ছিন্নমুকুল/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

নূতন সন্দেহ

 সেখান হইতে অপরাহ্নে প্রমোদ পদব্রজে আপন বাটী অভিমুখে গমন করিতেছিলেন। সচরাচর ধনাঢ্যসন্তানেরা পদব্রজে চলিতে যেরূপ অপমান মনে করেন, প্রমোদ তাহা করিতেন না। রৌদ্র কিম্বা বৃষ্টিবশতঃ বিশেষ প্রয়োজন না হইলে, সকালে বিকালে কোথাও যাইবার সময় প্রমোদ প্রায়ই পদব্রজে গমন করিতেন, হাঁটিতে তাঁহার বেশ স্ফূর্ত্তি বোধ হইত। এবিষয়ে তিনি কলিকাতার দৃষ্টান্ত অনুকরণ করেন নাই।

 বিচারের ফলাফল জানিতে সমস্ত দিন ঔৎসুক্য থাকা প্রযুক্ত এবং শেষে পরাজিত হইয়া এখন প্রমোদ বেশ একটু অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছেন, তাঁহার স্বাভাবিক স্ফূর্ত্তি চিন্তাযুক্ত ম্লানভাবে আচ্ছন্ন। প্রমোদ একাকী একমনে কত কি ভাবিতে ভাবিতে চলিতেছিলেন। মাঝে মাঝে এক একবার সেই বনবালামুর্ত্তি তাঁহার হৃদয়ে চমকিয়া যাইতেছিল, প্রত্যেক চিন্তার সঙ্গেই যেন সে মূর্ত্তি কোন না কোন প্রকারে জড়িত। সন্ন্যাসীর দারুণ সন্দেহের কথাও মাঝে মাঝে মনে পড়িয়া তাঁহাকে ব্যথিত করিয়া তুলিতেছিল; এরূপ জঘন্য দোষে তাঁহাকে দোষী করা সন্ন্যাসীর কি ভয়ানক অন্যায়! কি করিয়া তিনি তাঁহার সে সন্দেহ হইতে মুক্ত হইবেন? নীরজার পিতার চক্ষে দোষী থাকা কি ভয়ঙ্কর কষ্টকর। এইরূপ এদিক ওদিক কত কি ভাবিতে ভাবিতে প্রমোদ চৌরঙ্গির রাস্তায় আসিয়া পড়িলেন। দেখিলেন অপরাহ্নের কনককিরণোজ্জল শ্যামদূর্ব্বাদল-পূর্ণ মাঠে কোথাও যুবকেরা ক্রিকেট খেলিতেছে, কোথাও ফুটবল চলিতেছে, কোথাও সুন্দর সুন্দর বালক বালিকাগণ দাসদাসীর নজরবন্দী হইয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে। প্রমোদ একবার সেই ক্রীড়াকৌতুক প্রফুল্ল মাঠের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, একবার সেই দিগন্তবর্ত্তী সূর্য্যের প্রতি চাহিয়া দেখিলেন; তাহার পর আবার নিজের ভূতভবিষ্যৎ-বর্ত্তমান চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া পড়িলেন। কিছু পরে আবার যখন তাঁহার মাঠের দিকে দৃষ্টি পড়িল তখন দেখিলেন, অস্তগামী সূর্য্যের হেমাভ রশ্মি সেই শ্যামলক্ষেত্র-প্রান্তরে জ্বলিতেছে, বৃহৎ বৃহৎ অট্টালিকা-চূড়ায় জ্বলিতেছে; এবং সেই মাঠের দূরপ্রান্তে একজন জটাধারী ব্যক্তির মুখে পড়িয়াছে। প্রমোদ নীরজার পিতাকে চিনিতে পারিলেন; চিনিয়া তাহার মুখ যেন হর্ষোৎফুল্ল হইল; তিনি দ্রুতপদে সন্ন্যাসীর নিকট আসিলেন। হঠাৎ প্রমোদকে দেখিয়া সন্ন্যাসীও কিছু আশ্চর্য্য হইলেন। প্রমোদ বলিলেন—

 “মহাশয়, আপনার সহিত একটু বিশেষ কথা আছে।” নীরজার সম্বন্ধে কিছু হইতে পারে ভাবিয়া সন্ন্যাসী তাঁহার সহিত মাঠের একটি নির্জ্জন প্রান্তে আসিয়া পঁহছিবামাত্র প্রমোদ বলিলেন “মহাশয়, আপনাকে আমি খুঁজছিলেম। দেখা পেয়ে যে কত সুখী হলেম কি বলব।”

সন্ন্যাসী অধীর গম্ভীর ভাবে বলিলেন “নীরজাকে আমায় ফিরে দিতে কি তবে মানস করেছ?”

 প্র। আপনি জানেন না যে আমাকে দোষী ভেবে আমার মনে কি কষ্ট দিচ্ছেন। কিন্তু আজ আপনার অবিশ্বাস দূর হবে। দিন হঠাৎ জেনেছি নীরজা কোথায়।

 সন্ন্যাসী প্রতিধ্বনির মত জিজ্ঞাসা করিলেন—

 “কোথায়?”

 প্রমোদ তখন নীরজার উদ্ধার বিবরণ সংক্ষেপে বলিয়া কহিলেন, “যামিনীনাথ আপনাকে অনেক বার চিঠি লিখেছেন; আপনি তা না পাওয়াতেই যত গোল ঘটেছে।”

 সন্ন্যাসী বিস্ময়সহকারে বলিলেন “যামিনীনাথ! যাকে নীরজা তোমার সঙ্গে একরাত্রি আশ্রয় দিয়েছিল, তার নামই না যামিনীনাথ? সে নীরজাকে উদ্ধার করেছে? কিন্তু উদ্ধার ক’রে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া দূরে থাক্‌ সে খবরটা পর্য্যন্ত আমাকে এত দিন দেয় নি।”

 প্রমোদ বলিলেন “মহাশয় তাঁকে সন্দেহ করবেন না, আগেইত বল্লেম তিনি আপনাকে খবর দিতে ত্রুটি করেন নি, আপনার কাছে যে সে সব চিঠি কেন পৌঁছয় নি সেইটেই আশ্চর্য্য!”

 সন্ন্যাসী কিয়ৎকাল চিন্তামগ্ন ভাবে নিরুত্তর থাকিয়া পরে বলিলেন “চিঠি লিখলে আমি পেতেম না এ অসম্ভব!”

 প্র। না মহাশয়, আপনি আবার আর একজনকে অন্যায় রূপে দোষী করছেন।

 সন্ন্যাসী সে কথা না শুনিয়া প্রমোদকে বলিলেন “নীরজা কোথা, এত দিন তুমি তা জানতে না?”

 প্র। না।

 স। অথচ যামিনী তোমার পরম বন্ধু?

 প্রমােদ একটু বিপদে পড়িয়া বলিলেন “মহাশয়, বন্ধু বটে, কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর”—

 সন্ন্যাসী প্রমােদকে কথা শেষ করিতে না দিয়াই বলিলেন “তােমার আর কিছুই বলবার প্রয়ােজন নেই। আমি এখনই তােমার বন্ধুর বাড়ী যাচ্ছি।”

 তিনি ভবানীপুরে একজন আত্মীয় ব্যক্তির সহিত নীরজার সম্বন্ধে পরামর্শ করিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু তাহার সন্ধান পাইয়া আর সেখানে না গিয়া, যামিনীনাথের বাড়ীই যাত্রা করিলেন।