ছিন্নমুকুল/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ভ্রাতা-ভগিনী
প্রমোদ আজ সন্ধ্যাকালে কলিকাতায় যাইবেন, তাঁহার সঙ্গে লইবার সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী কনক গুছাইয়া দিল। পোর্টম্যাণ্টে কাপড় রাখিল, বই সাজাইল; হাতব্যাগে অন্যান্য আবশ্যকীয় দ্রব্যাদির সহিত স্বহস্তনির্ম্মিত পশমের মোজা গলাবন্ধ এবং টিফিন বাক্সে নানাবিধ উপাদেয় খাদ্য দ্রব্যের সঙ্গে বাগানের কতকগুলি বাদাম পর্য্যন্ত পূরিয়া বাক্সগুলি বন্ধ করিল। তাহার পর চাকরের হাতে চাবি সমর্পণ করিয়া পাঠগৃহে আসিয়া বসিল। পাঠে মনোনিবেশ করিবার চেষ্টা করিয়া একখানি পাঠ্য পুস্তক লইয়া পড়িতে গেল। শীঘ্র শীঘ্র অনেকগুলি পাতা উল্টাইল বটে, কিন্তু পড়িয়া তাহা উল্টাইল কিম্বা অশ্রুসিক্ত হওয়াতে তাহা উল্টাইতে বাধ্য হইল, তাহা আমরা ঠিক বলিতে পারিলাম না। কিছু পরে কনক বিরক্তভাবে বইখানি মুড়িয়া অঞ্চলে অশ্রু মুছিতে লাগিল, মুছিয়া মুছিয়া আবার কি ভাবে জানি না, বইখানি খুলিয়া পড়িতে গেল, এই সময় প্রমোদ ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আস্তে আস্তে তাহার নিকট আসিয়া একখানি চৌকিতে স্থিরভাবে বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কি পড়ছিলে?
“ভারতবর্ষের ইতিহাস।”
“কই দেখি” বলিয়া প্রমোদ বইখানি হাতে লইলেন, কিন্তু তাহাতে একবার চক্ষু বুলাইয়াই আবার সশব্দে টেবিলের উপর ফেলিয়া রাখিয়া বলিলেন “কনক!—"
কনক বলিয়াই প্রমোদ থামিলেন, কি বলিতে গিয়াছিলেন আর বলিলেন না, কনক তাহা বুঝিয়া বলিল “দাদা, কি? কি বলছিলে বল না?”
“না, কিছু না—জিজ্ঞাসা করছিলুম তোর ইতিহাস বেশ মনে আছে? বল দেখি নূরজাহান কে?”
“সের আফগানের স্ত্রী, পরে জাহাঙ্গীরের রাণী হয়।”
“জাহাঙ্গীর নূরজাহানকে চিন্লে কি করে?”
"অল্পবয়স্কা নূবজাহান আকবরের অন্দরে প্রায়ই থাকত, সেই সময় যুবরাজ জাহাঙ্গীর তাহাকে দেখে রূপে মুগ্ধ হন।”
"আচ্ছা, আচ্ছা, তার পর সের আফগানের সঙ্গে বিবাহের পর আবার জাহাঙ্গীরের রাণী হ’ল কি করে?”
“জাহাঙ্গীরের আদেশে সের আফগান নিহত”
কনকের কথাটি শেষ না হইতে হইতেই প্রমোদ বলিলেন—
“ছিঃ ছিঃ, জাহাঙ্গীরের প্রেম প্রেমই নয়, সে প্রেমে আত্মবিসর্জ্জন কই?” বলিতে বলিতে প্রমোদের মনে কত ভাব বহিয়া গেল। মনে হইল নীরজা যে তাঁহার হইবে, ইহা তো তাঁহার দুরাশা। নীরজা এক দিন অন্যের হইবেই, নিতান্তই পর হইয়া যাইবে, যদি তখন কখনও দেখা হয় তো তাঁহার কাছ হইতে লুকাইবে, আর হয় তো কখনও দেখিতেও পাইবেন না। ভাবিতেও তাঁহার কষ্ট হইল, নৈরাশ্যাবেগে প্রমোদের ওষ্ঠাধর মৃদু মৃদু কাঁপিতে লাগিল, কিন্তু পরক্ষণেই তিনি প্রশান্ত ভাবে চৌকি হইতে উঠিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে বলিলেন, “নূরজাহানের ছবি কখনো দেখেছিস্?”
“দেখেছি। আমার ইচ্ছা হয় আমাদের অমনি একটি বেশ সুন্দর বৌ হয়। দাদা, তুমি বিয়ে করবে না? তাহলে আমার বেশ একটী সঙ্গী হয়।”
প্রমোদের প্রফুল্ল অমায়িকতায় আশ্বস্ত হইয়া কনক আজ মুক্তকণ্ঠ, তাহাকে ঈষৎ প্রগল্ভ বলিতেও আমাদের সঙ্কোচ হইতেছে না। প্রমোদ কনকের সেই সরল প্রশ্নে ধীরে ধীরে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন, কি ভাবিতে ভাবিতে একটি সেল্ফের উপর, যেখানে কতকগুলি পুস্তক সজ্জিত ছিল সেইখানে আসিলেন, অন্য মনে তাহার মধ্য হইতে একখানি বই তুলিয়া হাতে লইলেন। কনক বলিল, “দাদা তোমাকে আজ অমন দেখছি কেন, তুমি আমাকে কি বলতে যাচ্ছিলে, কই বল্লে না?”
প্রমোদ বলিলেন, “বলতে গিয়েছিলুম সত্য, কিন্তু কেন যে তোকে বলতে গেলুম তা তো জানি না”। কনক মুখটী চুন করিয়া বলিল, “আমাকে বল্লে কি দোষ হয়?”
“তুই ছেলে মানুষ, তোর কাছে সে কথা বলতে যাওয়াই পাগলামি?”
“কখনো তো কিছু বলতে আস না, তবে যে আজ বলতে এলে?”
“পাগলামি, মনের চঞ্চলতা। কি আর বলব, কিছুই না।—তোকে আর এক দিন পড়া শুনা জিজ্ঞাসা করব, এখন পড়।”
কনক দেখিল প্রমোদের মুখে তাঁহার সেই স্বাভাবিক চঞ্চল ভাব নাই, তিনি ঈষৎ বিষণ্ণ, কথা ধীর অথচ দৃঢ়তাব্যঞ্জক। কথা কহিতে কহিতে প্রমোদ অন্যমনে সেই সেল্ফের এক একখানি বই লইয়া টেবিলে ফেলিতে লাগিলেন, কনক অন্যমনস্কতা বশতঃ তাহা দেখিল না; দুঃখিত ভাবে প্রমোদকে বলিল, “তুমি দাদা আমাকে কোন কথাই বলতে চাও না।” কনকের মুখখানি ম্লান হইল, চোখ দু’টি ছল ছল করিয়া আসিল। প্রমোদ কনকের কথায় নিরুত্তর হইয়া রহিলেন, তাহার কথা শুনিতে পাইলেন কি না তাহাও বোঝা গেল না। ক্ষণকাল মৌনভাবে থাকিয়া প্রমোদ সে গৃহ হইতে প্রস্থান করিলেন। তাহাতে কনকের বড় দুঃখ হইল, কনকের কান্না আসিল, কাঁদিয়া কিছু হাল্কা হইলে গৃহান্তরে যাইবার জন্য উঠিল, উঠিয়া সেল্ফের বইগুলি টেবিলে স্তুপাকার দেখিয়া সহসা তাহার যেন চমক ভাঙ্গিল, ব্যস্ত হইয়া বইগুলি গুছাইয়া সেল্ফে তুলিতে গেল।
সে বইগুলি সুশীলার যত্নের বই, বাল্যকালে তাঁহার পিতা তাঁহাকে আদর করিয়া পড়িতে দিয়াছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর সুশীলা তাহা অতি যত্নে রাখিয়াছিলেন। কেহ তাহাতে হাত দিলে তিনি অতিশয় বিরক্ত হইতেন, স্বহস্তে সেগুলি তিনি প্রত্যহ মুছিয়া রাখিতেন। একদিন কনক আপন পড়ার বই একখানি হারাইয়া সেই সেল্ফে তাহা খুঁজিতে গিয়াছিল, তাহাতে সুশীলা তাহাকে বকিয়াছিলেন এবং ভবিষ্যতে সেই সেল্ফে হাত দিতে বিশেষরূপে বারণ করিয়াছিলেন। সেই অবধি আর কনক তাহাতে হাত দিত না। এখন কনক তাড়াতাড়ি বই গুছাইতে যাইতেছে, এই সময় সহসা সুশীলা এই গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বালিকার মুখখানি শুকাইয়া গেল, চোরের ন্যায় সে সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার বইগুলির ঐরূপ দুর্দ্দশা দেখিয়া সুশীলা অতিশয় বিরক্ত হইলেন। সুশীলা স্বভাবতই কিঞ্চিৎ বাহুল্যরূপে কর্ত্তব্যজ্ঞান-সম্পন্ন, আপন আজ্ঞা পালিত না হইলে তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইতেন। অল্প ত্রুটিতেই কিঞ্চিৎ কঠোর হইয়া পড়িতেন। তাঁহার বিশেষ বারণ সত্ত্বেও কনক উহাতে হাত দিয়াছে, তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন; ভাবিলেন, “সেদিন বারণ করিলাম, বিশেষরূপে বারণ করিলাম, আবার সেইকাজ! আমার কথায় অবহেলা! গুরুলোকের আজ্ঞা পালনে অবহেলা! কি করিয়া এ মেয়েকে কর্ত্তব্য শিখাইব?”
সুশীলা পিতাকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন, শ্রদ্ধাভক্তি করিতেন, তাঁহার দত্ত বইগুলিও সেই হেতু তিনি ভক্তির চক্ষে দেখিতেন। তিনি ভাবিলেন, কনক যদি সুশীলাকে তেমন ভক্তি করিত, তাহা হইলে তাঁহার কথা কখনই অগ্রাহ্য করিতে পারিত না। মেয়েছেলের গুরুজনের প্রতি ভক্তি নাই, কি ভয়ানক কথা! সুশীলা বড় ভাবিত হইয়া পড়িলেন। গম্ভীরম্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন “বইগুলিতে হাত দিতে আমার বারণ তা কি তুমি জান না? কেনই বা বারণ, তাও কি আমি তোমাকে বলি নাই? তবুও তুমি কথা মাননা?”
কনক চুপ করিয়া রহিল, কি উত্তর দিবে? যদি বলে —আমি ওরূপ করি নাই, তাহা হইলে সুশীলা আবার জিজ্ঞাসা করিবেন, কে তবে করিয়াছে, প্রাণ থাকিতে ভ্রাতার নাম বলিতে পারিবে না। কোন উপায় না দেখিয়া সে চুপ করিয়া রহিল। সুশীলা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, তখনও কনক নিরুত্তর। একে দোষী, তাহাতে আবার এইরূপ ব্যবহার! তিনি হতাশ হইয়া পড়িলেন। কিন্তু তবু হাল ছাড়া উচিত নহে, তবু তো চেষ্টা করিয়া দেখিতে হইবে, দেখা যাক, যদি শাস্তি দিয়াই তাহার স্বভাব শোধরাইতে পারেন, তিনি শাস্তি স্বরূপ বলিলেন, “প্রমোদের সঙ্গে আজ দেখা করতে পাবে না, সে আজ রাত যাবে, সে সময় তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।” সুশীলা জানিতেন, এ শাস্তি তাহার পক্ষে শাস্তির পরাকাষ্ঠা হইবে। রাত্রিকালে যাইবার সময় প্রমোদ সুশীলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “কনক আজ কোথায়? তাকে আজ অনেকক্ষণ দেখি নি, আমার আবার যাবার সময় হয়ে এল, এখনো যে তার দেখা নেই?” সুশীলা বলিলেন, “সে আজ দোষ করেছে, শাস্তি স্বরূপ তাকে বন্ধ রেখেছি।” প্রমোদ শুনিয়া একটু ক্ষুণ্ণ হইলেন এবং বিমর্ষভাবে বাড়ী হইতে যাত্রা করিলেন। কিন্তু গাড়ীতে গিয়া সে কথা ভুলিয়া গেলেন।