ছিন্নমুকুল/ষড়্‌বিংশ পরিচ্ছেদ

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ

দ্রুমচ্যুত বল্লরী

 সুশীলার মৃত্যুতে কনকের অত্যন্ত আঘাত লাগিল, আজ তাহার আপনাকে নিতান্তই অনাথিনী বলিয়া মনে হইতে লাগিল। বাল্যকালে মাতাকে হারাইয়া সে সুশীলাকেই মা বলিয়া জানিত। কনককে সুশীলাও মাতার ন্যায়ই ভালবাসিতেন। কনক ভাবিল তাহার আর কেহ নাই, আজ হইতে আর তাহাকে কেহ সেরূপ স্নেহ দিবে না। অপরাধ করিলে স্বভাব শােধরাইবার জন্য, কনকের ভালর জন্য শাস্তি দিয়া,পরে সে নিমিত্ত তাঁহার কত কষ্টই হইত। তাহার উপর যতই রাগ করুন, যতই বিরক্ত হউন, কাতর বিষণ্ণ দেখিলে অবশেষে তাহাকে আদর করিয়া কোলে টানিয়া লইতেন। ছেলেবেলা হইতে কনক সকলকে ভালবাসে, কিন্তু সুশীলা বই আর কাহারো নিকট কনক এরূপ স্নেহাদর পায় নাই। পিতাকে তার বড় স্মরণ হয় না। তথাপি যেটুক মনে আছে, তাহাতে কনকের অপেক্ষা তাহার পিতা প্রমোদকেই অধিক ভালবাসতেন বলিয়া মনে আছে। প্রমােদের জন্য পিতা মাতার নিকট সে বাল্যকালে কত না ভর্ৎসিত হইয়াছে, কিন্তু তবুও সেজন্য কনকের তেমন মর্ম্মান্তিক দুঃখ হইত না। কনক প্রমোদকে এত দূর ভালবাসে যে, পিতা মাতা তাহাকে অনাদর করিয়া প্রমোদকে আদর করিলে তাহার সেই কষ্টের মধ্যেও একটি সুখ হইত। প্রমোদের নিকট উপেক্ষিত হইলেই কেবল তাহার দুঃখের সীমা থাকিত না। সূশীলার স্নেহে প্রমোদের ভালবাসার অভাবও সে ভুলিয়া গিয়াছিল, সুশীলার ভালবাসাই তাহাকে যেন বাঁচাইয়া রাখিয়াছিল। আজ কনক সেই স্নেহময়ী মাতাকে হারাইল, আজ সে যেন তাহার সর্ব্বস্ব হারাইল, এখন তাহার কি দশা হইবে? বালিকা কনক সেই মৃত্যুশয্যায় মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল।

 * * * * *

 তখন সন্ধ্যাকাল অতীত হইয়াছে; সুশীলা গঙ্গাতীরে চিতাশয্যায় শয়ান। মৃত্যুশয্যায় আজ তাঁহার সধবাবেশ,—পরিধানে লাল পট্টবস্ত্র, মস্তকে সিন্দূর, গলায় ফুলের মালা, হাতে লাল রুলি ও চরণ দুইখানি অলক্তকে রঞ্জিত। চতুঃপার্শ্বে, দাসদাসীগণ ক্রন্দন করিতেছে, ব্রাহ্মণ ও প্রতিবেশগণ হরিনাম কীর্ত্তন করিতেছে, স্বামী দয়ানন্দ শোকস্তব্ধ গম্ভীর মূর্ত্তিতে সম্মুখে দাঁড়াইয়া পত্নীর মৃত্যুপ্রশান্ত রমণীয় মূর্ত্তি নিরীক্ষণ করিতে করিতে মনে মনে শতাপরাধের ক্ষমা ভিক্ষা করিতেছেন।

 একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত একখানি প্রজ্জ্বলিত কাষ্ঠখণ্ড আনিয়া মন্ত্রোচ্চারণ পূর্ব্বক তাঁহার হস্তে প্রদান করিল—তিনি পূর্ব্ববৎ স্তব্ধ গম্ভীর ভাবেই তাহা গ্রহণ করিয়া মন্ত্রোচ্চারণ পূর্ব্বক মৃতপত্নীর মুখাগ্নি করিলেন। অচেতন ওষ্ঠাধরও যেন সহসা চেতনহাস্যে বিকম্পিত হইয়া উঠিল, অন্তিম শয্যা যেন ফুলশয্যার স্মৃতি মণ্ডিত হইয়া উঠিল, দয়ানন্দ পত্নীর শান্ত প্রফুল্ল মুখে পরিপূর্ণ মার্জ্জনা অনুভব করিলেন।

 মুখাগ্নির পর ঘৃত সংযোগে চিতাকাষ্ঠ যখন ধুধু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল, জ্বলন্ত বহ্নি যখন সুশীলাকে আপনার মধ্যে লুকাইয়া ফেলিলেন তখন দয়ানন্দের বিদীর্ণহৃদয় হইতে একবার ধ্বনিত হইল—ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ হরিঃ ওঁ—” তাহার পর নভোমণ্ডলস্খলিত নক্ষত্রের ন্যায় দ্রুতপদে তিনি পশ্চাৎমুখী হইয়া চলিয়া গেলেন, একবার ফিরিয়াও চাহিলেন না।

 কনক শববাহিদলের সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া অশ্রুহীন সুকরুণ প্রস্তর মূর্ত্তিবৎ চিতার নিকটেই দাঁড়াইয়া ছিল। অগ্নি সংযোগের পূর্ব্বে নয়ন প্রাণ ভরিয়া শেষবার সে স্নেহময়ী জননীতুল্যা মাতৃশ্বসার প্রশান্ত মূর্ত্তি এক দৃষ্টে চাহিয়া দেখিতেছিল। যখন সর্ব্বগ্রাসী অগ্নি তাহাকে গ্রাস করিতে আরম্ভ করিল—কনক আর দেখিতে পারিল না, এতক্ষণ কষ্টে তাহার অশ্রুরাশি স্তম্ভিত হইয়া পড়িয়াছিল সহসা উন্মত্তের মত চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া সেখান হইতে সে চলিয়া গেল। একজন দাসী কনককে গৃহভিমুখে যাইতে দেখিয়া নিকটে আসিয়া বলিল “এখন এ কাপড়ে ঘরে যেতে নেই। গঙ্গা নেয়ে চল পরে ঘরে যাবে।” দাসীর কথায় কনক নিস্তদ্ধে তাহার সঙ্গে সঙ্গে নদীতীরে আগমন করিল।

 রজনী স্তব্ধ গম্ভীর ও অন্ধকার। সেই তমসাচ্ছন্ন নিশীথে গঙ্গার অতল জলরাশির উপর দুইটি স্ত্রীলোক আসিয়া নামিল। অন্ধকারে আর কিছুই দেখা যায় না, কেবল উর্দ্ধে আকাশ নীচে চরণতলে জলরাশি, তল তল, ঢল ঢল করিয়া উদাসগীতি গাহিয়া সকল্লোলে, বহিয়া চলিতেছে, আর উপরে তারকাখচিত স্তব্ধ আকাশ দিগন্ত সীমাবদ্ধ করিয়াও অসীমরূপে প্রসারিত হইয়া আছে। নদীগর্ভে জলের উপরও যত্রতত্র আকাশ ভাসিয়া বেড়াইতেছে, তারকারাশি হাসির ছটা বিকীর্ণ করিয়া দূরের অন্ধকার আরো ঘনীভুত করিতেছে। আকাশলোক ছাড়া গঙ্গা বক্ষঃস্থিত একখানি নৌকার প্রদীপ মিট মিট করিয়া এক একবার আলেয়ার ন্যায় প্রকাশ পাইতেছিল। কনক সেই আলোকটির পানে চাহিয়া চাহিয়া জলে নামিল। দেখিতে দেখিতে সেই আলোকটিকে আর দেখিতে পাইল না,এই অন্ধকার জলরাশির মধ্যে যে একটি আলোক ছিল, তাহাও যেন নিবিয়া গেল। কনকের সংসার সমুদ্রের মধ্যে সুশীলা যে একটি আলো ছিলেন তাহাও এইরূপ নিবইয়া গিয়াছে, কনক এখন আর কাহার স্নেহে বাঁচিবে? কনক যাতনায় মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করিতে করিতে ব্যাকুল ভাবে ঊর্দ্ধদৃষ্টি করিল। দেখিল সেই অনন্ত আকাশ কেমন নীরব, কেমন গম্ভীর, কেমন শোভাময়। মনে হইল যেন তাহার দুঃখে তারাগণ ভ্রূকুটী করিয়া হাসিতেছে। সহসা সেই তারকারাশির মধ্য হইতে একটি তারকা খসিয়া পড়িল। কনকের মনে হইল এই যে তারাটি খসিল, এই অসংখ্য তারকার মধ্যে একটি খসিয়া গেল, উহার জন্য কাহার কি আসিবে যাইবে? একটি কমিয়াছে বলিয়া কেহ কি জানিতেও পারিবে? এখানেই বা আমি কে? এই বিস্তৃত পৃথিবী—তাহার মধ্যে আমি কে? আমি একটি অণুকণা হইতেও অধম। আমি খসিয়া পড়িলে কাহার কি ক্ষতিবৃদ্ধি? আমার জন্য একবিন্দু অশ্রু ফেলিবারও কেহই নাই। ব্যথিত কাতর কনক ভাবিতে ভাবিতে, অন্যমনে একটি একটি করিয়া সোপানশ্রেণী অবতরণ করিতে লাগিল। ক্রমে কখন্ যে সোপান গুলি ফুরাইয়া আসিল কনকের আর তাহাতে হুঁস হইল না, শেষ সোপানে নামিয়া যেমন আর একটি সোপানের প্রত্যাশায় সে পা বাড়াইল, অমনি সোপানচ্যুত হইয়া গভীর জলগহ্বরে নিপতিত হইল, দেখিতে দেখিতে গঙ্গার কৃষ্ণকায়ার মধ্যে কোথায় ভাসিয়া গেল; দুই একটি বিম্ব ব্যতীত গঙ্গার বিপুল বক্ষে কনকের আর কোন চিহ্নই রহিল না, ক্ষণপরে সে চিহ্নও লুপ্ত হইল। দাসী চীৎকার করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে উপরে উঠিয়া আসিল।