তীরন,
মার্চ, ১৮৯৩।

 এই মেঘবৃষ্টি পাকা কোঠার মধ্যে অতি ভাল কিন্তু ছোট্ট বোট্‌টির মধ্যে দুটি রুদ্ধ প্রাণীর পক্ষে মনোরম নয়। একেত উঠ্‌তে বস্‌তে মাথা ঠেকে, তার উপরে আবার যদি মাথায় জল পড়তে থাকে, তাহলে বেদনার কিঞ্চিৎ উপশম হতেও পারে কিন্তু আমার “দুর্দ্দশার পেয়ালা” একেবারে পূর্ণ হয়ে ওঠে। মনেকরেছিলুম বৃষ্টি বাদলা একরকম ফুরোলো, এখন স্নাত পৃথিবীসুন্দরী কিছুদিন রৌদ্রে পিঠ দিয়ে আপনার ভিজে এলোচুল শুকোবে, আপনার সিক্ত সবুজ সাড়িখানি রৌদ্রে গাছের ডালে টাঙিয়ে দেবে, মাঠের মধ্যে মেলে দেবে,—বসন্তী আঁচলখানি শুকিয়ে ফুরফুরে হয়ে বাতাসে উড়তে থাক্‌বে। কিন্তু রকমটা এখনও সে ভাবের নয়—বাদ্‌লার পর বাদ্‌লা, এর আর বিরাম নেই। আমিত দেখেশুনে এই ফাল্গুন মাসের শেষভাগে কটকের এক ব্যক্তির একখানি মেঘদূত ধার করে নিয়ে এসেছি। আমাদের পাণ্ডুয়ার কুঠির সম্মুখবর্ত্তী অবারিত শস্যক্ষেত্রের উপরে আকাশ যেদিন আর্দ্রস্নিগ্ধ সুনীলবর্ণ হয়ে উঠ্‌বে সেদিন বারান্দায় বসে আবৃত্তি করা যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার কিছুই মুখস্থ হয় না—কবিতা ঠিক উপযুক্ত সময়ে মুখস্থ আবৃত্তি করে যাওয়া একটা পরম সুখ, সেটা আমার অদৃষ্টে নেই। যখন আবশ্যক হয় তখন বই হাংড়ে সন্ধান করে পড়তে গিয়ে আবশ্যক ফুরিয়ে যায়। মনে কর, মনে ব্যথা লেগে ভারি কাঁদ্‌তে ইচ্ছে হয়েচে তখন যদি দরোয়ান পাঠিয়ে বাথ্‌গেটের বাড়ি থেকে শিশি করে চোখের জল আনতে হত, তাহলে কি মুস্কিলই হত। এই জন্যে মফস্বলে যখন যাই তখন অনেকগুলো বই সঙ্গে নিতে হয়, তার সবগুলোই যে প্রতিবার পড়ি তা নয়, কিন্তু কখন্ কোন্‌টা দরকার বোধ হবে আগে থাক্‌তে জানবার যো নেই তাই সমস্ত সরঞ্জাম হাতে রাখ্‌তে হয়। মানুষের মনের যদি নির্দ্দিষ্ট ঋতুভেদ থাক্‌ত তাহলে অনেক সুবিধে হত। যেমন শীতের সময় কেবল শীতের কাপড় নিয়ে যাই এবং গরমের সময় বালাপোষ নেবার কোন দরকার থাকে না, তেমনি যদি জানতুম মনে কখন্‌ শীত কখন্ বসন্ত আস্‌বে তাহলে আগে থাকতে সেইরকম গদ্য কিম্বা পদ্যের যোগাড় করা যেতে পারত। কিন্তু মনের ঋতু আবার ছ-টা নয় একেবারে বাহান্নটা,—এক প্যাকেট্ তাসের মত— কখন্ কোন্‌টা হাতে আসে তার কিছু ঠিক নেই—অন্তরে বসে বসে কোন্ খামখেয়ালী খেলোয়াড় যে এই তাস ডীল্ করে’ এই খামখেয়ালী খেলা খেলে তার পরিচয় জানিনে। সেইজন্য মানুষের আয়োজনের শেষ নেই—তাকে যে কত রকমের কত কি হাতে রাখতে হয় তার ঠিক্ নেই। সেই জন্যে আমার সঙ্গে “নেপালীজ্‌ বুদ্ধিষ্টিক্ লিটারেচর” থেকে আরম্ভ করে শেক্সপীয়র পর্য্যন্ত কত রকমেরই যে বই আছে তার আর ঠিকানা নেই। এর মধ্যে অধিকাংশ বইই ছোঁবনা কিন্তু কখন কি আবশ্যক হবে বলা যায় না। অন্যবার বরাবর আমার বৈষ্ণব কবি এবং সংস্কৃত বই আনি, এবার আনিনি সেই জন্যে ঐ দুটোরই প্রয়োজন বেশী অনুভব হচ্চে। যখন পুরী খণ্ডগিরি প্রভৃতি ভ্রমণ করছিলুম তখন যদি মেঘদূতটা হাতে থাকত ভারি সুখী হতুম। কিন্তু মেঘদূত ছিলনা তার বদলে Caird’s Philosophical Essays ছিল।