২৯

পরদিন ঘুম ভাঙিয়া বিছানা হইতে উঠিবা মাত্রই একটি মধুর আবেগে মহেন্দ্রের হৃদয় পূর্ণ হইয়া গেল। প্রভাতের সূর্যালােক যেন তাহার সমস্ত ভাবনায় বাসনায় সোনা মাখাইয়া দিল। কী সুন্দর পৃথিবী, কী মধুময় আকাশ, বাতাস যেন পুষ্পরেণুর মত সমস্ত মনকে উড়াইয়া লইয়া যাইতেছে।

 সকালবেলায় বৈষ্ণব ভিক্ষুক খােল করতাল বাজাইয়া গান জুড়িয়া দিয়াছিল। দরােয়ান তাড়াইয়া দিতে উদ্যত হইলে, মহেন্দ্র দরোয়ানকে ভর্ৎসনা করিয়া তখনই তাহাদিগকে একটা টাকা দিয়া ফেলিল। বেহারা কেনােসিনের ল্যাম্প লইয়া যাইবার সময় অসাবধানে ফেলিয়া দিয়া চুরমার করিল; মহেন্দ্রের মুখের দিকে তাকাইয়া ভয়ে তাহার প্রাণ শুকাইয়া গেল, মহেন্দ্র তিরস্কারমাত্র না করিয়া প্রসন্নমুখে কহিল, “ওরে, ওখানটা ভালাে করিয়া ঝাঁট দিয়া ফেলিস, যেন কাহারে পায়ে কাঁচ না ফোটে।”

 আজ কোনাে ক্ষতিকেই ক্ষতি বলিয়া মনে হইল না।

 প্রেম এতদিন নেপথ্যের আড়ালে লুকাইয়া বসিয়া ছিল, আজ সে সম্মুখে আসিয়া পর্দা উঠাইয়া দিয়াছে। জগৎসংসারের উপর হইতে আবরণ উঠিয়া গেছে। প্রতিদিনের পৃথিবীর সমস্ত তুচ্ছতা আজ অন্তর্হিত হইল। গাছপালা, পশুপক্ষী, পথের জনতা, নগরের কোলাহল, সকলই আজ অপরূপ। এই বিশ্বব্যাপী নূতনতা এতকাল ছিল কোথায়।

 মহেন্দ্রের মনে হইতে লাগিল, আজ যেন বিনােদিনীর সঙ্গে অন্য দিনের মতাে সামান্য ভাবে মিলন হইবে না। আজ যেন কবিতায় কথা বলিলে এবং সংগীতে ভাব প্রকাশ করিলে, তবে ঠিক উপযুক্ত হয়। আজিকার দিনকেও ঐশ্বর্যে সৌন্দর্যে পূর্ণ করিয়া মহেন্দ্র সৃষ্টিছাড়া সমাজছাঁড়া একটা আরব্য উপন্যাসের অদ্ভুত দিনের মতাে করিয়া তুলিতে চায়। তাহা সত্য হইবে, অথচ অল্প হইবে— তাহাতে সংসারের কোনাে বিধিবিধান, কোনাে দায়িত্ব, কোনাে বাস্তবিকতা থাকিবে না।

 আজ সকাল হইতে মহেন্দ্র চঞ্চল হইয়া বেড়াইতে লাগিল, কলেজে যাইতে পারিল না; কারণ মিলনের লগ্নটি কখন অকস্মাৎ আবির্ভূত হইবে, তাহা তাে কোনাে পঞ্জিকায় লেখে না।

 গৃহকার্যে-রত বিনােদিনীর কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে ভাঁড়ার হইতে, রান্নাঘর হইতে, মহেন্দ্রের কানে আসিয়া পৌঁছিতে লাগিল। আজ তাহা মহেন্দ্রের ভালাে লাগিল না; আজ বিনােদিনীকে মনে মনে সংসার হইতে বহু দূরে স্থাপন করিয়াছে।

 সময় কাটিতে চায় না। মহেন্দ্রের স্নানাহার হইয়া গেল, সমস্ত গৃহকর্মের বিরামে মধ্যাহ্ন নিস্তব্ধ হইয়া আসিল, তবু বিনোদিনীর দেখা নাই। দুঃখে এবং সুখে, অধৈর্যে এবং আশায় মহেন্দ্রের মনোযন্ত্রের সমস্ত তারগুলা ঝংকৃত হইতে লাগিল।

 কালিকার কাড়াকাড়ি-করা সেই বিষবৃক্ষখানি নীচের বিছানায় পড়িয়া আছে। দেখিব মাত্র সেই কাড়াকাড়ির স্মৃতিতে মহেন্দ্রের মনে পুলকাবেশ জাগিয়া উঠিল। বিনোদিনী যে বালিশ চাপিয়া শুইয়াছিল সেই বালিশটা টানিয়া লইয়া মহেন্দ্র তাহাতে মাথা রাখিল; এবং বিষবৃক্ষখানি তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা উল্টাইতে লাগিল। ক্রমে কখন এক সময় পড়ায় মন লাগিয়া গেল, কখন পাঁচটা বাজিয়া গেল— হুঁশ হইল না।

 এমন সময় একটি মােরাদাবাদি খুঞ্চের উপর থালায় ফল ও সন্দেশ এবং রেকাবে বরফ-চিনি সংযুক্ত সুগন্ধি দলিত খরমুজা লইয়া বিনােদিনী ঘরে প্রবেশ করিল এবং মহেন্দ্রের সম্মুখে রাখিয়া কহিল, “কী করিতেছ, ঠাকুরপাে। তােমার হইল কী। পাঁচটা বাজিয়া গেছে, এখনাে তােমার হাতমুখ-ধােওয়া কাপড়-ছাড়া হইল না?”

 মহেন্দ্রের মনে একটা ধাক্কা লাগিল। মহেন্দ্রের কী হইয়াছে, সে কি জিজ্ঞাসা করিবার বিষয়। বিনােদিনীর সে কি অগোচর থাকা উচিত। আজিকার দিন কি অন্য দিনেরই মতাে। পাছে যাহা আশা করিয়াছিল, হঠাৎ তাহার উল্টা কিছু দেখিতে পায়, এই ভয়ে মহেন্দ্র গতকল্যকার কথা স্মরণ করাইয়া কোনাে দাবি উত্থাপন করিতে পারিল না।

 মহেন্দ্র খাইতে বসিল। বিনােদিনী ছাদে-বিছানো রৌদ্রে-দেওয়া মহেন্দ্রের কাপড়গুলি দ্রুতপদে ঘরে বহিয়া আনিয়া নিপুণ হস্তে ভাঁজ করিয়া কাপড়ের আলমারির মধ্যে তুলিতে লাগিল।

 মহেন্দ্র কহিল, “একটু রোসাে, আমি খাইয়া উঠিয়া তােমার সাহায্য করিতেছি।”

 বিনােদিনী জোড়হাত করিয়া কহিল, “দোহাই তােমার, আর যা কর সাহায্য করিয়াে না।”

 মহেন্দ্র খাইয়া উঠিয়া কহিল, “বটে! আমাকে অকর্মণ্য ঠাওরাইয়াছ! আচ্ছা, আজ আমার পরীক্ষা হউক।”

 বলিয়া কাপড় ভাঁজ করিবার বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিল।

 বিনোদিনী মহেন্দ্রের হাত হইতে কাপড় কাড়িয়া লইয়া কহিল, “ওগাে মশায়, তুমি রাখাে, আমার কাজ বাড়াইয়াে না।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তবে তুমি কাজ করিয়া যাও, আমি দেখিয়া শিক্ষালাভ করি।”

 বলিয়া আলমারির সম্মুখে বিনােদিনীর কাছে আসিয়া মাটিতে আসন করিয়া বসিল। বিনােদিনী কাপড় ঝাড়িবার ছলে একবার করিয়া মহেন্দ্রের পিঠের উপর আছড়াইয়া কাপড়গুলি পরিপাটিপূর্বক ভাঁজ করিয়া আলমারিতে তুলিতে লাগিল।

 আজিকার মিলন এমনি করিয়া আরম্ভ হইল। মহেন্দ্র প্রত্যুষ হইতে যেরূপ কল্পনা করিতেছিল, সেই অপূর্বতার কোন লক্ষণই নাই। এরূপভাবে মিলন কাব্যে লিখিবার, সংগীতে গাহিবার, উপন্যাসে রচিবার যােগ্য নহে। কিন্তু তবু মহেন্দ্র দুঃখিত হইল না, বরঞ্চ একটু আরাম পাইল। তাহার কাল্পনিক আদর্শকে কেমন করিয়া খাড়া করিয়া রাখিত, কিরূপ তাহার আয়ােজন, কী কথা বলিত, কী ভাব প্রকাশ করিতে হইত, সকলপ্রকার সামান্যতাকে কী উপায়ে দূরে রাখিত, তাহা মহেন্দ্র ঠাওরাইতে পারিতেছিল না– এই কাপড় ঝাড়া ও ভাঁজ করার মধ্যে হাসি-তামাশা করিয়া সে যেন স্বরচিত একটা অসম্ভব দুরূহ আদর্শের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া বাঁচিল।

 এমন সময় রাজলক্ষ্মী ঘরে প্রবেশ করিলেন। মহেন্দ্রকে কহিলেন, “মহিন, বউ কাপড় তুলিতেছে, তুই ওখানে বসিয়া কী করিতেছিস।”

 বিনোদিনী কহিল, “দেখাে তো পিসিমা, মিছামিছি কেবল আমার কাজে দেরি করাইয়া দিতেছেন।”

 মহেন্দ্র কহিল, “বিলক্ষণ! আমি আরাে ওঁর কাজে সাহায্য করিতেছিলাম।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার কপাল! তুই আবার সাহায্য করিবি! জান বউ, মহিনের বরাবর ঐরকম। চিরকাল মা-খুড়ির আদর পাইয়া, ও যদি কোনো কাজ নিজের হাতে করিতে পারে।”

 এই বলিয়া মাতা পরম স্নেহে কর্মে-অপটু মহেন্দ্রের প্রতি নেপাত করিলেন। কেমন করিয়া এই অকর্মণ্য একান্ত মাতৃস্নেহাপেক্ষী বয়স্ক সন্তানটিকে সর্বপ্রকার আরামে রাখিতে পারবেন, বিনোদিনীর সহিত রাজলক্ষ্মীর সেই একমাত্র পরামর্শ। এই পুত্রসেবা ব্যাপারে বিনোদিনীর প্রতি নির্ভর করিয়া তিনি নিতান্ত নিশ্চিন্ত, পরম সুখী। সম্প্রতি বিনোদিনীর মর্যাদা যে মহেন্দ্র বুঝিয়াছে এবং বিনোদিনীকে রাখিবার জন্য তাহার যত্ব হইয়াছে, ইহাতেও রাজলক্ষ্মী আনন্দিত। মহেন্দ্রকে শুনাইয়া শুনাইয়া তিনি কহিলেন, “বউ, আজ তো তুমি মহিনের গরম কাপড় রোদে দিয়া তুলিলে, কাল মহিনের নূতন রুমালগুলিতে উহার নামের অক্ষর সেলাই করিয়া দিতে হইবে। তোমাকে এখানে আনিয়া অবধি যত্ন-আদর করিতে পারিলাম না বাছা, কেবল খাটাইয়া মারিলাম।”

 বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, অমন করিয়া যদি বল তবে বুঝিব তুমি আমাকে পর ভাবিতেছ।”

 রাজলক্ষ্মী আদর করিয়া কহিলেন, “আহা মা, তোমার মতো আপন আমি পাব কোথায়।”

 বিনোদিনীর কাপড় তোলা শেষ হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “এখন কি তবে সেই চিনির রসটা চড়াইয়া দিব, না, এখন তোমার অন্য কাজ আছে?”

 বিনোদিনী কহিল, “না পিসিমা, অন্য কাজ আর কই। চলো, মিঠাইগুলি তৈরি করিয়া আসি গে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “মা, এইমাত্র অনুতাপ করিতেছিলে উহাকে খাটাইয়া মারিতেছ, আবার এখনই কাজে টানিয়া লইয়া চলিলে?”

 রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীর চিবুক স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমাদের লক্ষ্মী মেয়ে যে কাজ করিতেই ভালোবাসে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “আজ সন্ধ্যাবেলায় আমার হাতে কোনো কাজ নাই, ভাবিয়াছিলাম বালিকে লইয়া একটা বই পড়িব।”

 বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, বেশ তো, আজ সন্ধ্যাবেলা আমরা দুজনেই ঠাকুরপোর বই-পড়া শুনিতে আসিব— কী বল।”

 রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, ‘মহিন আমার নিতান্ত একলা পড়িয়াছে, এখন সকলে মিলিয়া তাহাকে ভুলাইয়া রাখা আবশ্যক।’ কহিলেন, “তা বেশ তো, মহিনের খাবার তৈরি শেষ করিয়া আমরা আজ সন্ধ্যাবেল পড়া শুনিতে আসিব। কী বলিস মহিন।”

 বিনোদিনী মহেন্দ্রের মুখের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া একবার দেখিয়া লইল। মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা।” কিন্তু তাহার আর উৎসাহ রহিল না। বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে সঙ্গেই বাহির হইয়া গেল।

 মহেন্দ্র রাগ করিয়া ভাবিল, ‘আমিও আজ বাহির হইয়া যাইব— দেরি করিয়া বাড়ি ফিরিব।’ বলিয়া তখনই বাহিরে যাইবার কাপড় পড়িল। কিন্তু সংকল্প কাজে পরিণত হইল না। মহেন্দ্র অনেকক্ষণ ধরিয়া ছাদে পায়চারি করিয়া বেড়াইল, সিঁড়ির দিকে অনেকবার চাহিল, শেষে ঘরের মধ্যে আসিয়া বসিয়া পড়িল। বিরক্ত হইয়া মনে মনে কহিল, ‘আমি আজ মিঠাই স্পর্শ না করিয়া মাকে জানাইয়া দিব, এত দীর্ঘকাল ধরিয়া চিনির রস জ্বাল দিলে তাহাতে মিষ্টত্ব থাকে না।’

 আজ আহারের সময় বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীকে সঙ্গে করিয়া আনিল। রাজলক্ষ্মী তাঁহার হাঁপানির ভয়ে প্রায় উপরে উঠিতে চান না, বিনোদিনী তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াই সঙ্গে আনিয়াছে। মহেন্দ্র অত্যন্ত গম্ভীরমুখে খাইতে বসিল।

 বিনোদিনী কহিল, “ও কী ঠাকুরপো, আজ তুমি কিছুই খাইতেছ না যে!”

 রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু অসুখ করে নাই তো?”

 বিনোদিনী কহিল, “এত করিয়া মিঠাই করিলাম, কিছু মুখে দিতেই হইবে। ভালো হয় নি বুঝি? তবে থাক্। না না, অনুরোধে পড়িয়া জোর করিয়া খাওয়া কিছু নয়। না না, কাজ নাই।”

 মহেন্দ্র কহিল, “ভালো মুশকিলেই ফেলিলে! মিঠাইটাই সব চেয়ে খাইবার ইচ্ছ, লাগিতেছেও ভালো, তুমি বাধা দিলে শুনিব কেন।”

 দুইটি মিঠাই মহেন্দ্র নিঃশেষপূর্বক খাইল— তাহার একটি দানা, একটু গুঁড়া পর্যন্ত ফেলিল না।

 আহারান্তে তিনজনে মহেন্দ্রের শোবার ঘরে আসিয়া বসিলেন। পড়িবার প্রস্তাবটা মহেন্দ্র আর তুলিল না; রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তুই যে কী বই পড়িবি বলিয়াছিলি আরম্ভ কর্-না।”

 মহেন্দ্র কহিল,”কিন্তু তাহাতে ঠাকুর-দেবতার কথা কিছুই নাই, তোমার শুনিতে ভালো লাগিবে না।”

 ভালো লাগিবে না! যেমন করিয়া হোক, ভালো লাগিবার জন্য রাজলক্ষ্মী কৃতসংকল্প। মহেন্দ্র যদি তুর্কি ভাষাও পড়ে, তাঁহার ভালো লাগিতেই হইবে! আহা, বেচারা মহিন, বউ কাশী গেছে, একলা পড়িয়া আছে— তাহার যা ভালো লাগিবে মাতার তাহা ভালো না লাগিলে চলিবে কেন।

 বিনোদিনী কহিল, “এক কাজ করে-না ঠাকুরপো, পিলিমার ঘরে বাংলা শান্তিশতক আছে, অন্য বই রাখিয়া আজ সেইটে পড়িয়া শোনাও-না। পিসিমারও ভালো লাগিবে, সন্ধ্যাটাও কাটিবে ভালো।”

 মহেন্দ্র নিতান্ত করুণভাবে একবার বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিল। এমন সময় ঝি আসিয়া খবর দিল, “ম, কায়েত-ঠাকরুন আসিয়া তোমার ঘরে বসিয়া আছেন।”

 কায়েত-ঠাকরুন রাজলক্ষ্মীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সন্ধ্যার পর তাঁহার সঙ্গে গল্প করিবার প্রলোভন সংবরণ করা রাজলক্ষ্মীর পক্ষে দুঃসাধ্য। তবু ঝিকে বলিলেন, “কায়েত-ঠাকরুনকে বল, আজ মহিনের ঘরে আমার একটু কাজ আছে, কাল তিনি যেন অবশ্য-অবশ্য করিয়া আসেন।”

 মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “কেন মা, তুমি তাণর সঙ্গে দেখা করিয়াই এসো-না।”

 বিনোদিনী কহিল, “কাজ কী পিসিম, তুমি এখানে থাকে, আমি বরঞ্চ কায়েত-ঠাকরুনের কাছে গিয়া বসি গে।”

 রাজলক্ষ্মী প্রলোভন সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন, “বউ, তুমি ততক্ষণ এখানে বোসো— দেখি, যদি কায়েত-ঠাকরুনকে বিদায় করিয়া আসিতে পারি। তোমরা পড়া আরম্ভ করিয়া দাও, আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ো না।”

 রাজলক্ষ্মী ঘরের বাহির হইবা মাত্র মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না; বলিয়া উঠিল, “কেন তুমি আমাকে ইচ্ছা করিয়া এমন করিয়া মিছামিছি পীড়ন কর।”

 বিনোদিনী যেন আশ্চর্য হইয়া কহিল, “সে কী ভাই। আমি তোমাকে পীড়ন কী করিলাম। তবে কী তোমার ঘরে আসা আমার দোষ হইয়াছে। কাজ নাই, আমি যাই।”

 বলিয়া বিমর্ষমুখে উঠবার উপক্রম করিল।

 মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, “অমনি করিয়াই তো তুমি আমাকে দগ্ধ কর।”

 বিনোদিনী কহিল, “ইস, আমার যে এত তেজ, তাহা তো আমি জানিতাম না। তোমারও তো প্রাণ কঠিন কম নয়, অনেক সহ্য করিতে পার। খুব যে ঝলসিয়া-পুড়িয়া গেছ, চেহারা দেখিয়া তাহা কিছু বুঝিবার জো নাই।”

 মহেন্দ্র কহিল, “চেহারায় কী বুঝিবে।”

 বলিয়া বিনোদনীর হাত বলপূর্বক লইয়া নিজের বুকের উপর চাপিয়া ধরিল।

 বিনোদিনী “উঃ” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেই মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়া দিয়া কহিল, “লাগিল কি।”

 দেখিল, কাল বিনোদিনীর হাতের যেখানটা কাটিয়া গিয়াছিল সেইখান দিয়া আবার রক্ত পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্র অনুতপ্ত হইয়া কহিল, “আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম— ভারি অন্যায় করিয়াছি। আজ কিন্তু এখনই তোমার ও জায়গাট বাঁধিয়া ওষুধ লাগাইয়া দিব— কিছুতেই ছাড়িব না।”

 বিনোদিনী কহিল, “না, ও কিছুই না। আমি ওষুধ দিব না।”

 মহেন্দ্র কহিল, “কেন দিবে না।”

 বিনোদিনী কহিল, “কেন আবার কী। তোমার আর ডাক্তারি করিতে হইবে না, ও যেমন আছে থাক্‌।”

 মহেন্দ্র মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হইয়া গেল; মনে মনে কহিল, ‘কিছুই বুঝিবার জো নাই। স্ত্রীলোকের মন!’

 বিনোদিনী উঠিল। অভিমানী মহেন্দ্র বাধা না দিয়া কহিল, “কোথায় যাইতেছ।”

 বিনোদিনী কহিল, “কাজ আছে।”

 বলিয়া ধীরপদে চলিয়া গেল।

 মিনিটখানেক বসিয়াই মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য দ্রুত উঠিয়া পড়িল; সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া একলা ছাদে বেড়াইতে লাগিল।

 বিনোদিনী অহরহ আকর্ষণও করে, অথচ বিনোদিনী এক মুহূর্ত কাছে আসিতেও দেয় না। অন্যে তাহাকে জিনিতে পারে না, এ গর্ব মহেন্দ্রের ছিল, তাহা সে সম্প্রতি বিসর্জন দিয়াছে; কিন্তু চেষ্টা করিলেই অন্যকে সে জিনিতে পারে, এ গর্বটুকুও কি রাখিতে পারিবে না। আজ সে হার মানিল, অথচ হার মানাইতে পারিল না। হৃদয়ক্ষেত্রে মহেন্দ্রের মাথা বড়ো উচ্চেই ছিল, সে কাহাকেও আপনার সমকক্ষ বলিয়া জানিত না— আজ সেইখানেই তাহাকে ধুলায় মাথা লুটাইতে হইল। যে শ্রেষ্ঠতা হারাইল তাহার বদলে কিছু পাইলও না। ভিক্ষুকের মতো রুদ্ধদ্বারের সম্মুখে সন্ধ্যার সময় রিক্তহস্তে পথে দাঁড়াইয়া থাকিতে হইল।

 ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বিহারীদের জমিদারি হইতে সর্ষেফুলের মধু আসিত, প্রতি বৎসরই সে তাহ রাজলক্ষ্মীকে পাঠাইয়া দিত— এবারও পাঠাইয়া দিল।

 বিনোদিনী মধুভাণ্ড লইয়া স্বয়ং রাজলক্ষ্মীর কাছে গিয়া কহিল, “পিসিমা, বিহারী-ঠাকুরপো মধু পাঠাইয়াছেন।”

 রাজলক্ষ্মী তাহা ভাঁড়ারে তুলিয়া রাখিতে উপদেশ দিলেন। বিনোদিনী মধু

তুলিয়া আসিয়া রাজলক্ষ্মীর কাছে বসিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো কখনো তোমাদের তত্ত্ব লইতে ভোলেন না। বেচারার নিজের মা নাই নাকি, তাই তোমাকেই মার মতো দেখেন।”

 বিহারীকে রাজলক্ষ্মী এমনি মহেন্দ্রের ছায়া বলিয়া জানিতেন যে, তাহার কথা তিনি বিশেষ কিছু ভাবিতেন না— সে তাঁহাদের বিনা মূল্যের, বিনা যত্নের, বিনা চিন্তার অনুগত লোক ছিল। বিনোদিনী যখন রাজলক্ষ্মীকে মাতৃহীন বিহারীর মাতৃস্থানীয়া বলিয়া উল্লেখ করিল, তখন রাজলক্ষ্মীর মাতৃহৃদয় অকস্মাৎ স্পর্শ করিল। হঠাৎ মনে হইল, ‘তা বটে, বিহারীর মা নাই এবং আমাকেই সে মার মতো দেখে।’ মনে পড়িল, রোগে তাপে সংকটে বিহারী বরাবর বিনা আহ্বানে, বিনা আড়ম্বরে, তাঁহাকে নিঃশব্দে নিষ্ঠার সহিত সেবা করিয়াছে। রাজলক্ষ্মী তাহা নিশ্বাসপ্রশ্বাসের মতো সহজে গ্রহণ করিয়াছেন এবং সেজন্য কাহারো কাছে কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা তাঁহার মনেও উদয় হয় নাই। কিন্তু বিহারীর খোঁজখবর কে রাখিয়াছে। যখন অন্নপূর্ণা ছিলেন তিনি রাখিতেন বটে; রাজলক্ষ্মী ভাবিতেন, ‘বিহারীকে বশে রাখিবার জন্য অন্নপূর্ণা স্নেহের আড়ম্বর করিতেছেন।’

 রাজলক্ষ্মী আজ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বিহারী আমার আপন ছেলের মতোই বটে।”

 বলিয়াই মনে উদয় হইল, বিহারী তাঁহার আপন ছেলের চেয়ে ঢের বেশি করে— এবং কখনো বিশেষ কিছু প্রতিদান না পাইয়াও তাঁহাদের প্রতি সে ভক্তি স্থির রাখিয়াছে। ইহা ভাবিয়া তাঁহার অন্তরের মধ্য হইতে দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।

 বিনোদিনী কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো তোমার হাতের রান্না খাইতে বড়ো ভালোবাসেন!”

 রাজলক্ষ্মী সস্নেহ গর্বে কহিলেন, “আর-কারো মাছের ঝোল তাহার মুখে রোচে না।”

 বলিতে বলিতে মনে পড়িল, অনেকদিন বিহারী আসে নাই। কহিলেন, “আচ্ছা বউ, বিহারীকে আজকাল দেখিতে পাই না কেন।”

 বিনোদিনী কহিল, “আমিও তো তাই ভাবিতেছিলাম, পিসিমা তা, তোমার ছেলেটি বিবাহের পর হইতে নিজের বউকে লইয়াই এমনি মাতিয়া রহিয়াছে— বন্ধুবান্ধবরা আসিয়া আর কী করিবে বলো।”

 কথাটা রাজলক্ষ্মীর অত্যন্ত সংগত বোধ হইল। স্ত্রীকে লইয়া মহেন্দ্র তাঁহার সমস্ত হিতৈষীদের দূর করিয়াছে। বিহারীর তো অভিমান হইতেই হয়— যেন সে আসিবে। বিহারীকে নিজের দলে পাইয়া তাহার প্রতি রাজলক্ষ্মীর সমবেদনা বাড়িয়া উঠিল। বিহারী যে ছেলেবেলা হইতে একান্ত নিঃস্বার্থভাবে মহেন্দ্রের কত উপকার করিয়াছে, তাহার জন্য কতবার কত কষ্ট সহ্য করিয়াছে, সে-সমস্ত তিনি বিনোদিনীর কাছে বিবৃত করিয়া বলিতে লাগিলেন— ছেলের উপর তাঁহার নিজের যা নালিশ তা বিহারীর বিবরণ দ্বারা সমর্থন করিতে লাগিলেন। দুদিন বউকে পাইয়া মহেন্দ্র যদি তাহার চিরকালের বন্ধুকে এমন অনাদর করে, তবে সংসারে ন্যায়ধর্ম আর রহিল কোথায়।

 বিনোদিনী কহিল, “কাল রবিবার আছে, তুমি বিহারী-ঠাকুরপোকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াও, তিনি খুশি হইবেন।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ঠিক বলিয়াছ বউ, তা হইলে মহিনকে ডাকাই, সে বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইবে।”

 বিনোদিনী। না পিসিমা, তুমি নিজে নিমন্ত্রণ করো।

 রাজলক্ষ্মী। আমি কি তোমাদের মতো লিখিতে পড়িতে জানি।

 বিনোদিনী। তা হোক, তোমার হইয়া নাহয় আমিই লিখিয়া দিতেছি।

 বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর নাম দিয়া নিজেই নিমন্ত্রণ-চিঠি লিখিয়া পাঠাইল।

 রবিবার দিন মহেন্দ্রের অত্যন্ত আগ্রহের দিন। পূর্বরাত্রি হইতেই তাহার কল্পনা উদ্দাম হইয়া উঠিতে থাকে, যদিও এ পর্যন্ত তাহার কল্পনার অম্বরূপ কিছুই হয় নাই— তবু রবিবারের ভোরের আলো তাহার চক্ষে মধুবর্ষণ করিতে লাগিল। জাগ্রত নগরীর সমস্ত কোলাহল তাহার কানে অপরূপ সংগীতের মতো আসিয়া প্রবেশ করিল।

 কিন্তু ব্যাপারখানা কী। মার আজ কোনো ব্রত আছে নাকি। অন্য দিনের মতো বিনোদিনীর প্রতি গৃহকর্মের ভার দিয়া তিনি তো বিশ্রাম করিতেছেন না। আজ তিনি নিজেই ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতেছেন।

 এই হাঙ্গামে দশটা বাজিয়া গেল— ইতিমধ্যে মহেন্দ্র কোনো ছুতায় বিনোদিনীর সঙ্গে এক মুহূর্ত বিরলে দেখা করিতে পারিল না। বই পড়িতে চেষ্টা করিল, পড়ায় কিছুতেই মন বসিল না; খবরের কাগজের একটা অনাবশ্যত বিজ্ঞাপনে পনেরো মিনিট দৃষ্টি আবদ্ধ হইয়া রহিল। আর থাকিতে পারিল না। নীচে গিয়া দেখিল, মা তাঁহার ঘরের বারান্দায় একটা তোলা উনানে রাঁধিতেছেন এবং বিনোদিনী কটিদেশে দৃঢ় করিয়া আঁচল জড়াইয়া জোগান দিতে ব্যস্ত।

 মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “আজ তোমাদের ব্যাপারটা কী। এত ধুমধাম যে?”

 রাজলক্ষ্মী বলিলেন, “বউ তোমাকে বলে নাই? আজ যে বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিয়াছি।”

 বিহারীকে নিমন্ত্রণ! মহেন্দ্রের সর্বশরীর জ্বলিয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ কহিল, “কিন্তু মা, আমি তো থাকিতে পারিব না।”

 রাজলক্ষ্মী। কেন।

 মহেন্দ্র। আমায় যে বাহিরে যাইতে হইবে।

 রাজলক্ষ্মী। খাওয়াদাওয়া করিয়া যাস, বেশি দেরি হইবে না।

 মহেন্দ্র। আমার যে বাহিরে নিমন্ত্রণ আছে।

 বিনোদিনী মুহূর্তের জন্য মহেন্দ্রের মুখে কটাক্ষপাত করিয়া কহিল, “যদি নিমন্ত্রণ থাকে, তা হইলে উনি যান-না পিসিমা। নাহয় আজ বিহারী-ঠাকুরপো একলাই খাইবেন।”

 কিন্তু নিজের হাতের যত্নের রান্না মহিনকে খাওয়াইতে পারিবেন না, ইহা রাজলক্ষ্মীর সহিবে কেন। তিনি যতই পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন, মহিন ততই বাঁকিয়া দাঁড়াইল। ‘অত্যন্ত জরুরি নিমন্ত্রণ, কিছুতেই কাটাইবার জো নাই—বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিবার পূর্বে আমার সহিত পরামর্শ করা উচিত ছিল’ ইত্যাদি।

 রাগ করিয়া মহেন্দ্র এইরূপে মাকে শাস্তি দিবার ব্যবস্থা করিল। রাজলক্ষ্মীর সমস্ত উৎসাহ চলিয়া গেল। তাঁহার ইচ্ছা হইল, রান্না ফেলিয়া তিনি চলিয়া যান। বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, তুমি কিছু ভাবিয়ে না— ঠাকুরপো মুখে আস্ফালন করিতেছেন, কিন্তু আজ উহার বাহিরে নিমন্ত্রণে যাওয়া হইতেছে না।”

 রাজলক্ষ্মী মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “না বাছা, তুমি মহিনকে জান না, ও যে একবার ধরে তা কিছুতেই ছাড়ে না।”

 কিন্তু বিনোদিনী মহেন্দ্রকে রাজলক্ষ্মীর চেয়ে কম জানে না, তাহাই প্রমাণ হইল। মহেন্দ্র বুঝিয়াছিল, বিহারীকে বিনোদিনীই নিমন্ত্রণ করাইয়াছে। ইহাতে তাহার হৃদয় ঈর্ষায় যতই পীড়িত হইতে লাগিল, ততই তাহার পক্ষে দূরে যাওয়া কঠিন হইল। বিহারী কী করে, বিনোদিনী কী করে, তাহা না দেখিয়া সে বাঁচিবে কী করিয়া। দেখিয়া জ্বলিতে হইবে, কিন্তু দেখাও চাই।

 বিহারী আজ অনেক দিন পরে নিমন্ত্রিত আত্মীয়-ভাবে মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। বাল্যকাল হইতে যে ঘর তাহার পরিচিত এবং যেখানে সে ঘরের ছেলের মতো অবারিত ভাবে প্রবেশ করিয়া দৌরাত্ম্য করিয়াছে, তাহার দ্বারের কাছে আসিয়া মুহূর্তের জন্য সে থমকিয়া দাঁড়াইল— একটা অশ্রতরঙ্গ পলকের মধ্যে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিরার জন্য তাহার বক্ষকবাটে আঘাত করিল। সেই আঘাত সংবরণ করিয়া লইয়া সে স্মিতহাস্যে ঘরে প্রবেশ করিয়া সদ্যস্নাতা রাজলক্ষ্মীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ধূলা লইল। বিহারী যখন সর্বদা যাতায়াত করিত তখন এরূপ অভিবাদন তাহাদের প্রথা ছিল না। আজ যেন সে বহুদূরপ্রবাস হইতে পুনর্বার ঘরে ফিরিয়া আসিল। বিহারী প্রণাম করিয়া উঠিবার সময় রাজলক্ষ্মী সস্নেহে তাহার মাথায় হস্তস্পর্শ করিলেন।

 রাজলক্ষ্মী আজ নিগূঢ় সহানুভূতি-বশত বিহারীর প্রতি পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি আদর ও স্নেহ প্রকাশ করিলেন। কহিলেন, “ও বেহারি, তুই এতদিন জাসিস নাই কেন। আমি রোজ মনে করিতাম, আজ নিশ্চয় বেহারি আসিবে, কিন্তু তোর আর দেখা নাই।”

 বিহারী হাসিয়া কহিল, “রোজ আসিলে তো তোমার বিহারীকে রোজ মনে করিতে না, মা। মহিনদা কোথায়।”

 রাজলক্ষ্মী বিমর্ষ হইয়া কহিলেন, “মহিনের আজ কোথায় নিমন্ত্রণ আছে, সে আজ কিছুতেই থাকিতে পারিল না।”

 শুনিবামাত্র বিহারীর মনটা বিকল হইয়া গেল। আশৈশব প্রণয়ের শেষ এই পরিণাম! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মন হইতে সমস্ত বিষাদবাষ্প উপস্থিতমত তাড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কী রান্না হইয়াছে শুনি।”

 বলিয়া তাহার নিজের প্রিয় ব্যঞ্জনগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মীর রন্ধনের দিন বিহারী কিছু অতিরিক্ত আড়ম্বর করিয়া নিজেকে লুদ্ধ বলিয়া পরিচয় দিত; আহারলোলুপতা দেখাইয়া বিহারী মাতৃহৃদয়শালিনী রাজলক্ষ্মীর স্নেহ কাডিয়া লইত। আজও তাহার স্বরচিত ব্যঞ্জন সম্বন্ধে বিহারীর অতিমাত্রায় কৌতূহল দেখিয়া, রাজলক্ষ্মী হাসিতে হাসিতে তাঁহার লোভাতুর অতিথিকে আশ্বাস দিলেন।

 এমন সময় মহেন্দ্র আসিয়া বিহারীকে শুষ্ক স্বরে দস্তুরমত জিজ্ঞাসা করিল, “কী বিহারী, কেমন আছ।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কই মহিন, তুই তোর নিমন্ত্রণে গেলি না?”

 মহেন্দ্র লজ্জা ঢাকিতে চেষ্টা করিয়া কহিল, “না, সেটা কাটাইয়া দেওয়া গেছে।”

 স্নান করিয়া আসিয়া বিনোদিনী যখন দেখা দিল, তখন বিহারী প্রথমটা কিছুই বলতে পারি না। বিনোদনী ও মনের যে দৃশ্য সে দেখিয়াছিল, তাহ তাহার মণে মুদ্রিত ছিল।

 বিনোদিনী বিহারীর অনতিদূরে আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “কী ঠাকুরপো, একেবারে চিনিতেই পারনা নাকি।”

 বিহারী কহিল, “সকলকেই কি চেনা যায়।”

 বিনোদিনী কহিল, “একটু বিবেচনা থাকিলেই যায়।”

 বলিয়া খবর দিল, “পিসিমা, খাবার প্রস্তুত হইয়াছে।”

 মহেন্দ্র বিহারী খাইতে বসিল; রাজলক্ষ্মী অদূরে বসিয়া দেখিতে লাগিলেন এবং বিনোদিনী পরিবেশন করিতে লাগিল।

 মহেন্দ্রের খাওয়ায় মনোযোগ ছিল না, সে কেবল পরিবেশনে পক্ষপাত লক্ষ করিতে লাগিল। মহেন্দ্রের মনে হইল, বিহারীকে পরিবেশন করিয়া বিনোদিনী যেন একটা বিশেষ সুখ পাইতেছে। বিহারীর পাতেই যে বিশেষ করিয়া মাছের মুড়া ও দধির সর পড়িল, তাহার উত্তম কৈফিয়ত ছিল— মহেন্দ্র ঘরের ছেলে, বিহারী নিমন্ত্রিত। কিন্তু মুখ ফুটিয়া নালিশ করিবার ভালো হেতুবাদ ছিল না বলিয়াই মহেন্দ্র আরো বেশি করিয়া জ্বলিতে লাগিল। অময়ে বিশেয সন্ধানে তপসি মাছ পাওয়া গিয়াছিল, তাহার মধ্যে একটি ডিমওয়ালা ছিল; সেই মাছটি বিনোদিনী বিহারীর পাতে দিতে গেলে বহারী কাইল, “না না, মহিনদাকে দাও, মহিনদা ভালোবাসে।”

 মহেন্দ্র তীব্র অভিমানে বলিয়া উঠিল, “না না, আমি চাই না।”

 শুনিয়া বিনোদিনী দ্বিতীয় বার অনুরোধমাত্র না করিয়া সে মাছ বিহারীর পাতে ফেলিয়া দিল।

 আহারান্তে দুই বন্ধু উঠিয়া ঘরের বাহিরে আসিলে বিনোদিনী তাড়াতাড়ি আসিয়া কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, এখনই যাইয়ো না, উপরের ঘরে একটু বসিবে চলো।”

 বিহারী কহিল, “তুমি থাইতে যাইবে না?”

 বিনোদিনা কহিল, “না, আজ একাদশী।”

 নিষ্ঠুর বিদ্রুপের একটি সূক্ষ হাস্তরেখা বিহারীর ওষ্ঠপ্রান্তে দেখা দিল— তাহার অর্থ এই যে, একাদশী করাও আছে! অনুষ্ঠানের ক্রটি নাই।

 সেই হাস্যের আভাসটুকু বিনোদিনীর দৃষ্টি এড়ায় নাই— তবু সে যেমন তাহার হাতের কাটা ঘা সহ করিয়াছিল, তেমনি করিয়া ইহাও সহ্য করিল। নিতান্ত মিনতির স্বরে কহিল, “আমার মাথা খাও, একবার বসিবে চলো।”

 মহেন্দ্র হঠাৎ অসংগতভাবে উত্তেজিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “তোমাদের কিছুই তো বিবেচনা নাই— কাজ থাক্ কর্ম থাক্, ইচ্ছা থাক্ বা না থাক্, তবু বসিতেই হইবে। এত অধিক আদরের আমি তো কোনো মানে বুঝিতে পারি না।”

 বিনোদিনী উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, শোনো একবার, তোমার মহিনদার কথা শোনো। আদরের মানে আদর, অভিধানে তাহার আর কোনো দ্বিতীয় মানে লেখে না।”—

 মহেন্দ্রের প্রতি, “যাই বল ঠাকুরপো, অধিক আদরের মানে শিশুকাল হইতে তুমি যত পরিষ্কার বোঝ, এমন আর কেহ বোঝে না।”

 বিহারী কহিল, “মহিনদা, একটা কথা আছে, একবার শুনিয়া যাও।”

 বলিয়া বিহারী বিনোদিনীকে কোনো বিদায়সস্তাবণ না করিয়া মহেন্দ্রকে লইয়া বাহিরে গেল। বিনোদিনী বারান্দার রেলিং ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া শূন্য উঠানের শূন্যতার দিকে তাকাইয়া রহিল।

 বিহারী বাহিরে আসিয়া কহিল, “মহিনদা, আমি জানিতে চাই, এইখানেই কি আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হইল।”

 মহেন্দ্রের বুকের ভিতর তখন জ্বলিতেছিল, বিনোদিনীর পরিহাস-হাস্য বিদ্যুৎশিখার মতো তাহার মস্তিষ্কের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত বারংবার ফিরিয়া ফিরিয়া বিঁধিতেছিল; সে কহিল, “মিটমাট হইলে তোমার তাহাতে বিশেষ সুবিধা হইতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তাহা প্রার্থনীয় বোধ হয় না। আমার সংসারের মধ্যে আমি বাহিরের লোক ঢুকাইতে চাই না, অন্তঃপুরকে আমি অন্তঃপুর রাখিতে চাই।”

 বিহারী কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল। ঈর্ষাজর্জর মহেন্দ্র একবার প্রতিজ্ঞা করিল, ‘বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা করিব না। তাহার পরে বিনোদিনীর সহিত সাক্ষাতের প্রত্যাশায় ঘরে বাহিরে, উপরে নীচে ছট্‌ফট্‌ করিয়া বেড়াইতে লাগিল।