ছিন্নমুকুল/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

বিদায়

 গান গাহিতে গাহিতে নীরজা সহসা থামিল। পার্শ্বস্থ বটবৃক্ষতল হইতে হঠাৎ যেন মনুষ্যের চঞ্চল পদনিক্ষেপশব্দ তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল, সে চমকিত হইয়া সেইখানে দাঁড়াইল, সেই দিকে চাহিবামাত্র তাহার মনে হইল, কে যেন ছায়ার মত বৃক্ষান্তরাল হইতে সহসা সরিয়া পড়িল। ইহা শুনিয়া সন্ন্যাসী ও প্রমোদ দু’জনেই কিছুক্ষণ বৃক্ষতল অন্বেষণ করিলেন, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলেন না, তখন নীরজার ভ্রম বুঝিয়া আবার মন্দিরাভিমুখী হইলেন। কুটীরে পৌছিয়া আহারান্তে সন্ন্যাসী প্রমোদকে তাহার নাম ধাম জিজ্ঞাসা করিলেন; পরিচয় লাভে সহসা যেন কেমন মুহ্যমান্ হইয়া পড়িলেন। কিন্তু অল্পক্ষণ মাত্র স্তব্ধ থাকিয়া স্বাভাবিক ধীর শান্তভাবে পুনরায় কহিলেন—“কানপুরে কেন আসা হ’ল?”

 প্র। “পূজার ছুটীতে বেড়াতে এসেছি।”

 স। “কতদিন এখানে থাকা হবে?”

 প্রমোদ একটু থামিয়া থামিয়া বলিলেন, “আর দু’চার দিনের মধ্যেই আমাদের কলেজ খুলবে, কাজেই আর বেশীদিন এখানে থাকতে পাব না। কাল আমাদের কানপুর ছাড়তেই হবে। কলকাতা যা’বার আগে আমার আবার বাড়ী গিয়ে দু চার দিন থাকা চাই ত,—নইলে—”

 এই সময় নীরজা বলিয়া উঠিল—“আমার বউকথা কওটি দেখান হ’ল না—আপনি কি আর আস্‌বেন না?”

 প্রমোদ এই কথায় একটু হাসিয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। সন্ন্যাসীও সেই কথায় একটু হাসিলেন, কিন্তু কিছু পরেই আবার সে হাসি বিষাদরূপে পরিণত হহল, সন্ন্যাসীর মুখকান্তি গম্ভীর হইয়া পড়িল। প্রমোদ বালিকার দিকে চাহিয়া স্বগতচিন্তার অসাবধানতায় আস্তে আস্তে বলিলেন “এমন সরলা বালিকা আর কখনও দেখি নাই।”—এই কথাগুলি যদিও প্রমোদ মৃদুম্বরেই বলিয়াছিলেন, কিন্তু ইহা সন্ন্যাসীর কর্ণে প্রবেশ করিল, তিনি বলিয়া উঠিলেন “সত্য, এমন সরলা আর নাই; কিন্তু উপযুক্ত পাত্র কোথায়? যোগ্য পাত্রে অর্পণ ক’রে হরিদ্বারে যাওয়া কি আমার অদৃষ্টে ঘবে?”

 শুনিয়া নীরজা বাল্যভাব ছাড়িয়া গম্ভারভাবে বলিল, “বাবা হরিদ্বারে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে না? আমি সঙ্গে যাব। হরিদ্বার কতদূর?”

 স। “অনেক দূর।”

 “তা হোক্ অনেক দূর! আমরা যদি যাই আপনিও চলুন না আমাদের সঙ্গে বেড়িয়ে আসবেন?” শেষের কথাগুলি প্রমোদের দিকে চাহিয়া বালিকা বলিল। সন্ন্যাসী অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে নীরজার প্রতি চাহিলেন, কি ভাবে এই কথাটি তাহার অন্তঃস্থল হইতে বাহির হইল, তিনি তাহা যেন জানিতে চেষ্টা করিলেন। যে একটী ভাবে সমস্ত পৃথিবী মুগ্ধ, সমস্ত জগৎ সংসার চলিতেছে, সন্ন্যাসী দেখিতে চাহিলেন, নীরজার ঐ ব্যাকুলতা সেই ভাবের অঙ্কুর কি না? কিন্তু কিছু বুঝিতে পারিলেন না। প্রমোদ বলিলেন, “তা যেতে পারি হরিদ্বার কতই বা দূর!”

 নী। বাবা ত বল্লেন সে অনেক দূর—অতদূর কি আপনি যাবেন?

 প্রমোদ প্রত্যুত্তরে একটু হাসিলেন, সন্ন্যাসী ওকথা বন্ধ করিবার জন্য বলিলেন “নীরজ, তোকে রেখে কি আর আমি হরিদ্বার যাব? তোর আগে বিবাহ হ’ক। কিন্তু তাহ’লেই কি যেতে পারব? উঃ মায়ার কি প্রচণ্ড পীড়ন, জানছি কিছুই কিছু না, জানছি সেই পরব্রহ্ম বই আর গতি নাই, দিনও প্রায় অবসান হ’য়ে এল, তথাপি

‘মমতাবর্ত্তে মোহগর্ত্তে নিপাতিতাঃ।
মহামায়াপ্রভাবেন সংসারস্থিতিকারিণ॥

সন্ন্যাসী চক্ষু নিমীলিত করিলেন, দুই এক বিন্দু অশ্রুবারি তাঁহার গণ্ড বাহিয়া পড়িল। কিছুক্ষণ এইরূপে অতিবাহিত হইবার পর, প্রমোদ বাড়ী যাইবার নিমিত্ত বিদায় প্রার্থনা করিলেন। তখন সন্ন্যাসী, স্বয়ং পথপ্রদর্শক হইবার ইচ্ছায় উঠিলেন। নীরজা সঙ্গে আসিতে চাহিল, কিন্তু সন্ন্যাসী নিষেধ করিয়া বলিলেন “কাল প্রাতে আমি আবার নৈমিষারণ্যে যাব, তোমার খুব রাত থাকতে উঠতে হবে, শুতে আর বিলম্ব করো না।” নীরজা ইহাতে কিছু ক্ষুণ্ণ হইল, কিন্তু পিতার কথায় বিরক্ত না হইয়া শয়ন করিতে গমন করিল।

 প্রমোদ বাড়ী আসিয়া দেখিলেন, যামিনীনাথ সেখানে নাই, ভৃত্যের নিকট শুনিলেন, অপরাহ্নে কলিকাতার এক পত্র পাইয়া বিশেষ প্রয়োজনবশতঃ সেই রাত্রেই তাঁহাকে কলিকাতায় যাইতে হইয়াছে।

 একাকী সেখানে, সে রাত্রি কাটাইয়া পরদিন প্রমোদও প্রয়াগ যাত্রা করিলেন।