ছড়ার ছবি/মাধো
মাধো
রায়বাহাদুর কিষনলালের স্যাকরা জগন্নাথ,
সােনারুপাের সকল কাজে নিপুণ তাহার হাত।
আপন বিদ্যা শিখিয়ে মানুষ করবে ছেলেটাকে
এই আশাতে সময় পেলেই ধরে আনত তাকে;
বসিয়ে রাখত চোখের সামনে, জোগান দেবার কাজে
লাগিয়ে দিত যখন তখন; আবার মাঝে মাঝে
ছােটো মেয়ের পুতুল-খেলার গয়না গড়াবার
ফর্মাশেতে খাটিয়ে নিত; আগুন ধরাবার
সােনা গলাবার কর্মে একটুখানি ভুলে
চড়-চাপড়টা পড়ত পিঠে, টান লাগাত চুলে।
সুযােগ পেলেই পালিয়ে বেড়ায় মাধ্যে যে কোন্খানে
ঘরের লােকে খুঁজে ফেরে বৃথাই সন্ধানে।
শহরতলির বাইরে আছে দিঘি সাবেক-কেলে
সেইখানে সে জোটায় যত লক্ষ্মীছাড়া ছেলে।
গুলিডাণ্ডা খেলা ছিল, দোলনা ছিল গাছে,
জানা ছিল যেথায় যত ফলের বাগান আছে।
মাছ ধরবার ছিপ বানাত, সিমুডালের ছড়ি;
টাট্টুঘােড়ার পিঠে চড়ে ছােটাত দড়্ বড়ি।
কুকুরটা তার সঙ্গে থাকত, নাম ছিল তার বটু—
গিরগিটি আর কাঠবেড়ালি তাড়িয়ে ফেরায় পটু।
শালিখ পাখির মহলেতে মাধাের ছিল যশ,
ছাতুর গুলি ছড়িয়ে দিয়ে করত তাদের বশ।
বেগার দেওয়ার কাজে পাড়ায় ছিল না তার মতো,
বাপের শিক্ষানবিশিতেই কুঁড়েমি তার যত।
কিষনলালের ছেলে, তারে দুলাল ব’লে ডাকে—
পাড়াসুদ্ধ ভয় করে এই বাঁদর ছেলেটাকে।
বড়োলােকের ছেলে ব’লে গুমর ছিল মনে,
অত্যাচারে তারই প্রমাণ দিত সকল খনে।
বটুর হবে সাঁতারখেলা, বটু চলছে ঘাটে,
এসেছে যেই দুলালচাঁদের গােলা খেলার মাঠে
অকারণে চাবুক নিয়ে দুলাল এল তেড়ে;
মাধাে বললে, ‘মারলে কুকুর ফেলব তােমায় পেড়ে।’
উঁচিয়ে চাবুক দুলাল এল, মানল নাকো মানা,
চাবুক কেড়ে নিয়ে মাধো করলে দু-তিন-খানা।
দাঁড়িয়ে রইল মাধো, রাগে কাঁপছে থরােথরাে—
বললে, ‘দেখব সাধ্য তােমার, কী করবে তা করাে।’
দুলাল ছিল বিষম ভীতু, বেগ শুধু তার পায়ে—
নামের জোরেই জোর ছিল তার, জোর ছিল না গায়ে।
দশ-বিশ-জন লােক লাগিয়ে বাপ আনলে ধরে,
মাথােকে এক খাটের খুরােয় বাঁধল কষে জোরে।
বললে, ‘জানিস নেকো, বেটা, কাহার অন্ন ধারিস!
এত বড়াে বুকের পাটা, মনিবকে তুই মারিস!
আজ বিকালে হাটের মধ্যে হিঁচড়ে নিয়ে তােকে
দুলাল স্বয়ং মারবে চাবুক, দেখবে সকল লােকে।’
মনিববাড়ির পেয়াদা এল দিন হল যেই শেষ।
দেখলে দড়ি আছে পড়ি, মাধো নিরুদ্দেশ।
মাকে শুধায়, ‘এ কী কাণ্ড।’ মা শুনে কয়, ‘নিজে
আপন হাতে বাঁধন তাহার আমিই খুলেছি যে।
মাধাে চাইল চলে যেতে; আমি বললেম, যেয়াে,
এমন অপমানের চেয়ে মরণ ভালাে সেও।’
স্বামীর ’পরে হানল দৃষ্টি দারুণ অবজ্ঞার;
বললে, “তােমার গােলামিতে ধিক্ সহস্রবার।”
পেরােলাে বিশ-পঁচিশ বছর; বাংলাদেশে গিয়ে
আপন জাতের মেয়ে বেছে মাথাে করল বিয়ে।
ছেলে মেয়ে চলল বেড়ে, হল সে সংসারী;
কোন্খানে এক পাটকলে সে করতেছে সর্দারি।
এমন সময় নরম যখন হল পাটের বাজার
মাইনে ওদের কমিয়ে দিতেই, মজুর হাজার হাজার
ধর্মঘটে বাঁধল কোমর; সাহেব দিল ডাক—
বললে, ‘মাধাে, ভয় নেই তাের, আলগােছে তুই থাক্।
দলের সঙ্গে যােগ দিলে শেষ মরবি-যে মার খেয়ে।’
মাধাে বললে, ‘মরাই ভালাে এ বেইমানির চেয়ে।’
শেষ পালাতে পুলিস নামল, চলল গুঁতােগাঁতা;
কারাে পড়ল হাতে বেড়ি, কারাে ভাঙল মাথা।
মাথাে বললে, ‘সাহেব, আমি বিদায় নিলেম কাজে,
অপমানের অন্ন আমার সহ্য হবে না যে।’
চলল সেথায় যে দেশ থেকে দেশ গেছে তার মুছে—
মা মরেছে, বাপ মরেছে, বাঁধন গেছে ঘুচে।
পথে বাহির হল ওরা ভরসা বুকে আঁটি—
ছেঁড়া শিকড় পাবে কি আর পুরােনাে তার মাটি।
শ্রাবণ ১৩৪৪