জীবনচরিত/টামস জেঙ্কিন্স

টামস জেঙ্কিন্স।


 এক্ষণে আমরা এমন এক অদ্ভুত ব্যাপার লিখিতে প্রবৃত্ত হইতেছি যে তাহা দূরদেশ বা অতীত কালে ঘটিলে তাহাতে বিশ্বাস জন্মাইবার সম্ভাবনা ছিল না; এবং বোধ হয় উক্ত হেতুবশতঃ আমরা এ বিষয় লিপিবদ্ধ ও প্রচা- রিত করিতে উদ্যত হইতাম না। কিন্তু বর্ণনীয় বিষয় অত্যন্ত সন্নিহিত দেশে ও সন্নিহিত কালে ঘটিয়াছে। অতএব কোন অংশ অপ্রমাণিক বোধ হইলে অনায়াসে প্রামাণ্য সংস্থাপন করা যাইতে পারিবে; এই নিমিত্ত আমরা অসঙ্কুচিত চিত্তে এ বিষয় প্রচার করিতেছি।

 টামস জেঙ্কিন্স আফ্রিকাদেশীয় কোন রাজার পুত্র। তাহার আকার কাফরির সমুদায় লক্ষণোপেত ছিল। তাঁহার পিতা বহ্বায়ত গিনি উপকূলের অন্তর্গত লিটিল কেপ মৌণ্ট সংজ্ঞিত স্থান ও তৎপূর্ব্ববর্তী জনপদের অনেকাংশের অধিপতি ছিলেন। এই উপকূলে ব্রিটে- নীয় সাংযাত্রিকেরা দাস ক্রয়ার্থ সর্ব্বদা গতায়াত করিত। কাফরিরাজ শরীরগত কোন বৈলক্ষণ্য প্রযুক্ত ব্রিটেনীয় নাবিকদিগের নিকট কুক্কুটাক্ষ নামে বিখ্যাত ছিলেন। উয়ুরোপীয়েরা সভ্যতা ও বিদ্যার প্রভাবে বাণিজ্য বিষয়ে কাফরি জাতি অপেক্ষা অনেক উৎকৃষ্ট ইহা প্রত্যক্ষ করিয়া তিনি আপন জ্যেষ্ঠ পুত্রকে বিদ্যানুশীলনার্থে ব্রিটনে পাঠাইবার নিশ্চয় করিলেন। স্কটলণ্ডের অন্তর্গত হাউয়িক প্রদেশীয় কাপ্তেন স্বানষ্টন এই উপকূলে আসিয়া হস্তিদন্ত, স্বর্ণরেণু প্রভৃতি ক্রয় করিতেন। কাফরিরাজ তাঁহার সহিত এই নিয়ম স্থির করিলেন যে আপনি আমার পুত্রকে স্বদেশে লইয়া গিয়া কতিপয় বৎসরে সুশিক্ষিত করিয়া আনিয়া দিবেন; তাহা হইলে আমি এতদ্দেশোৎপন্ন পণ্য বিষয়ে আপনার পক্ষে বিশেষ বিবেচনা করিব।

 এই বালক যে প্রকারে স্বনিষ্টনের হস্তে ন্যস্ত হইলেন তাহা তাঁহার অন্তঃকরণে কিছু কিছু জাগরূক ছিল। প্রস্থান দিবসে তাঁহার পিতামাতা কতিপয় কৃষ্ণকায় মহামাত্র সমভিব্যাহারে উপকূল সন্নিহিত এক উন্নত হরিত প্রদেশের প্রান্তভাগে উপস্থিত হইলেন। বালক যথাবিধানে পোতবণিকের হস্তে সমর্পিত হইলেন। তাঁহার জননী রোদন করিতে লাগিলেন। স্বানষ্টন ধর্ম্মপ্রমাণ অঙ্গীকার করিলেন আপনাদিগের পুত্র যত পারেন তত বিদ্যা শিখাইয়া কতিপয় বৎসরের পর আনিয়া দিব। অনন্তর ঐ বালক পোতপরি আনীত হইলেন এবং পোতপতি যদৃচ্ছা ক্রমে তাহার নাম টামস জেন্সি রাখিলেন।

 স্বানষ্টন, জেন্সিকে হাউয়িকে আনয়ন করিয়া আপন প্রতিজ্ঞা পরিপালনের যথোচিত উপায় দেখিতেছেন এমন সময়ে দুর্দ্দৈববশতঃ কাল গ্রাসে পতিত হইলেন। এরূপ দুর্দৈব ঘটিলে কি হইবে তাহার কোন প্রতিবিধান করা না থাকাতে জেস্কিন্সের কেবল বিদ্যা শিক্ষারই প্রতিবন্ধ উপস্থিত হইল এমন নহে গ্রাসাচ্ছাদনাদিরূপ অত্যন্ত আবশ্যক বিষয়েও যৎপরোনাস্তি ক্লেশ হইতে লাগিল। হাউয়িকে টৌন ইন নামক পান্থনিবাসের অন্তর্গত এক গৃহে স্বানষ্টনের প্রাণত্যাগ হয়। তথায় জেকিন্স স্কটদেশীয় দুরন্ত হেমন্তের শীতে ম্রিয়মাণ হইয়াও সাধ্যানুসারে তাঁহার শুশ্রুষা করিতে ক্রটি করেন নাই। স্বানষ্টনের মৃত্যুর পর তিনি শীতে কি পর্যন্ত ক্লেশ পাইয়াছিলেন তাহা বর্ণনাতীত। পরিশেষে সেই স্থানের অধিকারিণী বিবি ব্রৌন রন্ধনাগারের রাশীকৃত প্রজ্বলিত জুলনসন্নিধানে তাঁহাকে আনয়ন করিলেন। সমুদায় বাটীর মধ্যে কেবল ঐ স্থানই তাহার সচ্ছান্দাবাসের যোগ্য ছিল। তিনি বিবি ব্রৌনের এই দয়ার কার্য চিরকাল স্মরণ করিতেন।

 জেকিন্স সেই পান্থনিবাসে কিয়ৎকাল অবস্থিতি করিলেন। পরে মৃত স্বানষ্টর্নের অতি নিকট কুটুম্ব টিবিয়টহেডবাসী এক কৃষক তদীয় সমস্ত ভার গ্রহণ পূর্ব্বক তাঁহাকে স্বীয় আবাসে আনয়ন করিলেন। তথায় তিনি শূকরশাবক ও হংস কুক্কুটাদি গ্রাম্য বিহঙ্গম গণের রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি নিকৃষ্ট কর্ম্ম করিতে লাগিলেন। পান্থনিবাস হইতে প্রস্থান কালে তিনি কোন রূপে ইঙ্গরেজীর এক বর্ণও বুঝিতে পারিতেন না। কিন্তু এখানে আসিয়া অতি ত্বরায় সেই প্রদেশের প্রচলিত ভাষা উচ্চারণের সমুদায় নিয়ম সহিত শিক্ষা করিয়াছিলেন। ল-র বাটীতে যে কয়েক বৎসর অবস্থিতি করিয়াছিলেন তন্মধ্যে কিছুকাল রাখালের কর্ম্ম করেন। তৎপরে এক প্রকার তৃণ শকটপুর্ণ করিয়া হাউয়িকে বিক্রয় করিতে লইয়া যাইতেন। এই কর্ম্ম এমন উত্তমরূপে নির্ব্বাহ করিতেন যে গৃহস্বামী তাহার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন।

 জেকিন্স দৃঢ়কায় হইলে পর, ফলনাসনিবাসী লেডল। নামক এক ব্যক্তি কোন অনির্ণীত হেতু বশতঃ তাঁহার প্রতি সদয় হইয়া সেই গৃহস্বামীর নিকট প্রার্থনাপূর্ব্বক আপন বাটীতে আনিয়া রাখিলেন। কৃষ্ণকায় জেকিন্স ফলনাসে আসিয়া সকল কর্মই করিতে লাগিলেন; কখন রাখাল হইতেন,কখন বা মন্দুরায় কর্ম্ম করিতেন; ফলতঃ তিনি কর্ম্মমাত্রেই হস্তার্পণ করিতে পারিতেন। তাঁহার বিশেষ কর্ম্ম এই নির্দিষ্ট ছিল যে, সর্ব্বপ্রকার সংবাদ লইয়া হাউয়িকে যাইতে হইত। অত্যন্ত মেধা থাকাতে তিনি এই কর্ম্মে বিশেষ উপযুক্ত ছিলেন। অনন্তর তিনি ঐ লেডলার এক জন প্রকৃত কৃষাণ হইয়া উঠিলেন।

 এই সময়েই বিদ্যা শিক্ষা বিষয়ে তাঁহার প্রথম অনুরাগ জমে। তিনি প্রথম কিরূপে শিক্ষা করিয়াছিলেন সে বিষয় জ্ঞাত নহে। বোধ হয় এই বালকের বিদ্যা শিক্ষা বিষয়ে অবশ্যকর্ত্তব্যতা বোধ ছিল; এবং এইরূপ দুরবস্থায় যত দূর হইতে পারে পিতার মানস পূর্ণ করিবার নিমিত্ত তিনি নিতান্ত উৎসুক ছিলেন। ইহা সম্ভব বোধ হইতেছে লেড়লার সন্তানদিগের অথবা তাঁহার গৃহদাসী দিগের নিকট শিক্ষা আরম্ভ করেন।

 লেডলা অতি অল্প দিন মধ্যেই জেঙ্কিন্সকে বর্ত্তিকার শেষ গ্রহণে বিশেষ ব্যগ্র দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। জেঙ্কিন্স দশা ও বসার অবশেষ সম্মুখে দেখিলেই তৎক্ষণাৎ তাহা লইয়া মন্দুরার উপরিমঞ্চে লুকাইয়া রাখিতেন। এই সকল লইয়া তিনি কি করেন এ বিষয়ে সকলের অন্তঃকরণে নানা সন্দেহ উপস্থিত হইতে লাগিল। ত্বরায় তত্রত্যলোক সকল কৌতুহলপরতন্ত্র হইয়া,জেঙ্কিন্স বাসায় গিয়া কি করেন, এই বিষয়ে অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু সকলেই দেখিয়া চমৎকৃত হইল যে ঐ দীন বালক এক পুস্তক ও প্রস্তরফলক লইয়া অক্ষর লিখিতে অভ্যাস করিতেছেন। দৃষ্ট হইল একটি পুরাতন বীণাষন্ত্রও তাঁহার নিকটে আছে। ঐ যন্ত্রের জন্যে অধঃস্থিত অশ্বদিগকে বহুসংখ্যক রাত্রি অসুখে যাপন করিতে হইত।

 এই রূপে বিদ্যানুশীলনে তাঁহার অনুরাগ প্রকাশ হওয়াতে লেডলা তাঁহাকে কোন প্রতিবেশিসংস্থাপিত বৈকালিক পাঠশালায় অধ্যয়ন করিতে অনুমতি দিলেন। তিনি তথায় অল্প দিন মধ্যে এমন বিদ্যোপার্জ্জন করিলেন যে সেই প্রদেশের সমুদায় লোক শুনিয়া চমৎকৃত হইল। যেহেতু কখন কাহারও বোধ ছিল না যে কাফ্রিজাতি কোন কালে বিদ্যার্থী হইতে পারে। যাহা হউক, যদিও তাঁহাকে লেডলার ক্ষেত্রসংক্রান্ত নীচ কর্ম্মেই নিয়ত ব্যাপৃত থাকিতে হইত,তথাপি তিনি অবকাশমতে ক্রমে ক্রমে বিনা সাহায্যে আপনা আপনি লাটিন ও গ্রীক অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করিলেন।

 এক বালকের সহিত তাঁহার বন্ধুতা ছিল। সেই বালক উক্ত ভাষাদ্বয়ের অধ্যয়নার্থ যে যে পুস্তক আবশ্যক তাহা তাহাকে পাঠ করিতে দিতেন। আমরা যে সকল বৃত্তান্ত লিখিতেছি ঐ বালক বন্ধুই অধিক বয়সে তৎ সমুদায় আমাদের নিকট প্রেরণ করেন। লেডলার স্ত্রী পুরুষে তাঁহার ইষ্টসিদ্ধি বিষয়ে যথাশক্তি আনুকুল্য করিয়াছিলেন; কিন্তু নিকটে লাটিন ও গ্রীক শিক্ষার বিদ্যালয় না থাকাতে তাঁহারা তাঁহার প্রকৃত রূপে শিক্ষা করিবার সদুপায় ও সুযোগ করিয়া দিতে পারেন নাই।

 অনেকেই অনেক বার প্রত্যক্ষ করিয়াছেন যে লেডলারা স্ত্রীপুরুষে তাঁহার প্রতি যে সৌজন্য দর্শাইয়াছিলেন স্বমুখে তাহা বর্ণন করিতে তাঁহার হৃদয়কন্দর কৃতজ্ঞতা প্রবাহে উজ্জ্বলিত ও নয়নদ্বয় বিগলিত বাষ্প সলিলে প্লাবিত হইত। কিয়দ্দিন পরে লাটিন ও গ্রীক ভাষাতে এক প্রকার বোধাধিকার জন্মিলে, তিনি গণিত বিদ্যার অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হইলেন।

 জেঙ্কিন্স যে এক গ্রীক অভিধান ক্রয় করেন তাহা তাঁহার জীবনচরিতের মধ্যে একটা প্রধান ব্যাপার বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে। হাউয়িকে কতকগুলি পুস্তক বিক্রয় হইবে শুনিয়া, তিনি পূর্ব্বনির্দিষ্ট বয়স্যের সহিত তথায় গমন করিলেন। তিনি যে বেতন পাইতেন তাহার মধ্যে ছয় টাকা বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন। আর তাঁহার সহচরও স্বীকার করিলেন যদি কোন বিশেষ পুস্তক ক্রয় করিবার নিমিত্ত আর কিছু আবশ্যক হয় আমারও বার অনা সংস্থান আছে দিতে পারিব। এক্ষণে অধ্যয়ন বিষয়ে গ্রীকভাষার অভিধান অত্যন্ত উপযোগী জ্ঞান করিয়া বিক্রয় অবসরে জেঙ্কিন্স তাহার মূল্য ডাকিতে আরম্ভ করিলেন। যে পুস্তক কেবল বহুজ্ঞ বিদ্যার্থীর প্রয়োজনোপযোগী, অতি হীনবেশ এক জন কাফরিকে তৎক্রয়ার্থ প্রতিযোগিতা করিতে দেখিয়া,ব্যক্তিমাত্রেই বিস্ময়াপন্ন হইলেন।

 মনক্রিফ নামক এক ব্যক্তির জেঙ্কিন্সের সহচরের সহিত আলাপ ছিল। তিনি ইঙ্গিত দ্বারা তাঁহাকে আহ্বন করিয়া কৌতুকাকুলিত চিত্তে এই অদ্ভুত ব্যাপারের রহস্য জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। বালক সবিশেষ সমুদায় নিবেদন করিলেন। তখন মনক্রিফ তাঁহাদের ছয় টাকা বার আনা মাত্র সংস্থান অবগত হইয়া কহিলেন তোমার যত দূর পর্য্যন্ত ইচ্ছা হয় মূল্য ডাকিবে। যাহা অকুলান পড়িবে আমি তাহার দায়ী রহিলাম।

 জেঙ্কিন্স, মনক্রিফ মহাশয়ের এই সানুগ্রহ প্রস্তাবের বিষয় অবগত ছিলেন না; সুতরাং তিনি আপনাদের সঙ্গতি পর্যন্ত ডাকিয়া নিরাশ হইয়া বিষন্ন বদনে ক্ষান্ত হইবামাত্র, তাঁহার সহচর মূল্য ডাকিতে লাগিলেন। দীন কাফ্রিবালক তদ্দর্শনে অতিশয় ব্যাকুল হইয়া কহিলেন বয়স্য! কি কর তুমি ত জান আমাদিগের এত মূল্য ও শুল্ক উভয় দিবার সংস্থান নাই। কিন্তু ঐ বালক তাঁহার সেই নিষেধ না মানিয়া পুস্তক ক্রয় করিলেন এবং তৎক্ষণাৎ হৃষ্টচিত্তে বন্ধুহস্তে সমর্পণ করিয়া তাঁহার ক্ষোভ নিবারণ করিলেন। মনক্রিফ মহাশয়কে এ বিষয়ে কেবল আট আনা মাত্র সাহায্য করিতে হইয়াছিল। জেঙ্কিন্স আহ্লাদ সাগরে মগ্ন হইয়া পুস্তক লইয়া প্রত্যাগমন করিলেন। অনন্তর তিনি যে উহা সার্থক করিয়া ছিলেন তদুল্লেখ বাহুল্য মাত্র।

 এক্ষণে ইহা জিজ্ঞাস্য হইতে পারে যে কাফ্রি জাতির বুদ্ধির অদ্ভুত আদর্শস্বরূপ সেই সুবোধ বালকের স্বভাৰ ও চরিত্র কিরূপ ছিল। ইহাতে আমরা একবারেই এই উত্তর দিতে পারি যত উৎকৃষ্ট হইতে পারে। জেস্কিন্স বিনীত নিরহঙ্কৃত ও দুষ্ক্রিয়াসক্তিশূন্য ছিলেন। তাঁহার আচরণ এমন অসামান্য সৌজন্য ব্যঞ্জক ছিল যে,পরিচিত ব্যক্তিমাত্রেই তাঁহার প্রতি স্নেহ ও অনুগ্রহ করিতেন। ফলতঃ, সমুদায় উচ্চ টিবিয়টহেড প্রদেশে অতিমাত্র লোকরঞ্জন বলিয়া যাঁহারা বিখ্যাত, ইনি তন্মধ্যে পরিগণিত ছিলেন।

 তিনি আপন কার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ে কিঞ্চিম্মাত্রও আলস্য বা ঔদাস্য করিতেন না। এই নিমিত্ত তাঁহার নিযোগ্যেরা অত্যন্ত সমাদর করিতেন এবং জ্ঞানোপার্জ্জন বিষয়ে তাঁহার অদৃষ্টপূর্ব্ব উৎসাহ দর্শনে ব্যক্তিমাত্রেই মুগ্ধ ছিলেন। তাঁহার স্বদেশ ভাষার বিন্দুবিসর্গও মনে না থাকাতে স্কটলণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলের সামান্য কৃষকদিগের সহিত শরীরের বর্ণ ব্যক্তিরিক্ত কোন বিষয়েই বিভিন্নতা ছিল না। কিন্তু এই মাত্র বিশেষ যে তিনি তাহাদিগের প্রায় সকল অপেক্ষা সমধিক বিদ্যাসম্পন্ন ছিলেন এবং বিদ্যানুশীলন দ্বারা সময় যাপন করিতেন। খৃষ্টোপদিষ্ট ধর্ম্মে তাঁহার দ্রঢ়ীয়সী শ্রদ্ধা ছিল এবং ধর্ম্মসংক্রান্ত প্রত্যেক বিধি প্রতিপালনে তিনি অত্যন্ত অবহিত ছিলেন। সমুদায় পর্য্যালোচনা করিলে বোধ হয় জেঙ্কিন্স অত্যুৎকৃষ্ট উপাদানে নির্ম্মিত। আর তিনি বিদ্যালাভের নিমিত্ত যে অশেষ প্রকার প্রয়াস পাইয়াছিলেন তাহা গণনা না করিলেও সর্ব্বত্র আদৃত ও প্রিয় হইতেন, সন্দেহ নাই।

 জেঙ্কিন্সের বিংশতিবর্ষ বয়ঃক্রম কালে টিবিয়ট হেডের পাঠশালায় শিক্ষকের পদ শূন্য হয়। উক্ত কৃষকবহুল জনপদের নিবাসিগণের শিক্ষার্থে যে পাঠশালা ছিল ইহা তাহার শাখা স্বরূপ। এই বিষয়ে জেটবর্গের যাজকগণের উপর এই ভারার্পণ হইল যে তাঁহারা কোন এক দিন হাউয়িকে সমাগত হইয়া কর্ম্মাকাঙ্ক্ষীদিগের পরীক্ষা করিয়া অধ্যক্ষবর্গের নিকট বিজ্ঞাপনী প্রেরণ করিবেন। পরীক্ষা দিবসে ফলনাসের কৃষ্ণকায় কৃষকও পুস্তকরাশি কক্ষে করিয়া অতি হীনবেশে তথায় উপস্থিত হইয়া পরীক্ষা দানের অনুমতি প্রার্থনা করিলেন। পরীক্ষকেরা কাফরিকে পরীক্ষাদানার্থ উদ্যত দেখিয়া চমৎকৃত হইলেন; কিন্তু তাঁহার স্বভাব চরিত্র বিদ্যাদি বিষয়ক প্রশংসাপত্র দর্শনে অন্যান্য তিন চারি জন কর্ম্মাকাঙ্খীদিগের ন্যায় তাঁহারও যথা নিয়মে পরীক্ষা গ্রহণ করিতে হইল, অস্বীকার করিতে পারিলেন না। পরীক্ষাতে অন্যান্য ব্যক্তি অপেক্ষায় এমন উৎকৃষ্ট হইলেন যে পরীক্ষকদিগকে উপস্থিত ব্যাপারে তাঁহাকেই সর্ব্বাপেক্ষায় উপযুক্ত বলিয়া অধ্যক্ষবর্গের নিকট বিজ্ঞাপনী দিতে হইল। তখন জেস্কিন্স জয়প্রাপ্ত হইয়া হৰ্ষোৎফুল্ল লোচনে এই আলোচনা করিতে করিতে প্রত্যাগমন করিলেন যে এক্ষণে আমি যে পদে নিযুক্ত হইব তাহা পূর্ব্বতন সমুদায় কর্ম্মাপেক্ষা উত্তম এবং তাহাতে বিদ্যোপার্জ্জনের বিশিষ্টৰূপ সুযোগ ও সদুপায় হইবেক।

 কিন্তু কিয়ৎকালের নিমিত্ত জেঙ্কিন্সের এই অভ্যুদয়াশা প্রতিহত হইয়া রহিল। পরীক্ষকদিগের বিজ্ঞাপনী যাজকমণ্ডলীর সম্মুখে উপস্থিত হইলে, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই কাকরিকে উপস্থিত কর্ম্মে নিযুক্ত করা অযুক্ত বিবেচনা করিয়া, অন্য এক ব্যক্তিকে ঐ পদে নিযুক্ত করিলেন। তদনুসারে তিনি পরীক্ষাদানের সমুদায় ফলে বঞ্চিত হইয়া, জাতি ও অবস্থার অপকর্ষ নিমিত্তই এই সমস্ত দুরবস্থা ঘটিতেছে,এই মনস্তাপে ত্রিয়মাণ হইয়া রহিলেন। কিন্তু যাজকমণ্ডলীর এই অবিচারে তিনি যেরূপ বিষাদ ও ক্ষোভ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন সৌভাগ্যক্রমে বর্ত্তমান ব্যাপারের প্রধান উদ্যোগী ব্যক্তিবর্গ তদনুরূপ অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হইলেন।

 অনন্তর ডিউক আব বক্লিয়ু প্রভৃতি ভূম্যধিকারীরা উপস্থিত বিষয়ে বিশিষ্ট রূপে উদ্ঘুক্ত হইয়া বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন যে পরীক্ষোর্ত্তীর্ণ জেঙ্কিন্সকে নিযুক্ত করা যাইবেক এবং এ পর্যন্ত যাজকমণ্ডলীর নিযুক্ত শিক্ষক যত বেতন পাইয়াছেন ইহাকে পুনরায় তাহা ধরিয়া দিতে হুইবেক। তদনন্তর অতি ত্বরায় এক কর্ম্মকারের পুরাণ বিপণিতে স্থান নিরূপণ করিয়া জেঙ্কিন্সকে শিক্ষকের পদে অভিষিক্ত করিলেন। তদ্দর্শনে সমুদায় বালক ও তাহাদের পিতা মাতারা পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইলেন; সুতরাং অতি অল্প দিনের মধ্যেই সমুদায় ছাত্র পুর্ব্ব পাঠশালা পরিত্যাগ করিয়া জেঙ্কিন্সের নিকটেই অধ্যয়ন করিতে লাগিল। জেঙ্কিন্স কিয়দ্দিন পূর্বে শিক্ষা করিতে গিয়াছিলেন কিন্তু অল্পকালেই শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন। এমন বেতন পাইতে লাগিলেন যে তাহাতে আবশ্যক ব্যয় নির্ব্বাহ হইয়া কিঞ্চিৎকিঞ্চিৎ উদ্বৃত্ত হইতে লাগিল।

 তিনি অতি ত্বরায় এক জন উৎকৃষ্ট শিক্ষক হইয়া উঠিলেন। তদ্দর্শনে তাঁহার বন্ধুবৰ্গ আনন্দ প্রবাহে মগ্ন হইলেন; আর তাঁহার প্রতিপক্ষ যাজকমণ্ডলীর মুখ মলিন হইল। তিনি শিক্ষা দিবার অত্যুৎকৃষ্ট ও ফলোপধায়ক প্রণালী জানিতেন; কোন প্রকার কার্কশ্য প্রকাশ না করিয়া কেবল কৌশলবলে কার্য্য নির্ব্বাহ করাতে স্বীয় ছাত্রবর্গের সাতিশয় প্রিয় ও নিযোগ্যগণের অত্যন্ত সমাদরণীয় ছিলেন। সপ্তাহে পাঁচ দিন পাঠশালার কার্য্য করিতেন এবং এই কয়েক দিবস স্বয়ং যাহা শিক্ষা করিতেন প্রতি শনিবার অবাধে হাউয়িকে গমন করিয়া তত্রত্য বিদ্যালয়ের অধ্যাপকের নিকট পরিচয় দিয়া আসিতেন। ইহাতে দৃষ্ট হইতেছে যে, তিনি শিক্ষক হইয়াও স্বয়ং শিক্ষা করিতে বিরত ও নিরুৎসাহ হয়েন নাই।

 এইরূপে দুই এক বৎসর পাঠশালার কার্য্য সম্পাদন করিলে, জেঙ্কিন্সের দুই শত মুদ্রার সংস্থান হইল। তখন তিনি প্রতিনিধি দিয়া শীত কয়েক মাস কোন প্রধান বিদ্যালয়ে থাকিয়া লাটিন, গ্রীক ও গণিত শাস্ত্র বিশেষরূপে অধ্যয়ন করিবার নিমিত্ত অভিলাষী হইলেন। তিনি পাঠশালার অধ্যক্ষবর্গের অত্যন্ত আদরণীয় ছিলেন; অতএব তাঁহারা সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে বিদায় দিলেন। তখন তিনি উপস্থিত ব্যাপারে সৎপরামর্শ লইবার নিমিত্ত তাঁহার দয়ালু বন্ধু মনক্রিফ মহাশয়ের নিকট উপস্থিত হইলেন। এই দয়াবান্ ব্যক্তি তাঁহার গ্রীক অভিধান ক্রয় কালে সাহায্য করিয়াছিলেন এবং তৎপরেও আর আর অনেক উপকার করেন।  মনক্রিফ পরিচয় দিবসাবধি জেঙ্কিন্সকে অদ্ভুত পদার্থ মধ্যে গণনা করিতেন। এক্ষণে তাঁহার এই অভিনব প্রস্তাব শ্রবণে আরও চমৎকৃত হইলেন; এবং সর্ব্বাগ্রে তাঁহার সংস্থানের বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়া সবিশেষ অবগত হইয়া কহিলেন শুন জেঙ্কিন্স! ইহাতে কোন রূপেই তোমার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইতে পারে না। যাহা সঞ্চয় করিয়াছ তদ্দ্বারা শুল্কদান নির্ব্বাহ হওয়াই কঠিন। তিনি শুনিয়া অত্যন্ত বিষণ্ণ ও ক্ষুব্ধ হইলেন। কিন্তু ঐ বদান্য বন্ধু তাঁহার ক্ষোভ শান্তি করিবার নিমিত্ত, তাঁহার হস্তে এক অনুমতি পত্র প্রদান করিয়া কহিলেন এডিনবরা নগরে অমুক বণিককে লিখিলাম, অতিরিক্ত যখন যাহা আবশ্যক হইবেক তাঁহার নিকট চাহিয়া লইবে।

 তখন জেঙ্কিন্স অপরিসীম হর্ষ প্রাপ্ত হইয়া এডিনবরা প্রস্থান করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া, প্রথমতঃ লাটিনের অধ্যাপকের নিকটে গিয়া, তাঁহার শ্রেণীতে নিবিষ্ট হইবার নিমিত্ত প্রবেশিকা প্রার্থনা করাতে, তিনি তাঁহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া আপাততঃ কয়েক মুহূর্ত্ত অবাক হইয়া রহিলেন; অনন্তর জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি লাটিনের কিছু শিখিয়াছ কি না। জেঙ্কিন্স বিনীতভাবে উত্তর করিলেন আমি বহু কাল লাটিন অধ্যয়ন করিয়াছি; এক্ষণে উক্ত ভাষায় সম্পূর্ণরূপ জ্ঞানলাভের আশয়ে এই স্থানে আসিয়াছি। উক্ত অধ্যাপক, জেঙ্কিন্স যাহা কহিলেন তাহা যথার্থ নিশ্চয় করিয়া, তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে এক প্রবেশিকা প্রদান করিলেন,কিন্তু বদান্যতা প্রদর্শন পূর্ব্বক নিয়মিত শুক গ্রহণ করিলেন না।

 অনন্তর জেঙ্কিন্স অন্য দুই জন অধ্যাপকের নিকট প্রার্থনা করাতে,তাঁহারাও উভয়ে প্রথমতঃ চমৎকৃত হইয়াছিলেন; পরিশেষে তাঁহাকে শিষ্যমণ্ডলী মধ্যে নিবেশিত করেন। তাঁহাদের মধ্যে কেবল এক ব্যক্তি শুল্ক গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি, এইরূপে তিন শ্রেণীতে নিবিষ্ট হইয়া, শীত কয়েক মাস তথায় অবস্থিতি পুর্ব্বক অভিলাষানুরূপ অধ্যয়ন সমাধান করিলেন, অথচ পরম দয়ালু মনক্রিফ মহাশয়ের অনুমতি পত্রের উপরি অধিক নির্ভর করিতে হইল না। বসন্তকাল উপস্থিত হইলে, টিবিয়টহেডে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক তিনি পুনর্ব্বার যথা নিয়মে পাঠশালার কার্য্য করিতে আরম্ভ করিলেন।

 এই অদ্ভুত আখ্যানের শেষ ভাগ যেরূপে উপসংহৃত হইলে সকলের মনোরঞ্জন হইত সেরূপ হয় নাই। আমাদিগের বোধে কোন লোকহিতৈষী সমাজের সাহায্যে জেঙ্কিন্সের স্বদেশে প্রতিপ্রেরিত হওয়াই উচিত ছিল। তাহা হইলে তিনি তথায় পৈতৃক প্রজাগণের সভ্যতা সম্পাদন ও শিক্ষা প্রদান করিতে পারিতেন।

 প্রায় বত্রিশ বৎসর হইল, প্রতিবেশবাসী কোন সদাশয় ব্যক্তি, সদভিপ্রায়প্রণোদিত হইয়া, ঔপনিবেশিক দাসমণ্ডলীর উপযুক্ত ধর্ম্মোপদেষ্টা বলিয়া, জেঙ্কিন্সকে খৃষ্টধর্ম্মসঞ্চারিণী সভার নিকট বলিয়া দেন। উক্ত সভার অধ্যক্ষেরা জেঙ্কিন্সকে সম্মত করিয়া, উপদেশকতার ভার দিয়া, মরিশস্ উপদ্বীপে প্রেরণ করিয়াছেন। কিন্তু এই নিয়োগ তাঁহার পক্ষে কোন রূপেই উপযুক্ত হয় নাই।