জাতীয় সাহিত্য/মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

“সাহিত্য-কুসুমে প্রমত্ত মধুপ
বঙ্গের উজ্জ্বল রবি,
তোমার অভাবে দেশ অন্ধকার
শ্রীমধুসূদন কবি।”[]

 বন্ধুবর যোগীন্দ্রনাথ কবিভূষণ ও সমবেত সভ্যবৃন্দ, যে মহাকবির স্মৃতিবাসরে আজ আমরা সমবেত হইয়াছি, তিনি, শুধু বঙ্গের নহেন, সমগ্র ভারতবর্ষের বরণীয় ও প্রেমিক কবিশ্রেষ্ঠগণের অন্যতম ছিলেন। তাঁহার ন্যায় মহাকবির আবির্ভাবে বঙ্গদেশ চিরদিনের মত পূজনীয় হইয়া রহিয়াছে। আর তাঁহার কবিতারূপিণী মন্দার-মালায় বঙ্গভাষা আচন্দ্রদিবাকর সুশোভিত হইয়া থাকিবে। কৃত্তিবাস, কাশীদাস, রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্র প্রভৃতি মহাকবিগণের বহুযত্ন-কল্পিত কবিতা-কাননে মধুময় মধুসূদনের মধুমতী ভাব-মন্দাকিনী প্রবাহিত হইয়া বঙ্গদেশকে যেন চিরদিনের মত সরস করিয়া রাখিয়াছে। বাঙ্গালার মাটী, বাঙ্গালার জলের এমনই একটা মাহাত্ম্য, বাঙ্গালার শ্যামল শস্যক্ষেত্রের, সুনীল বনাবলীর এমনই একটা মাধুরী, এমনই একটা উন্মাদকতা যে, অতিবড় নীরস পাষাণেও এখানে নির্ঝর দেখিতে পাওয়া যায়। ইচ্ছায় হউক, অনিচ্ছায় হউক, আমরা সত্যই

“পাখীর ডাকে ঘুমিয়ে উঠি পাখীর ডাকে জেগে।”[]

  তীর্থস্থানে উপনীত হইলে যেমন হৃদয়ে কেমন একটা স্পৃহণীয় ভাবের উদয় হয়, অরুণোদয়ে নীলাম্বুরাশির বেলাভূমিতে উপবিষ্টের মনে যেমন একটা অনির্ব্বচনীয় ভাবের আবেশ হয়, সায়ংকালে পল্লী প্রান্তরে সমাসীন ব্যক্তির পশ্চাদ্‌বর্ত্তী দোয়েল-শ্যামার তানে নয়ন ও মনে যেমন একটা আনন্দময়ী জড়তার আবির্ভাব হয়, এই বাঙ্গালার পল্লীকুঞ্জে যাঁহারা গান করেন, তাঁহাদের হৃদয়ে স্বতঃই ঐরূপ ভাবাবেশ জন্মিয়া থাকে। যাঁহারা আবার ভাগ্যবান্, বিধাতার অনুগ্রহ যাঁহাদের মস্তকে বর্ষিত, তাঁহারা ঐ ভাবাবেশে আত্মোৎসর্গ করিয়া ধন্য হন, মরজীবন সার্থক করেন। দিবাবসানে, যখন পল্লীপদ-বাহিনী তটিনী কুলকুল গীতিকায় পথিকের প্রাণে কেমন একটা উদাস ভাব জাগাইয়া বহিয়া যায়, তটবর্ত্তী বটবৃক্ষের মূলে সমাসীন পথিকের হৃদয় সান্ধ্য সমীরণে যেন কেমন বিভোর হইয়া আপনার মধ্যে আপনাকে হারাইয়া ফেলে, তখন সেই আত্মবিস্মৃত ব্যক্তির অজ্ঞাতসারে হৃদয়ের সুপ্ত বীণা আপনিই অনুরণিত হইয়া উঠে। যদি তাহার চিত্তে প্রেম থাকে, যদি তাহার জন্মান্তরের পুণ্য থাকে, তবে তখন সে পাগলের মত গাহিতে থাকে,—তাহার সম্মুখবর্ত্তিনী কল্পনাময়ী প্রতিমার চিরপ্রসন্ন মুখের দিকে চাহিয়া মুদ্রিত নেত্রে বলে,—

“মধুর মুরতি তব ভরিয়ে রয়েছে ভব,
সমুখে ও মুখশশী জাগে অনিবার!
কি জানি কি ঘুমঘোরে, কি চোখে দেখেছি তোরে,
এ জনমে ভুলিতে রে পারিব না আর![]

তখন সে যুক্তকরে তাহার আদরিণী প্রতিমাকে স্তব করিতে আরম্ভ করে, কখনও ধ্যান করে, কখনও আবার দুই হাত বাড়াইয়া সেই সস্মিতবদনা জ্যোতির্ম্ময়ীকে ধরিতে যায়; সত্যই সেই করুণাময়ীর সকরুণ নয়নের দীপ্তিতে নিজেকে ডুবাইয়া দিয়া তখন ঐ ব্যক্তি কত কি বলিতে থাকে,—কখনও শোকাশ্রুতে ধরণী ভাসাইয়া দেয়, আবার প্রেমাশ্রুতে কখন-বা মরুভূমিকে অমরধামে পরিণত করে। তখন তাহার

“সে শোক-সঙ্গীত-কথা
শুনে কাঁদে তরুলতা,
তমসা আকুল হয়ে কাঁদে উভরায়।

নিরখি নন্দিনীচ্ছবি,
গদ্গদ আদিকবি,
অন্তরে করুণা-সিন্ধু উথলিয়া যায়।”[]

যথার্থই তখন সেই বিশ্বনন্দিনী প্রতিমার প্রতিনিঃশ্বাসে জগৎ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠে। ঐ সাধক-কবি তখন বুঝিতে পারেন না, বা জানিতেও পান না যে, তিনি কি করিতেছেন, কি গাহিতেছেন। তাঁহার অপ্রবুদ্ধ কণ্ঠের “মা নিষাদ” গীতিকা যে, জগতে এক নূতন ছন্দের সৃষ্টি করিবে, নূতন রাগের প্রবাহ বহাইবে, ইহার বিন্দুবিসর্গও তিনি তখন ঘুণাক্ষরে জানিতে পান না। কবি তখন পার্শ্ববর্ত্তিনী বিলাস-বিহ্বলা কমলার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া, পুরোবর্ত্তিনী করুণাময়ী বাগ্‌দেবতার দিকে অনিমেষে চাহিয়া অতৃপ্ত হৃদয়ে বলেন,

“এস মা করুণা-রাণী!
ও বিধু-বদনখানি,
হেরি হেরি আঁখি ভরি, হেরি গো আবার;
শুনে সে উদার কথা
জুড়াক মনের ব্যথা,
এস আদরিণী বাণী সমুখে আমার!
যাও লক্ষ্মী অলকায়,
যাও লক্ষ্মী অমরায়,
এস না এ যোগি-জন-তপোবনে আর!”[]

কবির তখনকার সেই উন্মাদনা-সঙ্গীত যে, কালে এক নব মন্দাকিনী প্রবাহিত করিবে, তাহা কবি বুঝিতে পারেন না।

 এমনই অপ্রবুদ্ধ ভাবে, বাঙ্গালায় অমিত্রাক্ষরের কবি মধুসূদন একদিন সঙ্গীত ধরিয়াছিলেন। আদি-কবি বাল্মীকি যখন আপনার গানে আপনিই বিমুগ্ধ ও কদাচিৎ “কি গাহিলাম” বলিয়া সংশয়িত, তখন চতুর্ম্মুখ স্বয়ং আবির্ভূত হইয়া রত্নাকরকে আশ্বস্ত করিয়া দিলেন; বলিলেন,—“ঋষিবর, তুমিই জগতের আদিকবি হইলে, অসঙ্কোচে উদাত্তকণ্ঠে রামায়ণ গান কর, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিমোহিত হইবে, তোমার গানে মর জীব অমরতার সুখ উপলব্ধি করিবে।” হায়! এ বাঙ্গালার রত্নাকর মধুসূদনের ভাগ্যে ঠিক ইহার বিপরীত ফলিয়াছিল। অথবা শুধু এ দেশে কেন, সকল দেশের মহাকবিদের ভাগ্যেই লাঞ্ছনা সমান! দুর্জ্জন সমালোচকের মর্ম্মঘাতিনী কশায় মহাকবি কীট্‌সের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হইয়াছিল![] হায়! অকালে ক্ষয়রোগে তাঁহাকে গ্রাস করিয়াছিল!

 বঙ্গের কবিতাসুন্দরীর রাতুল চরণ শৃঙ্খলিত দেখিয়া মধুসূদনের প্রাণে বাজিয়াছিল, উপাস্য দেবতার দুর্দ্দশায় ভক্তের হৃদয় ব্যথিত হইয়াছিল, তাই কাঁদিতে কাঁদিতে মধুসূদন বলিয়াছিলেন,—

“বড়ই নিষ্ঠুর আমি ভাবি তারে মনে,
লো ভাষা, পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে,
মিত্রাক্ষর রূপ বেড়ি। কত ব্যথা লাগে,
পর যবে এ নিগড় কোমল চরণে—
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে।
... ... ... ... ...
চীন-নারী-সম পদ কেন লৌহ-ফাঁসে!”[]

প্রেমে হউক, শোকে হউক, আদরে হউক, উপেক্ষায় হউক, মানুষ যখন পাগল-পারা হয়, তখন তাহার সকল বিষয়েই শৃঙ্খল ভাঙ্গিয়া যায়, সে তখন উদ্দাম ভাবে বিচরণ করিতে চায়,—তাহার সমক্ষে তখন বিশ্বের তাবৎ পদার্থই ঐহিক রীতিনীতির শৃঙ্খলা ভাঙ্গিয়া-চূরিয়া, পুরাতন সমস্ত চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া এক অতি মনোরম নবীনতায় সাজিয়া আসিয়া দাঁড়ায়।

“যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধি র্ভবতি তাদৃশী,”

এই কবি-বাক্যের তখন প্রকৃত সার্থকতা জন্মে। মহা-কবি মধুসূদন বীণাপাণির প্রেমে পাগল হইয়াছিলেন,— আপনার ইহকাল, পরকাল, সুখদুঃখ, সম্পদবিপদ, পুত্রকলত্র সমস্ত ভুলিয়া কবিতার সেবা করিয়াছিলেন, যথার্থই “ক্ষিপ্ত গ্রহের” ন্যায় দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া, কবিতাসুন্দরীর প্রেমে আকৃষ্ট হইয়া ছুটিয়াছিলেন,— একাগ্র হৃদয়ে ধ্যানে বসিয়াছিলেন,—তাঁহার সাধনায় সিদ্ধি হইয়াছে। তাঁহার “অনন্য-পরতন্ত্রা” ভারতীকে মানস সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়া, তিনি বলিয়াছিলেন,

“দুর্ম্মতি সে জন, যার মন নাহি মজে
কবিতা-অমৃত-রসে! হায়! সে দুর্ম্মতি,
পুষ্পাঞ্জলি দিয়া সদা যে জন না ভজে
ও চরণপদ্ম, পদ্ম-বাসিনি ভারতি!
কর পরিমলময় এ হিয়া-সরোজে—
তুষি যেন বিজ্ঞে, মাগো, এ মোর মিনতি।”[]

তাঁহার ‘মিনতি’ সফল হইয়াছে। শুধু ‘হিয়া’ নহে, ভারতীর করস্পর্শে তাঁহার দেহ-মন সমস্তই “পরিমলময়” হইয়াছিল, তাই তাঁহার সংস্পর্শে বঙ্গভাষা এবং বঙ্গভূমি চিরদিনের মত পরিমলময়ী হইয়া রহিয়াছে।

  বঙ্গভাষায় রাঙ্গা চরণে “মিত্রাক্ষর রূপ বেড়ি” দেখিয়া মধুসূদনের হৃদয়ে যে কি ব্যথা লাগিয়াছিল, তাহা উপরিধৃত কয় পঙ্‌ক্তি হইতেই বেশ বুঝা যায়। আমি যাঁহার সেবা করিয়া জীবন ধন্য করিব, যাঁহাকে মা বলিয়া প্রাণ শীতল করিব, কানন-প্রান্তর প্রতিধ্বনিত করিয়া যাঁহাকে ডাকিব—আমার সেই ডাকে সমগ্র গৌড়ভূমি চমকিয়া উঠিবে, আমার মাকে মা বলিয়া ডাকিবে—আমার এমন যে মা, এত সাধের, এত আদরের যে মা, তাঁহার চরণে শৃঙ্খল! পুত্র আমি, আমার সমগ্র সামর্থ্য ব্যয় করিয়া সে শৃঙ্খল ভগ্ন করিব। মা আমার উন্মুক্ত চরণে, বনকুরঙ্গীর মত স্বৈর চরণে ইতস্ততঃ বিচরণ করিবেন, আর পুত্র আমি ‘মা মা’ বলিয়া তাঁহার পশ্চাতে পশ্চাতে বেড়াইব। যদি মায়ের চরণ নিগড়-মুক্ত করিতে না পারিলাম, তবে কিসের পুত্র আমি?—কুপুত্র আমি। তাই বাণীর বরপুত্র মধুসূদন সজল-নয়নে বলিলেন,

“ছিল নাকি ভাব-ধন, কহ লো ললনে,
মনের ভাণ্ডারে তার, যে মিথ্যা সোহাগে,
ভুলাতে তোমারে দিল এ তুচ্ছ ভূষণে!
কি কাজ রঞ্জনে রাঙ্গি কমলের দলে?
নিজরূপে শশিকলা উজ্জ্বল আকাশে।”[]

লৌকিক ভাষায় অনুষ্টুপ্‌ ছন্দের প্রবর্ত্তনের ন্যায় বঙ্গভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্ত্তন করিয়া মধুসূদন বাঙ্গালা কবিতার পথ অতি সুগম করিয়া গিয়াছেন। যতদিন বঙ্গভাষা ও বাঙ্গালী জাতি থাকিবে, ততদিন তাঁহার অমিত্রাক্ষরের মধুর বীণাধ্বনি শ্রুত হইবে। অনেকের কবিতা পাঠকালেই হৃদয়ের ওজস্বিতা যেন কর্পূরের মত ক্রমে উপিয়া যায়, ক্রমে শরীর ঝিমাইতে থাকে, দেহে অহিফেনের লক্ষণ প্রকাশ পায়, আর মধুসূদনের ওজস্বিনী কবিতা পাঠ করিয়া—

“উৎসাহে বসিল রোগী শয্যার উপরে।”[১০]

 মধুসূদন চাহিতেন যে, তাঁহার স্বজাতিকে, তাঁহার চিরপ্রিয় গৌড়জনকে এমন সুধা পান করাইবেন, যাহাতে তাহারা মানুষের মত হইবে। একেই ত নানা ভাবে সকলে ক্রমে নিদ্রাবেশে আচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে, ইহার উপর আবার ঘুমের ঔষধ প্রয়োগ কেন? এখন জাগ্রত করিতে হইবে। তাই মধুর সমস্ত কবিতাতেই একটা প্রাণের অস্তিত্ব দেখিতে পাই। দেখিতে পাই, তাঁহার কবিতার সমস্তই প্রায় দেশীয় উপাদানে রচিত, তাহাতে বিদেশীয় মলা নাই। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা পাইয়াছিলেন, পাশ্চাত্ত্য জগতের ভালমন্দ সমস্তই দেখিয়াছিলেন ও শিখিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার পিতৃ-পিতামহের প্রাচ্যের প্রতিমার স্থানে কদাচ পাশ্চাত্ত্য প্রতিমা বসান নাই, জাতীয়তা বিসর্জ্জন দেন নাই। (পশ্চিম গগনের সুচারু সান্ধ্য রাগের আভায় তিনি তদীয় কবিতারাণীর ললাট মার্জ্জনা করিয়া দিয়াছেন মাত্র, কিন্তু তাঁহার প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন প্রাচীর অরুণ-রাগে।) তাই তাঁহার কবিতার বিনাশ অসম্ভব। উপবৃক্ষই কালে শুকাইয়া যায়—মূল বৃক্ষের কিছুই হয় না। সোজা কথায়, ইউরোপের নানা কারুকার্যখচিত সুন্দর ফ্রেমে তিনি ভারতীয় ছবি বাঁধাইয়াছেন। জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্পকলা দেশাত্তর হইতে গ্রহণ করা কর্ত্তব্য; কিন্তু জাতীয় কবিতাও যদি বিজাতীয় ছাঁচে ঢালাই করিতে হয়, তবে আর রহিল কি? এরূপ দুষ্কার্য্যের ফল জাতীয়তার ক্রমিক ধ্বংস।

  মহাকবি মধুসূদন সে পথে যান নাই। তিনি ইউরোপের অমিত্রাক্ষরে এ দেশের কবিতাকে সাজাইয়াছেন। তিনি গৌড়কে প্রাণময় করিতে চাহিয়াছিলেন, বঙ্গের কবিতাকে মদালসার পরিবর্ত্তে বীরাঙ্গনার ভূষায় ভূষিত করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন,—কৃতকার্য্যও হইয়াছেন। নাটকপ্রহসনাদি সম্বন্ধে তাঁহার সাফল্য তর্কের বিষয় হইলেও অমিত্রচ্ছন্দের সম্পর্কে তিনি যে নব যুগের প্রবর্ত্তন করিয়া গিয়াছেন, তাহা সর্ব্ববাদিসম্মত। মধুসূদনের পূর্বে বঙ্গভাষায় অমিত্রচ্ছন্দ অন্যভাবে কদাচিৎ পরিদৃষ্ট হইত বটে, কিন্তু তাহার কোনরূপ আকর্ষণী শক্তি ছিল না। মধুসূদনের যে কম্বুনাদে, বঙ্গসাহিত্য-গগন মুখরিত, তাহার এক ভগ্নাংশও ঐ সব প্রাণহীন কবিতায় খুঁজিয়া পাওয়া যাইত না। শুধু তাঁহার নয়নের নহে, তাঁহার কবিতার “হিরণ্ময় জ্যোতিতে”ও[১১] বাঙ্গালা ভাষা চিরদিনের মত জ্যোতিষ্মতী হইয়া রহিয়াছে। তাঁহার কার্য্যে এবং কবিতায়, উভয়ত্রই একটা উৎকট আবেগ দেখিতে পাই। কার্যক্ষেত্রে যেমন তিনি কদাচ জড়তার অধীন হইতেন না, কখনও এক ভাবে একটা বিষয় লইয়া থাকিতে পারিতেন না,—সর্ব্বদাই চাহিতেন, যাহা করিতেছেন তাহা ছাড়া আরও একটা কিছু,— কবিতার ক্ষেত্রেও তদ্রূপ। যখন যেখানে গিয়াছেন, ভালমন্দ যেমন অৱস্থাতেই পড়িয়াছেন, তাঁহার হৃদয়ের টান কিন্তু কবিতার প্রতি সর্বদাই সমান। কোন কারণে, কোন অবস্থাতেই তাহার ন্যূনতা ঘটে নাই ৷ বরঞ্চ বাহা বিশৃঙ্খলা, সাংসারিক অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে কবিতার সেবায় তিনি অধিকতররূপে নিবিষ্ট হইতে পারিতেন । আত্ম-সত্তায় তাঁহার প্রভূত বিশ্বাস ছিল, তাই যখন একটা নূতন কিছু করিতে আরম্ভ করিতেন, তখন দৃঢ়তার সহিত বন্ধু-বান্ধবকে তাহার সাফল্যের কথা বলিতেন। মাইকেল সর্ব প্রথম যখন চতুর্দশপদী কবিতা লেখেন, তখন তিনি প্রথম কবিতাটি তদীয় প্রিয় ও অকৃত্রিম সুহৃদ্রাজনারায়ণ বসুকে পাঠাইয়া লিখিয়াছিলেন:

 “What say you to this, my good friend In my humble opinion, if cultivated by men of genius, our sonnet in time would rival the Italian.”

  তাঁহার ভবিষ্যদ্বাণী তিনিই সার্থক করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার এই সনেটটি কবিভূষণ যোগীন্দ্রনাথের সুপ্রসিদ্ধ মাইকেল-জীবনীতে আমরা এইরূপ দেখিতে পাই:

কবি-মাতৃভাষা

নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন
অগণ্য ; তা সবে আমি অবহেলা করি,

অর্থলোভে দেশে দেশে করিনু ভ্রমণ,
বন্দরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী।
কাটাইনু কত কাল সুখ পরিহরি,
এই ব্রতে, যথা তপোবনে তপোধন,
অশন-শয়ন ত্যজে ইষ্টদেবে স্মরি,
তাঁহার সেবায় সদা সঁপি কায়-মন।
বঙ্গকুললক্ষ্মী মোরে নিশার স্বপনে
কহিলা, “হে বৎস, দেখি তোমার ভকতি,
সুপ্রসন্ন তব প্রতি দেবী সরস্বতী।
নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে
ভিখারী তুমি হে আজি? কহ ধনপতি!
কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ-সদনে?”

এই কবিতা-রচনার অনেক পরে মাইকেল চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী নাম দিয়া যে কবিতাগুচ্ছ প্রকাশ করেন, এইটি তাহার দ্বিতীয় কবিতা; মনে হয়, উদ্ধৃত কবিতাটি মাজিয়া-ঘষিয়া কবিবর “বঙ্গভাষা” নামে বাহির করেন; কেন-না প্রথমের কথা ভোলা বা প্রথমের মায়া ছাড়া বড়ই কঠিন।

বঙ্গভাষা

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন,
তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি,—
অনিদ্রায়, অনাহারে, সঁপি কায়মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি,—
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন!

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে,—
‘ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারি-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!’

পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষারূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।

  তিলোত্তমা-রচনার পর চতুর্দ্দশপদী কবিতায় মাইকেল হাত দেন।[১২] তিলোত্তমা অমিত্রচ্ছন্দের একপ্রকার প্রথম কাব্য। বোধ হয় বঙ্গের তদানীন্তন পণ্ডিতমণ্ডলী তিলোত্তমার প্রতি প্রথম প্রথম তত সদয় ব্যবহার করেন নাই। মাইকেল যদিও কখনও আত্মমতানুযায়ী কার্য্য করিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন নাই, বা পরের মুখাপেক্ষী হইয়া কবিতা লেখেন নাই, তবুও কিন্তু বঙ্গের নূতন ছন্দের আবিষ্কর্তা তাঁহার আদরিণী তিলোত্তমাকে অন্যে আদর করিতেছে দেখিয়া, আনন্দে বন্ধু রাজ-নারায়ণকে লিখিয়াছিলেন:

 “You will be pleased to hear that the Pandits are coming round regarding Tilot-tama. The renowned Vidyasagore has at last condescended to see 'great merit' in it, and the ‘Shome Prakash’ has spoken out in a favourable manner.”

 বঙ্গভাষার প্রধান মহাকাব্য মেঘনাদবধ প্রকাশ-বিষয়ে রাজা দিগম্বর মিত্র অর্থ সাহায্য করিবেন, এই প্রতিশ্রুতি পাইয়া, বঙ্গ-কবিকূল-কেশরী মধুসূদন নিজেকে অশেষ সৌভাগ্যশালী মনে করিয়াছিলেন। হায়! বাণীর বরপুত্রের এই সময়ের উক্তিতে নয়ন সজল হইয়া আসে। তিনি বলিয়াছিলেন,—“In this respect, I must thankfully acknowledge I am singularly fortunate. All my idle things find patrons and customers **” তাঁহার ‘idle things’ গুলি আজ বঙ্গভাষার উজ্জ্বল রত্ন, বঙ্গবাণীর কিরীটমণি এবং বাঙ্গালার তথা বাঙ্গালীর অশেষ গর্বের কারণ।

 সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাসের কাব্যাবলীর প্রত্যেকখানিই যেমন নিজের নিজের এক অতি অসাধারণ ধর্ম্মে শ্রেষ্ঠত্ব-সম্পন্ন, মধুসূদনের কবিতা-গ্রন্থগুলিরও প্রত্যেকখানি সেইরূপ এক একটি অসাধারণ ধর্ম্মে বিমণ্ডিত শ্রেষ্ঠত্ব-সম্পন্ন। সেইরূপ অসাধারণ ধর্ম্ম বাঙ্গালার অন্য কোনও কাব্যে আছে কি-না, বা কালে থাকিবে কি-না, তাহা বলিতে পারি না। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা যখন পড়ি, দ্বারকানাথের উদ্দেশে রুক্মিণীর সেই পত্র—সেই,

সরমে মায়ের পদে নারি নিবেদিতে
এ পোড়া মনের কথা। চন্দ্রকলা সখী,
তার গলা ধরি, দেব, কান্দি দিবানিশি,—
নীরবে দু'জনে কাঁদি সভয়ে বিরলে!
লইনু শরণ আজি ও-রাজীব-পদে;—
বিঘ্ন-বিনাশন তুমি, ত্রাণ বিঘ্ন মোরে।
কি ছলে ভুলাই মনঃ, কেমনে যে ধরি
ধৈরয, শুনিবে যদি, কহিব, শ্রীপতি!
বহে প্রবাহিণী এক রাজ-বন-মাঝে;
যমুনা' বলিয়া তারে সম্বোধি আদরে,
গুণনিধি, কূলে তার কত যে রোপেছি
তমাল, কদম্ব—তুমি হাসিবে শুনিলে।
পুষিয়াছি সারী-শুক, ময়ূর-ময়ূরী
কুঞ্জবনে; অলিকুল গুঞ্জরে সতত;
কুহরে কোকিল ডালে; ফোটে ফুলরাজী।
কিন্তু শোভাহীন বন প্রভুর বিহনে।
কহ কুঞ্জবিহারীরে, হে দ্বারকাপতি,

আসিতে সে কুঞ্জবনে বেণু বাজাইয়া;
কিংবা মোরে লয়ে, দেব, দেহ তাঁর পদে।”[১৩]

এই অনুপম পঙ্‌ক্তিগুলি যখন পাঠ করি, তখন যথার্থই আত্মবিস্মৃত হই, কবির অপূর্ব সৃষ্টি-চাতুর্য্য-দর্শনে, ও শব্দ-গ্রন্থনের অনুপম কৌশলে একেবারে বিমোহিত হইয়া পড়ি। তখন

“তয়া কবিতয়া কিংবা তয়া বনিতয়াপি বা।
পাদবিন্যাসমাত্রেণ মনো নাপহৃতং যয়া॥”[১৪]

অলঙ্কারিকের এই উক্তির প্রকৃত অর্থবোধ হয়। এমন সুন্দর কবিতা, সুন্দর পদ-রচনা, সুন্দর ভাবাবেশ যে ভাষায় আছে, যে ভাষায় হইতে পারে, সেই ভাষা আমার মাতৃভাষা, সেই ভাষা আমার জন্মভূমির ভাষা, আমার বাঙ্গালার ভাষা—ইহা যখন ভাবি, তখন সত্যই একটা অপূর্ব্ব শ্লাঘা অনুভব করি। যখন

“এই দেখ্‌ ফুলমালা  গাঁথিয়াছি আমি—
চিকণ গাঁথন!
দোলাইব শ্যাম-গলে, বাঁধিব বঁধুরে ছলে—
প্রেম-ফুল-ডোরে তারে করিব বন্ধন!
হ্যাদে, তোর পায়ে ধরি,   কহু না, লো, সত্য করি,
আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধা-বিনোদন?

কি কহিলি, কহ, সই,  শুনি লো আবার—
মধুর বচন।
সহসা হইনু কালা,  জুড়া এ প্রাণের জ্বালা,
আর কি এ পোড়া প্রাণ পাবে সে রতন?
মধু—যার মধুধ্বনি—  কহে, কেন কাঁদ, ধনি!
ভুলিতে কি পারে তোমা শ্রীমধুসূদন?”[১৫]


প্রভৃতি ব্রজাঙ্গনার বিষাদ-গীতিকা শ্রবণ করি, তখন এই সকল কবিতার প্রতি চরণে, প্রতি অক্ষরে, মধুধ্বনি মধুসূদনের নবনীতকল্প হৃদয়ের প্রকৃত রূপ দেখিতে পাই।

আবার—

“ কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কা’র হেন সাধ্য বল রোধে তার গতি?
দানব-নন্দিনী আমি, রক্ষঃ-কুল-বধূ;
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,—
আমি কি ডরাই, সখি! ভিখারী রাঘবে?”[১৬]


প্রমীলার এই মেঘমন্ত্রধ্বনির সহিত ব্রজাঙ্গনার ঐ মধুধ্বনি মিলাইয়া পড়িলে বুঝা যায় যে, বিধাতা কি অপূর্ব্ব উৎকটে-মধুরে, কঠোরে—কোমলে, রৌদ্রে—জ্যোৎস্নায় মধুর কল্পনা-প্রতিমার গঠন করিয়াছিলেন! কল্পনা সহচরীর ন্যায় তাঁহার অনুবর্ত্তন করিত। কোনও কল্পনার মন্দতায় বা ভাবের অল্পতায় তাঁহার কবিতার অঙ্গহানি ঘটে নাই। তাঁহার যে কোনও কবিতা যখনই পাঠ করি, দেখি তাহাতে তদীয় হৃদয়ের দৃঢ়তার একটা ছায়া যেন স্বতঃই লাগিয়া আছে। বঙ্গকাব্য-কাননে তিনি দৃপ্ত সিংহের ন্যায়, মদগর্ব্বিত নাগেন্দ্রের ন্যায় বিচরণ করিয়া গিয়াছেন,— কোথাও কদাচ কোন কারণে তিনি স্খলিত হন নাই। বিশ্বের কে কি বলিল, কে কি করিল,— যে পথে চলিয়াছি ইহাতে কোথায় কতদূরে যাইয়া পান্থশালা পাইব,—যে পাথেয় আছে তাহাতে কুলাইবে কি-না, এই সব ঐহিক হিসাবনিকাশের তিনি কোন ধারই ধারিতেন না। তাঁহার পৃথিবী এক স্বতন্ত্র বস্তু ছিল। তাঁহার পৃথিবী যথার্থ ই “নিয়তিকৃত-নিয়মরহিতা, হ্লা‌দৈকময়ী, অনন্য-পরতন্ত্রা এবং নবরসরুচিরা ”[১৭] ছিল। মহাকবি তাঁহার সেই কল্পিত জগতের কল্পনা-সাগরে নিজেকে ভাসাইয়া দিতেন, ক্ষীরোদশায়ী পুরুষোত্তমের ন্যায় নিজের ভূমায় নিজেই ডুবিয়া থাকিতেন। মধ্যে মধ্যে আনন্দালস নেত্রে স্বদেশবাসীদের দিকে চাহিয়া প্রেমভরে মধুবর্ষণ করিতেন, “যোড় করি কর, গৌড়-সুভাজনে”[১৮] কহিতেন; “শুন যত গৌড়-চূড়ামণি”—বলিয়া যে অমৃতে নিজে আত্মহারা, তাহা বিলাইবার জন্য স্বদেশবাসী ভ্রাতৃবৃন্দকে আহ্বান করিতেন।

“বিনা স্বদেশের ভাষা পূরে কি আশা?”

এই কবিবাক্য তাঁহাকে উদ্বোধিত করিয়াই যেন গন্তব্য পথ চিনাইয়া দিয়াছিল। যখন তিনি আদিকবি বাল্মীকির ন্যায় দিব্যচক্ষু পাইলেন, তখন ধ্যানভঙ্গের পর দেখিলেন, তাঁহার বড় সাধের “ মাতৃভাষারূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে ।” তদবধি কি এক উন্মাদনা তাঁহার হৃদয়ে আসন পাতিয়া বসিল; সেই উন্মাদনার অঙ্গুলিসঙ্কেতে কবিবর দিগ্‌বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া স্বকীয় স্বৈরচারিণী কল্পনাকে লইয়া ছুটিলেন।—অন্য কথা নাই, অন্য চিন্তা নাই, অন্য কার্য্য নাই,—ঐ এক ধ্যান, এক জ্ঞান। কবিভূষণ যোগীন্দ্রনাথের সঙ্কলিত মাইকেলজীবনীতে কবিবরের যে সকল পত্র মুদ্রিত হইয়াছে, তাহা পাঠ করিলে বুঝা যায় যে, মহাকবি মধুসূদনের চিত্তে দিবা-রজনী বঙ্গভাষার এবং বঙ্গকবিতার চিন্তা কিরূপ প্রকটভাব ধারণ করিয়াছিল। ঐ সকল পত্রের প্রত্যেকখানির গড়ে প্রতি ত্রিশ পঙ্‌ক্তির মধ্যে সাতাইশ পঙ্‌ক্তি কেবল বঙ্গকবিতার কথায় পূর্ণ। বিধাতা দেবদুর্লভ প্রেম-রত্নে তাঁহার হৃদয় বিমণ্ডিত করিয়াছিলেন, তাই তাঁহার সমস্তই কবিত্বময় ছিল। তিনি দেখিতেন কবিতা, শুনিতেন কবিতা, কহিতেন কবিতা। কখনও তিনি ভারত-সাগরে ডুবিয়া তিলোত্তমারূপ মুকুতা তুলিতেন ও তাহার মালা গাঁথিয়া মাতৃভাষার কমকণ্ঠে পরাইয়া দিতেন,—কখনও আবার

“গম্ভীরে বাজায়ে বীণা গাইল—কেমনে
নাশিলা সুমিত্রাসুত লঙ্কার সমরে,
দেব-দৈত্য-নরাতঙ্ক রক্ষেন্দ্র-নন্দনে;”

কখন বা—

“কল্পনা-দূতীর সাথে ভ্রমি ব্রজধামে,”

“গোপিনীর হাহাকার ধ্বনি” শুনিতেন, ও সেই “বিরহে বিহ্বলা বালার” করুণ কণ্ঠে কণ্ঠ মিশাইয়া বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের বীণায় বিরহ-সঙ্গীতের আলাপ করিতেন। কত সাগর মহাসাগর পার হইয়া দেশ-বিদেশে তিনি ঘুরিয়াছিলেন, কিন্তু ভারতের প্রতি তাঁহার কেমনই একটা আকর্ষণ ছিল যে, তিনি উদ্দাম যৌবনেও ডুব দিলেন “ ভারত-সাগরে ”— অন্য সাগরে নহে; পাশ্চাত্য কবিকুলের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়াও তিনি তিলার্দ্ধের জন্য প্রাচ্য কবিকুলের সেবা করিতে বিস্মৃত হন নাই। “কবিগুরু বাল্মীকির প্রসাদ” পাথেয় লইয়া তিনি দুর্গম কবিত্ব-কাননে প্রবেশ করিয়াছিলেন।[১৯]

 তাঁহার কবি-জীবনের দুইটি স্তর আমরা দেখিতে পাই। প্রথমটি কবির ইউরোপ-গমনের পূর্ব্ব কাল, দ্বিতীয়টি ইউরোপ-যাত্রা হইতে তাহার পরবর্ত্তী কাল। তাঁহার যে সমুদয় কাব্য-রত্নাবলীতে বঙ্গবাণী অলঙ্কৃত, সেগুলি ঐ পূর্ব্ব কালে গ্রথিত, আর হেক্টর-বধ, মায়াকানন এবং কবিতামালা [২০]তাঁহার ইউরোপ হইতে প্রত্যাগমনের পর লিখিত। ইহাতে বেশ দেখা যায় যে, যে শক্তি থাকায় তিনি পূর্ব্বে “ভারত-সাগরে” ডুবিয়া রত্ন তুলিতে পারিয়াছিলেন, ভারত-সাগরের পারে যাইয়া তাঁহার সে শক্তির তিনি উপচয় করিতে পারেন নাই—প্রত্যুত অপচয়ই ঘটিয়াছিল। যদিও চতুর্দ্দশপদী কবিতার প্রকাশ ফরাসীর ভার্‌সেল্‌স নগরে, কিন্তু তাহার জন্মগ্রহণ এই ভারতবর্ষে। রাজনারায়ণবাবুর নিকট কবি নিজেই সে কথা ব্যক্ত করিয়া দিয়াছেন। তিনি যখন ইউরোপে গমন করেন, তখন তাঁহার ঐ প্রথম সনেট্‌টি সঙ্গে লইয়া গিয়াছিলেন, নতুবা রাজনারায়ণবাবুর নিকট লিখিত সেই সনেট্ আমরা বর্ত্তমান চতুর্দ্দশপদী কবিতাপুস্তকে ঐরূপ সংশোধিত আকারে দেখিতে পাইতাম না। তিনি ইউরোপে যাইয়া বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, যে উদ্দেশ্যে তিনি গিয়াছিলেন, তাহার সুসিদ্ধি লাভ করিতে পারিবেন না। তিনি আইন-কানুন যাহাই পড়ুন বা যাহাই করুন না-কেন, প্রাণ কিন্তু তাঁহার সর্ব্বদাই মাতৃভাষার জন্য কাঁদিত। তিনি নিজেই কাঁদিতে কাঁদিতে বলিয়াছেন,—

“পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি,—

অনিদ্রায়, অনাহারে, সঁপি কায়মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি,—”[২১]

বাহ্যতঃ মধুসূদন ইউরোপে ছিলেন, কিন্তু অন্তর তাঁহার ভারতে—বিশেষতঃ বঙ্গে পড়িয়াছিল। কবে বাঙ্গালায় শ্রীপঞ্চমী, কবে শরতে সারদার অর্চ্চনা, কবে বিজয়াদশমী, কপোতাক্ষ নদ কেমন কুল কুল করিয়া বহিয়া যায়, কোন্ ঘাটে ভাগ্যবান্ ঈশ্বরী পাট্‌নী খেয়া দিয়া ছিল,—সুদূর ফরাসীদেশে বসিয়া—বিলাসের তরঙ্গে যে দেশ প্লাবিত-প্রায় সেই স্থানে বসিয়া—তিনি বঙ্গের এই সমুদয় সুখস্মৃতি মনে জাগাইতেন, ও না-জানি কত আনন্দই পাইতেন! বাঙ্গালার মেঘমুক্ত শারদাকাশে সায়ংকালের তারা যে কত সুন্দর, তাহা তিনি ভার্‌সেল্‌সে বসিয়া কল্পনা-নেত্রে দেখিতে পাইতেন। জন্মভূমি যশোর সাগরদাঁড়ীর অনতিদূরে নদীতীরে বটবৃক্ষতলে শিবমন্দির নিশাকালে পর্য্যটকের মনে যে কি ভাব জাগাইত, কেমন একটা ঘুমে নয়ন ছাইয়া আসিত, সে সমুদয় তিনি সাগরপারে থাকিয়াও অনুভব করিতে পারিতেন। ফলতঃ তাঁহার হৃদয় যথার্থই মধুময় ছিল। “বাংলার ফুল, বাংলার ফলে,—বাংলার মাটী, বাংলার জলে ”[২২] তাঁহার অন্তর-বাহির ভরপূর হইয়া গিয়াছিল। ফরাসীদেশে বসিয়া তিনি যমুনার কথা ভাবিয়া অশ্রুবিসর্জ্জন করিতেন:

“আর কি কাঁদে লো, নদি, তোর তীরে বসি,
মথুরার পানে চেয়ে ব্রজের সুন্দরী?
আর কি পড়ে লো এবে তোর তীরে খসি
অশ্রুধারা মুকুতার কমরূপ ধরি?”[২৩]

বলিয়া তাঁহার মধুর বাঁশরী বাজাইতেন। কতকাল হইল বঙ্গের কবিকুঞ্জ মধুহীন হইয়াছে, কিন্তু অদ্যাপি যেন সে বাঁশীর সুর বাঙ্গালার বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। ‘শ্যামা’ বঙ্গভূমিকে লক্ষ্য করিয়া মধুসূদন বলিয়াছিলেন—

“মধুহীন করো নাক তব মন-কোকনদে।”

তাঁহার সে প্রার্থনা সফল হইয়াছে। বঙ্গভূমি বক্ষের উপর মধুর স্মৃতি ধারণ করিয়া রাখিয়াছেন। যত দিনের পর দিন যাইতেছে, ততই মধুর মধুর কবিতার রসে বঙ্গ অধিকতররূপে নিমগ্ন হইতেছে।

 সভ্যবৃন্দ, কৃত্তিবাস কাশীদাসের দেশে, রামপ্রসাদ ভারতচন্দ্রের দেশে, জয়দেব মুকুন্দরাম চণ্ডীদাস জ্ঞানদাসের দেশে মধুসূদনের জন্ম; যে দেশের নির্ম্মল আকাশে বলাকার খেলা, শ্যামল বনানীতে শ্যামা দোয়েলের সঙ্গীত, সুনীল তটিনীতে দাঁড়িমাঝিদের সারিগান, সেই দেশে মধুসূদনের জন্ম; যেখানে সায়ংকালে নদীতীরে বটবৃক্ষের মূলে বসিয়া রাখাল বালক

“হরি, বেলা গেল সন্ধ্যা হল’ পার কর আমারে—”

বলিয়া গান ধরে, নদীর কুল কুল গীতিকার সহিত সেই রাখাল-সঙ্গীত মিশিয়া ভাসিতে ভাসিতে ক্রমে মিলাইয়া যায়,—মধুর সেই দেশে জন্ম; তাহার উপর আবার সম্ভ্রান্ত বংশের অবতংস, ধনে মানে কুলে শীলে সর্ব্বাংশে তদানীন্তন সমাজে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। সকল রকমেই স্পৃহণীয় অবস্থায় অভিজাত ও অবস্থাপন্ন পিতামাতার আদরের পুত্ত্র মধুসূদন পরিবর্দ্ধিত। সর্ব্বোপরি, বিধাতার শুভাশীর্ব্বাদে বাগ্‌দেবতার কৃপামৃত তাঁহার উপর বর্ষিত। রাজরাজেশ্বরের অক্ষয় ভাণ্ডারেও যে রত্ন নাই, শত শত সাম্রাজ্য-বিনিময়ে যে রত্ন লাভ করা যায় না, সেই সর্ব্বোত্তম কবিত্ব-রত্নের অম্লান মালা বীণাপাণি স্বহস্তে তাঁহার কণ্ঠে পরাইয়া দিয়াছিলেন,—সুতরাং তাঁহার সমকক্ষ কে?

 শুভক্ষণে মধুসূদন ভক্তি-গদ্‌গদ কণ্ঠে বাগ্‌দেবতার চরণে প্রার্থনা করিয়াছিলেন—

“...........অতি মন্দমতি
আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে
ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিলা আসিয়া
বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন)
... ... ... ... ...
তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি!
... ... ... ... ...
হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর

কাব্যরত্নাকর কবি!.........
.........ঊর তবে, ঊর দয়াময়ি,
বিশ্বরমে! গাইব, মা! বীররসে ভাসি
মহাগীত; ঊরি দাসে দেহ পদচ্ছায়া।”[২৪]

 মধুসূদনের প্রার্থনায় বীণাপাণি প্রসন্ন হইয়াছিলেন। মায়ের বীণায় পুত্ত্র স্বরসংযোগ করিতে পাইয়াছিল। পুত্ত্রের জীবন সার্থক হইয়াছে। আর সেই সঙ্গে তদ্দেশবাসী বলিয়া এবং সেই কবি যে ভাষার দিবাকর-কল্প, সেই ভাষার সেবক বলিয়া আমরাও ধন্য ও কৃতকৃতার্থ হইয়াছি। তাঁহার বিরচিত মধুচক্রে গৌড়জন দিবা-রজনী আনন্দে মধুপান করিতেছে ও করিবে । বঙ্গভাষাকে তিনি যে অনর্ঘ সম্পদে সাজাইয়া গিয়াছেন, যে “কাঞ্চনকঞ্চুক-বিভায়” বঙ্গভাষাকে উদ্ভাসিত করিয়া গিয়াছেন, তাহার মহিমা কোনও দিন ক্ষুণ্ণ হইবে না। বঙ্গকবিতাসাম্রাজ্যে তিনি সম্রাটের ন্যায় আসিয়াছিলেন, সম্রাট্‌জননীর যেমন হওয়া উচিত, তেমনি ভাবে, বুঝি-বা ততোধিক রূপে, বঙ্গভাষাকে সাজাইয়া গিয়াছেন । কালের নিরঙ্কুশ বিধানে কত-কি ভাঙ্গিবে-গড়িবে, কিন্তু মধুসূদনের কবিত্ব-প্রতিমার জ্যোতি দিন দিন আরও বর্দ্ধিত হইবে বই ম্লান হইবে না। মধুসূদনের জন্মে বঙ্গভাষার ও বঙ্গদেশের মর্য্যাদাবৃদ্ধি হইয়াছে; আর তাঁহার ন্যায় একজন জাতীয় মহাকবিকে বৎসরান্তে অন্ততঃ একটি দিনও আমরা পূজা করিতে আসি বলিয়া আমরাও ধন্য হইতেছি।

 আহা!

“বঙ্গভাষা সুললিত কুসুম-কাননে
কত লীলা করি,
কাঁদাইয়া গৌড়জন,  সে কবি মধুসূদন
গিয়াছে,—বঙ্গের মধু বঙ্গ-পরিহরি।

যাও তবে কবিবর, কীর্ত্তিরথে চড়ি,
বঙ্গ আঁধারিয়া;
যথায় বাল্মীকি ব্যাস,  কৃত্তিবাস কালিদাস,—
রহিয়াছে সিংহাসন তোমার লাগিয়া।

যে অনন্ত মধুচক্র রেখেছ রচিয়া
কবিতা-ভাণ্ডারে,
অনন্ত কালের তরে,  গৌড়মন-মধুকরে
পান করি, করিবেক যশস্বী তোমারে।”[২৫]






  1. ৩৫ মধুসূদনের মৃত্যুর পরে লিখিত হেমচন্দ্রের “স্বর্গারোহণ”।
  2. ৩৬ দ্বিজেন্দ্রলালের “ধন-ধান্য-পুষ্পে ভরা” হইতে।
  3. ৩৭ বিহারীলালের সারদামঙ্গল, উপহার।
  4. ৩৮ বিহারীলালের সারদামঙ্গল, প্রথম সর্গ, ১৭।
  5. ৩৯ বিহারীলালের সারদামঙ্গল, প্রথম সর্গ ২০।
  6. ৪০ বর্ত্তমান কালে সমালোচকেরা এ বিষয়ে একমত নহেন।
  7. ৪১ চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী—মিত্রাক্ষর।
  8. ৪২ চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী— কবিতা।
  9. ৪৩ চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী— মিত্রাহার।
  10. ৪৪ নবীনচন্দ্র সেন।
  11. ৪৫ ‘হিরণ্ময়েন জ্যোতিষা সত্যস্যাপাবৃতং মুখম্’ তুলনীয়।
  12. ৪৬ তিলোত্তমাসম্ভব ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়; কবিমাতৃভাষা ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত। চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলীর অন্যান্য কবিতা ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ইউরোপে রচিত।
  13. ৪৭ বীরাঙ্গনা-কাব্য, তৃতীয় সর্গ।
  14. ৪৮ সে কবিতায় বা সে বনিতায় কি কাজ, যাহার পদবিন্যাস মাত্রে মন মুগ্ধ না হয়?
  15. ৪৯ ব্রজাঙ্গনা—সখী।
  16. ৫০ মেঘনাদবধ-কাব্য, তৃতীয় সর্গ।
  17. ৫১ কাব্যপ্রকাশের প্রথম শ্লোক—কবির বাণীর বর্ণনা।
  18. ৫২ চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী—উপক্রম।
  19. ৫৩ উপরের উদ্ধৃত অংশগুলি প্রায় সকলই উপক্রম কবিতা (চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী) হইতে গৃহীত।
  20. ৫৪ কবিতামালা—অসম্পূর্ণ স্কুলপাঠ্য কবিতাবলী।
  21. ৫৫ চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী—বঙ্গভাষা।
  22. ৫৬ রবীন্দ্রনাথের গান।
  23. ৫৭ চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী—ব্রজবৃত্তান্ত।
  24. ৫৮ মেঘনাদবধ, প্রথম সর্গ।
  25. ৫৯ নবীনচন্দ্র সেন।