চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

দেহি পদপল্লবমুদারম্

কবি জয়দেব

 আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগেকার বাংলা।

 বাংলায় রাজা তখন বল্লাল সেন। বৃদ্ধ হয়েছেন। যুবরাজ লক্ষ্মণ সেনই তখন বৃদ্ধ পিতার হয়ে রাজ-কার্য্য পরিচালনা করেন।

 যুবরাজ লক্ষ্মণ সেনের পরাক্রমে গৌড়-রাজ্য কলিঙ্গ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তাঁর বীরত্বের কাহিনী নিয়ে কবিরা কাব্য লিখেছেন। যখন তিনি শিশু, তখন থেকেই তীরধনুক নিয়ে রীতিমত অস্ত্রবিদ্যা শিখতে আরম্ভ করেন। কথিত আছে সেই বালককালেই তাঁর নিক্ষিপ্ত বাণ গঙ্গার এ-তীর থেকে ও-তীরে গিয়ে পড়তো।

 কিন্তু আজ আর রাজত্বে যুদ্ধের কোন আবহাওয়াই নেই। পরিপূর্ণ শান্তির মধ্যে গৌড়রাজ্যের প্রজারা যুদ্ধ-বিগ্রহের কথা ভুলে গিয়েছে। নিয়মিত যোদ্ধারাও ক্রমশঃ অস্ত্র ত্যাগ করে নাগরিক জীবনের শান্ত স্রোতে গা ঢেলে দিয়েছে।

 এ হেন সময়ে যুবরাজ লক্ষ্মণ সেনের কাণে একদিন ভয়াবহ এক গুরু-নিন্দার কথা ভেসে এলো। পিতৃ-নিন্দা। বৃদ্ধ বল্লাল সেন নাকি এক তরুণী চণ্ডালরমণীর সঙ্গে সংগোপনে প্রেম-লীলা করছেন!

 যুবরাজ লক্ষ্মণ সেন রীতিমত ব্যথিত হলেন। বৃদ্ধ পিতা সম্বন্ধে এ হেন কুৎসায়, যে-কোন তরুণ পুত্রেরই মনে ক্ষোভ জন্মায়, বিশেষতঃ সে-পিতা আবার দেশের রাজা। তাঁরই আদর্শে একদিন এই গৌড়-সমাজে মানুষের কৃতিত্বের উপর মানুষের কৌলীন্যের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, সেই তিনিই কি না এই বৃদ্ধ বয়সে এক তরুণী চণ্ডালরমণীর কামে নিজের সমস্ত চারিত্রিক মর্য্যাদা বিসর্জ্জন দেবেন?

 যুবরাজ লক্ষ্মণ সেন অনুসন্ধান করতে লাগলেন, এ কুৎসার মূল কোথায়? কিছুদিন যাবৎ বল্লাল সেন রাজপ্রাসাদ থেকে অনুপস্থিত। রাজপুরচারীদের ধারণা তিনি কোথাও গঙ্গার ধারে নির্জ্জন-বাস করতে গিয়েছেন।

 লক্ষ্মণ সেন অনুসন্ধান করে জানলেন, বৃদ্ধ পিতা সেই চণ্ডালরমণীকে নিয়ে নির্জ্জন এক উদ্যানে তান্ত্রিক শক্তি-সাধনা করছেন। অন্ততঃ এইভাবেই সংবাদটা তাঁর কাছে অনুসন্ধানের ফলে এলো।

 তন্ত্র-সাধনার নামে তখন সমগ্র রাঢ় আর বরেন্দ্রভূমিতে এক জাতীয় সংগোপন কামলীলা সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে আরম্ভ করেছে। পরিপূর্ণ শান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে মানুষের অলস মন তখন একমাত্র যৌনতৃপ্তির মধ্যে জীবনের বিচিত্রতার স্বাদ উপভোগ করতে চলেছে। ধর্ম্মও বিকৃত হয়ে সমাজের এই কাম-লিপ্সার সহায়ক হয়ে উঠেছে। তান্ত্রিক সাধনার নামে নারী-উপাসনাকে কেন্দ্র করে সংক্রামক ব্যাধির মতন এই চরিত্রহীনতা আর যৌন-লিপ্সা সমাজকে পেয়ে বসেছে। এবং তার পরিণাম যে কি হয়েছিল, তা লক্ষ্মণ সেন বৃদ্ধ বয়সে নিজে চোখে দেখে গিয়েছিলেন। মুষ্টিমেয় তুর্কী সৈন্য এসে অনায়াসে এই বীর্য্যহীন ভ্রষ্টচরিত্র জাতিকে পদানত করে। সেই সামাজিক অধঃপতন বল্লাল সেনের আমল থেকেই শুরু হয়।

 বৃদ্ধ পিতার সেই সংগোপন আচরণে তরুণ যুবরাজের অন্তর ক্ষুণ্ণ ও বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। তরুণ লক্ষ্মণ সেনের মনে একটা আভিজাত্য-সুলভ মহত্তর জীবনের প্রতি আস্পৃহা ছিল, তাতে নিদারুণ আঘাত লাগলো। লক্ষ্মণ সেন নীরবে পিতার এই পরিবর্ত্তনকে সহ্য করতে পারলেন না। তিনি সমস্ত ব্যাপার জানিয়ে পিতাকে পত্র লিখলেন এবং সেই পত্রে তাঁকে নিবৃত্ত হতে অনুরোধ করলেন।

 বৃদ্ধ বল্লাল সেন পুত্রের এই আচরণকে ঔদ্ধত্য হিসাবে দেখলেন এবং তান্ত্রিক সাধনার দোহাই দিয়ে নিজের কৃতকর্ম্মকে সমর্থন করলেন।

 এই নিয়ে পিতা-পুত্রে রীতিমত একটা মনোমালিন্যের সৃষ্টি হলো। যুবরাজ লক্ষ্মণ সেন অভিমানে কিছুদিনের জন্য রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বীরভূম জেলার কেন্দুবিল্ব গ্রামে বসবাস করতে লাগলেন।

 অজয় নদের ধারে এই কেন্দুবিল্ব গ্রাম। অজয়ের ধারে এই গ্রামে সেনবংশেরই নির্ম্মিত এক দুর্গ ছিল, সেনপাহাড়ী নামে তা জনসাধারণে পরিচিত ছিল। পিতার উপর অভিমান করে যুবরাজ লক্ষ্মণ সেন কেন্দুবিল্বের এই সেনপাহাড়ী দুর্গে এসে বাস করতে লাগলেন।

 ঠিক সেই সময় এই অজয় নদের তীরে কেন্দুবিল্ব গ্রামে একজন তরুণ ব্রাহ্মণ-যুবা আপনার মনে শাস্ত্র আর কাব্যচর্চ্চা করে চলেছিলেন। সেই যুবক-কবির কাব্য-প্রতিভাই এক দিন লক্ষ্মণ সেনের নামকে বাংলার কৃষ্টির ইতিহাসে অমর করে রেখে দিয়ে যায়। সেই যুবক-কবিই হলেন জয়দেব গোস্বামী, শ্রীশ্রী গীতগোবিন্দ কাব্যের অমর রচয়িতা।