জাতীয় সাহিত্য
প্রকাশক
শ্রীবমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
৭৭, আশুতোষ মুখার্জি রোড, ভবানীপুর,
কলিকাতা
প্রথম সংস্করণ:
দ্বিতীয় মুদ্রণ
কলিকাতা ইউনিভারসিটি প্রেসে
শ্রীভূপেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কর্ত্তৃক মুদ্রিত
সার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
ভারতীয় সাহিত্যের ভবিষ্যৎনামক প্রবন্ধে আশুতোষ ভারতব্যাপী বিশাল ভূমিকায় তাঁর মনের সর্ব্বোচ্চ কামনার ও সাধনার যে চিত্র এঁকেছেন তাতে এই কর্ম্মবীরের ধ্যানের মহত্ত্ব আমি সুস্পষ্টরূপে অনুভব করেচি। তাঁর বলিষ্ঠ প্রকৃতি শিক্ষানিকেতনে দুরূহ বাধার বিরুদ্ধে আপন সৃষ্টিশক্তির ক্ষেত্র অধিকার করেছিল। এইখানে তিনি সমস্ত ভারতের চিত্তমুক্তি ও জ্ঞানসম্পদের ভিত্তিস্থাপন করতে প্রবৃত্ত ছিলেন। তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব ও উদার কল্পনাশক্তি সমস্ত দেশের ভবিষ্যৎকে ধ্রুব আশ্রয় দেবার অভিপ্রায়ে সেই বিদ্যানিকেতনের প্রসারীকৃত ভিত্তির উপর স্থায়ী কীর্ত্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ করেছিল। এই প্রবন্ধে সেই তাঁর মহতী ইচ্ছার সম্পূর্ণ স্বরূপটি দেখে সেই পরলোকগত মনস্বী পুরুষের কাছে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
পূর্ব্বভাষ
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে কলিকাতা মহানগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা ডাক্তার গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কলিকাতার একজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক এবং তাঁহার মাতা জগত্তারিণী দেবী একজন আদর্শ রমণী ছিলেন। মাতাপিতার অতন্দ্রিত যত্ন ও সতর্কতার মধ্যে আশুতোষের বাল্য জীবন অতিবাহিত হইয়াছিল। পঞ্চম বর্ষ বয়ঃক্রমকালে বালক আশুতোষ একটি শিশু-বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। কিঞ্চিদধিক দুই বৎসর-মধ্যে ঐ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করিয়া, তিনি কিয়ৎকাল গৃহশিক্ষকের নিকট পাঠাভ্যাস করেন এবং পরে ভবানীপুর সাউথ সুবার্ব্বান স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্ত্তি হয়েন। তখন বিখ্যাত ব্রাহ্মধর্ম্ম-প্রচারক শিবনাথ শাস্ত্রী ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
১৮৭৯ সালের নভেম্বর মাসে আশুতোষ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করিয়া দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। অতঃপর তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে প্রবেশ করিলেন। এই সময়ে চার্ল্স্ টনি ইহার অধ্যক্ষ ছিলেন। ফার্ষ্ট আর্ট্স্ পরীক্ষার পূর্ব্বে আশুতোষ পীড়িত হইয়া পড়েন, কিন্তু পরীক্ষার ফল বাহির হইলে দেখা গেল যে তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করিয়াছেন। ১৮৮৪ সালের জানুয়ারী মাসে আশুতোষ প্রথম স্থান অধিকার করিয়া বি. এ. পরীক্ষা পাস করেন এবং পরবৎসর গণিতে ও তৎপর বৎসর পদার্থ-বিজ্ঞানে এম. এ. পরীক্ষা পাস করেন। তিনি ১৮৮৬ সালে ২২ বৎসর বয়সে গণিতে ও পদার্থ-বিজ্ঞানে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন এবং ইহার দুই মাস পরেই সাহিত্যে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি পরীক্ষা দিবার জন্য আবেদন করেন। আশুতোষের যেরূপ অসাধারণ প্রতিভা ছিল, তাহাতে তিনি ঐ বৃত্তির জন্য প্রার্থী হইলে অন্য ছাত্রের পক্ষে উহা লাভ করা কঠিন হইত। বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়ে তাঁহার প্রার্থনা উপেক্ষা করিলেও, তাঁহার অনন্যসাধারণ প্রতিভার দাবী অগ্রাহ্য করিতে পারে নাই; আশুতোষ যে বৎসর গণিতে এম. এ. পাস করিলেন, তাহার পরবৎসরই এম. এ. পরীক্ষার পরীক্ষক মনোনীত হইয়াছিলেন। গণিতে তাঁহার যে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল, তাহা ভারতের বাহিরেও স্বীকৃত হইয়াছিল। এডিনবরার রয়েল সোসাইটী, আয়ার্লণ্ডের রয়েল একাডেমি এবং আরও বহু গণিত-সভা তাঁহাকে সভ্যপদে বরণ করিয়াছিল। গণিত ভিন্ন অন্য বিষয়েও আশুতোষের প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। ঐ সকল বিষয়েও তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জ্জন করিয়াছিলেন।
আশুতোষ যদি সারাজীবন গণিতের চর্চ্চা করিয়া কাটাইতেন, তাহা হইলেও তিনি যে বিশ্ববিশ্রুত কীর্ত্তির অধিকারী হইতে পারিতেন, সে বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা অপেক্ষা তিনি তাঁহার দেশের ও জাতির সেবাই জীবনের ব্রত বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন। শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টার সার আল্ফ্রেড্ ক্রফ্ট্ তাঁহাকে প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপকপদে নিয়োগ করিতে চাহিয়াছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ভাইস্-চান্সেলার সার কোর্ট্নে ইল্বার্ট তাঁহার উপকার করিতে আগ্রহান্বিত ছিলেন। কিন্তু আশুতোষের লক্ষ্য অনেক উচ্চে ছিল। তাঁহার একান্ত অভিলাষ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবায় আত্মোৎসর্গ করিয়া দেশের শিক্ষা-প্রণালীর উন্নতি-সাধন করিবেন। তাঁহার দেশের মেধাবী যুবকবৃন্দ যাহাতে নানা বিদ্যায় পারদর্শী হইয়া দেশের মুখোজ্জ্বল করিতে পারে, তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে, বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্যকে গড়িয়া তুলিয়া তাহাকে গৌরবময় সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে,—ইহাই ছিল তাঁহার জীবনের লক্ষ্য।
আশুতোষ বি. এল্. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া হাই কোর্টের উকীল হইলেন। ইহার পূর্ব্বে তিনি সার রাসবিহারী ঘোষের নিকট চুক্তিবদ্ধ (articled) সহকারী থাকিয়া আইনের প্রয়োগবিদ্যা শিক্ষা করিয়াছিলেন। মাত্র চল্লিশ বৎসর বয়সে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় হাই কোর্টের জজ নিযুক্ত হয়েন। আইন ব্যবসায়ে প্রভূত অর্থ উপার্জ্জন করিলেও তিনি জজিয়তী গ্রহণ করেন এই মানসে যে, ইহাতে তাঁহার যেটুকু অবসর থাকিবে, সেই অবসরসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবায়, দেশের সেবায় নিয়োগ করিতে পারিবেন। ১৯০৪ হইতে ১৯২৩ সাল পর্য্যন্ত আশুতোষ জজের পদে নিযুক্ত ছিলেন। ইহার মধ্যে একবার তিনি চীফ্ জষ্টিসের পদে কার্য্য করিয়াছিলেন। জজ হিসাবে সর্ব্বত্র তাঁহার সুনাম ছিল এবং তিনি যে সমস্ত নজীর রাখিয়া গিয়াছেন তাহা আইনের পণ্ডিতেরও বিস্ময়ের কারণ। তাঁহার বিচারে সূক্ষ্মদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও অধ্যবসায়ের প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। এই সকল কারণে, যে সকল মনস্বী হাই কোর্টের জজের পদ অলঙ্কৃত করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্থান অতি উচ্চে।
হাই কোর্টের জজের কঠোর দায়িত্বপূর্ণ, বহু শ্রমসাধ্য কর্ম্ম করিয়াও আশুতোষ দেশের কার্য্যে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করিবার অসাধ্যসাধন হইতে বিরত হয়েন নাই। নিজের স্বাস্থ্য ও পারিবারিক কর্তtব্যে উদাসীন থাকিয়া তিনি দেশের সেবায় প্রাণ উৎসর্গ করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রাণে বিধাতা যেরূপ জাতীয়তা ও স্বদেশ-প্রেমের অসাধারণ প্রেরণা প্রদান করিয়াছিলেন, তাঁহার বাহুতেও সেইরূপ বিরাট্ কর্ম্মশক্তি দিয়াছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে তাঁহার শুধু অফুরন্ত কর্ম্মশক্তি ও অলৌকিক সৃষ্টিপ্রতিভার পরিচয় প্রদান করে তাহা নহে; ইহা তাঁহার জাতীয়তা-বুদ্ধিরও প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আশুতোষেরই চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয়েরা তাহাদের স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত হইল। ইহা এক্ষণে সম্পূর্ণরূপে স্বদেশী প্রতিষ্ঠান। বাঙ্গালীর বিশ্ববিদ্যালয় সত্যই বাঙ্গালীর সম্পত্তি হইয়াছে; ইহা আশুতোষের সামান্য কৃতিত্ব নহে।
সার আশুতোষের চরিত্র নৈতিক সম্পদে ভূষিত ছিল। এই নৈতিক চরিত্র-বলের জন্য তিনি দেশের সর্ব্বত্র সম্মান প্রাপ্ত হইতেন। কি সর্ব্বোচ্চ ধর্ম্মাধিকরণের বিচারাসনে, কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধাররূপে, সর্ব্বত্রই তাঁহার নির্ভীকতা ও সাহসের সম্যক্ পরিচয় পাওয়া যাইত। এই স্বাধীনচেতা মহাপুরুষ ভয় কাহাকে বলে জানিতেন না। তাঁহার অপ্রতিহত তেজের নিকট সকলেই শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ে মস্তক অবনত করিত। শ্রেষ্ঠ রাজপুরুষগণের সহিত ব্যবহারেও তিনি কখনও সংকীর্ণ স্বার্থের লোভে মস্তক অবনত করেন নাই। বস্তুতঃ এই তেজোদৃপ্ত পুরুষসিংহের চরিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁহার নির্ভীকতা। এই জন্য তিনি ‘বাংলার বাঘ’ এই আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সত্যকে আশ্রয় করিয়া তিনি স্বৈর গতিতে কল্যাণের পথে, প্রগতির দিকে চলিতেন। কোনও সংকীর্ণতা, দৈন্য, তুচ্ছ স্বার্থাভিসন্ধি তাঁহাকে ক্ষণকালের জন্যও বিচলিত করিতে পারে নাই। কোনও বিরাট্ প্রতিষ্ঠান গঠন করিতে হইলে, কোনও উদার কল্পনাকে রূপ দান করিতে হইলে যে সকল গুণের সমবায় আবশ্যক, তাহা তাঁহাতে পূর্ণ মাত্রায় বর্ত্তমান ছিল। বিপুল কল্পনাশক্তি ও তাহাকে মূর্ত্তি দান করিতে হইলে যে অক্লান্ত সাধনা আবশ্যক, সৃষ্টি করিবার সামর্থ্য ও তাহাকে শ্রেয়স্কর পন্থায় পরিচালিত করিতে হইলে যে প্রতিভার আবশ্যক, আশুতোষের চরিত্রে তাহার অপূর্ব্ব মিলন ঘটিয়াছিল।
আশুতোষ অসাধারণ প্রতিভা লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং এই প্রতিভা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে অকাতরে প্রয়োগ করিয়াছিলেন। তাহার ফলে আজ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জগতের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম। আশুতোষ ২৫ বৎসর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যপদে মনোনীত হয়েন এবং ১৮৮৯ সাল হইতে জীবনের শেষ দিবস (১৯২৪ খৃষ্টাব্দ, ২৫শে মে) পর্য্যন্ত এই সদস্যপদের অধিকারী ছিলেন। এই দীর্ঘকালের মধ্যে তিনি একাধিক বার ভাইস্-চান্সেলারের পদে বৃত হইয়াছিলেন। ১৯০৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকল্পে যখন আইন প্রণীত হয়, তখন তাহার জন্য যে সমিতি গঠিত হয় আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ব্যবস্থাপক-সভার সদস্যরূপে সেই সমিতির সভ্য মনোনীত হয়েন। এই আইন অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সকল নূতন বিধি (Regulations) প্রস্তুত হয়, তাহা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হইয়াছিল। ১৯০৬ হইতে ১৯১৪ সাল পর্য্যন্ত তিনি ভাইস-চান্সেলারের দায়িত্বপূর্ণ কার্য্য অসামান্য দক্ষতার সহিত সম্পাদন করেন। এই সময়ের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালর অভূতপূর্ব্ব উন্নতি লাভ করে। ১৯১৭ সালে যখন পোষ্ট্-গ্রাজুয়েট্ শিক্ষার ভার বিশ্ববিদ্যালয় নিজ হস্তে গ্রহণ করে, তখন আশুতোষের সাহস ও প্রতিষ্ঠানগঠন-নৈপুণ্যে সকলে বিস্মিত হইয়াছিল। ইহার পূর্ব্বে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ছাত্রদিগের পরীক্ষা গ্রহণ করিয়াই দায়িত্ব শোধ করিত। এখন হইতে নানা বিষয়ে সর্ব্বোচ্চ শিক্ষা প্রদান ও গবেষণার ভারও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করিল। আশুতোষের নেতৃত্বে এই বিশালায়তন নব প্রতিষ্ঠান গঠিত হইল এবং ইহার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করিবার ভারও তাঁহার সুপরিসর স্কন্ধে অর্পিত হইল।
এই ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গেই আশুতোষ ভারতের দেশীয় ভাষাগুলির পঠন-পাঠনের আয়োজন করিয়া দেশের ধন্যবাদভাজন হইলেন। ইতিপূর্ব্বে বাঙ্গালা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য অনাদৃত ছিল। কলিকাতায় যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাঙ্গালা সাহিত্য একটি অবশ্যপাঠ্য বিষয়-মধ্যে গণ্য ছিল। কিন্তু ১৮৬৮ সাল হইতে এই ব্যবস্থা উঠিয়া যায়। ইংরেজি সাহিত্যের নূতন রসাস্বাদে বিভোর বাঙ্গালী শিক্ষিত সম্প্রদায় বাঙ্গালা ভাষাকে অবজ্ঞা করিতেই শিক্ষা করিলেন! পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা লাভ করিব, পাশ্চাত্ত্য শিক্ষায় বিদ্বান্ হইব, ইহাই তখন ছিল বাঙ্গালীর চরম লক্ষ্য।
১৮৮৯ সালে সিনেটের সদস্যপদ প্রাপ্ত হইয়া অল্প দিনের মধ্যেই আশুতোষ সিণ্ডিকেটে প্রবেশ লাভ করেন। তখন হইতেই তাঁহার লক্ষ্য ছিল, কি উপায়ে পুনরায় বাঙ্গালা ভাষাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অবশ্যপাঠ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এই উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হইয়াই তিনি ১৮৯১ সালের ফ্যাকাল্টি অব আর্ট্স্ সভার একটি অধিবেশনে প্রস্তাব করেন যে, এফ. এ. এবং বি. এ. পরীক্ষায় যে সকল ছাত্র সংস্কৃত অধ্যয়ন করে, তাহাদিগকে বাঙ্গালা, হিন্দী অথবা ওড়িয়া ভাষায় এবং যাহারা পার্সী অথবা আর্বী অধ্যয়ন করে, তাহাদিগকে উর্দু ভাষায় পরীক্ষা দিতে হইবে; তিনি এই সঙ্গে আরও প্রস্তাব করেন যে, এম্. এ. পরীক্ষার্থিগণকে ইংরেজি ভাষায় রচনা লেখার সহিত উল্লিখিত ভারতীয় ভাষার কোনও একটি ভাষায়ও রচনা লিখিতে হইবে। আশুতোষের এই প্রস্তাব সভায় গৃহীত হয় নাই।
কিন্তু আশুতোষ তাঁহার সঙ্কল্পচ্যুত হইবার পাত্র নহেন। ১৮৯৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ বাঙ্গালা ভাষাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্যপাঠ্য বিষয়-মধ্যে গণ্য করিবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটে একটি অনুরোধ-প্রস্তাব পাঠাইয়া দেন। এই অনুরোধ-সম্বন্ধে ইতিকর্ত্তব্য নির্দ্ধারণ করিবার জন্য ফ্যাকাল্টি অব আর্ট্স্ কর্ত্তৃক যে কমিটি নিযুক্ত হয়, আশুতোষ সেই কমিটির অন্যতম সভ্য মনোনীত হইলেন। এই কমিটির মন্তব্য সিনেট কর্ত্তৃক গৃহীত হইল এবং স্থির হইল যে, এফ. এ. ও বি. এ. পরীক্ষায় বাঙ্গালা ও উর্দু ভাষায় রচনার পরীক্ষা গৃহীত হইবে; ছাত্রগণ এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারিলে তাঁহাদের সার্টিফিকেটে সে বিষয়ের উল্লেখ থাকিবে, তবে রচনার পরীক্ষা দেওয়া না-দেওয়া ছাত্রের ইচ্ছাধীন।
বঙ্গসাহিত্যের অকৃত্রিম বন্ধু আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১৯০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নববিধি প্রবর্ত্তিত হইল, তাহাতে বি. এ. পরীক্ষা পর্য্যন্ত বাঙ্গালা ভাষার অধ্যাপনা ও পরীক্ষা-গ্রহণের ব্যবস্থা হইয়াছিল। বঙ্গভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকের রচনার সহিত যাহাতে ছাত্রগণ পরিচয় লাভ করিতে পারে, তজ্জন্য কতকগুলি গ্রন্থ আদর্শরূপে নির্দ্দিষ্ট হইত। বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যের নিদর্শন প্রকাশিত হইয়া ছাত্রগণের পক্ষে বিভাপতি-চণ্ডীদাস প্রমুখ শ্রেষ্ঠ কবিগণের সুললিত কাব্যগাথার সহিত পরিচিত হইবার সুযোগ প্রদান করিল। এ সকলই আগুতোষের অক্লান্ত চেষ্টার ফল। অনাদৃতা, উপেক্ষিতা বঙ্গভাষার জন্য তিনি যাহা করিয়াছেন, বঙ্গবাসী চিরদিন তাহা কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করিবে।
এম্. এ. পরীক্ষায় ভারতীয় ভাষার পরীক্ষা-গ্রহণের ব্যবস্থা পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েট প্রতিষ্ঠান-গঠনের অল্পকাল পর হইতেই প্ররর্ত্তিত হইয়াছে; ইহাও আশুতোষের অন্যতম কীর্ত্তি। ইহার পূর্ব্বে দেশীয় ভাষায় সর্ব্বোচ্চ পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা ভারতের অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয় করিতে পারে নাই। এক্ষণে বঙ্গদেশের প্রায় সমস্ত কলেজেই বাঙ্গালা ভাষার অধ্যাপনার ব্যবস্থা হইয়াছে। নানা বিভাগে যাহাতে বঙ্গভাষার সম্পদ বর্দ্ধিত হয়, তাহার ব্যবস্থা হইতেছে। বঙ্গভাষার ভাগ্যে এরূপ শুভ যুগ আর কখনও আসে নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না। মনস্বী আশুতোষই এই শুভ যুগের প্রবর্ত্তক, ইহা স্মরণ না রাখিলে এই পুস্তকের অধিকাংশ স্থলের মর্ম্ম হৃদয়ঙ্গম করা যাইবে না। আশুতোষ ভগীরথের ন্যায় বঙ্গসাহিত্যের পুণ্যপ্রবাহ আপামর সাধারণের জন্য বঙ্গের সমতল ক্ষেত্রে বহাইয়া দিয়াছেন। তিনি তাঁহার উদাত্ত স্বরে বঙ্গীয় যুবকগণকে বলিতেন: ‘সর্ব্বোপরি, আপ্রাণচেষ্টায় মাতৃভাষার অনুশীলন কর; মাতৃভাষার মধ্য দিয়াই দেশের জনসাধারণের হৃদয় স্পর্শ করিতে পারিবে।’[১]
মাতৃভাষার সাহায্য ব্যতীত লোকশিক্ষার চেষ্টা ব্যর্থ, ইহা তিনি বুঝিয়াছিলেন। বঙ্গদেশে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার করিতে হইলে বঙ্গভাষার সাহায্যেই করিতে হইবে, অন্য কোনও পন্থাই নাই। এই সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করিয়াই আশুতোষ বাঙ্গালা ভাষাকে শিক্ষার বাহন করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন। সার আশুতোষের অঙ্গুলিনির্দ্দেশ অনুসরণ করিয়া বর্ত্তমানে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বঙ্গভাষা (ও অন্যান্য দেশীয় ভাষা) শিক্ষা ও পরীক্ষার বাহন হইবে, ইহা বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক স্থিরীকৃত হইয়াছে।
বঙ্গভাষার উন্নতিকল্পে যে সকল চেষ্টা হইয়াছে, তাহার প্রসঙ্গে বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের নাম পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। সাহিত্য-পরিষৎ এই সম্বন্ধে জনমতকে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে সম্মিলনের ব্যবস্থা করেন। এই সম্মিলনের নাম ‘বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলন’ রাখা হয়। বঙ্গের বাহিরেও এই সম্মিলনের অধিবেশন হইয়াছে। বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনের প্রথম অধিবেশন ১৩১৩ সালে (১৯০৬ খৃষ্টাব্দে) কাশিমবাজার রাজ-বাটীতে আহূত হয়। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। সাহিত্য-সম্মিলনের দশম অধিবেশন হয় ১৩২৩ সালে (১৯১৬ খৃষ্টাব্দে) বাঁকিপুরে! এই অধিবেশনের মূল সভাপতি ছিলেন সার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং সাহিত্য-শাখার সভাপতি-পদে বৃত হইয়াছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের দ্বাদশ অধিবেশন হয় ১৩২৬ সালে (১৯১৯ খৃষ্টাব্দে) হাওড়ায়। বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনের আদর্শে রঙ্গপুরের শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী-প্রমুখ ব্যক্তিগণের চেষ্টায় ‘উত্তরবঙ্গ সাহিত্য-সম্মিলন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৬ সালে সার আশুতোষ ইহার একটি অধিবেশনে সভাপতি হইয়াছিলেন। এই সকল অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণরূপে তিনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসে রক্ষিত হইবার যোগ্য। এই সকল সভায় ও অন্যত্র তাঁহার ওজস্বিনী বাণী বাঙ্গালীর সাহিত্য-জীবনে এক নূতন উদ্দীপনা ও প্রেরণা আনয়ন করিয়াছিল।
কৃত্তিবাস ও মাইকেল মধুসূদন বাঙ্গালীর জাতীয় কবি। ফুলিয়ায় কৃত্তিবাসের স্মৃতিমন্দিরের ভিত্তিস্থাপন-উপলক্ষে ও মাইকেলের মৃত্যুদিনের স্মৃতিবাসরে তাঁহার সমাধি-প্রাঙ্গণে সভাপতিরূপে সার আশুতোষ যে প্রাণময়ী বক্তৃতা করিয়াছিলেন, তাহাতেও বঙ্গদেশ ও বঙ্গভাষার প্রতি তাঁহার কি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল, তাহা বুঝিতে পারা যায়। কর্ম্মবহুল জীবনের বিবিধ ও বিচিত্র কার্য্যকলাপের মধ্যে আশুতোষ বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। নবযুগের কবিতা—মধুসুদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র ও বিহারীলালের অমৃতময়ী লেখনী হইতে নিঃসৃত ভাবময়ী কবিতা—তাঁহার অতিশয় আদরের বস্তু ছিল, তাই কোনও বিষয়ে কিছু বলিতে গেলেই ঐ সকল কবির বাণী তাঁহার মুখে আপনি আসিয়া জুটিত, তাঁহার কল্পনাকে আরও স্পষ্ট, ভাষাকে আরও আবেগময়ী, প্রকাশভঙ্গীকে আরও সরস ও দৃপ্ত করিয়া তুলিত। বাঙ্গালা সাহিত্যের কোন্ কোন্ সাধকের প্রভাব তাঁহার উপর পড়িয়াছিল তাহা এই ভাবে নির্ণয় করা বিশেষ কঠিন নহে।
এই যে বক্তৃতাগুলি নিবদ্ধ হইয়া ‘জাতীয় সাহিত্য’ নামে প্রকাশিত হইল, ইহার প্রত্যেক পঙ্ক্তিতে তাঁহার অতুলনীয় স্বদেশপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙ্গালা দেশ ও বাঙ্গালা সাহিত্যকে তিনি প্রাণ দিয়া ভালবাসিয়াছিলেন। এক দিকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্বেতদ্বীপের সরস্বতীর পার্শ্বে বাঙ্গালার শ্বেত শতদলবাসিনী বীণাপাণির আসন প্রতিষ্ঠিত করিয়া অভীষ্ট বর লাভ করিয়াছিলেন, অপর দিকে সাহিত্য-সম্মিলন ও অন্যান্য সভার দ্বার দিয়া বাঙ্গালী জাতিকে প্রবুদ্ধ করিতে চেষ্টা করিয়া তাঁহার দেশবাসীর হৃদয়ে আপন অটল আসন স্থাপিত করিয়াছিলেন।
বাঙ্গালী জাতির—বিশেষতঃ বাঙ্গালী ছাত্রের—প্রতি তাঁহার অপরিমেয় বিশ্বাস ছিল। এই বক্তৃতাগুলিতে ভবিষ্যতের যে উজ্জ্বল সম্মোহন চিত্র তিনি কল্পনার নেত্রে দেখিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি নিজেও মুগ্ধ হইয়াছিলেন এবং তাঁহার শ্রোতৃবৃন্দকেও মুগ্ধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহার অপ্রমেয় বিশ্বাসপূর্ণ, শ্রদ্ধাপূর্ণ ও ভবিষ্যতের আশায় বলিষ্ঠ হৃদয়ের আবেগভরা উচ্ছ্বাসে এই নিবন্ধগুলি এমনই একটি পবিত্র মাধুর্য্য ও গাম্ভীর্য্যে মণ্ডিত হইয়াছে, যাহার তুলনা বঙ্গসাহিত্যে বিরল। তাঁহার অতুলনীয় কর্ম্মশক্তি তাঁহার উচ্ছ্বাসময়ী বাণীকে এক অভিনব সার্থকতার অরুণরাগে উজ্জ্বল করিয়াছে। অন্য কোনও স্বপ্নশক্তিসম্পন্ন লোকের মুখে এই বিপুল আশার বাণী মানাইত কি না সন্দেহ।
ভাষা ও সাহিত্যের মধ্য দিয়া ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে যে একটি ঘনিষ্ঠ ভাব-গত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করা যায়, ইহা তিনি বিশ্বাস করিতেন। তাঁহার অদম্য কর্ম্মশক্তি ও অক্লান্ত সাধনার দ্বারা ভারতবর্ষে এইরূপ এক জাতীয়তার ভিত্তি সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত করিবেন, ইহাই ছিল তাঁহার ঐকান্তিক চেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্য দিয়া ভারতের জাতীয় সাহিত্যগুলিকে উন্নত করা, দেশীয় সাহিত্যের মধ্য দিয়া বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদানের সুযোগ প্রদান করা, ইহাই ছিল তাঁহার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙ্গালা সাহিত্যের সঙ্গে মারাঠী, গুজরাটী, অসমীয়, ওড়িয়া, উর্দু, প্রভৃতি ভাষার অধ্যাপনা-প্রবর্ত্তনের দ্বারা আশুতোষ তাঁহার উদ্দেশ্য কতটা সফলতার পথে লইয়া গিয়াছিলেন, তাহা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রকাশ করিবে।
- ↑ “Above all, asdulously cultivate your Vernacular, for it is through the medium of the Vernacular alone that you can hope to reach the masses of your countrymen.”
সূচীপত্র
এই লেখাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত কারণ এটি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারির পূর্বে প্রকাশিত।
লেখক ১৯৩৬ সালে মারা গেছেন, তাই এই লেখাটি সেই সমস্ত দেশে পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত যেখানে কপিরাইট লেখকের মৃত্যুর ৮০ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এই রচনাটি সেই সমস্ত দেশেও পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত হতে পারে যেখানে নিজ দেশে প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রলম্বিত কপিরাইট থাকলেও বিদেশী রচনার জন্য স্বল্প সময়ের নিয়ম প্রযোজ্য হয়।