চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ

নয়

 সেইদিন রাত্রিতে জয়দেব অবসন্ন দেহে এক গাছতলায় যখন শুয়ে পড়ে ছিলেন, তখন স্বপ্নে শুনলেন, প্রিয়তমের নির্দ্দেশ। কে যেন তাঁর কাণে এসে বল্লো, ওগো ভক্ত, তোমার আকুল ডাকে সাড়া দেবার জন্যেই আমি এসেছি। অজয়ের কূলে কদম্বখণ্ডীর ঘাটে জলের তলায় আমি তোমার অপেক্ষায় আছি, সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসো আমাকে!

 প্রভাত না হতেই জয়দেব অজয়ের তীর ধরে ছোটেন কদম্বখণ্ডীর ঘাটের দিকে। উন্মাদের মতন জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন। জলের ভেতর দুহাত বাড়িয়ে খোঁজেন, কোথায় আছে তাঁর ইষ্টদেবতার মূর্ত্তি।

 বহুক্ষণ অজয়ের জলে অবগাহন-অনুসন্ধানের পর সহসা কিসে যেন হাত ঠেকে গেল! ডুব দিয়ে সজোরে সেই বস্তুকে আঁকড়ে ধরে টেনে তুল্লেন, দেখেন, রাধাশ্যামের যুগল মূর্ত্তি, তাঁর ইষ্টদেবতা। সেই রাধাশ্যামের যুগল মূর্ত্তিকে কোলে করে জয়দেব অজয়ের তীরে উন্মাদ নৃত্য করতে সুরু করে দিলেন।

 এক কদম্ব গাছের তলায় সেই মূর্ত্তিকে রেখে জয়দেব উল্লাসে আপনার মনে গেয়ে চলেন কৃষ্ণনাম। কোথায় মন্দির, কোথায় আশ্রয়? এক গৃহহীন যাযাবরের কাছে তুমি এলে ঠাকুর, কোথায় কি করে সে করবে তোমার পূজা?

 দেখতে দেখতে কদম্বখণ্ডী ঘাটের সেই রাধাশ্যাম বিগ্রহের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। চারদিক থেকে লোক কিসের যেন উন্মাদ আকর্ষণে কদম্বীখণ্ডীর ঘাটের দিকে ছুটে আসতে লাগলো। কৃষ্ণ-নামে বিভোর জয়দেবের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিরাট জনতা সমস্বরে গেয়ে ওঠে কৃষ্ণনাম। কৃষ্ণনামে মুখরিত হয়ে ওঠে অজয়ের তীরভূমি। মেলার মতন অনবরত সেখানে আসে যায় জনপ্রবাহ।

 সেই বিগ্রহের কথা গিয়ে পৌঁছল বর্দ্ধমানের মহারাজের কাছে। তখন সেই অঞ্চলেই তিনি পরিভ্রমণ করছিলেন। কদম্বখণ্ডীর ঘাটে এসে কৃষ্ণনামে উন্মত্ত সেই বিরাট জনতা আর সেই জনতার কেন্দ্র-পুরুষ-স্বরূপ কবি জয়দেবকে দেখে মহারাজের অন্তর ভক্তি-রসে উদ্বেল হয়ে উঠলো। অবিলম্বে তিনি সেই কদম্বীখণ্ডীর ঘাটে রাধাশ্যামের বিরাট মন্দিরের ব্যবস্থা করলেন। রাজানুগ্রহে কয়েক দিনের মধ্যে সেই নির্জ্জন নদীতটে মাথা তুলে উঠলো মন্দির, মন্দিরসংলগ্ন বিরাট চত্বর, অতিথশালা, ভজনালয়। কাল যে ছিল গৃহহীন যাযাবর, আজ তাকে ঘিরে কলগুঞ্জন করে উঠলো শত শত ভক্তের দল; কাল যে ছিল অপরিচিত, অজ্ঞাত, আজ তার নামে মুখরিত হয়ে উঠলো অজয়ের দুই তট।

 পদ্মাবতীর পিতা বিস্ময়ে সেই দৃশ্য দেখলেন এবং নিজের অবিশ্বাসের জন্যে নিজেকে শত ধিক্কার দিলেন। ভগবান যে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন, তার আবার আশ্রয়ের অভাব কি? তার আবার ঐশ্বর্য্যের প্রয়োজন কি? ভগবান নিজেই তার ভার বহন করে থাকেন।

 পদ্মাবতীর পিতা সেই পুরাতন সত্যকে আবার নিজের চোখের সামনে সার্থক হয়ে উঠতে দেখলেন। জয়দেবের অপূর্ব্ব ভক্তি দেখে, তাঁর অন্তর-উচ্ছসিত দৈবসঙ্গীত শুনে, পদ্মাবতীর পিতা নিজে কবির পরম ভক্ত হলেন এবং তাঁর কেন্দুবিল্বতে আসার সমস্ত কাহিনী আনুপূর্ব্বিক জানালেন। জয়দেবের হাত ধরে মিনতি করলেন, বিশ্বনাথের বিধানে তাঁর কন্যাকে গ্রহণ করে ধন্যা করতে হবে।

 জয়দেব সেই অপরূপ কন্যার কথা শুনে তাকে দেখবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

 সেদিন স্বপ্নে দেখলেন, রাধাশ্যামের যুগল মূর্ত্তিতে শ্রীমতীর অঙ্গ থেকে এক আলোকধারা বিনির্গত হলো। সেই আলোক-ধারা ক্রমশঃ এক নারীমূর্ত্তির রূপ ধরে জয়দেবের দিকে অগ্রসর হয়ে আসতে লাগলো। ক্রমশঃ জয়দেবের সামনে এসে সেই অসামান্যা-রূপলাবণ্যময়ী নারী মুগ্ধ-দৃষ্টিতে কবির দিকে চেয়ে রইলো। কবি মর্ম্মের চক্ষু দিয়ে সেই মূর্ত্তিকে বহুক্ষণ ধরে নিরীক্ষণ করলেন। ধীরে জয়দেবকে প্রণাম করে সেই মূর্ত্তি আবার পিছন ফিরে ধীরে ধীরে শ্রীমতীর অঙ্গে মিশিয়ে গেল।

 সেদিন প্রভাতে ব্রাহ্মণ যখন পদ্মাবতীকে সঙ্গে নিয়ে জয়দেবের কাছে এলেন, জয়দেব বিস্ময়ে দেখেন, এই সেই নারী যাকে স্বপ্নে দেখেছিলেন।

 পদ্মাবতী জয়দেবের চরণে নত হয়ে প্রণাম করে।

 শুভলগ্নে রাধাশ্যামের বিগ্রহের সামনে জয়দেব অন্তরের সম্রাজ্ঞীরূপে বরণ করে নিলেন পদ্মাবতীকে।

 নবপরিণীতার হাত ধরে বল্লেন, তুমি হবে আমার প্রেম-সাধনার সহায়। তোমার প্রেমের মধ্যে আমি যেন নতুন করে পাই আমার রাধাশ্যামের প্রেমকে। তোমার সেই প্রেমে আমি রচনা করবো রাধাশ্যামের অনন্ত প্রেম-লীলা! তুমি হবে আমার প্রেরণা, আমার শ্রীমতী!