৈব প্রেমের স্পর্শ। তাই গীতগোবিন্দ হলো মানুষের হৃদয়ে দেবতার স্বাক্ষর। তাই কাব্য-সাহিত্যে গীতগোবিন্দের একটা বিশেষ স্বতন্ত্র সার্থকতা আছে।