ছিন্নমুকুল/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

সাধু না চোর?

 নীরজার সহিত কথা কহিবার পর যামিনীকে সন্ন্যাসীর নির্দ্দোষী মনে হইল; তিনি শুনিলেন যে রাত্রে নীরজা অপহৃত হয়, সে রাত্রে যামিনীনাথ কানপুরেই ছিলেন না।

 “কিন্তু যদি যামিনীনাথ নির্দ্দোষী তবে দোষী কে? প্রমোদ? যামিনীনাথের কথার ভাবে মনে হয় যেন প্রমোদ ইহার মধ্যে আছেন। অথচ নীরজার কথা মতে প্রমোদও সম্পূর্ণ নিরপরাধ। কিন্তু তাহা তো হইতেই পারে না; এই দুই জনের মধ্যে এক জন তো নিশ্চয়ই দোষী হইবে। নীরজা বলে সে দস্যু দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিল, কিন্তু দস্যুরা কি লোভে নীরজাকে হরণ করিবে? তাহার অঙ্গে তো অলঙ্কার ছিল না। ধনলোভ নহিলে কেবল সৌন্দর্য্যে মোহিত হইয়া কি দস্যুরা নীরজাকে হরণ করিবে? ইহা কি সম্ভব? তাহা হইলে যামিনী ও প্রমোদের সহিত সাক্ষাৎ হইবার পূর্ব্বেই বা কেহ তাহাকে হরণ করিল না কেন? ইহারা মন্দিরে অতিথি হইবার পর যখন এ ঘটনা ঘটিয়াছে তখন এই দুইজনের মধ্যেই কোন এক জন যে ধনদ্বারা দস্যুক্রয় করিয়া এ কার্য্য সিদ্ধি করিয়াছে, ইহা একরূপ নিঃসন্দেহ। অথচ কথায় বার্ত্তায় দুইজনকেই সম্পূর্ণ নির্দ্দোষী বলিয়া মনে হয়।”

 সন্ন্যাসী ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া মহা সমস্যায় পড়িলেন। আপনাকে ইহার মীমাংসায় অপারগ দেখিয়া তিনি সে দিনের জন্য নীরজাকে যামিনীর বাড়ীতেই রাখিয়া অবিলম্বে ভবানীপুরে তাঁহার সেই আত্মীয়টির বাটী গমন করিলেন; আত্মীয়টি আমাদের পূর্ব্বপরিচিত হিরণকুমার ব্যতীত আর কেহই নহেন। সন্ন্যাসী এখানে আসিয়া হিরণকুমারকে আদ্যোপান্ত সবিশেষ বলিলেন। হিরণকুমার সকল শুনিয়া বলিলেন “আপনার কথায় আমার যামিনীকেই দোষী মনে হচ্ছে।”

 কিন্তু তা কি করে হবে? প্রথমতঃ যে রাত্রে নীরজা অপহৃত হয়, সে রাত্রে যামিনী কানপুরে ছিলই না; দ্বিতীয়ত, নৌকার মাঝির মুখে নীরজার খবর পেয়ে তবে যামিনী তার উদ্ধারে আসে।”

 হিরণকুমার। আমার মনে হয় এ সকল যামিনীর চাতুরী মাত্র। যামিনী যে কি ভয়ানক লোক আপনি জানেন না! মনে হয় এমন কোন কাজই নেই সে করতে না পারে।

 সত্য নাকি? যামিনীর স্বভাব কি অত্যন্ত জঘন্য? কিন্তু তাকে দেখে তো তা মনে হয় না এবং নীরজার মুখেও তো তার প্রশংসা শুনলেম।

 হি। যামিনী অনেক লোকের মাথা খেয়েছে। বাইরে থেকে তাকে চেনা বড় সহজ নয়।

 স। কিন্তু তার স্বভাব মন্দ হলেও এ কার্য্যে আমার তাকে দোষী মনে হয় না। বরঞ্চ প্রমাণ সমস্ত বিপরীত। যামিনীর কথার ভাবে মনে হয় প্রমোদই এর মধ্যে আছে।

 হি। যামিনী ঐ যে অস্পষ্ট ভাবে প্রমোদের ঘাড়ে দোষ ফেলতে চাচ্ছে, তাতে তাকেই আমার বেশী সন্দেহ হয়। যা হক, যামিনীর সঙ্গে একবার কথা না কয়ে আমি নিশ্চয় ক’রে কিছু বলতে পারিনে। হয় তো বাস্তবিকই যামিনী এ কাজ করে নি, আমিই অযথা সন্দেহ করছি।

 তবে সাক্ষাৎ-ই হ’ক না কেন? যদি বাস্তবিকই যামিনী ঐরূপ ষড়যন্ত্রকারী হয় তো আমি রক্ষা রাখব না।

 যামিনীকে সঙ্গে লইয়া পরদিন সন্ন্যাসী হিরণের বাড়ীতে আসিলেন; যামিনীর সহিত কথাবার্ত্তা কহিয়া হিরণের সন্দেহ আরও বৃদ্ধি হইল। হিরণকুমার যামিনীকে বলিলেন—

 “আপনি বলছেন কানপুরে সন্ন্যাসীমহাশয়কে আপনি পত্র লিখেছেন। সমস্ত চিঠি মারা গেল, একখানিও সেখানে পৌঁছল না এ কি সম্ভব?

 যামিনী বলিলেন “আমার কথায় অবিশ্বাস করতে পারেন, কিন্তু আমি মিথ্যা বলছি না। আপনাকে বলতে কি, যে দিন মিথ্যা কথা বলব সেদিন এ জিব কেটে ফেলব। স্বীকার করি আমি মানুষ নানা দোষে দোষী—কিন্তু আমার কোন শত্রুও আমাকে মিথ্যা কহার দোষে দোষী করতে পারবে না।”

 হি। কেবল আপনার কথায় বিশ্বাস করতে বলা ছাড়া এবিষয়ে আপনার বলবার তবে আর কিছুই নেই। আপনি সেই রাত্রেই হঠাৎ প্রমোদকে ছেড়ে কানপুর থেকে চলে গেলেন কেন? দুজনে গিয়েছিলেন হঠাৎ একা চলে আসবার কি কারণ হতে পারে?

 যা। বিকালে টেলিগ্রাম পেলুম, সে রাত্রে তখনি না ছাড়লে একটা মকদ্দমায় আমার সর্ব্বনাশ হতে পারে। আপনার আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?

 হি। কলকাতায় যাবার যদি এতই প্রয়োজন ছিল, তবে এলাহাবাদে কি করছিলেন? এলাহাবাদেই না আপনি নীরজাকে ডাকাতের হাত থেকে উদ্ধার করেন?

 যা। আপনি দেখছি আমাকে নিতান্তই আদালতের সাক্ষী পেয়েছেন। কিন্তু যখন আমি এই উপকারে ব্রতী হয়েছি, যখন সন্ন্যাসীমহাশয়ের কথায় আপনার বাড়ী পর্য্যন্ত এসেছি, তখন এতেও আমি কিছু মনে করব না। শুনুন, আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। কানপুর থেকে গাড়ী এলাহাবাদ ষ্টেশনে যখন থামল, তখন প্লাটফরমে নেমে দেখি আমার নায়েব সেখানে হাজির। ব্যাপারখানা কি, না মকদ্দামার একজন প্রধান সাক্ষীর বাড়ী এলাহাবাদে, সে আমাদের পক্ষে সাক্ষ্য দিলে হারবার সম্ভাবনা, তাই নায়েব স্বয়ং আমাকে এলাহাবাদে আটক করে বলতে এসেছে যে, আমি যেন সেই লোককে নিজে বলে কয়ে সঙ্গে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাই। কি করি কলকাতায় আর তখনি ফেরা হল না। বিপদ আবার এমনি, তখনি সে সাক্ষীর বাড়ী গিয়ে শুনি সে বাড়ী নেই, কোথায় কোন্ গাঁয়ে গেছে, দুচার দিন পরে ফিরবে,—কাজেই আমাকে তার অপেক্ষায় এলাহাবাদে বসে থাকতে হোল।

 হিরণ। যদি এলাহাবাদের সাক্ষীকে মকদ্দমার জন্য ধরা এতই আবশ্যক ছিল তবে নায়েব আগে থাকতে সে কথাও কেন আপনাকে টেলিগ্রামে জানালে না?

 যা। এটা বোঝা কি এতই দুষ্কর! নায়েব আমাকে টেলিগ্রাম করবার সময় তা জানত না, তারপর জানা মাত্র আমাকে নিজে খবর দিতে এল।

 হি। আর আপনি সে কার্য্য সিদ্ধ করে যথাসময়ে কলকাতায় পৌঁছে মকদ্দামা বজায় রাখলেন?

 যা। চিরকালই তাই করে আসছি। আমরা ত আর কোম্পানীর চাকর নই। কিন্তু দেখুন আপনি নিতান্ত অসভ্যের মত আমাকে মিথ্যাবাদী দাঁড় করাতে চেষ্টা করছেন—কিন্তু আর নয়!

 হি। আর একটি কথা। ঠিক যে মুহূর্ত্তে নীরজার নৌক এলাহাবাদের ঘাটে এসে পৌঁছল—আপনিও ঠিক সেই মুহূর্ত্তে কি করতে সেখানে এসেছিলেন তার কারণটা কি জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে?

 যামিনী সজোরে বলিলেন—“কারণটা আপনার শ্রাদ্ধ করতে। মহাশয় আপনার সঙ্গে আর আমি বাক্যালাপ করতে চাইনে, আপনি অতি অসভ্য।”

 হিরণকুমার সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করিয়া সন্ন্যাসীকে বলিলেন—এর কথায় আপনার কি মনে হয়? সমস্ত ত শুনলেন। দেখুন নীরজা ঘাটে আসছে না জানলে সেই বৃষ্টি বাদলে এঁর কি সেখানে তখন যাওয়া সম্ভব? আমার ত বিশ্বাস ইনিই দস্যু দিয়ে নীরজাকে হরণ ক’রে আপনার নির্দ্দোষিতা প্রমাণের জন্যই সে রাত্রে কানপুর ছেড়েছিলেন।”

 সন্ন্যাসীরও যামিনীকে দোষী বলিয়া মনে হইল, তিনি ক্রোধে বলিলেন—“আমার এখন মনে হচ্ছে এ কার্য্য তোমারি। এমন শঠ প্রবঞ্চক পাষণ্ডকে আমি কন্যাদানে মানস করছিলেম!”

 হিণকুমার বলিলেন “কি সর্ব্বনাশ! একে কন্যাদান! তার চেয়ে নীরজাকে জলে ফেলে দেওয়াও ত ভাল। কেন, মহাশয় আপনার কন্যার কি আর বর জোটে না? প্রমোদের সহস্র দোষ থাকলেও যামিনীর চেয়ে প্রমোদ সুপাত্র।”

 হিরণের কথা শুনিয়া যামিনী মনে মনে গর্জ্জিতে লাগিলেন! তাঁহার চিত্ত দমন করিয়া রাখা কঠিন হইয়া উঠিল। সরোষে বলিয়া উঠিলেন,—

 “কন্যাদান সম্বন্ধে তার পিতা যা ইচ্ছা স্থির করুন, কিন্তু মহাশয় কথা কবার কে?”

 হিরণকুমার ঈষৎ ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন “আচ্ছা, পিতাই কন্যার যথার্থ হিতাহিত বুঝুন।”

 কথাবার্ত্তার পর সন্ন্যাসী রোষগম্ভীর-মৌন ভাবে সেইখান হইতে বিদায় লইয়া নীরজাকে আনিতে যামিনীনাথের সহিত তাহার বাটী যাত্রা করিলেন। সন্ন্যাসীকে একাকী পাইয়া যামিনীর যেন প্রাণে প্রাণ আসিল, রাস্তায় যাইতে যাইতে তিনি বলিলেন “মহাশয়, আপনি অন্যের কথায় আমাকে কি যথার্থই দোষী মনে করছেন?—আমার ব্যবহারে কি সত্যই একজন নীচমনা দস্যু বলেই আমাকে মনে হয়?”

 সন্ন্যাসী কোন উত্তর করিলেন না, নীরবে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিলেন মাত্র।

 যামিনী আশ্বস্ত হইয়া আবার বলিলেন, “কিন্তু আমার এই মিনতি, আপনি আমাকে দোষী স্থির করবার আগে আর একবার নীরজার সহিত কথা করে দেখবেন।”

 কথা কহিতে কহিতে তাঁহারা যামিনীর বাটীতে আসিয়া উপনীত হইলেন। বাড়ী আসিয়া যামিনী সন্ন্যাসীর আদেশ অনুসারে নীরজাকে তাঁহার নিকট আনিয়া দিলেন। তিনি আজই কন্যাকে কানপুর লইয়া যাইবেন এইরূপ সংকল্প প্রকাশ করিলেন। সন্ন্যাসী যামিনীনাথের প্রতি সন্দেহ করিতেছেন শুনিয়া নীরজা বলিল,—

 “কেন বাবা, আপনি এমনতর মিথ্যা সন্দেহ করছেন, আমি শপথ করে বলতে পারি যামিনী বাবুর এতে কোন হাত নেই। হিরণকুমার নিশ্চয়ই যামিনীনাথের প্রতি অন্যায় দোষারোপ করছেন। সে কথায় বিশ্বাস করে উপকারক ব্যক্তিকে দোষী করলে ঘোর পাপে পড়তে হবে; তা হলে আমিও আজীবন কষ্ট পাব। দস্যুরাই যে আমাকে হরণ করেছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতেই পারে না।”

 কন্যার এইরূপ দৃঢ় বিশ্বাস দেখিয়া সবলচেতা সন্ন্যাসীও আবার বিচলিত হইতে লাগিলেন। সন্ধা অতিবাহিত হইয়া গেল, কিন্তু পিতা কন্যা কথোপকথনে সব ভুলিয়া রহিলেন।