ছড়ার ছবি/সুধিয়া
সুধিয়া
গয়লা ছিল শিউনন্দন, বিখ্যাত তার নাম,
গােয়ালবাড়ি ছিল যেন একটা গােটা গ্রাম।
গােরু-চরার প্রকাণ্ড ক্ষেত, নদীর ওপার চরে,
কলাই শুধু ছিটিয়ে দিত পলি-জমির ’পরে।
জেগে উঠত চারা তারই, গজিয়ে উঠত ঘাস,
ধেনুদলের ভােজ চলত মাসের পরে মাস।
মাঠটা জুড়ে বাঁধা হত বিশ-পঞ্চাশ চালা,
জমত রাখাল ছেলেগুলাের মহােৎসবের পালা।
গােপাষ্টমীর পর্বদিনে প্রচুর হত দান,
গুরুঠাকুর গা ডুবিয়ে দুধে করত স্নান।
তার থেকে সর ক্ষীর নবনী তৈরি হত কত,
প্রসাদ পেত গাঁয়ে গাঁয়ে গয়লা ছিল যত।
বছর তিনেক অনাবৃষ্টি, এল মন্বন্তর;
শ্রাবণ মাসে শােণনদীতে বান এল তার পর।
ঘুলিয়ে ঘুলিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে গর্জি ছুটল ধারা,
ধরণী চায় শূন্য-পানে সীমার চিহ্নহারা।
ভেসে চলল গােরু বাছুর, টান লাগল গাছে।
মানুষে আর সাপে মিলে শাখা আঁকড়ে আছে।
বন্যা যখন নেমে গেল, বৃষ্টি গেল থামি
আকাশ জুড়ে দৈত্য-দেবের ঘুচল সে পাগলামি।
শিউনন্দন দাঁড়ালো তার শূন্য ভিটেয় এসে-
তিনটে শিশুর ঠিকানা নেই, স্ত্রী গেছে তার ভেসে।
চুপ করে সে রইল বসে, বুদ্ধি পায় না খুঁজি
মনে হল সব কথা তার হারিয়ে গেল বুঝি।
ছেলেটা তার ভীষণ জোয়ান, সামরু বলে তাকে;
এক-গলা এই জলে-ডােবা সকল পাড়াটাকে
মথন করে ফিরে ফিরে তিনটে গােরু নিয়ে
ঘরে এসে দেখলে, দু হাত চোখে ঢাকা দিয়ে
ইষ্টদেবকে স্মরণ করে নড়ছে বাপের মুখ;
তাই দেখে ওর একেবারে জ্বলে উঠল বুক—
বলে উঠল, ‘দেব্তাকে তাের কেন মরিস ডাকি?
তার দয়াটা বাঁচিয়ে যেটুক আজও রইল বাকি
ভার নেব তার নিজের ’পরেই, ঘটুক-নাকো যাই আর,
এর বাড়া তাে সর্বনাশের সম্ভাবনা নাই আর।’
এই বলে সে বাড়ি ছেড়ে পাঁকের পথে ঘুরে
চিহ্ন-দেওয়া নিজের গােরু অনেক দূরে দূরে
গােটা পাঁচেক খোঁজ পেয়ে তার আনলে তাদের কেড়ে,
মাথা ভাঙবে ভয় দেখাতেই সবাই দিল ছেড়ে।
ব্যাবসাটা ফের শুরু করল নেহাত গরিব চালে,
আশা রইল উঠবে জেগে আবার কোনােকালে।
এ দিকেতে প্রকাণ্ড এক দেনার অজগরে
একে একে গ্রাস করছে যা আছে তার ঘরে।
একটু যদি এগােয় আবার পিছন দিকে ঠেলে,
দেনা পাওনা দিনরাত্রি জোয়ার-ভাঁটা খেলে।
মাল তদন্ত করতে এল দুনিয়াচাঁদ বেনে,
দশ বছরের ছেলেটাকে সঙ্গে করে এনে।
ছেলেটা ওর জেদ ধরেছে— ঐ সুধিয়া গাই
পুষবে ঘরে আপন ক’রে ঐটে নেহাত চাই।
সামরু বলে, ‘তােমার ঘরে কী ধন আছে কত
আমাদের এই সুধিয়াকে কিনে নেবার মতো?
ও যে আমার মানিক, আমার সাত রাজার ঐ ধন,
আর যা আমার যায় সবই যাক, দুঃখিত নয় মন।
মৃত্যুপারের থেকে ও যে ফিরেছে মাের কাছে,
এমন বন্ধু তিন ভুবনে আর কি আমার আছে!’
বাপের কানে কী বললে সেইচাঁদের দুনি ছেলে,
জেদ বেড়ে তার গেল বুঝি যেমনি বাধা পেলে।
শেঠজি বলে মাথা নেড়ে, ‘দুই-চারি মাস যেতেই
ঐ সুধিয়ার গতি হবে আমার গােয়ালেতেই।’
কালােয় সাদায় মিশােল বরন, চিকন নধর দেহ,
সর্ব অঙ্গে ব্যাপ্ত যেন রাশীকৃত স্নেহ।
আকাল এখন, সামরু নিজে দুইবেলা আধ-পেটা;
সুধিয়াকে খাওয়ানাে চাই যখনি পায় যেটা।
দনের কাজের অবসানে গােয়ালঘরে ঢুকে
ব’কে যায় সে গাভীর কানে যা আসে তার মুখে।
কারাে ’পরে রাগ সে জানায়, কখনাে সাবধানে
গােপন খবর থাকলে কিছু জানায় কানে কানে।
সুধিয়া সব দাঁড়িয়ে শােনে কানটা খাড়া ক’রে,
বুঝি কেবল ধ্বনির সুখে মন ওঠে তার ভরে।
সামরু যখন ছােটো ছিল পালােয়ানের পেশা
ইচ্ছা করেছিল নিতে, ঐ ছিল তার নেশা।
খবর পেল, নবাববাড়ি কুস্তিগিরের দল
পাল্লা দেবে— সামরু শুনে অসহ্য চঞ্চল।
বাপকে ব’লে গেল ছেলে, ‘কথা দিচ্ছি শােনো,
এক হপ্তার বেশি দেরি হবে না কখ্খােনো!’
ফিরে এসে দেখতে পেলে, সুধিয়া তার গাই
শেঠ নিয়েছে ছলে-বলে, গােয়ালঘরে নাই।
যেমনি শােনা অমনি ছুটল, ভোজালি তার হাতে,
দুনিচাঁদের গদি যেথায় নাজির-মহল্লাতে।
‘কী রে সামরু, ব্যাপারটা কী’ শেঠজি শুধায় তাকে।
সামরু বলে ‘ফিরিয়ে নিতে এলুম সুধিয়াকে।’
শেঠ বললে, ‘পাগল নাকি, ফিরিয়ে দেব তােরে,
পরশু ওকে নিয়ে এলুম ডিক্রিজারি করে।
‘সুধিয়া রে' ‘সুধিয়া রে’ সামরু দিল হাঁক,
পাড়ার আকাশ পেরিয়ে গেল বজ্রমন্দ্র ডাক।
চেনা সুরের হাম্বা ধ্বনি কোথায় জেগে উঠে,
দড়ি ছিঁড়ে সুধিয়া ঐ হঠাৎ এল ছুটে।
দু চোখ বেয়ে ঝরছে বারি, অঙ্গটি তার রােগা,
অন্নপানে দেয় নি সে মুখ, অনশনে-ভােগা।
সামরু ধরল জড়িয়ে গলা, বললে, ‘নাই রে ভয়,
আমি থাকতে দেখব এখন কে তােরে আর লয়।—
তােমার টাকায় দুনিয়া কেনা, শেঠ দুনিচাঁদ, তবু
এই সুধিয়া একলা নিজের, আর কারাে নয় কভু।
আপন ইচ্ছামতে যদি তােমার ঘরে থাকে
তবে আমি এই মুহূর্তে রেখে যাব তাকে।’
চোখ পাকিয়ে কয় দুনিচাঁদ, ‘পশুর আবার ইচ্ছে!
গয়লা তুমি, তােমার কাছে কে উপদেশ নিচ্ছে!
গােল কর তাে ডাকব পুলিস।’ সামরু বললে, ‘ডেকো।
ফাঁসি আমি ভয় করি নে, এইটে মনে রেখাে।
দশ বছরের জেল খাটব, ফিরব তো তার পর,
সেই কথাটাই ভেবে বসে, আমি চললেম ঘর।’
আষাঢ় ১৩৪৪
শান্তিনিকেতন