ছিন্নমুকুল/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সংশয়।

 যামিনীনাথ দেখিলেন সন্ন্যাসী নীরজার সন্ধান জানিয়ছেন, এরূপ স্থলে তাঁহার নিকট মিথ্যা কথা কহিয়া নীরজাকে গোপন করিতে কিম্বা বলপূর্ব্বক আটকাইয়া রাখিতে চেষ্টা করা আর যুক্তিসঙ্গত নহে। বুঝিলেন সে উপায়ে অভিপ্রায় সিদ্ধ হওয়া বড় দুরূহ। তিনি তখন অন্য উপায় অবলম্বন করিতে স্থির করিয়া দ্বারদেশ হইতে সন্ন্যাসীকে উপরে আনিতে আদেশ করিলেন। সন্ন্যাসী উপরে আসিলে তাঁহাকে সম্মানপূর্ব্বক বসিতে বলিয়া অতি বিনীত ভাবে বলিলেন “মহাশয়ের কি অভিপ্রায়ে আগমন? সন্ন্যাসী বলিলেন “বৃথা বাক্যব্যয়ের প্রয়োজন কি—আমি নীরজাকে নিতে এসেছি।”

 যা। “হাঁ, নীরজা নামে একটি কন্যাকে আমি দস্যুহস্ত হতে মুক্ত করে এখানে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু আপনি অপরিচিত, আপনার নিকট কি করে তাকে সমর্পণ করি।”

 স। “আমি তােমার নিকট অপরিচিত, কিন্তু আমিই নীরজার পিতা।”

 যামিনী বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন “আপনিই নীরজার পিতা?”

 স। “হাঁ, আমিই নীরজার পিতা; নীরজা আমারই ন্যায্যধন! আমা হতে তাকে ছিন্ন করে, পাষণ্ড; আমাকে কি কষ্টই না দিয়েছিস? দিন নাই, রাত্রি নাই, রৌদ্র নাই, বৃষ্টি নাই, নীরজার অনুসন্ধানে কোথায় না ফিরেছি? মনের ব্যাকুলতায় নির্দ্দোষীকে পর্যন্ত অপরাধী করেছি। পাষণ্ড, তােকে এর সমুচিত ফল পেতে হবে।” যামিনী বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে বলিলেন “মহাশয় কি বলছেন? আমি নীরজাকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি!”

 স। নইলে এখনো নীরজা এখানে কেন? যদি যথার্থ ই দস্যুহস্ত হতে রক্ষা করতে, তা’হলে তাকে তার পিতার নিকট পৌঁছিয়ে না দিয়ে এখানে রাখবে কেন? পাষণ্ড, পামর, নীরজা এখনো ত দস্যুহস্তগত।”

 যা। “কি আশ্চর্য্য! আমার এ উত্তম পুরস্কারই বটে! কোথায় নীরজার জীবনদান করলেম বলে আপনার প্রিয়পাত্র হব, না আপনি আমাকেই অবিশ্বাস করছেন। নীরজাকে এখানে এনে অবধি আপনাকে কত চিঠিই লিখেছি তার ঠিক নেই—এখন বুঝতে পারছি, সেখানে না থাকায় আপনি কোন চিঠিই পান নাই, কিন্তু সেটাত আর আমার দোষ নয়।

 স। “আমি বন্দবস্ত করে এসেছিলেম আমার নামে যে কোন পত্র আসুক আমি যেখানে থাকি পাব। কিন্তু এ পর্য্যন্ত তো কানপুর থেকে একখানি পত্রও ফেরত আসেনি।”

 যা। তবে কি গোল হয়েছে কি করে বলব—কিন্তু সে জন্যে কি আপনি আমাকে দোষী করবেন? যদি বিশেষ কাজে কলকাতায় না আটকা পড়তেম তো আমি নীরজাকে নিশ্চয়ই এতদিন নিজে সঙ্গে করে কানপুরে রেখে আসতেম। যা হ’ক আমার এ উত্তম পুরস্কারই বটে!” যামিনীর কথা শুনিয়া তাহার দোষের প্রতি সন্ন্যাসী বিচলিতমনা হইলেন!যামিনী তাহা বুঝিয়া আবার ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন—

 “মহাশয় আপনার কিসে সন্দেহ হ’ল আমি নীরজাকে হরণ করেছি, বড় জানতে ইচ্ছা হচ্ছে। কেন না ভবিষ্যতে কারো উপকার করতে গেলেও ভেবে চিন্তে অতি সাবধানে করতে হবে; উপকার করলেও দেখছি তার শাস্তি আছে, যথার্থ ই ভাল করলে মন্দ হয়।” সন্ন্যাসী পূর্ব্ব হইতে একটু নরম হইয়া বলিলেন—

 “যুবা পুরুষেরা অনেক সময় সৌন্দর্য্যমুগ্ধ হয়ে অতি গর্হিত কার্য্যেও অগ্রসর হয়।”

 যা। “যদি তাই হ’ত তবে এত দিন কি আমি তাকে বিবাহ করতেম না? একবার বিবাহ হয়ে গেলে আপনি আর কি করতেন? যদি ভাবেন নীরজা অসম্মত বলেই তা হয় নি কিন্তু ভেবে দেখুন নীরজা এখন আমার সম্পূর্ণ অধীনে, তাকে বলপূর্ব্বক বিবাহ করলে সে কি করতে পারত? নীরজা অসহায়, আমি তার উপর যত ইচ্ছা অত্যাচার করতে পারি। কিন্তু তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন আমি তাকে কিরূপ যত্নে রেখেছি।” যামিনীর কথায় সন্ন্যাসী অনেকটা নরম হইয়া আসিলেন। যামিনী তাহা বুঝিতে পারিয়া আবার বলিলেন,

 “মহাশয়, এমনতর অন্যায় অবিচার করবেন না। বরং নীরজাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন তা হলে যথার্থ অবস্থা সব বুঝতে পারবেন।” সন্ন্যাসী বলিলেন—

 “যদি সত্যই তুমি নীরজাকে রক্ষা করে থাক তা হলে তোমাকে দোষী করা আমার অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। তুমিও তো ব্রাহ্মণ, তোমার হস্তে নীরজাকে সমর্পণ করে আমার এ দোষের প্রায়শ্চিত্ত করব। তুমি নীরজার উদ্ধারকর্তা, নীরজা তোমারি প্রাপ্য।” শুনিয়া যামিনীর মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইয়া উঠিল, সবিনয়ে কহিলেন—

 “মহাশয়, আমি বহু কষ্টে নীরজাকে উদ্ধার করেছি বটে, কিন্তু আমি নীরজার যোগ্য পাত্র নই। নীরজা যেরূপ রূপবতী ও গুণবতী তার উপযুক্ত পাত্র তো আমার চক্ষে পড়ে না। আমার উপর আপনি অত কৃপা করলে আমাকে—

 স। তোমার বিনয় অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু একটি কথা। তুমি ও প্রমোদ ছাড়া অরণ্যে নীরজাকে কেহই দেখে নাই—তুমি যদি দোষী হও তবে প্রমোদ দোষী, অন্য কারো তাকে হরণ করা ত সম্ভব নয়।” যামিনীনাথ এই কথায় থামিয়া থামিয়া হাত রগড়াতে রগড়াইতে বলিলেন “প্রমোদ! না না মহাশয় সে কি? সে কখনই না—কিন্তু প্রমোদ—প্রমোদ—না; আমার যে বিশ্বাস—উঃ তাও কি হতে পারে? কিন্তু—জগদীশ্বর! তুমিই জান—মানুষের মন।”

 যামিনীনাথের কথার ভাবে বোধ হইল তিনি যেন ইহার কিছু জানেন, কিন্তু বলিতে অনিচ্ছুক। সন্ন্যাসী ইহাতে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করিয়া কন্যাকে দেখিতে চাহিলেন। যামিনী নীরজাকে অন্তঃপুর হইতে এইখানে আনিয়া দিয়া অন্য গৃহে গিয়া বসিলেন। এতদিন পরে পিতা কন্যার সাক্ষাতে তাহাদের মনের ভাব কি হইল, তাহাদের কি কথা বার্ত্তা হইল তাহা অনুভবের বিষয়, বর্ণনীয় নহে।