ছিন্নমুকুল/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

কনকলতা

 এইখানে আমরা কনকের কথা কিছু বলিতে প্রবৃত্ত হইলাম। কনক এখন পঞ্চদশবর্ষীয়া, কিন্তু তাহার এখনো বিবাহ হয় নাই। সুশীলা ও প্রমোদ দুজনেরই বাল্যবিবাহে বিশেষ ঘৃণা বলিয়া কনকের এখনো তাঁহারা বিবাহ দেন নাই। কনক স্নেহময়ী প্রতিমা। তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়খানির সমস্তই ভালবাসায় পূর্ণ। সুশীলাকে সে মাতার মতই ভাল বাসে— আর তাহার ভাইটিকে? কোন প্রণয়িনী বুঝি তাহার প্রণয়ীকেও এত ভালবাসিতে পারে না। যদি সম্ভব হইত তবে প্রমোদের পায়ে ধূলা লাগিতে না দিয়া মাটীতে সে বুক পাতিয়া রাখিত।

 যতদিন প্রমোদ কলিকাতায় থাকিতেন, ততদিন অত্যন্ত কষ্টে কনকের দিন কাটিত, সে কেবল দিন গণিত করে ছুটীতে তিনি বাড়ী আসিবেন; এবং ইহার মধ্যে ভ্রাতার জন্য মোজা গলাবন্ধ কতই বুনিয়া রাখিত। ভাইটি আসিলে কি করিয়া তাহাকে আদর যত্ন করিবে, কি গল্প করিবে, কি ভাষায় তাহার বিরহদুঃখ প্রকাশ করিবে; এই সমস্ত বিষয় লইয়া কতই ভাবিত, কতই না কল্পনা করিত! কিন্তু অনেক কল্পনাই তাহার মনের মধ্যে সৃষ্ট হইয়া মনের মধ্যেই লয় পাইয়া যাইত;—মুখ ফুটিয়া কোন আদরের কথা, ভালবাসার কথা ব্যক্ত করিতে সে লজ্জিত হইত, সাহসেও কুলাইত না—হাজার ইচ্ছা হইলেও সে তাহা পারিত না। তবে, কনকের সকল কার্য্যেই, একটি সাধারণ ক্ষুদ্র কথাতেও তাহার মনের প্রগাঢ় স্নেহভাব প্রকাশ পাইত। কনক সর্ব্বদাই প্রমোদকে পত্র লিখিত, কিন্তু সময়াভাবে প্রমোদ কনকের সকল পত্রের উত্তর দিতে পারিতেন না। আপনার দশখানির উত্তরে কনক দু’একখানি যাহা পাইত, তাহাতেই তাহার আহ্লাদ ধরিত না। প্রমোদ কিন্তু ভগিনীর সেই নিঃস্বার্থ ভালবাসা কিছুই বুঝিতেন না। তবে সর্ব্বপ্রথমে তিনি যখন বাড়ী হইতে কলিকাতায় পড়িতে আসেন তখন, প্রথম বিদেশে আসিয়া স্নেহের অভাব কিছু বুঝিয়াছিলেন। কলিকাতায় প্রথমে আসিয়া প্রমোদ দেখিলেন এখানে আর তাঁহার জন্য কেহ যত্নে বাদাম কুড়াইয়া দেয় না, যত্নে তাঁহার পড়িবার বইগুলি কেহ গুছাইয়া রাখে না, তাঁহার বিষণ্ণ মুখ দেখিলে কেহ কাতরভাবে তাঁহার দিকে চাহিয়া থাকে না, তাঁহার কষ্টে কেহ ভ্রূক্ষেপও করে না। প্রমোদ তখন তাঁহার ভগিনীর স্নেহ বুঝিতে পারিলেন, স্নেহের অভাব কি ভয়ানক — বুঝিতে পারিলেন। আগে কত সময় কনককে মর্ম্মে আঘাত দিয়াছেন, বিষণ্ণ ভ্রাতাকে কনক কাতরভাবে সান্ত্বনা দিতে আসিলে, প্রমোদ বিরক্তভাবে উঠিয়া গিয়া তাহাকে কত মর্ম্মপীড়া দিয়াছেন, আদর করিয়া খাওয়াইতে আসিলে কতবার হাত ছুঁড়িয়া ফেলিয়া তাহাকে কাঁদাইয়াছেন, তাহার ভালবাসার প্রতিদানে বিরক্তি ও তাচ্ছিল্য উপহার দিয়া তাহাকে কত কষ্ট দিয়াছেন, কাছে থাকিতে প্রমোদের তখন এ সকল কিছুই মনে হয় নাই, এখন সহসা অপরিচিতের মধ্যে আসিয়া স্নেহের অভাব বুঝিয়া এই সকল কথা তাঁহার মনে পড়িল। কি করিয়া ভ্রাতার দোষ ভ্রাতার অজ্ঞাতভাবে আপন স্কন্ধে লইয়া সে প্রমোদকে সুশীলার নিকট নির্দোষী প্রতিপন্ন করিত, কত সময় সেই জন্য কনক কত কষ্ট পাইত, প্রমোদের তাহা মনে পড়িল। তাঁহার মনে পড়িল, এক দিন বৃষ্টির পর তাঁহারা ভ্রাতাভগিনীতে বৃষ্টির জলে উদ্যানে খেলা করিতেছিলেন, হঠাৎ বাতায়ন হইতে সুশীলা তাহা দেখিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া ডাকিলেন, প্রমোদ তাঁহার নিকট যাইতে যাইতে আবার অনিচ্ছুক হইয়া অন্য স্থানে পলায়ন করিল, প্রমোদের পলায়নে কনক হৃষ্টচিত্তে একাকী সুশীলার নিকট গেল। কনকের সন্তুষ্টির কারণ তখন প্রমোদ বুঝিতে পারেন নাই, তাহার পর বুঝিলেন যে কনক এখন একাকী গেলে, তাহার উপর দিয়াই যাহা ঝড় বহিবার বহিয়াই ক্ষান্ত হইয়া যাইবে, প্রমোদের আর কোন কষ্ট পাইতে হইবে না, এই মনে করিয়াই কনক আহ্লাদপূর্ণ হইয়াছিল। আপন পৃষ্ঠে শাস্তি লইয়া ভ্রাতাকে বাঁচাইতে পারিল, এইজন্য কনকের যে প্রচুর আহ্লাদ হইয়াছিল, তাহা প্রমোদের মনে পড়িল। এইরূপ কত শত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্নেহময় ঘটনাগুলি তখন প্রমোদের মনে পড়িতে লাগিল। তখন কনকের ভালবাসা তাঁহার নিকট অমূল্য বলিয়া বোধ হইল। আপনাব সমস্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার মনে করিয়া প্রমোদের অনুতাপ হইতে লাগিল। ভাবিলেন এবার বাড়ী গিয়া আর কনককে কষ্ট দিবেন না। কিন্তু দিন কতক কলিকাতায় থাকিতে থাকিতে আবার যখন কলিকাতা সহিয়া গেল, তখন সঙ্গে সঙ্গে তিনি সে সকল কথাও ভুলিয়া গেলেন, কনককেও ভুলিলেন, অনুতাপেরও ক্রমে অবসান হইল। কিন্তু কনক ভাইটিকে দেখিবার জন্য কতই ব্যাকুল হইত, সারা বৎসর তাহার জন্য কতই উৎহকভাবে অপেক্ষা করিয়া থাকিত, পরে ছুটিতে প্রমোদ বাড়ী আসিলে সে আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিত। যে ক’দিন প্রমোদ বাড়ী থাকিতেন কি মুখে যে দিনগুলি তাহার কাটিত তাহা বলিবার নহে। এবারও সারাবৎসর অপেক্ষা করিয়া করিয়া আশ্বিন মাস আসিল, কত ব্যগ্রভাবে কনক প্রমোদের জন্য অপেক্ষা করিতেছিল তাহা বলা যায় না। কিন্তু অবশেষে এক দিন হতাশ হইয়া তাহার শুনিতে হইল যে, প্রমোদ আপাততঃ কানপুরে বেড়াইতে যাইতেছেন, সেখান হইতে কিছুদিন পরে আসিবেন। কনক রালিকার বড়ই কষ্ট হইল, কিন্তু কি করিবে?—সহিষ্ণুতার সহিত আবার দিন গণিতে লাগিল। প্রমোদ যে দিন কানপুর হইতে বাড়ী আসিলেন, তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়টি অপরিমিত সুখে ভাসিতে লাগিল। বিশেষতঃ প্রমোদের ভাবভঙ্গী এবারে অন্যবার হইতে স্নেহমমতাময়। প্রমোদের সদা প্রফুল্ল মুখখানি এবারে এমন এক নূতন অমায়িক উজ্জ্বল জ্যোৎস্নাময় ভাবে পরিপত, যে দেখিলে বোধ হয় তাঁহার হৃদয়ে একটি নূতন ভাবের স্ফূর্ত্তি হইয়াছে। কিন্তু ছুটির দিন শীঘ্রই অবসান হইল, কনকের সুখের দিনও অবসান হইল; প্রমোদের আবার কলিকাতায় যাইবার দিন আসিয়া পড়িল।