চোখের বালি/৫৩
৫৩
মহেন্দ্র তাহার মাতার ঘরে প্রবেশ করিতে যাইতেছে, তখন আশা তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া আসিয়া কহিল, “এখন ও ঘরে যাইয়ো না।”
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কেন।”
আশা কহিল, “ভাক্তার বলিয়াছেন, হঠাৎ মার মনে, সুখের হউক, দুঃখের হউক, একটা কোনো আঘাত লাগিলে বিপদ হইতে পারে।”
মহেন্দ্র কহিল, “আমি একবার আস্তে আস্তে তাঁহার মাথার শিয়রের কাছে গিয়া দেখিয়া আসি গে― তিনি টের পাইবেন না।”
আশা কহিল, “তিনি অল্প শব্দেই চমকিয়া উঠিতেছেন, তুমি ঘরে ঢুকিলেই তিনি টের পাইবেন।”
মহেন্দ্র। তবে, এখন তুমি কী করিতে চাও।
আশা। আগে বিহারী-ঠাকুরপো আসিয়া একবার দেখিয়া যান― তিনি যেরূপ পরামর্শ দিবেন তাহাই করিব।
বলিতে বলিতে বিহারী আসিয়া পড়িল। আশা তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিল।
বিহারী। বোঠান, ডাকিয়াছ? মা ভালো আছেন তো?
আশা বিহারীকে দেখিয়া যেন নির্ভর পাইল। কহিল, “তুমি যাওয়ার পর হইতে মা যেন আরো চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন। প্রথম দিন তোমাকে না দেখিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বিহারী কোথায় গেল।’ আমি বলিলাম, তিনি বিশেষ কাজে গেছেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে ফিরিবার কথা আছে। তাহার পর হইতে তিনি থাকিয়া থাকিয়া চমকিয়া উঠিতেছেন। মুখে কিছুই বলেন না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যেন কাহার অপেক্ষা করিতেছেন। কাল তোমার টেলিগ্রাম পাইয়া জানাইলাম আজ তুমি আসিবে। শুনিয়া তিনি আজ তোমার জন্য বিশেষ করিয়া খাবার আয়োজন করিতে বলিয়াছেন। তুমি যাহা যাহা ভালোবাস সমস্ত আনিতে দিয়াছেন, সম্মুখের বারান্দায় রাঁধিবার আয়োজন করাইয়াছেন, তিনি ঘর হইতে দেখাইয়া দিবেন। ডাক্তারের নিষেধ কিছুতেই শুনিলেন না। আমাকে এই খানিকক্ষণ হইল ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, ‘বউমা, তুমি নিজের হাতে সমস্ত রাঁধিবে, আমি আজ সামনে বসাইয়া বিহারীকে খাওয়াইব।’”
শুনিয়া বিহারীর চোখ ছল্ ছল্ করিয়া আসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মা আছেন কেমন।”
আশা কহিল, “তুমি একবার নিজে দেখিবে এসো― আমার তো বোধ হয়, ব্যামো আরো বাড়িয়াছে।”
তখন বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। মহেন্দ্র বাহিরে দাঁড়াইয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। আশা বাড়ির কর্তৃত্ব অনায়াসে গ্রহণ করিয়াছে— সে মহেন্দ্রকে কেমন সহজে ঘরে ঢুকিতে নিষেধ করিল। না করিল সংকোচ, না করিল অভিমান। মহেন্দ্রের বল আজ কতখানি কমিয়া গেছে। সে অপরাধী, সে বাহিরে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল― মার ঘরেও ঢুকিতে পারিল না।
তাহার পরে ইহাও আশ্চর্য― বিহারীর সঙ্গে আশা কেমন অকুণ্ঠিত ভাবে কথাবার্তা কহিল। সমস্ত পরামর্শ তাহারই সঙ্গে। সেই আজ সংসারের একমাত্র রক্ষক, সকলের সুহৃৎ। তাহার গতিবিধি সর্বত্র, তাহার উপদেশেই সমস্ত চলিতেছে। মহেন্দ্র কিছুদিনের জন্য যে জায়গাটি ছাড়িয়া চলিয়া গেছে, ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সে জায়গা ঠিক আর তেমনটি নাই।
বিহারী ঘরে ঢুকিতেই রাজলক্ষ্মী তাঁহার করুণ চক্ষু তাহার মুখের দিকে রাখিয়া কহিলেন, “বিহারী, ফিরিয়াছিস?”
বিহারী কহিল, “হাঁ মা, ফিরিয়া আসিলাম।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তোর কাজ শেষ হইয়া গেছে?”
বলিয়া তাহার মুখের দিকে একাগ্রদৃষ্টিতে চাহিলেন।
বিহারী প্রফুল্লমুখে “হাঁ মা, কাজ সুসম্পন্ন হইয়াছে, এখন আমার আর-কোনো ভাবনা নাই” বলিয়া একবার বাহিরের দিকে চাহিল।
রাজলক্ষ্মী। আজ বউমা তোমার জন্য নিজের হাতে রাঁধিবেন, আমি এখান হইতে দেখাইয়া দিব। ডাক্তার বারণ করে কিন্তু আর বারণ কিসের জন্য বাছা। আমি কি একবার তোদের খাওয়া দেখিয়া যাইব না।
বিহারী কহিল, “ডাক্তারের বারণ করিবার তো কোনো হেতু দেখি না মা― তুমি না দেখাইয়া দিলে চলিবে কেন। ছেলেবেলা হইতে তোমার হাতের রান্নাই আমরা ভালোবাসিতে শিখিয়াছি― মহিনদার তো পশ্চিমের ডালরুটি খাইয়া অরুচি ধরিয়া গেছে― আজ সে তোমার মাছের ঝোল পাইলে বাঁচিয়া যাইবে। আজ আমরা দুই ভাই ছেলেবেলাকার মতো রেষারেষি করিয়া খাইব, তোমার বউমা অন্নে কুলাইতে পারিলে হয়।”
যদিচ রাজলক্ষ্মী বুঝিয়াছিলেন, বিহারী মহেন্দ্রকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে, তবু তাহার নাম শুনিতেই তাঁহার হৃদয় স্পন্দিত হইয়া নিশ্বাস ক্ষণকালের জন্য কঠিন হইয়া উঠিল।
সে ভাবটা কাটা গেলে বিহারী কহিল, “পশ্চিমে গিয়া মহিনদার শরীর অনেকটা ভালো হইয়াছে। আজ পথের অনিয়মে সে একটু ম্লান আছে, স্নানাহার করিলেই শুধরাইয়া উঠিবে।”
রাজলক্ষ্মী তবু মহেন্দ্রের কথা কিছু বলিলেন না; তখন বিহারী কহিল, “মা, মহিনদা বাহিরেই দাঁড়াইয়া আছে, তুমি না ডাকিলে সে তো আসিতে পারিতেছে না।”
রাজলক্ষ্মী কিছু না বলিয়া দরজার দিকে চাহিলেন। চাহিতেই বিহারী ডাকিল, “মহিনদা, এসো।”
মহেন্দ্র ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল। পাছে হৃৎপিণ্ড হঠাৎ স্তব্ধ হইয়া যায় এই ভয়ে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের মুখের দিকে তখনই চাহিতে পারিলেন না। চক্ষু অর্ধনিমীলিত করিলেন। মহেন্দ্র বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া চমকিয়া উঠিল, তাহাকে কে যেন মারিল।
মহেন্দ্র মাতার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া পা ধরিয়া পড়িয়া রহিল। স্পন্দনে রাজলক্ষ্মীর সমস্ত শরীর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল।
কিছুক্ষণ পরে অন্নপূর্ণা ধীরে ধীরে কহিলেন, “দিদি, মহিনকে তুমি উঠিতে বলো, নহিলে ও উঠিবে না।”
রাজলক্ষ্মী কষ্টে বাক্যস্ফুরণ করিয়া কহিলেন, “মহিন, ওঠ্।”
মহিনের নাম উচ্চারণমাত্র অনেক দিন পরে তাহার চোখ দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। সেই অশ্রু পড়িয়া তাহার হৃদয়ের বেদনা লঘু হইয়া আসিল। তখন মহেন্দ্র উঠিয়া, মাটিতে হাঁটু গাড়িয়া খাটের উপর বুক দিয়া তাহার মার পাশে আসিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী কষ্টে পাশ ফিরিয়া দুই হাতে মহেন্দ্রের মাথা লইয়া তাহার মস্তক আঘ্রাণ করিলেন, তাহার ললাট চুম্বন করিলেন।
মহেন্দ্র রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “মা, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, আমাকে মাপ করো।”
বক্ষ শান্ত হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও কথা বলিস নে মহিন, আমি তোকে মাপ না করিয়া কি বাঁচি। বউমা, বউমা কোথায় গেল।”
আশা পাশের ঘরে পথ্য তৈরি করিতেছিল— অন্নপূর্ণা তাহাকে ডাকিয়া আনিলেন।
তখন রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ভূতল হইতে উঠিয়া তাঁহার খাটে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। মহেন্দ্র খাটে বসিলে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের পার্শ্বে স্থান-নির্দেশ করিয়া আশাকে কহিলেন, “বউমা, এইখানেই তুমি বোসো― আজ আমি একবার তোমাদের দুজনকে একত্রে বসাইয়া দেখিব, তাহা হইলে আমার সকল দুঃখ ঘুচিবে। বউমা, আমার কাছে আর লজ্জা করিয়ো না, আর মহিনের ’পরেও মনের মধ্যে কোনো অভিমান না রাখিয়া একবার এইখানে বোসো— আমার চোখ জুড়াও মা।”
তখন ঘোমটা-মাথায় আশা লজ্জায় ধীরে ধীরে আসিয়া কম্পিতবক্ষে মহেন্দ্রের পাশে গিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী স্বহস্তে আশার ডান হাত তুলিয়া লইয়া মহেন্দ্রের ডান হাতে রাখিয়া চাপিয়া ধরিলেন; কহিলেন, “আমার এই মাকে তোর হাতে দিয়া গেলাম মহিন— আমার এই কথাটি মনে রাখিস, তুই এমন লক্ষ্মী আর কোথাও পাবি নে। মেজবউ, এসো, ইহাদের একবার আশীর্বাদ করো— তোমার পুণ্যে ইহাদের মঙ্গল হউক।”
অন্নপূর্ণা সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই উভয়ে চোখের জলে তাঁহার পদধুলি গ্রহণ করিল। অন্নপূর্ণা উভয়ের মস্তকচুম্বন করিয়া কহিলেন, “ভগবান তোমাদের কল্যাণ করুন।”
রাজলক্ষ্মী। বিহারী, এসো বাবা, মহিনকে তুমি একবার ক্ষমা করো।
বিহারী তখনই মহেন্দ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই মহেন্দ্র উঠিয়া দৃঢ় বাহ দ্বারা বিহারীকে বক্ষে টানিয়া লইয়া কোলাকুলি করিল।
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “মহিন, আমি তোকে এই আশীর্বাদ করি— শিশুকাল হইতে বিহারী তোর যেমন বন্ধু ছিল চিরকাল তেমনি বন্ধু থাক্— ইহার চেয়ে তোর সৌভাগ্য আর-কিছু হইতে পারে না।”
এই বলিয়া রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া নিস্তব্ধ হইলেন। বিহারী একটা উত্তেজক ঔষধ তাঁহার মুখের কাছে আনিয়া ধরিতেই রাজলক্ষ্মী হাত সরাইয়া দিয়া কহিলেন, “আর ওষুধ না বাবা! এখন আমি ভগবানকে স্মরণ করি— তিনি আমাকে আমার সমস্ত সংসারদাহের শেষ ওষুধ দিবেন। মহিন, তোরা একটুখানি বিশ্রাম কর্ গে। বউমা, এইবার রান্না চড়াইয়া দাও।”
সন্ধ্যাবেলায় বিহারী এবং মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীর বিছানার সম্মুখে নীচে পাত পাড়িয়া খাইতে বসিল। আশার উপর রাজলক্ষ্মী পরিবেশনের ভার দিয়াছিলেন, সে পরিবেশন করিতে লাগিল।
মহেন্দ্রের বক্ষের মধ্যে অস্ত্র উদ্বেলিত হইয়া উঠিতেছিল, তাহার মুখে অন্ন উঠিতেছিল না। রাজলক্ষ্মী তাহাকে বারবার বলিতে লাগিলেন, “মহিন, তুই কিছুই খাইতেছিস না কেন। ভালো করিয়া খা, আমি দেখি।”
বিহারী কহিল, “জানই তো মা, মহিনদা চিরকাল ঐ রকম, কিছুই খাইতে পারে না। বোঠান, ঐ ঘণ্টটা আমাকে আর-একটু দিতে হইবে, বড়ো চমৎকার হইয়াছে।”
রাজলক্ষ্মী খুশি হইয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমি জানি, বিহারী ঐ ঘণ্টটা ভালোবাসে। বউমা, ওটুকুতে কী হইবে, আর-একটু বেশি করিয়া দাও।”
বিহারী কহিল, “মা, তোমার এই বউটি বড়ো কৃপণ, হাত দিয়া কিছু গলে না।”
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া কহিলেন, “দেখো তো বউমা, বিহারী তোমারই নুন খাইয়া তোমারই নিন্দা করিতেছে।”
আশা বিহারীর পাতে একরাশ ঘণ্ট দিয়া গেল।
বিহারী কহিল, “হায়, হায়, ঘণ্ট দিয়াই আমার পেট ভরাইবে দেখিতেছি, আর ভালো ভালো জিনিস সমস্তই মহিনদার পাতে পড়িবে।
আশা ফিসফিস করিয়া বলিয়া গেল, “নিন্দুকের মুখ কিছুতেই বন্ধ হয় না।”
বিহারী মৃদুস্বরে কহিল, “মিষ্টান্ন দিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখো, বন্ধ হয় কি না।”
দুই বন্ধুর আহার হইয়া গেলে রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত তৃপ্তিবোধ করিলেন। কহিলেন, “বউমা, তুমি শীঘ্র খাইয়া এসো।”
রাজলক্ষ্মীর আদেশে আশা খাইতে গেলে তিনি মহেন্দ্রকে কহিলেন, “মহিন, তুই শুইতে যা।”
মহেন্দ্র কহিল, “এখনই শুইতে যাইব কেন।”
মহেন্দ্র রাত্রে মাতার সেবা করিবে স্থির করিয়াছিল। রাজলক্ষ্মী কোনোমতেই তাহা ঘটিতে দিলেন না। কহিলেন, “তুই শ্রান্ত আছিস মহিন, তুই শুইতে যা!”
আশা আহার শেষ করিয়া পাখা লইয়া রাজলক্ষীর শিয়রের কাছে আসিয়া বসিবার উপক্রম করিলে, তিনি চুপি চুপি তাহাকে কহিলেন, “বউমা, মহেন্দ্রের বিছানা ঠিক হইয়াছে কি না দেখো গে, সে একলা আছে।”
আশা লজ্জায় মরিয়া গিয়া কোনোমতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। কেবল বিহারী এবং অন্নপূর্ণা রহিলেন।
তখন রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বিহারী, তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। বিনোদিনীর কী হইল বলিতে পারিস? সে এখন কোথায়।”
বিহারী কহিল, “বিনোদিনী কলিকাতায় আছে।”
রাজলক্ষ্মী নীরব দৃষ্টিতে বিহারীকে প্রশ্ন করিলেন। বিহারী তাহা বুঝিল। কহিল, “বিনোদিনীর জন্য তুমি আর কিছুমাত্র ভয় করিও না মা।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “সে আমাকে অনেক দুঃখ দিয়াছে বিহারী, তবু তাহাকে আমি মনে মনে ভালোবাসি।”
বিহারী কহিল, “সেও তোমাকে মনে মনে ভালোবাসে মা।”
রাজলক্ষ্মী। আমারও তাই বোধ হয় বিহারী। দোষগুণ সকলেরই আছে, কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসিত। তেমন সেবা কেহ ছল করিয়া করিতে পারিত না।
বিহারী কহিল, “তোমার সেবা করিবার জন্য সে ব্যাকুল হইয়া আছে।”
রাজলক্ষ্মী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “মহিনরা তো এখন শুইতে গেছে, রাত্রে তাহাকে একবার আনিলে কি ক্ষতি আছে।”
বিহারী কহিল, “মা, সে তো এই বাড়িরই বাহির-ঘরে লুকাইয়া বসিয়া আছে। তাহাকে আজ সমস্ত দিন জলবিন্দু পর্যন্ত মুখে দেওয়াইতে পারি নাই। সে পণ করিয়াছে, যতক্ষণ তুমি তাহাকে ডাকিয়া না মাপ করিবে ততক্ষণ সে জলস্পর্শ করিবে না।”
রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “সমস্ত দিন উপবাস করিয়া আছে! আহা, তাহাকে ডাক্, ডাক্।”
বিনোদিনী ধীরে ধীরে রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিতেই তিনি বলিয়া উঠিলেন, “ছি ছি বউ, তুমি করিয়াছ কী। আজ সমস্ত দিন উপোস করিয়া আছ! যাও যাও, আগে খাইয়া লও, তাহার পরে কথা হইবে।”
বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, “আগে তুমি পাপিষ্ঠাকে মাপ করো পিসিমা, তবে আমি খাইব।”
রাজলক্ষ্মী। মাপ করিয়াছি বাছা, মাপ করিয়াছি, আমার এখন কাহারো উপর আর রাগ নাই।
বিনোদিনীর ডান হাত ধরিয়া তিনি কহিলেন, “বউ, তোমা হইতে কাহারো মন্দ না হউক, তুমিও ভালো থাকো।”
বিনোদিনী। তোমার আশীর্বাদ মিথ্যা হইবে না পিসিমা, আমি তোমার পা ছুঁইয়া বলিতেছি, আমা হইতে এ সংসারের মন্দ হইবে না।
অন্নপূর্ণাকে বিনোদিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া খাইতে গেল। খাইয়া আসিলে পর রাজলক্ষ্মী তাহার দিতে চাহিয়া কহিলেন, “বউ, এখন তুমি তবে চলিলে?
বিনোদিনী। পিসিমা, আমি তোমার সেবা করিব। ঈশ্বর সাক্ষী, আমা হইতে তুমি কোনো অনিষ্ট আশঙ্কা করিয়ো না।
রাজলক্ষ্মী বিহারীর মুখের দিকে চাহিলেন। বিহারী একটু চিন্তা করিয়া কহিল, “বোঠান থাকুন মা, তাহাতে ক্ষতি হইবে না।”
রাত্রে বিহারী বিনোদিনী এবং অন্নপূর্ণা তিনজনে মিলিয়া রাজলক্ষ্মীর শুশ্রূষা করিলেন।
এ দিকে আশা সমস্ত রাত্রি রাজলক্ষ্মীর ঘরে আসে নাই বলিয়া লজ্জায় অত্যন্ত প্রত্যুষে উঠিয়াছে। মহেন্দ্রকে বিছানায় সুপ্ত অবস্থায় রাখিয়া তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া প্রস্তুত হইয়া আসিল। তখন অন্ধকার একেবারে যায় নাই। রাজলক্ষ্মীর দ্বারের কাছে আসিয়া যাহা দেখিল তাহাতে আশা অবাক হইয়া গেল। ভাবিল, ‘একি স্বপ্ন।’
বিনোদিনী একটি স্পিরিট-ল্যাম্প্ জ্বালিয়া জল গরম করিতেছে। বিহারী রাত্রে ঘুমাইতে পায় নাই, তাহার জন্য চা তৈরি হইবে।
আশাকে দেখিয়া বিনোদিনী উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, “আমি আমার সমস্ত অপরাধ লইয়া তোমার আশ্রয় গ্রহণ করিলাম— আর কেহ আমাকে দূর করিতে পারিবে না— কিন্তু তুমি যদি বল ‘যাও’ তো আমাকে এখনই যাইতে হইবে।”
আশা কোনো উত্তর করিতে পারিল না— তাহার মন কী বলিতেছে ও সে যেন ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না, অভিভূত হইয়া রহিল।
বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কোনদিন তুমি মাপ করিতে পারিবে না সে চেষ্টাও করিয়ো না। কিন্তু আমাকে আর ভয় করিয়ো না। যে কয়দিন পিসিমার দরকার হইবে সেই কটা দিন আমাকে একটুখানি কাজ করিতে দাও, তার পরে আমি চলিয়া যাইব।”
কাল রাজলক্ষ্মী যখন আশার হাত লইয়া মহেন্দ্রের হাতে দিলেন, তখন আশা তাহার মন হইতে সমস্ত অভিমান মুছিয়া ফেলিয়া সম্পূর্ণভাবে মহেন্দ্রের কাছে আত্মসমর্পণ করিয়াছিল। আজ বিনোদিনীকে সম্মুখে দেখিয়া তাহার খণ্ডিত প্রেমের দাহ আর শান্তি মানিল না। ইহাকে মহেন্দ্র একদিন ভালোবাসিয়াছিল, ইহাকে এখনো হয়তো মনে মনে ভালোবাসে— এ কথা তাহার বুকের ভিতরে ঢেউয়ের মতো ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরেই মহেন্দ্র জাগিয়া উঠিবে, বিনোদিনীকে দেখিবে― কী জানি কী চক্ষে দেখিবে। কাল রাত্রে আশা তাহার সমস্ত সংসারকে নিষ্কণ্টক দেখিয়াছিল—আজ প্রত্যুষে উঠিয়াই দেখিল, কাঁটাগাছ তার ঘরের প্রাঙ্গণেই। সংসারে সুখের স্থানই সব চেয়ে সংকীর্ণ, কোথাও তাহাকে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে রাখিবার অবকাশ নাই।
হৃদয়ের ভার লইয়া আশা রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিল এবং অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে কহিল, “মাসিমা, তুমি সমস্ত রাত বসিয়া আছ― যাও, শুতে যাও।” অন্নপূর্ণা আশার মুখের দিকে একবার ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিলেন। তাহার পরে শুইতে না গিয়া আশাকে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন। কহিলেন, “চুনি, যদি সুখী হইতে চাস, তবে সব কথা মনে রাখিস নে। অন্যকে দোষী করিয়া যেটুকু সুখ, দোষ মনে রাখিবার দুঃখ তাহার চেয়ে ঢের বেশি।”
আশা কহিল, “মাসিমা, আমি মনে কিছু পুষিয়া রাখিতে চাই না, আমি ভুলিতেই চাই, কিন্তু ভুলিতে দেয় না যে।”
অন্নপূর্ণা। বাছা, তুই ঠিক বলিয়াছিল— উপদেশ দেওয়া সহজ, উপায় বলিয়া দেওয়াই শক্ত। তবু আমি তোকে একটা উপায় বলিয়া দিতেছি। যেন ভুলিয়াছিস এই ভাবটি অন্তত বাহিরে প্রাণপণে রক্ষা করিতে হইবে— আগে বাহিরে ভুলিতে আরম্ভ করিস, তাহা হইলে ভিতরেও ভুলিবি। এ কথা মনে রাখিস চুনি, তুই যদি না ভুলিস তবে অন্যকেও স্মরণ করাইয়া রাখিবি! তুই নিজের ইচ্ছায় না পারিস, আমি তোকে আজ্ঞা করিতেছি, তুই বিনোদিনীর সঙ্গে এমন ব্যবহার কর, যেন সে কখনো তোর কোনো অনিষ্ট করে নাই এবং তাহার দ্বারা তোর অনিষ্টের কোনো আশঙ্কা নাই।
আশা নম্রমুখে কহিল, “কী করিতে হইবে, বলো।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “বিনোদিনী এখন বিহারীর জন্যে চা তৈরি করিতেছে। তুই দুধ-চিনি-পেয়ালা সমস্ত লইয়া যা― দুইজনে মিলিয়া কাজ কর্।”
আশা আদেশপালনের জন্য উঠিল। অন্নপূর্ণা কহিলেন, “এটা সহজ― কিন্তু আমার আর-একটি কথা আছে, সেটা আরো শক্ত― সেইটে তোকে পালন করিতেই হইবে। মাঝে মাঝে মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর দেখা হইবেই, তখন তোর মনে কী হইবে তাহা আমি জানি― সে সময় তুই গোপন কটাক্ষেও মহেন্দ্রের ভাব কিংবা বিনোদিনীর ভাব দেখিবার চেষ্টামাত্রও করিস নে। বুক ফাটিয়া গেলেও, তোকে অবিচলিত থাকিতে হইবে। মহেন্দ্র ইহা জানিবে যে, তুই সন্দেহ করিস না, শোক করিস না, তোর মনে ভয় নাই, চিন্তা নাই― জোড় ভাঙিবার পূর্বে যেমন ছিল জোড় লাগিয়া আবার ঠিক তেমনি হইয়াছে— ভাঙনের দাগটুকুও মিলাইয়া গেছে। মহেন্দ্র কি আর-কেহ তোর মুখ দেখিয়া নিজেকে অপরাধী বলিয়া মনে করিবে না। চুনি, ইহা আমার অনুরোধ বা উপদেশ নহে, ইহা তোর মাসিমার আদেশ। আমি যখন কাশী চলিয়া যাইব, আমার এই কথাটি একদিনের জন্যও ভুলিস নে।”
আশা চায়ের পেয়ালা প্রভৃতি লইয়া বিনোদিনীর কাছে উপস্থিত হইল, কহিল, “জল কি গরম হইয়াছে? আমি চায়ের দুধ আনিয়াছি।”
বনোদিনী আশ্চর্য হইয়া আশার মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “বিহারীঠাকুরপো বারান্দায় বসিয়া আছেন, চা তুমি তাহার কাছে পাঠাইয়া দাও, আমি ততক্ষণ পিসিমার জন্য মুখ ধুইবার বন্দোবস্ত করিয়া রাখি। তিনি বোধ হয় এখনই উঠিকেন।”
বিনোদিনী চা লইয়া বিহারীর কাছে গেল না।— বিহারী ভালোবাসা স্বীকার করিয়া তাহাকে যে অধিকার দিয়াছে, সেই অধিকার স্বেচ্ছামতে খাটাইতে তাহার সংকোচ বোধ হইতে লাগিল। অধিকার লাভের যে মর্যাদা আছে সেই মর্যাদা রক্ষা করিতে হইলে অধিকার প্রয়োগকে সংযত করিতে হয়। যতটা পাওয়া যায় ততটা লইয়া টানাটানি করা কাঙালকেই শোভা পায়— ভোগকে খর্ব করিলেই সম্পদের যথার্থ গৌরব। এখন বিহারী তাহাকে নিজে না ডাকিলে, কোনো-একটা উপলক্ষ করিয়া বিনোদিনী তাহার কাছে আর যাইতে পারে না।
বলিতে-বলিতেই মহেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল। আশার বুকের ভিতরটা যদিও ধড়াস করিয়া উঠিল, তবু সে আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া স্বাভাবিক স্বরে মহেন্দ্রকে কহিল, “তুমি এত ভোরে উঠিলে যে? পাছে আলো লাগিয়া তোমার ঘুম ভাঙে, তাই আমি জানলা-দরজা সব বন্ধ করিয়া আসিয়াছি।”
বিনোদিনীর সম্মুখেই আশাকে এইরূপ সহজভাবে কথা কহিতে শুনিয়া মহেন্দ্রের বুকের একটা পাথর যেন নামিয়া গেল। সে আনন্দিতচিত্তে কহিল, “মা কেমন আছেন তাই দেখিতে আসিয়াছি— মা কি এখনো ঘুমাইতেছেন।”
আশা কহিল, “হাঁ, তিনি ঘুমাইতেছেন, এখন তুমি যাইয়ো না। বিহারীঠাকুরপো বলিয়াছেন, তিনি আজ অনেকটা ভালো আছেন। অনেক দিন পরে কাল তিনি সমস্ত রাত ভালো করিয়া ঘুমাইয়াছেন।”
মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কাকীমা কোথায়।”
আশা তাঁহার ঘর দেখাইয়া দিল।
আশার এই দৃঢ়তা ও সংযম দেখিয়া বিনোদিনীও আশ্চর্য হইয়া গেল।
মহেন্দ্র ডাকিল, “কাকীমা।”
অন্নপূর্ণা যদিও ভোরে স্নান করিয়া লইয়া এখন পূজায় বসিবেন স্থির করিয়াছিলেন, তবুও তিনি কহিলেন, “আয় মহিন, আয়।”
মহেন্দ্র তাঁহাকে প্রণাম করিয়া কহিল, “কাকীমা, আমি পাপিষ্ঠ, তোমাদের কাছে আসিতে আমার লজ্জা করে।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “ছি ছি, ও কথা বলিস্ নে মহিন— ছেলে ধুলা লইয়াও মার কোলে আসিয়া বসে।”
মহেন্দ্র। কিন্তু আমার এ ধুলা কিছুতেই মুছিবে না কাকীমা।
অন্নপূর্ণা। দুই-একবার ঝাড়িলেই ঝরিয়া যাইবে। মহিন, ভালোই হইয়াছে। নিজেকে ভালো বলিয়া তোর অহংকার ছিল, নিজের ’পরে বিশ্বাস তোর বড়ো বেশি ছিল, পাপের ঝড়ে তোর সেই গর্বটুকুই ভাঙিয়া দিয়াছে, আর কোনো অনিষ্ট করে নাই।
মহেন্দ্র। কাকীমা, এবার তোমাকে আর ছাড়িয়া দিব না, তুমি গিয়াই আমার এই দুর্গতি হইয়াছে।
অন্নপূর্ণা। আমি থাকিয়া যে দুর্গতি ঠেকাইয়া রাখিতাম সে দুর্গতি একবার ঘটিয়া যাওয়াই ভালো। এখন আর তোর আমাকে কোনো দরকার হইবে না।
দরজার কাছে আবার ডাক পড়িল, “কাকিমা, আহ্নিকে বসিয়াছ নাকি।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “না, তুই আয়।”
বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। এত সকালে মহেন্দ্রকে জাগ্রত দেখিয়া কহিল, “মহিনদা, আজ তোমার জীবনে এই বোধ হয় প্রথম সূর্যোদয় দেখিলে।”
মহেন্দ্র কহিল, “হাঁ বিহারী, আজ আমার জীবনে প্রথম সূর্যোদয়। বিহারীর বোধ হয় কাকীমার সঙ্গে কোনো পরামর্শ আছে— আমি যাই।”
বিহারী হাসিয়া কহিল, “তোমাকেও না-হয় ক্যাবিনেটের মিনিস্টার করিয়া লওয়া গেল। তোমার কাছে আমি তো কখনো কিছু গোপন করি নাই— যদি আপত্তি না কর, আজও গোপন করিব না।”
মহেন্দ্র। আমি আপত্তি করিব! তবে আর দাবি করিতে পারি না বটে। তুমি যদি আমার কাছে কিছু গোপন না কর, তবে আমিও আমার প্রতি আবার শ্রদ্ধা করিতে পারি।
আজকাল মহেন্দ্রের সম্মুখে সকল কথা অসংকোচে বলা কঠিন। বিহারীর মুখে বাধিয়া আসিল, তবু সে জোর করিয়া বলিল, “বিনোদিনীকে বিবাহ করিব এমন একটা কথা উঠিয়াছিল, কাকীমার সঙ্গে সেই সম্বন্ধে আমি কথাবার্তা শেষ করিতে আসিয়াছি।”
মহেন্দ্র একান্ত সংকুচিত হইয়া উঠিল। অন্নপূর্ণা চকিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এ আবার কী কথা বিহারী।”
মহেন্দ্র প্রবল শক্তি প্রয়োগ করিয়া সংকোচ দূর করিল। কহিল, “বিহারী, এ বিবাহের কোনো প্রয়োজন নাই।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “এ বিবাহের প্রস্তাবে কি বিনোদিনীর কোনো যোগ আছে।”
বিহারী কহিল, “কিছুমাত্র না।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি ইহাতে রাজি হইবে।”
মহেন্দ্র বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী কেন রাজি হইবে না কাকীমা। আমি জানি, সে একমনে বিহারীকে ভক্তি করে― এমন আশ্রয় সে কি ইচ্ছা করিয়া ছাড়িয়া দিতে পারে।”
বিহারী কহিল, “মহিনদা, আমি বিনোদিনীকে বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছি― সে লজ্জার সঙ্গে তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে।”
শুনিয়া মহেন্দ্র চুপ করিয়া রহিল।