শিলাইদহ,
১৬ই মে, ১৮৯৩।

 আমি বিকেলে বেলা সাড়ে ছটার পর স্নান করে ঠাণ্ডা এবং পরিষ্কার হয়ে চরের উপর নদীর ধারে ঘণ্টাখানেক বেড়াই, তার পর আমাদের নতুন জলিবোটটাকে নদীর মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে তার উপরে বিছানাটি পেতে ঠাণ্ডা হাওয়ায় সন্ধ্যার অন্ধকারে চীৎ হয়ে চুপচাপ্ পড়ে থাকি। শ—কাছে বসে’ নানা কথা বকে যায়। চোখের উপরে আকাশ তারায় একেবারে খচিত হয়ে ওঠে। আমি প্রায় রোজই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনো জন্মগ্রহণ করব? আর কি কখনো এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায় এই নিস্তব্ধ গোরাই নদীটির উপর বাংলা দেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে জলিবোটের উপর বিছানা পেতে পড়ে থাক্‌তে পাব? হয়ত আর কোনো জন্মে এমন একটি সন্ধ্যেবেলা আর কখনো ফিরে পাবনা। তখন কোথায় দৃশ্য পরিবর্ত্তন হবে—আর, কিরকম মন নিয়েই বা জন্মাব? এমন সন্ধ্যা হয়ত অনেক পেতেও পারি কিন্তু সে সন্ধ্যা এমন নিস্তব্ধভাবে তার সমস্ত কেশপাশ ছড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের উপরে এত সুগভীর ভালবাসার সঙ্গে পড়ে থাক্‌বেনা, আমি কি ঠিক এম্‌নি মানুষটি তখন থাক্‌ব। আশ্চর্য্য এই আমার সব চেয়ে ভয় হয় পাছে আমি য়ুরোপে গিয়ে জন্মগ্রহণ করি। কেননা সেখানে সমস্ত চিত্তটিকে এমন উপরের দিকে উদ্ঘা‌টিত রেখে পড়ে থাকবার যো নেই এবং পড়ে থাকাও সকলে ভারি দোষের বিবেচনা করে। হয়ত একটা কারখানায় নয়ত ব্যাঙ্কে নয়ত পার্ল্যামেণ্টে সমস্ত দেহমনপ্রাণ দিয়ে খাট্‌তে হবে। সহরের রাস্তা যেমন ব্যবসাবাণিজ্য গাড়িঘোড়া চল্‌বার জন্যে ইঁটে বাঁধানো কঠিন, তেমনি মনটা স্বভাবটা বিজ্‌নেস্‌ চালাবার উপযোগী পাকা করে বাঁধানো—তাতে একটি কোমল তৃণ একটি অনাবশ্যক লতা গজাবার ছিদ্রটুকু নেই। ভারি ছাঁটাছোঁটা গড়াপেটা আইনে বাঁধা মজ্‌বুৎরকমের ভাব। কি জানি, তার চেয়ে আমার এই কল্পনাপ্রিয় অকর্ম্মণ্য আত্মনিমগ্ন বিস্তৃত আকাশপূর্ণ মনের ভাবটি কিছুমাত্র অগৌরবের বিষয় বলে মনে হয় না। জলিবোটে পড়ে পড়ে জগতের সেই কাজের লোকের কাছে আপনাকে কিছুমাত্র খাটো মনে হয় না। বরঞ্চ আমিও যদি কোমর বেঁধে কাজে লাগ্‌তুম তাহলে হয়ত সেই সমস্ত বড় বড় ওক-গাছ-কাটা জোয়ান্‌ লোকদের কাছে আপনাকে ভারি যৎসামান্য মনে হত।