ছিন্নপত্র (১৯১২)/৮২
শিলাইদহ,
১১ই মে, ১৮৯৩।
কাল বিকেলের দিকে খুব ঘনঘটা করে মেঘ করে খানিকটা বৃষ্টি হয়ে আবার পরিষ্কার হয়ে গেছে। আজ খানকতক দলভ্রষ্ট বিচ্ছিন্ন মেঘ সূর্য্যালোকে শুভ হয়ে খুব নিরীহ নিরপরাধভাবে আকাশের ধারে ধারে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখেত মনে হয় এদের বর্ষণের অভিপ্রায় কিছুমাত্র নেই। কিন্তু চাণক্য তাঁর সুবিখ্যাত শ্লোকে যাদের যাদের বিশ্বাস করতে নিষেধ করেচেন তার মধ্যে দেবতাকেও ধরা উচিত ছিল। আজ সকালবেলাটি বড় সুন্দর হয়ে উঠেছে—আকাশ পরিষ্কার নীল, নদীর জলে রেখামাত্র নেই এবং ভাঙার কাছে গড়ানে জায়গায় যে ঘাসগুলি হয়েচে তাতে পূর্ব্বদিনকার বৃষ্টির কণাগুলি লেগে সেগুলি ঝক্ঝক্ করচে। এই সমস্ত মিলে সূর্য্যালোকে আজকের প্রকৃতিকে ভারি একটি শুভ্রবসনা মহিমময়ী মহেশ্বরীর মত দেখাচ্চে। সকালবেলাটি এমনি নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। কেন জানিনে নদীতে একটি নৌকো নেই, বোটের নিকটবর্ত্তী ঘাটে কেউ জল নিতে কেউ স্নান করতে আসেনি, নায়েব সকাল সকাল কাজ সেরে চলে গেছে। খানিকটা চুপ করে কানপেতে থাক্লে কি একটা ঝাঁ ঝাঁ শব্দ শোনা যায় এবং এই রৌদ্রালোক আর আকাশ আস্তে আস্তে প্রবেশ করে মাথার ভিতরটি একেবারে ভরে ওঠে এবং সেখানকার সমুদয় ভাব ও চিন্তাগুলিকে একটি নীল সোনালী রঙে রঙিয়ে দেয়। বোটের একপাশে একটা বাঁকা কৌচ আনিয়ে রেখেছি, এইরকম সকালবেলায় তার মধ্যে শরীরটা ছড়িয়ে দিয়ে সমস্ত কাজ ফেলে চুপচাপ করে পড়ে থাক্তে ইচ্ছে করে, মনে হয়
—“নাই মোর পূর্ব্বাপর,
যেন আমি একদিনে উঠেছি ফুটিয়া
অরণ্যের পিতৃমাতৃহীন ফুল!”—
যেন আমি এই আকাশের, এই নদীর, এই পুরাতন শ্যামল পৃথিবীর। বোটে আমার এইরকম করে কাটে। পড়ে’ পড়ে’ পরিচিত প্রকৃতির কত রকমের যে ভাবের পরিবর্ত্তন দেখি তার ঠিক নেই। এখানে আমার আরএকটি সুখ আছে। একএকসময় একএকটি সরল ভক্ত বৃদ্ধ প্রজা আসে, তাদের ভক্তি এমনি অকৃত্রিম! বাস্তবিক এর সুন্দর সরলতা এবং আন্তরিক ভক্তিতে এ লোকটি আমার চেয়ে কত বড়! আমিই যেন এ ভক্তির অযোগ্য কিন্তু এ ভক্তিটিত বড় সামান্য জিনিষ নয়। ছোট ছেলেদের উপর যেরকম ভালবাসা এই বৃদ্ধ ছেলেদের উপর অনেকটা সেইরকম—কিন্তু কিছু প্রভেদ আছে। এরা তাদের চেয়েও ছোট। কেননা তারা বড় হবে এরা আর কোন কালেও বড় হবেনা—এদের এই জীর্ণ শীর্ণ কুঞ্চিত বলিত বৃদ্ধদেহখানির মধ্যে কি একটি শুভ্র সরল কোমল মন রয়েচে! শিশুদের মনে কেবল সরলতা আছে মাত্র কিন্তু এমন স্থির বিশ্বাসপূর্ণ একাগ্রনিষ্ঠা নেই। মানুষে মানুষে যদি সত্যি একটা আধ্যাত্মিক যোগ থাকে তাহলে আমার এই অন্তরের মঙ্গল ইচ্ছা ওর হয়ত কিছু কাজে লাগ্তে পারে। কিন্তু সব প্রজা এরকম নয়— সেরকম প্রত্যাশা করাও যায় না। সব চেয়ে যা ভাল সব চেয়ে তা দুর্লভ।