জাতীয় সাহিত্য/ভারতীয় সাহিত্যের ভবিষ্যৎ
জাতীয় সাহিত্য
ভারতীয় সাহিত্যের ভবিষ্যৎ
মা বঙ্গভারতি!
“তুমিই মনের তৃপ্তি,
তুমি নয়নের দীপ্তি,
তোমা-হারা হ’লে আমি প্রাণ-হারা হই;
করুণা-কটাক্ষে তব
পাই প্রাণ অভিনব,
অভিনব শান্তি-রসে মগ্ন হ’য়ে রই।
যে ক’দিন আছে প্রাণ,
করিব তোমায় ধ্যান,
আনন্দে ত্যজিব তনু ও-রাঙ্গা চরণতলে॥”
এস মা, এক বার দশভুজার রূপে আসিয়া বাঙ্গালার সাহিত্য-মন্দিরে দাঁড়াও এবং আশার স্নিগ্ধ অঞ্জনে বাঙ্গালীর চক্ষু মাজিয়া দাও; তোমার বরাভয়দায়ী করস্পর্শে তাহাদের মোহ কাটিয়া যাক, হৃদয়ে বল আসুক, অন্তরের অন্তস্তলে উৎসাহের সঞ্জীবনী ধারা প্রবাহিত হোক;—বাঙ্গালী দ্বেষ-হিংসা ভুলিয়া, আত্মপর ভুলিয়া, এক প্রাণে, একতানে সঙ্গীত ধরুক,—সে সঙ্গীতে বিরাট্ ব্রহ্মাণ্ড ভরিয়া যাক, বাঙ্গালার সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের আসন অধিকার করুক।
একদিন—সেই অতি প্রাচীনকালে—যখন জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষীণ রশ্মিও জগতে ফুটে নাই,—বিশ্ব যখন একপ্রকার প্রগাঢ় অন্ধতমসে আচ্ছন্ন—সেই আদিকালে—ভারতের আর্য্যাবর্ত্তে যে বেদগান গীত হইয়াছিল, সেই গানে তখনকার ভারতের সর্ব্বত্র,—“পর্বত-পাথার, সমুদ্র কান্তার” সমস্ত ভরিয়া গিয়াছিল,—সেই এক সঙ্গীতের মধুর আকর্ষণে ভারতবর্ষ যেন একপ্রাণ হইয়া গিয়াছিল,—শ্রৌতযুগের সেই সাহিত্যিক একতা, সেই সঙ্ঘ-বদ্ধ ভাব, সেই চিরনবীন প্রেম, সেই বড় স্পৃহণীয় মিলন,—আর কি হইতে পারে না? সে বৈদিক যুগ নাই, সেই বিরাট্ বৈদিক সাহিত্য আজ অলঙ্ঘ্য হিমাচলের ন্যায় ঐ পড়িয়া আছে,—ভারতে, আবার সেই সাহিত্যিক একতা, মনীষার সম্মেলন একপ্রকার অসম্ভব, একথা বলিলে চলিবে না। সেই হারানো ধন আবার ফিরিয়া পাইতে হইবে; বাঁচিয়া থাকিতে হইলে সেই লুপ্তরত্নের পুনরুদ্ধার করিতে হইবে। কালের বশে চলিয়া আমাদিগকে কালজয়ী হইতে হইবে। বঙ্গসাহিত্যের একনিষ্ঠ সাধকগণকে উদাত্ত কণ্ঠে গাহিতে হইবে—
“কে বলিল পুনঃ পাবে না তায়?
হারানো মাণিক পাওয়া কি না যায়?
হয়, যায়, আসে মায়ার ভবে,
রাহুগ্রস্ত ছায়া ক’দিন রবে?
এ জগত-মাঝে করো না ভয়,
সাহস যাহার তাহারি জয়;
দেখো না, দেখো না, দেখো না পাছে,
আগে দেখ আর কত দূর আছে;
ঐ দেখ দূরে ভারতী-মন্দিরে সরস্বতী
উড়িছে নিশান ভারত-তিমিরে,—
করহ সাধনা,—পাইবে ফিরে॥”
একদিন যেমন বৈদিক সাহিত্য শিক্ষিত ভারতবাসীর আত্ম-সাহিত্য ছিল, আজ বঙ্গসাহিত্যকে সেইরূপ সমগ্র ভারতের আত্ম-সাহিত্য করিতে হইবে। জানি, এ কথায় হঠাৎ আস্থা স্থাপন করা বড়ই দুষ্কর;—স্বীকার করি, কথায় যাহা, বলা যায়, কার্য্যে তাহা পরিণত করা সর্ব্বদা সম্ভবপর নহে, কিন্তু চেষ্টায় ত দোষ নাই। মানুষের সামর্থ্য যে কত, এক দল মানুষ অথবা একটা মানুষ যে কত কাজ করিতে পারে, তাহা যদি মানুষ নিজে বুঝিতে পারিত, আত্মসত্তায় যদি মানুষ বিশ্বাস করিতে জানিত, তবে নরজাতির অবস্থা হয় ত আরও বিস্ময়করী হইত, জগৎ মধুময় হইত।
আজ এক বার ক্ষণকালের জন্য আমাদিগকে বঙ্গের মানচিত্র গুটাইয়া রাখিয়া, ভারতের মানচিত্রে দৃষ্টিসংযোগ করিতে হইবে। কলবাহিনী ভাগীরথীর তীরে দাঁড়াইয়া এক বার নর্ম্মদা-সিন্ধু-কাবেরীর স্রোতে মানস স্নান করিতে হইবে। শ্যামা বঙ্গভূমির কোলে বসিয়া শৌর্য্যবীর্য্যের সমাধিক্ষেত্র রাজপুতানার গম্ভীর মূর্ত্তি দেখিতে হইবে। কি করিলে, কোন্ পথে চলিলে, আমার বঙ্গভারতীকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সাজসজ্জায় মনের মত করিয়া বিভূষিত করিতে পারিব, কি করিলে আমার বঙ্গসাহিত্যকে কালে ভারত-সাহিত্যে পরিণত করিতে পারিব, সকল প্রদেশের মনীষাফলে বঙ্গভূমিকে ফলবতী করিতে পারিব,—এই চিন্তা আমাদিগকে করিতে হইবে। আমি বাঙ্গালী যেমন মহারাষ্ট্রীয় জ্ঞান-গরিমায় আমার মাকে সাজাইতে চাই, তেমনই আবার বাঙ্গালার মনীষা-সম্পদে তৎ তৎ প্রদেশ কি উপায়ে সম্পন্ন হইতে পারে, সে কথাও আমাকে ভাবিতে হইবে। একাকী দীর্ঘপথ চলা বড় দায় ও বিরক্তিজনক, দশজনকে লইয়া—আমার দেশীবিদেশী সকল ভাইকে লইয়া—যাহাতে সেই বিরাট্ সারস্বত মন্দিরের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইতে পারি, সেই চেষ্টা আমাকে করিতে হইবে। ক্ষুদ্র আপনাকে ভুলিয়া বৃহৎকে বরণ করিয়া লইতে হইবে। অল্পে সুখ নাই, যাহা ভূমা—বিরাট্—তাহাতে আত্মবিসর্জ্জন করিতে হইবে।[৩] তবে ত মুক্তি। যত সঙ্কোচ, বন্ধন তত কঠোর; যত প্রসার, মুক্তি তত সম্মুখে। বাহু প্রসারণ করিয়া সমগ্র ভারতকে আলিঙ্গন করিতে হইবে,—আপনার বুকের মধ্যে টানিয়া আনিতে হইবে,—বাঙ্গালায় রামপ্রসাদের “মিঠের লোভে তেতোমুখে সারাদিনটা গেল”[৪]—ক্রন্দনের করুণস্বরে নিদ্রিত গুর্জ্জরের চৈতন্য সম্পাদন করিতে হইবে, আবার রাজপুতানার ভট্টকবির উৎসাহপূর্ণ সঙ্গীতের সঞ্জীবনমন্ত্রে বঙ্গসাহিত্যের কোমল প্রাণে নবীন আশার আলোক ফুটাইতে হইবে।
অন্যের যাহা ভাল, তাহা আমাকে লইতে হইবে; আমার যদি কিছু ভাল থাকে, তাহা অন্যকে অঞ্জলি পূরিয়া দিতে হইবে। এইরূপ আদান-প্রদান ছাড়া আমাদের সাহিত্যের প্রকৃত অভ্যুদয়ের আশা নাই, পূর্ণত্ব-লাভের সম্ভাবনা নাই। এমন একটি সাধারণ উপায় নির্দ্ধারণ করিতে হইবে, যাহার আশ্রয়ে বঙ্গ, বিহার, উৎকল, মাদ্রাজ, গুর্জ্জর, রাজপুতানা, গান্ধার, পাঞ্জাব—সব এক সূত্রে গ্রথিত ও সাহিত্যের এক সমতটে সমবেত হইতে পারে। বাঙ্গালার শ্যামাদোয়েলের কূজনে রাজপুতানার ময়ুর কেকামৃত বর্ষণ করিবে, আবার গান্ধারের দ্রাক্ষারসে বাঙ্গালার সাহিত্যকুঞ্জ সরস হইবে। এক কথায়, এমন একটি সুখকর যান আবিষ্কার করিতে হইবে, এমন একখানি মনোহর বজ্রা গড়িতে হইবে, যাহার সাহায্যে ভারতের যে প্রদেশে যাহা কিছু উত্তম, মনোজ্ঞ, তাহা অন্য প্রদেশে অবাধে আমদানী করা যাইবে। যাহার যাহা ভাল, সকলেই তাহার আস্বাদ-গ্রহণে সমর্থ হইবে। এইরূপ করিতে পারিলে কালে—অনন্ত কালের তুলনায় অতি অল্প কালের মধ্যে—ভারতবর্ষে এক অদ্বিতীয় ও অবিচ্ছিন্ন প্রকৃত একাতপত্র সাহিত্য-সাম্রাজ্যের ভিত্তি-স্থাপন হইবে। সে যে কি সুখের সাম্রাজ্য, সে যে কি মোহের সাম্রাজ্য, তাহা ভাবিতেও কতই না আনন্দ! এক চিন্তা এক ধ্যান এক জ্ঞান যাহাদের, এক দেবতা এক মন্ত্র এক পূজা যাহাদের, এক গান এক সুর এক তান যাহাদের, তাহাদের আবার অভাব কিসের? যদি এমনই সাহিত্য গড়িয়া তুলিতে পারি,—সমগ্র ভারত যাহাকে নিজের বুকে তুলিয়া লইবে যদি এমনই রত্ন উদ্ধার করিতে পারি, তবেই ত মায়ের প্রকৃত পূজা করিলাম,—অন্যথা মায়ের অবমাননা মাত্র। এস সাহিত্যিক, এস বঙ্গভারতীর একনিষ্ঠ সাধক, এস ভাই বাঙ্গালী; এই মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া আমরা ভারতবর্ষের খণ্ড খণ্ড সাহিত্য-রাজ্যগুলি এক করিয়া, এক বিরাট্ সাহিত্য-সাম্রাজ্য স্থাপন করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। তুমি-আমি চলিয়া যাইব, আরও কত আসিবে, কত যাইবে, কিন্তু যদি এই ভারতব্যাপী একচ্ছত্র সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়া যাইতে পারি, অথবা ইহার বিন্দুমাত্র আনুকূল্যও করিয়া যাইতে পারি, আমাদের মরজীবন সার্থক হইবে। এ জগতে অসম্ভব কিছুই নাই। আমি একা, আমি দুর্ব্বল, আমি অসহায়, এই সকল মনুষ্যত্ব-ঘাতী চিন্তা পরিহার করিয়া সিংহবিক্রমে কার্য্যে প্রবৃত্ত হও, সিদ্ধি নিশ্চিত। মনে রাখিও যদি তোমার সঙ্কল্প-শুদ্ধি থাকে, তবে তোমার সঙ্কল্পের সিদ্ধিও নিশ্চিত। সুতরাং শুদ্ধ-সঙ্কল্পে হৃদয় সবল করিয়া সাহিত্যের সাধনায় প্রবৃত্ত হও। দেখিবে, আজ যাহা ভাবিতেছ স্বপ্ন, কাল তাহা বাস্তবে পরিণত হইয়াছে,— অসম্ভব সম্ভব হইয়াছে। দেখা যাউক, বাঙ্গালী আমরা এই সাহিত্য-সাম্রাজ্য স্থাপনে কতটুকু সাহায্য করিতে পারি।
বর্ত্তমান সময়ে ভারতবর্ষে একটা জিনিষ দেখিতে পাই যে, কি মাদ্রাজ বোম্বাই, কি গুজরাট বাঙ্গালা, সকল দেশের শিক্ষিত লোকেই ইংরাজীর দ্বারা পরস্পর কথাবার্ত্তা বা ভাবের আদান-প্রদান চালাইয়া থাকেন। বরোদার এক ব্যক্তি, যিনি বাঙ্গালার কিছুই জানেন না, তিনিও অবাধে ত্রিপুরার এক ব্যক্তির সহিত সুন্দর আলাপ করিতেছেন; পরস্পরের দেশীয় ভাষার অজ্ঞতা নিবন্ধন, তাঁহাদের কাহারই কোন অসুবিধা হইতেছে না। বিদেশী ইংরাজী ভাষাই তাঁহাদের উভয়ের মধ্যে ঘটকতা করিতেছে। হিসাবে ইংরাজী আমাদের বহুল উপকার করিতেছে। আজ যে ভারতে জগদীশচন্দ্র বা প্রফুল্লচন্দ্রকে পাইয়াছি, তাহা ইংরাজীর প্রসাদে। রাজভাষা ভারতের অনেক উপকার করিয়াছে, করিবেও। সত্য বটে, পাশ্চাত্ত্য ভাবের অনেক স্তর এ দেশের মাটীর সহিত খাপ খায় না, কিন্তু এমন অনেক জিনিষ পশ্চিম দেশের ভাষা আমাদিগকে আনিয়া দিয়াছে, যাহাতে আমাদের পরম উপকার হইয়াছে। অদৃষ্টবাদী আমরা, কর্ম্ম করিতে শিখিতেছি। পাশ্চাত্ত্য ভাষায় আমরা কতদূর উপকৃত বা আমাদের দেশীয় ভাষা পাশ্চাত্ত্য ভাষার সম্পর্কে কতটা সম্পন্ন, তাহা অদ্যকার বক্তব্য নহে; অন্য এক উপলক্ষে আমি তাহা বলিয়াছি,[৫] সুতরাং আজ সে কথার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।
ভারতবর্ষ ভাবের রাজ্য,—প্রাণের রাজ্য। ভারতের কোন প্রদেশেই ভাবের অভাব নাই। মনস্বী মহাজনের অভাব নাই। উদ্ধবদাস-সুরদাস, রামপ্রসাদ-চণ্ডীদাস, মীরা-তুলসীদাসের[৬] ভারতে অভাব নাই। কেহ লোকলোচনের সম্মুখে আসিয়াছেন, কেহ-বা পল্লীকুঞ্জের স্নিগ্ধচ্ছায়ায় জীবন কাটাইয়াছেন, দেশান্তরের লোকে তাঁহাকে চিনিবার অবসর পায় নাই। ভারতবর্ষের সকল প্রদেশেরই এক একটি নিজস্ব ভাষা আছে এবং তাহা অতি প্রাচীন। সেই সমস্ত প্রদেশের অনেক অমর কবি, অনেক নিপুণ লেখক সেই সেই ভাষায় কত সুমধুর কাব্য, কত সুমধুর কথাগ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন, এখনও লিখিতেছেন,—তাহার ইয়ত্তা নাই। সেই সেই দেশের অধিবাসীরা তৎ তৎ মহাকবির কাব্যামৃত-পানে কৃতার্থ হইয়াছে। ধরুন—যেমন কৃত্তিবাস বা চণ্ডীদাস, মাইকেল মধুসূদন বা হেমচন্দ্র, বঙ্কিম বা দীনবন্ধু[৭]। কে এমন বাঙ্গালী আছেন, যিনি ঐ সকল মহাকবির কাব্য পাঠ করিয়া, নিজে ঐ সকল কবির স্বজাতি বলিয়া শ্লাঘা অনুভব না করেন? বাঙ্গালার এমন কোন্ শিক্ষিত ব্যক্তির গৃহ আছে, যেখানে ঐ সকল কবির কোন-না-কোন গ্রন্থ গৃহের শোভাবর্দ্ধন না করিতেছে? ঐ প্রকার ভারতের অন্যান্য প্রদেশের কথাও ভাবুন। প্রত্যেক প্রদেশেই তাহার “নিজস্ব” বলিয়া কিছু-না-কিছু আছেই। ইংরাজী ভাষা আমাদের দেশে এখনও নৃতন, এখনও ত্রিশকোটী[৮] ভারতবাসীর মধ্যে অতি অল্প কয়েকজন মাত্র ইংরাজী ভাষার অনুশীলন করেন। যাহাদিগকে লইয়া ভারতবর্ষ, যাহাদিগকে বাদ দিলে ভারতবর্ষের অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া দুর্ঘট, সেই সাধারণ জন-সমাজ এখনও ইংরাজীর অনুশীলনে প্রবৃত্ত হয় নাই। আমার মনে হয়, তাহাদিগকে—সেই বিপুল জনসঙ্ঘকে—সাহিত্যের ভিতর দিয়া যদি এক করিতে পারা যায়, তবেই ভারতে প্রকৃত জাতীয় সাহিত্যের সৃষ্টি হইবে, অন্যথা নহে। এখন এমন একটি সাধারণ সেতু নির্ম্মাণ করিতে হইবে, যাহার উপর দিয়া ভারতের সকল দেশের অধিবাসীরা তাহাদের সর্ব্ববিধ বাধা-বিপত্তি পার হইয়া এক মুক্ত প্রান্তরে আসিয়া পৌঁছিতে পারে। সকলে সাহিত্যের অঙ্গনে এক হইবে, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই থাকিবে না। অবশ্য কথা বড়ই কঠিন। দেখা যাক, ইহার সমাধান হয় কি না।
ভারতবর্ষে এখন সাধারণতঃ শিক্ষার কেন্দ্র দেখিতে পাই প্রকৃত পক্ষে একটি; তাহা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচীন যত কিছু শিক্ষাকেন্দ্র ছিল, ক্রমে তাহা লোপ পাইতেছে, যাহা আছে, তাহাও যায় যায়। নবীনের সঙ্ঘর্ষে সে প্রাচীন পদ্ধতি ক্রমেই হটিয়া যাইতেছে। আর তাহার পুনরুদ্ভবের সম্ভাবনা নাই। এখন আর সে তেঁতুলের পাতার ঝোলে চতুষ্পাঠীর ছাত্র নির্ভর করিতে চায় না, বা অধ্যাপকও নির্ভর করাইতে পারেন না।[৯] সে রাম নাই, সে অযোধ্যাও নাই। সব ওলট্-পালট্ হইয়া গিয়াছে। এখন শিক্ষা বলিতে সাধারণতঃ লোকে বোঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, উচ্চশিক্ষিত বলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী। অভিভাবক এখন স্ব স্ব বালকদিগকে স্কুলকলেজে পাঠাইতে পারিলেই তাঁহাদের শিক্ষার সম্বন্ধে নিজ নিজ কর্ত্তব্য সম্পন্ন হইল মনে করিয়া থাকেন। দেশের সে চৌপাড়ি পাঠশালা ক্রমেই লোপ পাইতেছে, গ্রামে গ্রামে উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠার প্রয়াস দেখা যাইতেছে। শিক্ষা-সমাপ্তির পর যে কি হইবে, কোন্ পথে যাইতে হইবে,—সে সব চিন্তা না করিয়া ছেলেদিগকে স্কুলকলেজে শিক্ষা দেওয়া হইতেছে। ইহার ফল ভাল কি মন্দ,—এই ভাবে দেশের শিক্ষাপদ্ধতি চলিলে কোথায় যাইয়া যে ইহার কি পরিণাম দাঁড়াইবে, তাহা গুরুতর চিন্তার কথা। সমাজের সর্ব্ববিধ কল্যাণ যে শিক্ষার উপর নির্ভর করে, সেই শিক্ষা এই বর্ত্তমান প্রণালীতেই হওয়া উচিত, না অন্য কোন সমীচীন পথে শিক্ষার ধারা প্রবাহিত হওয়া বিধেয়,—সে বিষয় অদ্য আলোচ্য নহে। স্থানান্তরে সে কথা বলিবার ইচ্ছা রহিল।
যাহা বলিতেছিলাম—শিক্ষার প্রকৃত কেন্দ্র দেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়। বর্ত্তমান সময়ে ভারতে সবে সাত-আটটি বিশ্ববিদ্যালয়[১০] আছে মাত্র। কিন্তু সে দিন আর দূরে নহে, মনে হয়, যখন ভারতের এক এক প্রদেশে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় দেখিতে পাইব। যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশে আর অন্য কোন শিক্ষার কেন্দ্র নাই বা থাকিলেও তাহা গণনার মধ্যেই নহে, তখন যদি দেশের শিক্ষার সম্বন্ধে কোনরূপ কিছু অদল-বদল করিতে হয়, বা নূতন কিছু করা দরকার হয়, তবে তাহা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়াই করিতে হইবে। অন্যথা, একটা সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচালিত ব্যবস্থা থাকিতে, এখন আবার নূতন করিয়া আর একটা পথ খুলিতে যাওয়া সঙ্গত নহে। সুতরাং ভারতের সাহিত্যিক একতার সমাধান যদি করিতেই হয়, তবে তাহা যতদূর সম্ভব ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যেই করিতে হইবে। চাই আমরা কাজ,—যে ভাবে যত সহজে সেই কাজ সুসম্পন্ন করিতে পারি, তাহাই আমাদিগকে করিতে হইবে। সংজ্ঞা লইয়া বিতণ্ডা করিলে চলিবে না, সংজ্ঞিত পদার্থ-প্রাপ্তির সম্বন্ধে সাবধান থাকিতে হইবে। নৈরাশ্যের কোন কারণ নাই। ভগবানের নাম করিয়া, দেশ-মাতৃকার চরণ স্মরণ করিয়া, বঙ্গভারতীর পাদপদ্ম বক্ষে ধারণ করিয়া, আমরা কার্য্যে প্রবৃত্ত হইব,—মায়ের ছেলে আমরা—“মা মা” রবে অগ্রসর হইব, সকল বাধা-বিপত্তি কাটিয়া যাইবে। সভ্য মহোদয়গণ, আজ আমরা সকলেই এক সঙ্কল্পে, এক উদ্দেশ্যে এই পবিত্র সারস্বত সম্মেলনে সমবেত হইয়াছি; আজ গৈরিকস্রাবের ন্যায় আমার হৃদয়ের ভাবপ্রবাহ আপনাদের সম্মুখে ছুটিতে চাহিতেছে,—আত্মগোপন করিতে আমি জানি না, কোন দিন করিও নাই। বিশেষতঃ আজ—এমন পবিত্র দিনে—মাহেন্দ্রক্ষণে মনের কবাট খুলিয়া দেখাইতে ইচ্ছা করিতেছে যে,—ঐ দেখুন, আমার হৃদয়ে আমি ভারতের কি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখিতে পাইতেছি! এক ভাব, এক ধ্যান, এক জ্ঞানে একতাবদ্ধ হইয়া, এক পরিবারের মত ভারতবাসীরা,—হিন্দুমুসলমান, পার্শি-খৃষ্টান,—সকলে সর্ব্ববিধ মনোমালিন্য ভুলিয়া, জাতিভেদ ভুলিয়া, বীণাপাণির মন্দিরে সমবেত হইয়া, পাশাপাশি দাঁড়াইয়া মায়ের পদে,
“সকলবিভবসিদ্ধ্যৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ”[১১]
বলিয়া পুষ্পাঞ্জলি সমর্পণ করিতেছে! বাঙ্গালার
“হৃদিবৃন্দাবনে বাস যদি কর কমলাপতি,
ওহে ভক্তপ্রিয়া আমার ভক্তি হবে রাধা সতী।”[১২]
সঙ্গীত আমি যেন শুনিতে পাইতেছি,—ঐ শুনুন,—ভারতের অপর প্রান্তে,—সুদূর মহারাষ্ট্রদেশে প্রতিধ্বনিত হইতেছে; বাঙ্গালার শ্যামার ঔদাস্যপূর্ণ সঙ্গীত ঐ যেন রামেশ্বরের সিন্ধুতীরে মূর্চ্ছিত হইতেছে! আবার ঐ শুনুন,—মহারাষ্ট্রের মধুর গীতলহরী বাঙ্গালাভাষার মধ্য দিয়া আসিয়া বঙ্গের প্রতিপল্লী মাতাইয়া তুলিতেছে। আমি যেন দেখিতে পাইতেছি, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের জনসাধারণের মধ্যে স্ব স্ব দেশের ভাষার যে ব্যবধান বা প্রাচীর ছিল, যাহার জন্য বাঙ্গালী কৃষক বা পল্লীবাসী উৎকলের বা দ্রাবিড়ের পল্লী-সঙ্গীত বুঝিতে পারিত না, পরস্পরের ভাবের বিনিময়—সুতরাং প্রাণের বিনিময়—করিতে পারিত না, সেই ব্যবধান-প্রাচীর যেন ধূলিসাৎ হইয়াছে। এখন আর “পর পর” ভাব নাই, সব এক হইয়া গিয়াছে। বাঙ্গালীর কণ্ঠে গুর্জ্জরের কণ্ঠ মিশিয়া এক অভূতপূর্ব্ব, স্বপ্নময় সঙ্গীতের প্রস্রবণ ছুটাইতেছে।
আমি অনেক দূরে ভাসিয়া আসিয়াছি। এখন প্রস্তুতের অনুসরণ করি।[১৩] বলিতেছিলাম, আমরা চেষ্টা করিব ভারতে যে ক’টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তাহাদের সাহায্যে একটা ভাবগত একতা স্থাপন করিতে পারি কি না। আমি এ বিষয়ে খুব আশ্বস্ত। ভারতবাসীর একাগ্রতা, অধ্যবসায় ও আত্ম-সমর্পণের কথা যখন মনে করি, তখন আমি বিশ্বাস করিতে পারি না যে, ভারতবাসীরা কোন কাজে অসমর্থ,—তা সে কাজ যতই দুষ্কর বা আয়াসসাধ্য হউক না কেন! পারাঞ্জপে-গোখ্লে-রানাডে, রামমোহন-রবীন্দ্র-ঈশ্বরচন্দ্র, প্রফুল্ল-জগদীশ-রাসবিহারী, বিবেকানন্দ-সুরেন্দ্রনাথ-সুব্রহ্মণ্য[১৪] প্রভৃতির দিকে যখন তাকাই, তখন আশায় আমি উৎফুল্ল হই। এ পর্য্যন্ত এমন কোনও কাজ ত দেখিলাম না, যাহা কঠোর বা অসাধ্য বলিয়া ভারতবাসী ছাড়িয়া দিয়াছে। সুতরাং আমাদের নিরাশ বা ভগ্নোদ্যম হইবার কোন কারণ নাই। কাজ করিতে আসিয়াছি, করিয়া যাইব। সঙ্কল্পে যদি দোষ না থাকে, মনে যদি কলঙ্ক না থাকে, শত সহস্র মত্ত ঐরাবতেও আমাদিগকে প্রতিহত করিতে পারিবে না, মানুষ ত কোন্ ছার। এ সংসারে কেহ কাহাকেও কিছু করিয়া দেয় না, প্রকৃত পক্ষে দিতে পারে না। “Friends and patrons cannot do what man himself should do”—কথা বর্ণে বর্ণে সত্য। “বীরভোগ্যা বসুন্ধরা”—সত্য কথা। শুধু দৈহিক বল নহে,—দৈহিক বলের সামর্থ্য অতি অল্প,—মানসিক বল চাই। মনের বলে বলীয়ান্ হও, দেখিবে বিশ্ব তোমার সমক্ষে অবনত। একবার মস্তক উত্তোলন করিয়া সিংহের ন্যায় দাঁড়াও, দেখিবে জগৎ তোমার বশংবদ। কৈ, বনের পশু সিংহকে ত কেহ রাজপদে অভিষিক্ত করে না, সে কিন্তু নিজের মনের বিক্রমে সমগ্র পশুজাতির উপর রাজত্ব করিয়া থাকে।
নাভিষেকো ন সংস্কারঃ সিংহস্য ক্রিয়তে বনে।
বিক্রমৈর্জিতসত্ত্বস্য স্বয়মেব মৃগেন্দ্রতা॥
একোঽহমসহায়োঽহং ক্ষীণোঽহমপরিচ্ছদঃ।
স্বপ্নেঽপ্যেবংবিধা চিন্তা মৃগেন্দ্রস্য ন জায়তে॥[১৫]
সুতরাং
“কিসের দৈন্য, কিসের দুঃখ, কিসের লজ্জা,
কিসের ক্লেশ?”[১৬]
একবার ঐক্য-বদ্ধ হইয়া কার্য্যে প্রবৃত্ত হও,—দিগ্দর্শনযন্ত্রের ন্যায় এক দিকে লক্ষ্য রাখিয়া ব্রতানুষ্ঠান কর,—সাফল্য নিশ্চিত। এই আশায় বিমুগ্ধ হইয়া যৌবনের প্রারম্ভ হইতে এই অপরাহ্ণকাল পর্য্যন্ত আমি কতকি-না ভাবিতেছি! আমি রাজনীতির কথা বলিতেছি না,—কেন না, যাহাদের প্রকৃত শিক্ষা নাই, যাহাদের প্রকৃত একতা নাই, যাহাদের জাতীয় ভাব-গত ঐক্য নাই, যাহাদের চিন্তার ধারা একই খাতে প্রবাহিত নহে,—তাহাদের পক্ষে রাজনীতি-চর্চ্চা আপাততঃ উত্তেজনাজনক হইলেও পরিণতিতে চিত্তে অবসাদেরই সৃষ্টি করিয়া থাকে। আমি বলিতেছি,—শিক্ষার কথা, দীক্ষার কথা, ভাব-গত একতার কথা। স্ব স্ব ব্যক্তিত্ব বা বৈশিষ্ট্য না হারাইয়া, যাহার যাহা আছে তাহা বজায় রাখিয়া, কি করিয়া ভারতে এক ভাব, এক চিন্তা, এক সাহিত্যের সৃষ্টি করা যাইতে পারে,—কি করিয়া সমগ্রভারতে এক জাতীয় সাহিত্যের নির্ম্মাণ করা যাইতে পারে, তাহাই আমার বক্তব্য। বাঙ্গালী বাঙ্গালীই থাকিবে, পাঞ্জাবী পাঞ্জাবীই থাকিবে, অথচ তাহারা পরস্পরে পরস্পরের যাহা কিছু উত্তম, যাহা কিছু সুন্দর, নির্ম্মল, মনোহর, তাহা নিজের নিজের ভাষায় ফুটাইয়া তুলিয়া ক্রমে, ধীরে ধীরে এক হইতে শিখিবে, ইহাই আমার বক্তব্য। তাই বলিতেছিলাম, আমাদিগকে নিপুণভাবে দেখিতে হইবে যে, কি উপায়ে এই ভাব-গত, জাতীয় সাহিত্য-গত একতার সমাধান করিতে পারি।
যদি এই মহৎ কার্য্যের—এই দুঃসাধ্য কার্য্যের সু-সম্পাদনের কোনও উপায় থাকে, তবে তাহা আমাদের বর্ত্তমান বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আমরা এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারি যাহাতে বিদ্যার্থীরা, প্রথমতঃ ইংরাজী ও দেশীয় ভাষায় কৃতিত্বলাভের পর, ভারতীয় কতিপয় ভাষা শিক্ষা করিবার সুযোগ পাইবে; বি. এ., এম. এ. উপাধিমণ্ডিত বাঙ্গালী যুবক দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত হইয়া, বাঙ্গালা ভাষার সঙ্গে আরও দুই-একটা ভারতীয় ভাষা—হিন্দি বা মারাঠী, উর্দ্দু বা তৈলঙ্গী ভাষা শিক্ষা করিবে, তাহা হইলে শিক্ষা-সমাপ্তির পর, সেই সকল যুবক পরকীয় ভাষার অর্থাৎ ঐ হিন্দি বা মারাঠী ভাষার সম্পদ-সৌষ্ঠব ক্রমে বঙ্গভাষায় অনুক্রমিত করিয়া বঙ্গভাষার সম্পদ্ বর্দ্ধিত করিতে পারিবে। যে কবিতায় বা যে লেখার উন্মাদনায় মহারাষ্ট্র উন্মত্ত, যে কবিতায় বা যে লেখার উম্মাদনায় হিন্দুস্থান আপনার ভাবে আজও আপনি নৃত্য করে, তাহারা সেই উন্মাদনা বঙ্গভাষার শিরায় শিরায় বহাইতে পারিবে। বঙ্গের ধোয়ী, উমাপতি, জয়দেব, শরণ, গোবর্দ্ধন[১৭] আর বাঙ্গালা ভাষাতেই “অন্তরীণ” থাকিবেন না, ভারতের বিভিন্ন দেশের ভাষাতেও তাঁহাদের মধুর বংশীরব শ্রুত হইবে।
শুধু এক প্রদেশের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই রীতির প্রবর্ত্তন করিলে চলিবে না। ক্রমে ভারতের সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই এই ভাবে দেশীয় ভাষা-শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বোম্বাই-মান্দ্রাজ, পাঞ্জাব-এলাহাবাদ প্রভৃতি স্থানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দেশীয় ভাষায় এম. এ. পরীক্ষার প্রবর্ত্তন করিতে হইবে, নতুবা মাত্র বঙ্গে করিলে এই পারস্পরিক “রেসিপ্রোক্যাল” ফলের সম্ভাবনা অতি অল্প। যদি এই ভাবে সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই দেশীয় ভাষায় এম. এ. পরীক্ষা-গ্রহণের ব্যবস্থা করা যায়, তবে প্রতিবর্ষে আমরা এমন দুই-চারি জন শিক্ষিত ব্যক্তি পাইব, যাঁহারা তাঁহাদের স্ব স্ব মাতৃভাষা ছাড়া ভারতের অপর দুই-চারিটি ভাষাতেও সুপণ্ডিত। এইরূপে কিছুকাল পরে বিশ পঁচিশ কি পঞ্চাশ বৎসর পরে—আজ যেমন ইংরাজীতে বি. এ., এম. এ.-র অনেক লোক পাইতেছি, সেই প্রকার স্বীয় মাতৃভাষা ত আছেই, তাহা ছাড়া, দেশীয় অপরাপর ভাষাতেও সুপণ্ডিত লোকের অভাব থাকিবে না। ফলে দাঁড়াইবে এই, ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের শিক্ষা-দীক্ষা, মতি-গতি সমস্ত ক্রমে এক হইতে আরম্ভ করিবে। এক দেশের যে সাহিত্য উত্তম, এক দেশের যে কবিতা উত্তম, এক দেশের যে লেখায় দেশবাসী ধন্য তাহা অন্য দেশের ভাষায় প্রবিষ্ট হইবে।
সুগম, সরল পথ প্রস্তুত করিতেই যত পরিশ্রম, একবার পথ প্রস্তুত হইলে, যদি সে পথে আপদবিপদ না থাকে, তবে চলাচল করার লোকের অভাব কোন দিনই হয় না। এখন ভারতবর্ষে এই ভাবে জাতীয় শিক্ষার কোন বিশিষ্ট পথ নাই; যাহা আছে তাহা সমস্তই লুপ লাইনের মত বাঁকা পথ। এখন আর বসিয়া থাকিলে চলিবে না, আমাদিগকে কর্ড, ক্রমে গ্রাণ্ড্-কর্ড্, ও পরে গ্রেট্-গ্রাণ্ড্-কর্ড্[১৮] নির্ম্মাণ করিতে হইবে। জানি, এ পথ তৈরি করিতে অনেক ডাইনামাইটের প্রয়োজন, অনেক উত্তুঙ্গ পাহাড় উড়াইয়া দিতে হইবে, অনেক টানেল নির্ম্মাণ করিতে হইবে, কাজ বড়ই আয়াস-সাধ্য। কিন্তু তা বলিয়া হাল ছাড়িয়া দিলে চলিবে কেন? তপস্যায় কি না হয়? অর্জ্জুনের পাশুপত অস্ত্রলাভ যে দেশের সাহিত্যের চিত্র, প্রহ্লাদের সমক্ষে স্ফটিক-স্তম্ভে নরসিংহমূর্ত্তির আবির্ভাব যে দেশের চিত্র, মৎস্যচক্র-ভেদ যে দেশের চিত্র, সে দেশে অসাধ্য কি? সে দেশে অবসাদ কিসের? প্রারম্ভের পূর্ব্বেই যত হিসাব-নিকাশ, যত ইতস্ততঃ; একবার কাজ আরম্ভ করিয়া দিলে, যদি মনের বল থাকে, তবে ষ্টিম রোলারের মত, সমস্ত উচ্চনীচ সমান করিয়া চলিয়া যাওয়া বেশী কথা নহে। তোমার পিতৃপিতামহের নিত্য জপের মন্ত্র একবার স্মরণ কর—
“একো বলবান্ শতং বিজ্ঞানবতামাকম্পয়তে,
বলেন বৈ পৃথিবী জিতা বলং বাবতিষ্ঠস্ব।”[১৯]
এই উদ্দেশ্যেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত দিন পরে ভারতীয় ভাষায় এম. এ. পরীক্ষার সৃষ্টি হইয়াছে। এই এম. এ. পরীক্ষার্থিগণকে প্রধানত এক মূল ভাষায় ও তাহার সহিত অন্ততঃ একটি ভিন্নপ্রদেশের ভাষায় পরীক্ষা দিতে হইবে; অর্থাৎ যিনি প্রধানতঃ বাঙ্গালা ভাষা লইবেন তাঁহাকে সেই সঙ্গে হিন্দি বা মারাঠী বা তেলেগু বা গুজরাটি লইতে হইবে,—এইরূপ যিনি মারাঠী ভাষা লইবেন তাঁহাকে সেই সঙ্গে আর একটি ভাষা লইতে হইবে।—যদি যথার্থ অধ্যবসায়শীল উদ্যমসম্পন্ন কর্ম্মঠ যুবক পাওয়া যায়—অন্ততঃ বৎসরে একটিও মিলে—তবে দশ বৎসর পরে বাঙ্গালায় এমন দশ জন শিক্ষিত ব্যক্তিও পাইব, যাঁহারা অবাধে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ভাষায় যে সমস্ত অমূল্য রত্ন আছে, তাহা আনিয়া প্রতিভার সাহায্যে বঙ্গভাষা খচিত করিতে পারিবেন, বাঙ্গালার সম্পদ্ অনেক বাড়িয়া যাইবে। এইরূপে যদি ভারতের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও দেশীয় ভাষায় এম. এ. পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়, তবে বাঙ্গালার সম্বন্ধে যাহা যাহা বলিলাম, তাহা সেই সেই দেশের পক্ষেও খাটিবে। ফলে, সমগ্রভারতবর্ষে একটা ভাব-গত একতার সাড়া পড়িবে। পরস্পরের আদান-প্রদানের সুবিধা হইবে। অদূর ভবিষ্যতে, যাহারা ইংরাজী জানে না, ইংরাজী শিক্ষার সুবিধা পায় নাই, কিন্তু দেশীয় ভাষা জানে, তাহারাও ভিন্ন দেশের মনোহর ভাব-সম্পদ্ উপভোগ করিতে পারিবে। জনসাধারণের মধ্যে একটা ঐক্য-বন্ধনের সূত্রপাত হইবে। তখন আর দ্রাবিড়বাসীকে ইংরাজীর সাহায্যে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির মাধুর্য্য উপলব্ধি করিতে হইবে না। নিজের নিজের মাতৃভাষায় অপর প্রদেশের কবিত্বসৌন্দর্য্য অনুভব করিয়া তাহারা কৃতার্থ হইবে।
বঙ্গের সুলেখক হারানচন্দ্র বঙ্গভাষায় সংক্ষেপে মহাকবি সেক্স্পীয়রের কাব্যাবলীর কতকটা ভাবানুবাদ করিয়াছিলেন,—ইংরাজী ভাষায় অনভিজ্ঞ অনেক ব্যক্তি তাহা পাঠ করিয়া কি উক্ত কবিবরের কাব্যসৌন্দর্য্যের কতকটা উপভোগ করেন নাই? নাট্যাচার্য্য গিরিশচন্দ্রের ম্যাক্বেথের নাটকাকারে অনূদিত গ্রন্থ পড়িয়া ও অভিনয় দেখিয়া কে না শতমুখে প্রশংসা করিয়াছিল? বিদেশীয় কবির বিদেশীয় ভাষায় লিখিত বিদেশীয় ভাবে পরিপূর্ণ গ্রন্থের অনুবাদ মাত্র পাঠেই যদি এতটা তৃপ্তি হয়, তবে স্বদেশীয় ভাষায় লিখিত স্বদেশীয় কবির গ্রন্থের তাৎপর্য্য নিজ মাতৃভাষায় পাঠ করিলে কতটা আনন্দ জন্মিতে পারে, তাহা উল্লেখ করা বাহুল্য। অবশ্য আমার এই মতই যে অবিসংবাদী, ভ্রমপ্রমাদশূন্য, তাহা আমি বলিতে চাহি না, কিন্তু কার্য্য আরম্ভ করিতে হইলে এইরূপই একটা প্রণালীতে প্রথম সূত্রপাত করিতে হইবে। আমি জানি, আমার এই প্রস্তাব কর্কশ সমালোচনার হাত এড়াইতে পারিবে না; আমি জানি, এই প্রস্তাবের উপর নানাপ্রকার কল্পনা-জল্পনা উঠিতে পারে,—আবার সেই সঙ্গে আমি ইহাও জানি যে, কে কি বলিবে ভাবিয়া কোন কাজ করিতে গেলে আর কাজ করা হয় না।—
“সুদুর্লভাঃ সর্ব্বমনোরমা গিরঃ।”[২০]
এই কবি-বাক্য আমি বিস্মৃত হই নাই। আমার জীবনের চিরদিনের ‘মটো’—
“ধিয়াত্মনস্তাবদচারু নাচরং
জনস্তু তদ্বেদ স যদ্বদিষ্যতি।”[২১]
—আমাকে সর্ব্বদাই সবল করিয়া রাখিয়াছে। সুতরাং যাহা ভাল বুঝিলাম, বলিলাম। যদি কোন মনস্বী এই প্রস্তাবের উৎকর্ষ-বিধানের অনুকূল কোন প্রস্তাব করেন, সাদরে গ্রহণ করিব। নূতন পথে অনেক আবর্জ্জনা থাকিয়া যায়, অনেক কণ্টক প্রথম চোখ এড়াইয়া যায়, ক্রমে চলাচল করিতে করিতে তাহার উদ্ধার হয়। সুতরাং সাঁতার না শিখিয়া সাঁতরাইব না,—এই বুদ্ধি ভাল নহে। ও-পারের ঐ সুন্দর নন্দনবনে যাইতে হইলে বাহুতে ভর করিয়া সাঁতার শিখিতে হইবে। দু’চার বার হয়ত হাবুডুবু খাইবে, তাহাতে নিরাশ হইও না,—ভরসায় বুক বাঁধিয়া সাঁত্রাইয়া যাও, পারে পৌঁছিতে পারিবে। তখন তোমার সকল ক্লান্তি—সকল শ্রান্তি দূর হইবে। শ্যামল বনানীর স্নিগ্ধ অঞ্চলে তুমি আনন্দে ঘুমাইয়া পড়িবে।
এ স্থলে একটা তর্কের মীমাংসা আবশ্যক মনে করি। তাহা এই—এ দেশে আজকাল ইংরাজীর বহুল প্রচার হইয়াছে। জ্ঞানের জন্যই হউক, আর উদরের জন্যই হউক, অথবা আর কিছু করিবার নাই বলিয়াই হউক,—সকলেই অল্পবিস্তর ইংরাজী লেখাপড়া শিখিয়া থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে আবার নূতন করিয়া এই ভারতীয় ভাষার প্রচলনের প্রয়াস কেন? যে কার্য্যসাধনের জন্য এই প্রয়াস, সেই কার্য্য বা সেই উদ্দেশ্য ত অপেক্ষাকৃত অল্পায়াসে ইংরাজীতেই হইতে পারে, তবে এ শিরোবেষ্টনপূর্ব্বক নাসিকা-স্পর্শ কেন? ইহার উত্তরে আমার মাত্র দুইটি কথা বলিবার আছে।
প্রথম কথা—জাতীয় ভাব বজায় রাখিতে হইলে জাতীয় ভাষার সেবা আবশ্যক। বিজাতীয় ভাষার সাহায্যে জাতীয়-সাহিত্য-গঠনের চেষ্টা করা বাতুলতার কার্য্য। দশভুজার পাদপদ্মে রক্ত জবার অর্ঘ্যই মানায়, গোলাপ শত সুন্দর হইলেও মাতৃপদের অযোগ্য। ইহার অধিক আর কিছু বলিতে চাহি না।
দ্বিতীয় কথা—ইংরাজী ভাষা অর্থকরী হইলেও ভারতের অধিকাংশ লোক—ইতরসাধারণ—তাহা জানে না, বা এখনও জানিবার জন্য তাহাদের প্রাণে তেমন আকাঙ্ক্ষা দেখা যায় নাই। সুতরাং ইংরাজীর সাহায্যে তাহাদিগকে বুঝাইতে প্রয়াস করা বৃথা। যদি তেলেগু ভাষায় বা উৎকলীয় ভাষায় বাঙ্গালার রামপ্রসাদ-ভারতচন্দ্রের ভাব-সম্পদ্ ফুটাইতে পারা যায়, তবে ইংরাজীতে যতটা ফললাভের আশা করা যায়, তদপেক্ষা ফল যে লক্ষগুণ অধিক হইবে, সে বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। তুলসীদাসের রামায়ণ ইংরাজীতে তর্জমা করিয়া আমরা কয়জনে পড়িয়া থাকি বা পড়িয়া প্রকৃত রসাস্বাদন করিতে পারি? তাই আমার মনে হয়, জাতীয় ভাব ফুটাইতে হইলে—সকলকে এক অদ্বিতীয় জাতীয়তার সূত্রে গাঁথিতে হইলে, জাতীয় সাহিত্যে একতা-বন্ধনের চেষ্টা করিতে হইবে। বিভিন্ন জাতির ভাবের আদান-প্রদানের সুব্যবস্থা স্ব স্ব জাতীয় সাহিত্যের মধ্য দিয়া করিতে হইবে। উচ্চশিক্ষিত হইতে নিরক্ষর কৃষককুল পর্য্যন্ত এক ঊর্ণনাভের জালে বেড়িয়া ফেলিতে হইবে, অন্যথা একীকরণ অসম্ভব। এইরূপ করিতে করিতে ক্রমে, এখন যে খণ্ড খণ্ড সাহিত্য-রাজ্য আছে তাহা এক বিরাট্ সাম্রাজ্যে পরিণত হইবে। সমস্ত ভেদ মিটিয়া গিয়া এক অনির্ব্বচনীয় সুখময়, স্বপ্নময় সঙ্ঘের গঠন হইবে। তবে এই মহৎ কার্য্যে মহা ত্যাগ চাই। বড় জিনিষ পাইতে হইলে খুব বড় রকমের ত্যাগ আবশ্যক। যদি আমাদের সেই ত্যাগের সময় আসিয়া থাকে, তবে বলিতে হইবে যে, সে দিন আর দূরে নহে,—যখন ভারতের এক প্রান্তের একটি সঙ্গীতে অপর প্রান্তের প্রতিপল্লী সাড়া দিবে। আহা, সে অবস্থার কল্পনাতেও আমার কত-না সুখ, কত-না আনন্দ!
অবশ্য যে প্রণালীতে আমি ভারতীয় ভাষার আলোচনা করিতে বলিলাম, তাহাতে ঠিক ভাষা-গত একত্ব সংঘটিত হইবে না বটে, কিন্তু ভাব-গত একত্ব সাধিত হইবে। ক্রমে সমগ্রভারতে একই ভাবের বন্যা বহিবে। যদি একবার সেই ভারত-প্লাবিনী বন্যার আবির্ভাব হয়, তখন সকল অবসাদ, সকল অভাব ঘুচিয়া যাইবে। পরস্পরের সুখদুঃখের অংশীদারের অভাব থাকিবে না। একের কান্নায় অপরে কাঁদিবে, একের অভ্যুদয়ে অপরে আনন্দিত হইবে। Unification of language না হউক, unification of thought and culture নিশ্চয়ই জন্মিবে। সুতরাং সমগ্রভারতের সকল কেন্দ্রে, সকল পল্লীতে এক স্রোত প্রবাহিত হইবে। মরুভূমিও তখন সরস হইয়া উঠিবে!—ইহা আমার স্বপ্ন নহে।
কেহ কেহ বলেন, সমগ্রভারতে এক ভাষার প্রচলন আবশ্যক, কেন-না ভাষাভেদে মনোভেদ, সুতরাং মতভেদ অনিবার্য্য। তাই তাঁহাদের মতে অন্ততঃ হিন্দি ভাষা সমগ্রভারতের জাতীয় ভাষা হওয়া উচিত।
আমি কিন্তু এ মতের সমর্থন করিতে পারি না। যে কারণে ইংরাজী ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা হইতে পারে না, সেই কারণেই হিন্দি বা অন্য কোন একটা নির্দ্দিষ্ট ভাষাও ভারতের একমাত্র সার্ব্বজনীন ভাষা হইতে পারে না। ইংরাজী ভাষা ভারতের জাতীয় ভাষারূপে গৃহীত হইলে যেমন প্রকৃত পক্ষে ভারতবর্ষ ক্রমে তাহার নিজের বৈশিষ্ট্য হারাইয়া অশ্বত্থপাদপজাত উপবৃক্ষের মত হইয়া পড়িবে, সেইরূপ হিন্দিকে সমগ্রভারতের ভাষা করিতে গেলেও ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশসমূহ তাহাদের নিজের নিজের বৈশিষ্ট্য বা ব্যক্তিত্ব হারাইয়া ফেলিবে। যে মধুরতার জন্য, যে প্রসাদগুণের জন্য, যে মনোহারিতার জন্য বাঙ্গালা ভাষা এত স্পর্দ্ধার বস্তু, তাহা ক্রমে সিকতারাশিতে বারিবিন্দুর ন্যায় কোথায় লুপ্ত হইয়া যাইবে!
অন্য প্রদেশের সম্বন্ধেও এই একই কথা। সুতরাং আমার মতে, যে প্রদেশে যে ভাষা চিরদিন প্রচলিত, তথায় তাহা সেইরূপই থাকুক, সেই ভাষায় সেই প্রদেশের জাতীয় সাহিত্য ক্রমে বর্দ্ধিত হউক,— শ্রীসম্পন্ন হউক। সে পক্ষে কোন বাধার প্রয়োজন নাই। কেন-না যে জাতির জাতীয় সাহিত্য নাই, তাহার বড়ই দুর্ভাগ্য। জগতে তাহাদের স্থান অতি অল্প; কালের অক্ষয় শিলাফলকে তাহাদের কথা ক্ষোদিত থাকে না। তাহারা প্রাতঃকুজ্ঝটিকার ন্যায় অচিরকাল-মধ্যেই কোথায় মিলাইয়া যায়! সুতরাং তাহাদের জাতীয় ভাষার বিলোপ না ঘটাইয়া অন্য প্রদেশবাসীদিগকেও সেই ভাষা শিখিবার পথ সুগম করিয়া দেওয়া হউক। প্রত্যেক প্রদেশ স্ব স্ব জাতীয় ভাষায় সর্ব্বাঙ্গীণ উন্নতিসম্পন্ন হইয়াও অন্য প্রদেশের ভাষার যাহা গ্রহণ-যোগ্য, তাহা স্ব স্ব ভাষার অন্তর্ভুক্ত করিয়া লউক। এইরূপ করিতে পারিলে কিছুকাল পরে ভারতের সকল প্রদেশের মধ্যে একটা ভাবের একতা, চিন্তার একতা, এবং ক্রমে মনের একতা জন্মিবে। নানা ভাষা থাকা সত্ত্বেও এক ভাবে ভাবিত হইয়া ভারত একই লক্ষ্যের দিকে সমবেতভাবে অগ্রসর হইবে। ভারতের ভিন্ন প্রদেশের জাতীয় সাহিত্যের ধারা যাহাতে প্রতিহত হয়, দেশ-হিতৈষী কোন ব্যক্তিরই তাহা করা উচিত নহে। আপনার ধর্ম্মে আপনিই যাহা ধীরে ধীরে বাড়িতেছে, তাহাকে ব্যস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি বাড়াইবার জন্য বিরূপ করা কোন মতেই যুক্তি-সঙ্গত বা নীতি-সঙ্গত নহে।
আমার বক্তব্য ক্রমেই দীর্ঘ হইয়া পড়িতেছে;—আমার মনে এত ভাব আসিতেছে, কল্পনা আমাকে এত দূর-দূরান্তরের মনোহর দৃশ্য দেখাইতেছে যে, আমি আত্মসংযম বা আত্মগোপন করিতে পারিতেছি না,—আর আমি আত্মগোপন করিতে শিখিও নাই। তথাপি অদ্যকার এই সাহিত্যের ‘মহা-সম্মিলনে’ আমি আর আপনাদিগকে বিরক্ত করা সঙ্গত মনে করি না। আমি সাহিত্যসেবী নহি; বঙ্গসাহিত্যের সেবক বলিয়া স্পর্দ্ধা করিবার আমি অধিকারীও নহি, তথাপি ভালবাসিয়া আপনারা আমাকে যে অদ্যকার এই গৌরবের আসন প্রদান করিয়াছেন, সে জন্য আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
উপসংহারে বক্তব্য, বঙ্গের সাহিত্যসেবিগণ! ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মতভেদ, দলাদলি, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ভুলিয়া আপনারা এক মনে, এক প্রাণে একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হউন। আর কেন? যথেষ্ট হইয়াছে। এখনও মনে মন মিশাইয়া, প্রাণে প্রাণ মিশাইয়া, দুর্ব্বলকে কোলে তুলিয়া, সকলকে আপন করিয়া লইয়া এক পথে, এক যোগে যাত্রা করুন,— মায়ের পাদপদ্মে অঞ্জলি দিবার সময়ে মনে মালিন্য রাখিতে নাই। ব্রতানুষ্ঠানের পূর্ব্বে সংযম করিতে হয়, ইহা আপনাদেরই শাস্ত্রের আদেশ। বহিঃসংযম অনাবশ্যক, হৃদয়ের সংযম করিয়া বাগ্দেবতার মন্দিরের সম্মুখীন হউন,—এই আমার প্রার্থনা। মন্দির-প্রবেশের পূর্ব্বে কেবল হস্তপদাদি নহে, হৃদয়ও প্রক্ষালিত করুন,—এই আমার সবিনয় নিবেদন। মনে রাখিবেন,—এই বিংশ শতাব্দীতে জগতের গতি যে দিকে আপনাদিগকেও সেই দিকে যাইতে হইবে। কেন-না আপনারা জগৎ-ছাড়া নন। যাহা আজ স্বেচ্ছায় করিতে অনিচ্ছুক, কাল বাধ্য হইয়া তাহা করিতে হইবে। ভগবানের
“কর্ত্ত্রং নেচ্ছসি যন্মোহাৎ করিষ্যস্যবশোঽপি তৎ।”[২২]
বাক্য বিস্মৃত হইবেন না; আর সেই সঙ্গে ইহাও মনে রাখিবেন যে,—
“এবং প্রবর্ত্তিতং চক্রং নানুবর্ত্তয়তীহ যঃ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি॥”[২৩]
সভ্যগণ! স্মরণাতীত কাল হইতে জগতে ভারতবর্ষের যে প্রাধান্য, বাহুবল তাহার কারণ নহে, জ্ঞানবল তাহার কারণ। দুঃখিনী ভারতভূমির সে শিক্ষা-দীক্ষা ক্রমে মন্দীভূত হইতেছে,—মায়ের আমার অবস্থাও শোচনীয় হইয়া পড়িতেছে। এখনও রোগের প্রতিকারের সময় আছে, বদ্ধপরিকর হইয়া আবার ভারতভূমিকে সেই বিশ্ববরেণ্য জ্ঞানললামে বিভূষিত করুন। ত্রিশ কোটী কণ্ঠে একবার তারস্বরে “মা” বলিয়া ডাকুন,—মায়ের আসন টলিবে, মা মুখ তুলিয়া চাহিবেন। তখন আবার নবীন ঊষার বর্ণচ্ছটায় ভারত রঞ্জিত হইবে, অজ্ঞান-অবিদ্যার অবসাদ কাটিয়া যাইবে। হৃদয়ে বল করিয়া স্মরণ করুন—
“উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত, প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।”[২৪]
কিসের অবসাদ? কিসের সংশয়? কিসের সঙ্কোচ?
“কবি-রঙ্গভূমি এই না সে দেশ?
ঋষিবাক্যরূপ লহরী অশেষ
বহিছে যেখানে,—যেখানে দিনেশ
অতুল ঊষাতে উদয় হয়?
যেখানে সরসী-সলিলে নলিনী,
যামিনী ভুলায় যেথা কুমুদিনী,
যেখানে শরৎ-চাঁদের চাঁদিনী
গগন-ললাট ভাসায়ে রয়?
তবে মিছে ভয়, কেন রে সংশয়?
গাওরে আনন্দে পূরা’য়ে আশয়,—
যেরূপে মায়েরে কমল-আসনে,
দিয়া শতদল রাতুল চরণে,
অমর পূজিলা নন্দনবনে
- ↑ ১ সারদামঙ্গল, প্রথম সর্গ, ৩২।
- ↑ ২ “ইন্দ্রালয়ে সরস্বতীপূজা” হইতে গৃহীত।
- ↑ ৩ “যো বৈ ভূমা তৎ সুখং নামে সুখমস্তি ভূমৈব সুখং।” ছান্দোগ্যোপনিষৎ, সপ্তম অধ্যায়, ২৩শ খণ্ড।
- ↑ ৪
“কেবল আসার আশা, ভবে আসা; আসা মাত্র হলো।
যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে ভ্রমর ভুলে রলো॥
মা নিম খাওয়ালে চিনি বলে, কথায় করে ছল।
ওমা! মিঠের লোভে তেতোমুখে সারাদিনটা গেল॥” - ↑ ৫ ইহার তিন বৎসর পূর্ব্বে বাঁকিপুর বঙ্গীয়-সাহিত্য-সম্মিলনের সভাপতিরূপে। এই পুস্তকের শেষ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
- ↑ ৬ উদ্ধদাস, সুরদাস, মীরা, তুলসীদাস—উত্তর-ভারতের ধর্ম্মপ্রাণ কবি। মীরার ভজন, তুলসীদাসের রামায়ণ, সুরদাসের পদ, হিন্দী সাহিত্যের পরম সম্পদ। রামপ্রসাদ কালীভক্ত কবি; চণ্ডীদাস বৈষ্ণব সাহিত্যে সুপ্রসিদ্ধ কবি। উদ্ধবদাস বাঙ্গলার বৈষ্ণব পদকর্ত্তা।
- ↑ ৭ কৃত্তিবাস— ইহার চারি বৎসর পূর্ব্বে আশুতোষ ফুলিয়ায় কৃত্তিবাসের কথা স্মৃতিসভায় বলিয়াছিলেন।
চণ্ডীদাস— বৈষ্ণব সাহিত্যের সুপ্রসিদ্ধ কবি। মাইকেল মধুসূদন—দুই বৎসর পূর্ব্বে মাইকেলের সমাধিপ্রাঙ্গণে আশুতোষ যাহা বলিয়া ছিলেন তাহা এই পুস্তকের তৃতীয় প্রবন্ধে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। যোগীন্দ্রনাথ বসুর মাইকেল-জীবনী দ্রষ্টব্য।
হেমচন্দ্র—১৮৩৮-১৯০৩; “বৃত্রসংহারের কবি।”
বঙ্কিম—১৮৩৮-১৮৯৪; বাঙ্গলা সাহিত্যের “সম্রাট”।
দীনবন্ধু—১৮২৯-১৮৭৩; কবি ও নাট্যকার; হাস্যরসের জন্য বিখ্যাত, “নীলদর্পণে”র নাম বাঙ্গলার ইতিহাসে স্মরণীয়। - ↑ ৮ ত্রিশ কোটী—১৯৩১-এর আদমসুমারীতে ভারতের লোকসংখ্যা ৩৫,২৮,৩৭,৭৭৮।
- ↑ ৯ তেঁতুলের পাতার ঝোল—নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বুনো রামনাথ কৃষ্ণনগরের মহারাজকে প্রশ্নের উত্তরে বলিয়াছিলেন যে তাঁহার কোনও অভাব নাই—ক্ষেতে ধান আছে আর গৃহিণী তেঁতুলের ঝোল রাঁধেন, তাহাতেই পরিতৃপ্তি। স্বল্পে-সন্তুষ্ট বিদ্যানুরাগী ব্রাহ্মণের আদর্শ।
- ↑ ১০ সাত-আটটি বিশ্ববিদ্যালয়—এখন আঠারটি।
- ↑ ১১ সরস্বতীর ধ্যানের শেষ চরণ।
- ↑ ১২ দাশরথি রায়।
- ↑ ১৩ সংস্কৃতভাষার বাক্যভঙ্গির আদর্শে।
- ↑ ১৪ পারাঞ্জপে (জন্ম ইং ১৮৭৬)—মহারাষ্ট্রদেশীয় বিখ্যাত গণিতজ্ঞ পণ্ডিত। গোখ্লে (১৮৬৬-১৯১৫)—ভারত সেবক-সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা; মহারাষ্ট্রের অধিবাসী; ভারতীয় সরকারের আয়ব্যয়ের নিপুণ ও কঠোর সমালোচক; নির্ভীক, আড়ম্বরশূন্য, সংসারে নিস্পৃহ, হিসাব-পরীক্ষায় সূক্ষ্মবুদ্ধি, প্রকৃত দেশসেবক। রানাডে (১৮৪২-১৯০১)—মারাঠা ব্রাহ্মণ; বোম্বাই হাইকোর্টের অন্যতম জজ; নানা বিদ্যায় সুপণ্ডিত, সংস্কার-আন্দোলনের বিশিষ্ট সমর্থক; পুণার সার্ব্বজনিক সভা ও প্রার্থনা-সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রামমোহন (১৭৭৪-১৮৩৩)—নানা শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, ব্রহ্মোপাসনার প্রবর্ত্তক, ও ব্রাহ্ম সভার প্রতিষ্ঠাতা; বর্ত্তমান ভারতের চিন্তানায়ক, ও যাঁহাদের দানে বাঙ্গালা গদ্য-সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে তাঁহাদের একজন। রবীন্দ্রনাথ (জন্ম ইং ১৮৬১) বর্ত্তমান ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্ববরেণ্য, বাঙ্গালা সাহিত্যকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করিয়া রাখিয়াছেন। ঈশ্বরচন্দ্র (১৮২০-১৮৯১)—বিদ্যাসাগর, দয়ার সাগর, বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশেষভাবে পুষ্ট করিয়াছেন, সমাজ-সংস্কারক ও স্বাধীনচেতা বলিয়াও ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। প্রফুল্লচন্দ্র (জন্ম ইং ১৮৬১)— বিখ্যাত রাসায়নিক, বন্যা-দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি সঙ্কট হইতে দেশবাসীর পরিত্রাণের জন্য সর্ব্বদা চেষ্টিত, চিরকুমার, বঙ্গে বিজ্ঞান-চর্চ্চার নবযুগ আনিয়াছেন, ব্যবসায় বাণিজ্যের বিস্তারে উৎসাহী। জগদীশচন্দ্র (জন্ম ইং ১৮৫৮)—তড়িৎ-বিজ্ঞানে দেশ প্রসিদ্ধ পণ্ডিত; উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে তাহা সূক্ষ্ম স্বয়মুদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করিয়া দেখাইয়াছেন। রাসবিহারী (১৮৪৫-১৯২১)—প্রগাঢ় আইনজ্ঞানের জন্য প্রচুর অর্থ ও সম্মান অর্জ্জন করিয়াছিলেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঁহার দান পনের লক্ষ টাকারও অধিক; জ্ঞানবীর ও দানবীর। বিবেকানন্দ (১৮৬২-১৯০২)—বাঙ্গালার তথা ভারতের গৌরবস্থল; শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষায় ইঁহার অধ্যাত্ম-জ্ঞান প্রদীপ্ত হয়, ইনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন; পরে ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করিয়া ১৮৯৩ খ্রীঃ চিকাগোর ধর্ম্মসভায় বেদান্ত প্রচার করিয়াছিলেন; ইঁহার প্রতিভা ও পাণ্ডিত্য জগতে হিন্দুধর্ম্মকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে এবং বর্ত্তমান ভারতে কর্ম্মযোগের স্থান সুনির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে। সুরেন্দ্রনাথ (১৮৪৮-১৯২৫)— দেশবিশ্রুত রাজনৈতিক নেতা, বাগ্মিশ্রেষ্ঠ, জাতীয় মহাসভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং শেষজীবনে মনটেগু-সংস্কার-প্রবর্ত্তনের পর বঙ্গের স্বায়ত্ত-শাসন-বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। সুব্রহ্মণ্য (১৮৫৬-১৯১৬)—মান্দ্রাজের অধিবাসী; সমাজ-সংস্কারক ও দেশহিতৈষী; “হিন্দু” ও “স্বদেশমিত্রম্” নামে মান্দ্রাজের দুইখানি পত্রিকার সহিত ইঁহার যথেষ্ট যোগ ছিল; জাতীয় মহাসভার ইনিও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
- ↑ ১৫ প্রথম শ্লোকটি হিতোপদেশে সুহৃদ্ভেদের ১৬শ শ্লোক; দ্বিতীয়টী শার্ঙ্গধর-পদ্ধতিতে উদ্ধৃত আছে।
- ↑ ১৬ দ্বিজেন্দ্রলালের “আমার দেশ”।
- ↑ ১৭ গীতগোবিন্দের চতুর্থ শ্লোকে জয়দেব এই সকল কবির পরিচয় দিয়াছেন এবং কৌশলে নিজের বৈশিষ্ট্যের কথাও বলিয়াছেন। “বাচঃ পল্লবয়ত্যুমাপতিধরঃ” ইত্যাদি।
- ↑ ১৮ যেমন ঈস্ট্ ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে করিয়াছে।
- ↑ ১৯ ছান্দোগ্যোপনিষদে সপ্তমাধ্যায়ে অষ্টম খণ্ডে প্রথম শ্লোকে অনুরূপ বচন—শতং বিজ্ঞানবতামেকো বলবানাকম্পয়তে—বিজ্ঞান যাহাদের আছে এমন শত লোককে একজন বলবান্ আকম্পিত করেন।
- ↑ ২০ সকলের মনোরঞ্জন করা যায় এরূপ বাক্য অত্যন্ত দুর্ল্লভ। কিরাতার্জ্জুনীয়ম্, চতুর্দ্দশ সর্গ, পঞ্চম শ্লোক।
- ↑ ২১ জ্ঞাতসারে অশোভন কিছু করি নাই; লোকে কি বলিবে তাহা লোকেই জানে। নৈষধচরিতম্, নবম সর্গ, শ্লোক ১২৩ সংখ্যা। মুলে আছে— “পরস্তু যদ্বেদ স তদ্বদিষ্যতি।” (জীবানন্দ-ধৃত পাঠ)
- ↑ ২২ মোহে যাহা করিতে চাহিতেছ না, সংস্কারবশে অবশ হইয়াও তাহা করিবে।—গীতা, অষ্টাদশ অধ্যায়, শ্লোক ৬০ সংখ্যা।
- ↑ ২৩ পার্থ, এইরূপে প্রবর্ত্তিত চক্র যে অনুসরণ করে না, তাহার জীবন পাপময়, ইন্দ্রিয়-সেবায় তাহার রতি, অতএব তাহার বাঁচিয়া থাকা নিষ্ফল।—গীতা, তৃতীয় অধ্যায়, ১৬শ শ্লোক।
- ↑ ২৪ উঠ, জাগ, অভীষ্ট বস্তু লাভ করিয়া প্রবুদ্ধ হও।—কঠোপনিষৎ, ৩।১৪।
- ↑ ২৫ “ইন্দ্রালয়ে সরস্বতীপূজা”।