ছবি/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 যখন ডাক্তারের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি নয়টা বাজিয়া গিয়াছিল। ডাক্তারের বাড়ী ফিরিতে যে এত বিলম্ব হইবে, তাহা তিনি নিজেই জানিতেন না। তাঁহার স্ত্রীকে সেইজন্য কোন কথা বলিয়া যাইতে পারেন নাই।

 বাড়ীতে উপস্থিত হইয়াই ডাক্তার আমাকে বৈঠকখানায় বসিতে বলিয়া অন্দরে গমন করিলেন। প্রায় এক কোয়াটারের মধ্যেই তিনি হাস্যমুখে ফিরিয়া আসিলেন।

 আমি দ্বার রুদ্ধ করিয়া ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি ডাক্তার, শাস্তি কি গুরুতর হইয়াছে?”

 ডাক্তার বলিলেন, “কিসের শাস্তি?”

 আ। কেন, বাড়ী আসিতে বিলম্ব হওয়ায়।

 ডা। শাস্তি দিবে কে?

 আ। তোমার মনিব।

 ডা। আমার মনিবের মেজাজ তোমার অজ্ঞাত নাই। সে তেমন নয়।

 আ। তা জানি, তবু বেচারাকে এত রাত্রি পর্য্যন্ত একা রেখে আমার সঙ্গে তোমার ঘোরা উচিত হয় নাই।

 ডা। সে এখন আর একা নয়। আমি লোক রাখিয়া গিয়াছি।

 আ। কে সে? তোমার নবজাত পুত্ত্র?

 ডা। নিশ্চয়ই, আত্মবৈ জায়তে পুত্ত্রঃ। এখন সে কথা যাক, আগে কিছু জলযোগ করিয়া লও, তাহার পর সমস্ত ব্যাপার আমার কাছে প্রকাশ কর। ছবিখানি পাইয়াছ ত?

 আ। পাই নাই বটে, কিন্তু দেখিয়া আসিয়াছি? সেই অভিনেত্রী ছবিখানি যেখানে লুকাইয়া রাখিয়াছিল, তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি।

 ডা। তবে সঙ্গে করিয়া আনিলে না কেন?

 আ। কোন কাজ তাড়াতাড়ি করা ভাল নয়। যদি তখনই গ্রহণ করিতাম, তা হইলে নিশ্চয়ই কার্য্যোদ্ধার করিতে পারিতাম না। যখন গোপনীয় স্থান দেখিয়া আসিয়াছি, তখন আর যায় কোথা?

 ডা। অভিনেত্রী সেখান হইতে সরাইয়া আর কোথাও রাখিতে পারে।

 আ। যদি সে আমার উপর সন্দেহ করিত, তাহা হইলে সেইরূপই করিত। কিন্তু তাহার কথায় বোধ হইল যে, সে আমাকে কোনরূপ অবিশ্বাস করে নাই।

 ডা। কবে আনিতে যাইবে?

 আ। আজই।

 ডা। কখন?

 আ। রাত্রি তিন প্রহরের পর।

 ডা। একাই যাইবে?

 আ। ইচ্ছা সেইরূপ। তবে যদি জমীদার পুত্র আমার সহিত যাইতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে তাঁহাকেও লইয়া যাইব।

 ডা। অত লোক কোথা হইতে আসিল?

 আ। পয়সা দিলে কিসের অভাব হয়?

 ডা। তবে কি ঝগ্‌ড়া মারামারি সমস্তই মিথ্যা?

 আ। তা নয় ত কি? তুমি কি মনে কর, আমি সত্য সত্যই আহত হইয়াছিলাম?

 ডা। আমিত সেই রকমই ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু যদি উহা মিথ্যাই হয়, তবে তোমার মুখ হইতে অত রক্ত বাহির হইল কিসে?

 আ। উহা রক্ত নহে-আল্‌তা। মুখে চিবাইলেই রক্তের মত দেখায়।

 ডা। তোমার অসাধ্য কিছুই নাই। এখন সেই অভিনেত্রী তোমায় বাড়ী লইয়া গিয়া কি করিল বল? আমি ত বাড়ীর ভিতর যাই নাই, সুতরাং সে সকল বিষয় আমার কিছুই জানা নাই।

 আ। যেমন অনুমান করিয়াছিলাম, অভিনেত্রী আমায় তাহার বৈঠকখানায় লইয়া গেল। সকলে প্রস্থান করিলে আমি দেখিলাম, ঘরের জানালাগুলি সমস্ত বদ্ধ। সুতরাং তুমি আমার সঙ্কেত দেখিতে পাইবে না বুঝিতে পারিয়া, এরূপভাবে হাত বাড়াইয়া দিলাম, যাহাতে অভিনেত্রী বুঝিল, আমার বড় গরম বোধ হইতেছে। সে সমস্ত জানালা খুলিয়া দিল। আমিও তোমায় দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম, তুমিও আমার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিয়াছ। এইরূপে যখন দেখিলাম সমস্ত ঠিক হইয়াছে, তখন তোমায় ইঙ্গিত করিলাম। মুহূর্ত্ত মধ্যে সামান্য় মাত্র শব্দ করিয়া ঘরখানি ধূমে পরিপূর্ণ হইল। চারিদিকে আগুন লাগিয়াছে, বলিয়া চীৎকারধ্বনি হইতে লাগিল। অভিনেত্রী ভয়ে যেখানে ছবিখানি লুকাইয়া রাখিয়াছিল, তথায় গমন করিল এরং আমার কথা ভুলিয়া গিয়াই হউক কিম্বা আমাকে অজ্ঞান মনে করিয়াই হউক, ছবিখানি বাহির করিতে লাগিল। আমি দেখিলাম, শীকার হাতছাড়া হয়। কারণ অভিনেত্রী বদি ছবিখানি তথা হইতে গ্রহণ করিত, তাহা হইলে সে যে উহাকে আর কোথাও লুকাইয়া রাখিবে, তাহা বুঝিতে পারিলাম। অগত্যা ঠিক সেই সময়ে সাড়া দিলাম। অভিনেত্রী আমায় সচেতন দেখিয়া চমকিত হইল এবং ছবিখানি যথাস্থানে রাখিয়া আমার নিকট দৌড়িয়া আসিল। আমি তখন উঠিয়া বসিয়াছিলাম। অভিনেত্রীর অন্তরে যাহাই থাকুক, আমায় সুস্থ দেখিয়া মৌখিক আনন্দ প্রকাশ করিল। আমি তখন তাহাকে গোলযোগের কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। সে আমাকে ঘরে আগুন লাগিবার কথা বলিলে আমি হাস্য করিয়া তাহার ভুল দেখাইয়া দিলাম। বলিলাম, ঘরে আগুন লাগে নাই। কোন শত্রু বাহির হইতে কোনরূপ আতস বাজী নিক্ষেপ করিয়াছে, তাহাতেই গৃহমধ্যে এত ধূম হইয়াছে। অভিনেত্রী বোধ হয় আমার কথা ধিশ্বাস করিল না। সে একবার আমার দিকে তীব্র দৃষ্টি করিয়া আমার নিকট হইতে বেগে প্রস্থান করিল। আমি সেই সময় ছবিখানি গ্রহণ করিতে পারিতাম, কিন্তু একটা সহিস সে সময় আমার নিকটে ছিল বলিয়া সে কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে সাহস করিলাম না। ধীরে ধীরে গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম এবং জনতার মধ্যে প্রবেশ করিয়া অদৃশ্য হইলাম। তাহার পর তোমার সহিত গোলদীঘিতে সাক্ষাৎ করিলাম। ক্রমে রাত্রি অধিক হইতেছে। এখন আমায় বিদায় দাও। তোমার চাকরকে একখানি গাড়ী ডাকিয়া আনিতে বল।

 ডাক্তার সহাস্যবদনে উত্তর করিলেন, “তিনি বলিতেছিলেন, যে প্রিয়বাবু যখন আমাদের বাড়ীতে আসিয়াছেন, তখন আহার না করিয়া তিনি যেন না যান।”

 আমিও হাসিয়া বলিলাম, “তোমার স্ত্রীর হাতের রন্ধন আমারও খাইবার ইচ্ছা হইয়াছে। অনেক দিন ও কাজ হয় নাই। কি করিব, আজ আমায় মাপ কর। কাল তাঁহার অতিথি হইব। তিনি যে আমায় এখনও মনে রাখিয়াছেন, সেই আমার পরম সৌভাগ্য।”

 ডাক্তার আমর কথায় কিছু বিমর্ষ হইলেন। তিনি ভৃত্যকে আমার জন্য একখানা গাড়ী আনিতে বলিলেন।