ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 যখন আমি বাসার দ্বারে উপনীত হইলাম, তথন ঘড়ীতে দশটা বাজিল। গাড়োয়ানকে ভাড়া দিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইব, এমন সময়ে কে যেন আমার পশ্চাতে আসিয়া বলিল, “মহাশয়! আচ্ছা খেলা খেলেছেন। কিন্ত আমায় ঠকাইতে পারিলেন না। ইচ্ছা করিলে যাহার জন্য় আপনি এত চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা লইয়াই পলায়ন করিতে পারিতাম।”

 কণ্ঠস্বর ও কথাগুলি শুনিয়া আমি চমকিত হইলাম। ফিরিয়া দেখি একখানি গাড়ী আমার পার্শ্ব দিয়া বেগে চলিয়া গেল। আমি আর বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম না। যে গাড়ী করিয়া বাড়ী আসিয়াছিলাম, সেই গাড়ীর কোচমান তখনও যায় নাই। আমি তাহাকে অগ্রগামী গাড়ীখানি দেখাইয়া বলিলাম, “ঐ গাড়ীখানি ধরিতে পারিলে তোমায় পাঁচ-টাকা পুরস্কার দিব।”

 পুরস্কার লোভে সে অতি বেগে অশ্ব চালন করিল এবং অতি অল্পকাল মধ্যেই গাড়ীখানির নিকটবর্ত্তী হইল। আমি গাড়ীর ভিতর হইতে অতি গম্ভীর ভাবে চীৎকার করিয়া বলিলাম, “গাড়ী থামাও।”

 আমার কথায় দুইখানি গাড়ীই স্থির হইল। আমি অভিনেত্রীকে দেখিতে পাইলাম। বলিলাম, “সুন্দরি! তোমায় বাধা দিয়া অন্যায় করিয়াছি। কিন্তু কি করিব, তোমায় আমার বিশেষ গ্রয়োজন।”

 অভিনেত্রী হাস্য় করিল; বলিল, “যাহার জন্য় আপনি এত ব্যস্ত হইয়াছেন, তাহা রাখিয়া আসিয়াছি। ইচ্ছা করিলে লইয়া যাইতে পারিতাম, কিন্তু আপনার ন্যায় বিখ্যাত গোয়েন্দাকে পরাজিত করিবার ইচ্ছা নাই।”

 আ। আজ তুমি যে কার্য্য করিলে, এরূপ আর কখনও কোন লোকে করিতে পারে নাই। আমাকে পরাস্ত করে এমন লোক এপর্য্যন্ত দেখি নাই। আমার বড় অহঙ্কার ছিল যে, আমায় কেহ পরাজিত করিতে পারিবে না। কিন্তু আজ আমার সে অহঙ্কার দুর হইল। যদি কখন আমার মনে আবার অহঙ্কার উদয় হয়, তোমার নাম স্মরণ করিব, তাহা হইলে আমি নিজের গুণ বুঝিতে পারিব। কিন্তু আমায় চিনিলে কিরূপে?

 অ। আমি ছবিখানি লইতে উদ্যত হইলে আপনি যখন সাড়া দিলেন, তখন আমার মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহ হইল। আমার বোধ হইল, আপনি সেই ছবির জন্যই সেখানে গিয়াছেন। আপনার সাড়া পাইয়া আমিও আপনার নিকট যাইলাম। তখন আমি ভাল করিয়া আপনার মুখ নিরীক্ষণ করিলাম। দেখিলাম, আপনার মুখে বাস্তবিক রক্তের চিহ্ন নাই। লাল দাগগুলি আল্‌তা বা অন্য কোন পদার্থ সংযোগে হইয়াছে। তখন আর আপনার নিকট থাকিবার প্রয়োজন বুঝিলাম না এবং আপনাকে কোন কথা না বলিয়া তখনই পলায়নের বন্দোবস্ত করিলাম।

 আ। তোমার ন্যায় চতুরা রমণী আমি এ জীবনে আর কখনও দেখি নাই। কিন্ত তুমি একা কোথায় যাইতেছ?

 অ। আমি এখন একা নয়। আমার স্বামীও আমার সহিত যাইতেছেন।

 আ। তোমার স্বামী! তুমি ত একজন অভিনেত্রী?

 অ। হাঁ আমার স্বামী। তিনি আমায় ব্রাহ্মমতে বিবাহ করিয়াছেন।

আ। তিনি কোথায়?

 অ। এতক্ষণ বোধ হয় হাওড়া স্টেশনে।

 আ। কোথায় যাইবে?

 অ। তাঁহার দেশে।

 আ। আপাততঃ কোথায় নামিবে?

 অ। বৈদ্যনাথে।

 আ। সেই ছবিখানির কি করিলে?

 অ। সেইখানেই আছে। আপনি যাইলেই পাইবেন।

 আ। বাড়ীখানির কি বন্দোবস্ত করিলে?

 অ। বাড়ী ভাড়া হইয়া গিয়াছে।

 আ। এত শীঘ্র অত বড় বাড়ী কে ভাড়া লইলেন?

 অ। বাড়ী পূর্ব্বেই ভাড়া হইয়াছিল। সে যাহা হউক, এবার হইতে যখন কোন স্ত্রীলোকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিবেন, তখন কিছু সাবধান হইয়া করিবেন। পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোকের বুদ্ধি অনেক বিষয়ে ভাল।

 আ। তোমার কথায় সম্মত হইলাম। কিন্তু যদি ছবিখানি দিতেই তোমার ইচ্ছা, তবে তুমি পলায়ন করিতেছে কেন?

 অ। আজ না হয় আপনাকে পরাস্ত করিয়াছি, কিন্ত এমন দিন আসিতে পারে, যখন আমি স্বয়ং পরাজিত হইব। আপনার নামে দুর্দ্দান্ত দস্যুগণ পর্য্যন্ত যখন ভয়ে শশঙ্কিত, তখন আমি কোন্‌ সাহসে কলিকাতার বিখ্যাত গোয়েন্দার বিপক্ষে কার্য্য করিব। জানার সে সাহস নাই বলিয়াই এখান হইতে পলায়ন করিতেছি। আর এক কথা, এখন আমি আমার স্বামীর বশীভূতা। তিনি আমায় যেমন বলিবেন, আমি নির্ব্বিবাদে তাহাই করিব। আর নয় মহাশয়! রাত্রি অধিক হইল; সাড়ে এগারটার ট্রেনে আমরা যাইব মনে করিয়াছি; ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।