জীবনচরিত/বলণ্টিন জামিরে ডুবাল

বলণ্টিন জামিরে ডুবাল।


 এক্ষণে আমরা ডুবালের জীবনবৃত্ত লিখিতে প্রবৃত্ত হইলাম। এই মহানুভাব ১৬৯৫ খৃঃ অব্দে, ফ্রান্স রাজ্যের সাম্পেন প্রদেশের অন্তর্ব্বত্তী আর্র্টনি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন,সামান্যরূপ কৃষি কর্ম্ম মাত্র অবলম্বন করিয়া যথা কথঞ্চিৎ পরিবারের ভরণপোষণ নির্ব্বাহ করতেন। ডুবাল যখন দশমবর্ষীয়, তখন তাঁহার পিতা মাতা,আর কতক গুলি পুত্র ও কন্যা রাখিয়া পরলোক যাত্রা করেন। তাঁহাদের প্রতিপালনের কোন উপায় ছিল না; সুতরাং ডুবাল অত্যন্ত দুরবস্থায় পড়িলেন। কিন্তু এইরূপ দুরবস্থায় পড়িয়াও মহীয়সী উৎসাহশীলতা ও অবিচলিত অধ্যবসায় প্রভাবে সমস্ত প্রতিবন্ধক অতিক্রম করিয়া অসাধারণ বিদ্যোপার্জ্জনাদি দ্বারা পরিশেষে মনুষ্যমণ্ডলীতে অগ্রগণ্য হইয়াছিলেন। তিনি দুই বৎসর পরে এক কৃষকের আলয়ে পেরুশাবক সকলের রক্ষণাবেক্ষণার্থে নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু বালস্বভাবসুলভ কতিপয় গৰ্হিতাচার দোষে দূষিত হওয়াতে অল্প দিনের মধ্যেই তথা হইতে দূরীকৃত হইলেন। পরিশেষে ঐ কারণেই জন্মভূমিও পরিত্যাগ করিতে হইল।

 অনন্তর ডুবাল ১৭০৯ খৃঃ অব্দের দুঃসহ হেমন্তের উপক্রমে লোরেন প্রস্থান করিলেন। পথিমধ্যে বিষম বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইলেন। ঐ সময়ে যদি এক কৃষকের আশ্রয় না পাইতেন তাহা হইলে তাঁহার অকালে কালগ্রাসে পতিত হইবার কোন অসম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ঐ ব্যক্তি তাঁহার তাদৃশ দশা দর্শনে দয়ার্দ্র - চিত্ত হইয়া তাঁহাকে আপন মেষশালায় লইয়া গেল। তথায় মেষপুরীষরাশি ব্যতিরিক্ত অন্যবিধ শয্যার সঙ্গতি ছিল না। যাবৎ তাঁহার পীড়োপশম না হইল সেই কৃষক তাঁহাকে মেষপুরীষরাশিতে আকণ্ঠ মগ্ন করিয়া রাখিল এবং অতি কদর্য্য পোড়া রুটি ও জল এই মাত্র পথ্য দিতে লাগিল। এইরূপ চিকিৎসা ও এইরূপ শুশ্রুষাতেও তিনি সৌভাগ্যক্রমে এই ভয়ানক রোগের আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইলেন এবং পরিশেষে কোন সন্নিবেশবাসী যাজকের আশ্রয় পাইয়া সম্পূর্ণরূপে মুস্থ হইয়া উঠিলেন।

 ডুবাল, নান্সির নিকটে এক মেষপালকের গৃহে নিযুক্ত হইয়া, তথায় দুই বৎসর অবস্থিতি করিলেন। ঐ সময়ে ভূয়সী জ্ঞানবৃদ্ধি সম্পাদন করেন। ডুবাল শৈশবাবধি অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। অতি শৈশবকালেই সর্প, ভেক প্রভৃতি অনেকবিধ জন্তু সংগ্রহ করিয়াছিলেন এবং প্রতিবেশী ব্যক্তিবর্গকে, এই সকল জন্তুর কিরূপ অবস্থা, ইহার এরূপে নির্ম্মিত হইল কেন, ইহাদিগের সৃষ্টির তাৎপর্য্যই বা কি, এবম্বিধ বহুতর প্রশ্ন দ্বারা সর্ব্বদাই বিরক্ত করিতেন। কিন্তু এই সকল প্রশ্নের যে উত্তর পাইতেন তাহা যে সন্তোষজনক হইত না ইহা বলা বাহুল্যমাত্র। সামান্যবৃদ্ধি লোকের সামান্য বস্তুকে সামান্য জ্ঞানই করিয়া থাকে। কিন্তু অসামান্যবৃদ্ধিসম্পন্নেরা কোন বস্তুকেই সামান্য জ্ঞান করেন না। এই নিমিত্তেই সর্ব্বদা এরূপ ঘটিয়া থাকে যে প্রাকৃত লোকের মহানুভাবদিগের বুদ্ধির প্রথম কার্য্য সকল দেখিয়া উন্মাদ জ্ঞান করে।

 এক দিবস ডুবাল কোন পল্লীগ্রামস্থ বালকের হস্তে ঈসপ রচিত গল্পের পুস্তক অবলোকন করিলেন। ঐ পুস্তক পশু,পক্ষী, সৰ্প প্রভৃতি নানাবিধ জন্তুর প্রতিমূর্ত্তিতে অলঙ্কৃত ছিল। এ পর্যন্ত ডুবালের বর্ণ পরিচয় হয় নাই সুতরাং পুস্তকে কি লিখিত ছিল তাহার বিন্দু বিসর্গও অনুধাবন করিতে পারিলেন না। যে সকল জন্তু দেখিলেন তাহাদিগের নাম জানিতেও তত্তদ্বিষয়ে ঈসপ কি লিখিয়াছেন তাহা শুনিতে অত্যন্ত কৌতুহলাক্রান্ত ও ব্যগ্রচিত্ত হইয়া,আপন সমক্ষে সেই পুস্তক পাঠকরিবার নিমিত্ত স্বীয় সহচরকে অত্যন্ত অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই বালক কোন ক্রমেই তাঁহার বাসনা পূর্ণ করিল না। ফলতঃ তাঁহাকে সর্ব্বদাই এইরূপে কৌতুহলাক্রান্ত ও পরিশেষে একান্ত বিষাদ প্রাপ্ত হইতে হইত।

 এইরূপে যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ প্রাপ্ত হইয়া,এতাদৃশ ক্ষুণ্ণ অবস্থায় থাকিয়াও, তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি লেন যত কষ্টসাধ্য হউক না কেন, যেরূপে পারি, লেখা পড়া শিখিব। এইৰূপ অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া,যে কিছু অর্থ তাঁহার হস্তে আসিতে লাগিল, প্রাণপণে তাহা সঞ্চয় করিতে লাগিলেন; এবং তাহা দিয়া সন্তুষ্ট করিয়া বয়োধিক বালকদিগের নিকট বিদ্যা শিক্ষা আরম্ভ করিলেন।

 ভুবাল, কিছু দিনের মধ্যেই অসম্ভব পরিশ্রম দ্বারা আপন অভিপ্রেত এক প্রকার সিদ্ধ করিয়া, ঘটনাক্রমে এক দিবস এক খানি পঞ্জিকা অবলোকন করিলেন। ঐ পঞ্জিকাতে জ্যোতিশচক্রের দ্বাদশ রাশি চিত্রিত ছিল। তিনি তদ্দর্শনে অনায়াসেই স্থির করিলেন যে এই সমস্ত আকাশমণ্ডলস্থিত পদার্থ বিশেষের প্রতিমূর্ত্তি হইবেক, সন্দেহ নাই। অনন্তর ঐ সকল প্রত্যক্ষ করিবার নিমিত্ত একদৃষ্টে নভোমণ্ডল নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন এবং সেই সমুদায় দেখিলাম বলিয়া যাবৎ তাঁহার অন্তঃকরণে দৃঢ় প্রত্যয় না জন্মিল তাবৎ তিনি কোন মতেই ক্ষান্ত হইলেন না।

 কিয়দ্দিন পরে তিনি একদ কোন মুদ্রাযন্ত্রালয়ের গবাক্ষের নিকট দিয়া গমন করিতে করিতে তন্মধ্যে এক ভূগোল চিত্র দেখিতে পাইলেন। উহা পূর্ব্বদৃষ্ট সমস্ত বস্তু অপেক্ষায় উপাদেয় বোধ হওয়াতে তিনি তৎক্ষণাৎ ক্রয় করিয়া লইলেন; এবং কিয়দ্দিবস পর্য্যন্ত, অবসর পাইলেই, অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া কেবল তাহাই পাঠ করিতে লাগিলেন। নাড়ীমণ্ডলস্থিত অংশ সকল অবলোকন করিয়া প্রথমতঃ ঐ সমস্তকে ফ্রান্স প্রচলিত লীগ অর্থাৎ সাৰ্দ্ধক্রোশের চিহ্ণ বোধ করিয়াছিলেন। পরন্তু সাম্পেন হইতে লোরেনে আসিতে ঐরূপ অনেক লীগ অতিক্রম করিতে হইয়াছে কিন্তু ভূচিত্রে উহাদিগের অন্তর অতি অল্প লক্ষ্য হইতেছে এই বিবেচনা করিয়া সেই প্রথম সিদ্ধান্ত ভুল বলিয়া স্থির করিলেন। যাহা হউক এই ভূচিত্র ও অন্য অন্য ভূচিত্র সকল অভিনিবেশ পূর্ব্বক পাঠ করিয়া ক্রমে ক্রমে কেবল ঐ সকল চিহ্ণেরই স্বরূপ ও তাৎপর্য্য সূক্ষানুসূক্ষরূপে নিৰ্দ্ধারিত করিলেন এমন নহে ভূগোল বিদ্যা সংক্রান্ত প্রায় সমুদায় সংজ্ঞা ও সঙ্কেতের মর্ম্মগ্রহ করিতে পারিলেন।

 ডুবাল এইরূপে গাঢ়তর অনুরাগ ও অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন। কিন্তু অন্যান্য কৃষীবল বালকেরা অত্যন্ত ব্যাঘাত জন্মাইতে আরম্ভ করিল। অতএব তিনি বিজন স্থান লাভের নিমিত্ত নিতান্ত উৎসুক হইলেন। এক দিবস ঘটনাক্রমে ডিনিযুবরের নিকটে এক আশ্রম দর্শন করিয়া এমন প্রীতি প্রাপ্ত হইলেন যে তৎক্ষণাৎ মনে মনে সঙ্কল্প করিলেন যে তত্রত্য তপস্বী পালিমানের অনুবর্ত্তী হইয়া ধর্ম্ম চিন্তা বিষয়ে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ মনোনিবেশ করিব। অনন্তর তপস্বী মহাশয়কে আপন প্রার্থনা জানাইলেন। পালিমান অনুগ্রহ প্রদর্শনপুর্ব্বক তাঁহার প্রার্থিত বিষয়ে সম্মত হইলেন এবং আপন অধিকারে যে এক পদ শূন্য ছিল তাহাতে তাঁহাকে নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু অনতি চিরকাল মধ্যেই পালিমানের কর্তৃপক্ষীয়েরা ঐ পদে অন্য ব্যক্তিকে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন।

 লুনিবিলের প্রায় পাদোনক্রোশ অন্তরে, সেণ্ট এন নামে এক আশ্রম ছিল, তথায় কতকগুলি তপস্বী বাস করিতেন। পালিমান সাধ্যানুসারে ডুবালের ক্ষোভ শান্তি করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগের আশ্রমে তাঁহাকে এক অনুরোধ পত্র সমেত পাঠাইয়া দিলেন। সেই সতীর্থ তপস্বীদিগের আজীবনস্বরূপ যে ছয়টি ধেনু ছিল ডুবালের প্রতি তাঁহারা তাহাদিগের রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিলেন। বোধ হয়, তপস্বী মহাশয়েরা ডুবাল অপেক্ষা অজ্ঞ ছিলেন কিন্তু তাঁহাদিগের কতকগুলি পুস্তক ছিল, তাঁহারা ডুবালকে তাহা পাঠ করিবার অনুমতি দিলেন। ডুবাল যে যে কঠিন বিষয় স্বয়ং বুঝিতে না পারিতেন তাহা আশ্রমদর্শনাগত ব্যক্তিগণের নিকট বুঝিয়া লইতেন। এখানেও পুর্ব্বের মত কষ্ট স্বীকার করিয়া যে কিছু অর্থ বাঁচাইতে পারিতেন অন্য কোন বিষয়ে ব্যয় না করিয়া তদ্দ্বারা কেবল পুস্তক ও ভুচিত্র মাত্র ক্রয় করিতেন। এই স্থলে বিস্তর ব্যাঘাত সত্ত্বেও লিখিতে ও অঙ্ক কষিতে শিখিলেন।

 কোন কোন ভূচিত্রের নিম্নভাগে সন্ত্রান্ত লোক বিশেষের পরিচ্ছদ চিত্রিত ছিল তাহাতে গ্রিফিন, উৎক্রোশ পক্ষী,লাঙ্গুলদ্ধয়োপলক্ষিত কেশরী ও অন্যান্য বিকটাকার অদ্ভুত জন্তু নিরীক্ষণ করিয়া আশ্রমাগত কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলেন পৃথিবীতে এবম্বিধ জীব আছে কিনা। তিনি কহিলেন কুলাদর্শ নামে এক শাস্ত্র আছে এই সমস্ত তাহার সঙ্কেত। শ্রবণ মাত্র ঐ শব্দটী লিখিয়া লইলেন এবং অতি সত্বর হইয়া নিকটবর্ত্তী নগর হইতে উক্ত বিদ্যার এক পুস্তক ক্রয় করিয়া আনিলেন এবং অবিলম্বে তদ্বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হইয়া উঠিলেন।

 জ্যোতির্ব্বিদ্যা ও ভূগোলবৃত্তান্ত অধ্যয়নে ডুবাল অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলেন। তিনি সর্ব্বদাই সন্নিহিত বিপিন মধ্যে নির্জ্জন প্রদেশ অন্বেষণ করিয়া লইতেন এবং একাকী তথায় অবস্থিত হইয়া নির্ম্মল নিদাঘরজনীর অধিকাংশ জ্যোতির্মগুল পর্য্যবেক্ষায় যাপন করিতেন ও মস্তকোপরি পরিশোভমান মৌক্তিকময় নভোমণ্ডলের বিষয় সমধিক রূপে জানিতে মনোরথ করিতেন—যেরূপ অবস্থা,মনোরথের অধিক আর কি ঘটিতে পারে। জ্যোতির্গণের বিষয় বিশিষ্ট রূপে জানিতে পারবেন এই বাসনায় অত্যুন্নত ওকবৃক্ষ শিখরোপরি বন্যদ্রাক্ষা ও উইলো শাখার পরস্পর সংযোজনা করিয়া সারসকুলায়সন্নিভ একপ্রকার বসিবার স্থান নির্ম্মাণ করিলেন।

 ডুবালের ক্রমে ক্রমে যত জ্ঞান বৃদ্ধি হইতে লাগিল পুস্তক বিষয়েও তত আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। কিন্তু পুস্তক ক্রয়ের যে নিৰ্দ্ধারিত উপায় ছিল তাহার সেরূপ বৃদ্ধি হইল না। অতএব তিনি আয় বৃদ্ধি করিবার নিমিত্ত ফাঁদ পাতিয়া জন্তু ধরিতে আরম্ভ করিলেন ও কিয়ৎকাল এই ব্যবসায় দ্বারা কিছু কিছু লাভও করিতে লাগিলেন আয় বৃদ্ধি সম্পাদন নিমিত্ত কখন কখন অত্যন্ত দুঃসাহসিক ব্যাপারেও প্রবৃত্ত হইতে পরাঙ্মুখ হইতেন না।

 একদা তিনি কানন মধ্যে ভ্রমণ করিতে করিতে বৃক্ষোপরি এক অতি চিক্কণলোমা অরণ্যমাৰ্জ্জার অবলোকন করিলেন। ইহা অনেক উপকারে আসিবে এই বিবেচনা করিয়া তৎক্ষণাৎ বৃক্ষোপরি আরোহণ পূর্ব্বক অতি দীর্ঘ যষ্টি দ্বারা মার্জ্জারকে অধিষ্ঠান শাখা হইতে অবতীর্ণ। করাইলেন। বিড়াল দৌড়িতে আরম্ভ করিল। তিনিও পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। উহা এক তরুকোটরে প্রবেশ করিল; পরে তথা হইতে ত্বরায় নিষ্কাশিত করিবামাত্র তাঁহার হস্তোপরি ঝাঁপিয়া পড়িল। অনন্তর উভয়ের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইলে, কুপিত বিড়াল তাঁহার মস্তকের পশ্চাদ্ভাগে নখ প্রহার করিল। ডুবাল তথাপি উহাকে টানিতে লাগিলেন। বিড়াল আরো শক্ত করিয়া ধরিল; পরিশেষে খর নখর দ্বারা চর্ম্মের যত দূর আক্রমণ করিয়াছিল প্রায় সমুদায় অংশ উঠাইয়া লইল। অনন্তর ডুবাল নিকটবর্ত্তী বৃক্ষোপরি বারম্বার আঘাত করিয়া মার্জ্জারের প্রাণসংহার করিলেন এবং হর্ষোৎফুল্ললোচনে তাহাকে গৃহে আনিলেন। আর ইহা দ্বারা প্রয়োজনোপযোগী কিছু কিছু পুস্তক সংগ্রহ করিতে পারিব এই আহ্লাদে বিরালকৃত ক্ষতক্লেশ একবার মনেও করিলেন না।

 ডুবাল বন্যজন্তুর উদ্দেশে সর্ব্বদাই এইরূপ সঙ্কটে প্রবৃত্ত হইতেন এবং লুনিবিলে গিয়া সেই সেই পশুর চর্ম্ম বিক্রয় দ্বারা অর্থ সংগ্রহ করিয়া পুস্তক ও ভূচিত্র ক্রয় করিয়া আনিতেন।

 পরিশেষে এক শুভ ঘটনা হওয়াতে অনেক পুস্তক সংগ্রহ করিতে পারিলেন। এক দিবস শরৎকালে অরণ্য মধ্যে ভ্রমণ করিতে করতে সম্মুখবর্তী শুষ্ক পর্ণরাশিতে আঘাত করিবামাত্র ভূতলে কোন উজ্জ্বল বস্তু অবলোকন করিলেন এবং তৎক্ষণাৎ হস্তে লইয়া দেখিলেন উহা স্বর্ণময় মুদ্রা, উহাতে উত্তমরূপে তিনটি মুখ উৎকীর্ণ আছে। ডুবাল ইচ্ছা করিলেই ঐ স্বর্ণময় মুদ্রা আত্মসাৎ করিতে পারিতেন। কিন্তু তিনি পরের দ্রব্য অপহরণ করা গৰ্হিত ও অধর্ম্মহেতু বলিয়া জানিতেন অতএব পর রবিবারে লুনিবিলে গিয়া তত্রত ধর্ম্মাধ্যক্ষের নিকট নিবেদন করিলেন মহাশয়! অরণ্য মধ্যে আমি এক স্বর্ণ মুদ্রা পাইয়াছি। আপনি এই ধর্ম্মালয়ে ঘোষণা করিয়া দেন যে ব্যক্তির হারাইয়াছে তিনি সেণ্ট এনের আশ্রমে গিয়া আমার নিকটে আবেদন করিলেই আপন বস্তু প্রাপ্ত হইবেন।

 কয়েক সপ্তাহের পর ইংলণ্ড দেশীয় ফরষ্টর নামে এক ব্যক্তি অশ্বারোহণে সেণ্ট এনের আশ্রমদ্বারে উপস্থিত হইয়া ডুবালের অন্বেষণ করিলেন এবং ডুবাল উপস্থিত হইলে জিজ্ঞাসিলেন তুমি কি এক মুদ্রা পাইয়াছ? ডুবাল কহিলেন হাঁ মহাশয়! তিনি কহিলেন আমি তোমার নিকট বড় বাধিত থাকিলাম সে আমার মুদ্রা। ডুবাল কহিলেন ক্ষণেক অপেক্ষা করিতে হইবেক অগ্রে আপনি অনুগ্রহ করিয়া কুলাদর্শানুযায়ী ভাষায় নিজ আভিজাতিক চিহ্ন বর্ণন করুন তবে আমি আপনাকে মুদ্রা দিব। তখন সেই আগন্তুক কহিলেন অহে বালক! তুমি আমাকে পরিহাস করিতেছ, কুলাদর্শের বিষয় তুমি কি বুঝিবে। ভুবাল কহিলেন সে যাহা হউক আপনি নিজ আভিজাতিক চিহ্নের বর্ণন না করিলে মুদ্রা পাইবেন না।

 ডুবালের নির্ব্বন্ধাতিশয় দর্শনে চমৎকৃত হইয়া ফরষ্টর তাঁহার জ্ঞান পরীক্ষার্থে তাঁহাকে নানা বিষয়ে ভূরি ভূরি জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে তৎকৃত উত্তর শ্রবণে সন্তুষ্ট হইয়া নিজ আভিজাতিক চিহ্ন বর্ণন দ্বারা তাঁহার প্রার্থনা সিদ্ধ করিয়া মুদ্রা গ্রহণ পূর্ব্বক দুই সুবর্ণ পুরস্কার দিলেন; এবং প্রস্থান কালে ডুবালকে, মধ্যে মধ্যে লুনিবিলে গিয়া সাক্ষাৎ করিতে কহিয়া দিলেন। পরে ভুবাল যখন যখন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতেন প্রতিবারেই তিনি তাঁহাকে এক এক রজত মুদ্রা দিতেন। এইরূপে ফরষ্টরের নিকট মুদ্রা ও পুস্তক দান পাইয়া সেণ্ট এনের রাখালের পুস্তকালয়ে চারশত খণ্ড পুস্তক সংগৃহীত হইল। তণ্মধ্যে বিজ্ঞান শাস্ত্র ও পুরাবৃত্ত বিষয়ক বহুতর উৎকৃষ্ট গ্রন্থ ছিল।

 এইরূপে ডুবাল দ্বাবিংশতি বর্ষ বয়ঃক্রম প্রাপ্ত হই-লেন; কিন্তু এপর্য্য়ন্ত আপনার হীন অবস্থা পরিবর্ত্তের চেষ্টা এক দিবসের নিমিত্তেও মনে আনেন নাই। ফলতঃ এখনও তিনি জ্ঞান ব্যতীত সর্ব্ব বিষয়েই রাখাল ছিলেন। প্রতিদিন গোচারণ কালে তরুতলে উপবিষ্ট হইয়া আপ-নার চারি দিকে ভুচিত্র ও পুস্তক সকল বিস্তৃত করেন এবং ধেনুগণের রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে কিঞ্চিম্মাত্রও মনো-যোগ না রাখিয়া কেবল অধ্যয়ন বিষয়েই নিমগ্ন হইয়া থাকেন। ধেনু সকলও সচ্ছন্দ রূপে ইতস্ততঃ চরিতে থাকে।

 একদা তিনি এইরূপে অবস্থিত আছেন এমন সময়ে সহসা এক সৌম্যমূর্ত্তি পুরুষ আসিয়া তাহার সম্মুখবর্ত্তী হইলেন। ডুবালকে দেখিয়া তাঁহার হৃদয়ে যুগপৎ কারুণ্য ও বিস্ময় রসের উদয় হইল। এই মহানুভাব ব্যক্তি লোরেনের রাজকুমারদিগের অধ্যাপক, নাম কৌণ্ট বিডাস্পিয়র। ইনি ও রাজকুমারগণ এবং অন্য এক অধ্যাপক মৃগয়া করিতে গিয়াছিলেন। সকলেই ঐ অরণ্যে পথহারা হন। কৌণ্ট মহাশয়, অসংস্কৃত বিরল-কেশ অতি হীনবেশ রাখালের চতুর্দ্দিকে পুস্তক ও ভুচি-ত্ররাশি প্রসারিত দেখিয়া এমন চমৎকৃত হইলেন যে ঐ অদ্ভূত ব্যাপার প্রত্যক্ষ করবার নিমিত্ত স্বীয় সহচরদি-গকে তথায় আনয়ন করিলেন।

 এইৰূপে মৃগয়াবেশধারী দেশাধিপতনয়েরা ডবালকে চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। এই স্থলে পাঠকদিগের স্মরণার্থে ইহা লিখিলে অসঙ্গত হইবেক না যে ঐ কুমারদিগের মধ্যে এক জন পরে মেরিয়া থেরিসার পাণিগ্রহণ করেন এবং জর্ম্মনি রাজ্যের সম্রাট্‌ হয়েন।

 এই ব্যাপার নয়নগোচর করিয়া সকলেই একবারে মুগ্ধ হইলেন; পরিশেষে যখন কতিপয় প্রশ্ন দ্বারা তাঁহার বিদ্যা ও বিদ্যাগমের উপায় সবিশেষ অবগত হইলেন তখন তাঁহারা বাক্প‌থাতীত বিস্ময় ও সন্তোষ সাগরে মগ্ন হইলেন। সর্বজ্যেষ্ঠ রাজকুমার তৎক্ষণাৎ কহিলেন তুমি রাজসংসারে চল আমি তোমাকে এক উত্তম কর্ম্মে নিযুক্ত করিব। ডুবাল কোন কোন পুস্তকে পাঠ করিয়াছিলেন রাজসংসারের সংস্রবে মনুষ্যের ধর্ম্মভ্রংশ হয়; এবং নান্সিতেও দেখিয়াছিলেন বড় মানুষের অনুচরেরা প্রায় লম্পট ও কলহপ্রিয়। অতএব অকপট বাক্যে কহিলেন আমার রাজসেবায় অভিলাষ নাই; বরং চিরকাল অরণ্যে থাকিয়া গোচারণ করিয়া নিরুদ্বেগে জীবন ক্ষেপণ করিব; আমি এই অবস্থায় সম্পূর্ণ সুখী আছি। কিন্তু ইহাও কহিলেন যদি মহাশয় আমার অপুর্ব্ব অপুর্ব্ব পুস্তক পাঠ ও সমধিক বিদ্যা ও জ্ঞান লাভের সুযোগ করিয়া দেন তবে আমি আপনকার অথবা যে কোন ব্যক্তির সমভিব্যাহারে যাইতে প্রস্তুত আছি।

 রাজকুমার এই উত্তর শ্রবণে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন; এবং রাজধানীতে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক,ডুবালের যথানিয়মে সৎপণ্ডিত ও সদুপদেশকের নিকট বিদ্যাধ্যয়ন সমাধানের নিমিত্ত, নিজ পিতা ডিউককে সম্মত করিয়া, পোণ্টে মৌসলের জেসুটদিগের সংস্থাপিত বিদ্যালয়ে তাহাকে পাঠাইয়া দিলেন।

 ডুবাল তথায় দুই বৎসর অবস্থিতি করিয়া জ্যোতিষ, ভূগোল, পুরাবৃত্ত ও পৌরাণিক বিষয় সকল অধিক রূপে অধ্যয়ন করিলেন। তদনন্তর ১৭১৮ খৃঃ অব্দের শেষভাগে ডিউকের পারিস যাত্রাকালে তদীয় সম্মতিক্রমে তৎসমভিব্যাহারে গমন করিলেন, এই অভিপ্রায়ে যে তত্রত্য অধ্যাপকদিগের নিকট শিক্ষা প্রাপ্ত হইতে পারিবেন। অনন্তর পর বৎসর তিনি তথা হইতে লুনিবিলে প্রত্যাগমন করিলে, ডিউক মহাশয় তাহাকে সহস্র মুদ্রা বেতনে আপনার পুস্তকালয়ের অধ্যক্ষ ও সাত শত মুদ্রা বেতনে বিদ্যালয়ে পুরাবৃত্তের অধ্যাপক নিযুক্ত করিলেন এবং কোন বিষয়ে কোন নিয়মে বদ্ধ না করিয়া সচ্ছন্দে রাজবাটীতে অবস্থিতি করিতে অনুমতি দিলেন।

 তিনি পুরাবৃত্তে যে উপদেশ দিতে লাগিলেন তাহাতে এমন সুখ্যাতি হইল যে অনেকানেক বৈদেশিকেরাও শুশ্রূষাপরবশ হইয়া লুনিবিলে আসিয়াছিলেন।

 ডুবাল স্বভাবতঃ অত্যন্ত বিনীত ও লোকরঞ্জন ছিলেন। তিনি, আপনার পূর্বতন হীন অবস্থার কথা উত্থাপন হইলে তদুপলক্ষে কিঞ্চিন্মাত্রও লজ্জিত বা ক্ষুব্ধ না হইয়া, এবং সেই অবস্থায় যে, মনের সচ্ছন্দে কালযাপন করিতেন ও ক্রমে ক্রমে জ্ঞানের উপচয় সহকারে অন্তঃকরণ মধ্যে যে নব নব ভাবাদয় হইত সেই সমস্ত বর্ণনা করিতে করিতে অপর্য্য়াপ্ত প্রীতি প্রাপ্ত হইতেন।

 তিনি প্রথমসংগৃহীত বহুসংখ্যক অর্থ দ্বারা সেণ্ট এনের আশ্রম পুননির্ম্মাণ করিয়া দেন এবং তথায় আপনার নিমিত্তেও এক গৃহনির্ম্মাণ করান। অনন্তর,তরুতলে উপবিষ্ট হইয়া রাজকুমারগণ ও তাঁহাদিগের অধ্যাপক দিগের সহিত যেরূপে কথোপকথন করিয়াছিলেন,কোন নিপুণতর চিত্রকর দ্বারা,সেই অবস্থা ব্যঞ্জক এক আলেখ্য প্রস্তুত করাইলেন এবং ডিউকের সম্মতি লইয়া স্বপ্রত্যবেক্ষিত পুস্তকালয়ে স্থাপন করিলেন। কিয়ৎকাল পরে জন্মভূমি দর্শন বাসনা পরবশ হইয়া তথায় গমন করিলেন এবং যে ভবনে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা তত্রত্য শিক্ষকের ব্যবহারার্থে প্রশস্তরূপে নির্ম্মাণ করাইলেন; আর গ্রামস্থ লোকের জলকষ্ট নিবারণার্থে নিজ ব্যয়ে অনেক কূপ খনন করাইয়া দিলেন।

 ১৭৩৮ খৃঃ অব্দে, ডিউকের মৃত্যুর পর তদীয় উত্তরাধিকারী লোরেনের বিনিময়ে টস্কানির আধিপত্য গ্রহণ করিলে,রাজকীয় পুস্তকালয় ফোরেন্স নগরে নীত হইল। ডুবাল তথায় পূর্ব্ববৎ পুস্তকাধ্যক্ষের কার্যনির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অভিনব প্রভু, হঙ্গরির রাজ্ঞীর পাণি গ্রহণ দ্বারা অত্যুন্নত সম্রাট পদ প্রাপ্ত হইয়া, বিয়েনার পুরাতন ও নূতন টঙ্ক, পৃথিবীর অন্যান্য ভাগ প্রচলিত সমুদায় টঙ্ক সংগ্রহ করিবার বাসনা করিলেন। ডুবালের টঙ্কবিজ্ঞান বিদ্যা বিষয়ে অত্যন্ত অনুরাগ ছিল। অতএব তাঁহাকে উক্ত টঙ্কালয়ের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করিলেন; এবং রাজপল্লী মধ্যে রাজকীয় প্রাসাদের অদূরে তঁহার বাস স্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিলেন। ডুবাল প্রায় সপ্তাহে এক দিন মহারাজ ও রাজমহিষীর সহিত ভোজন করিতেন।

 এইৰূপে অবস্থার পরিবর্ত্ত হইলেও তাঁহার স্বভাব ও চরিত্রের কিঞ্চিন্মাত্র পরিবর্ত্ত হইল না। ইউরোপের এক অত্যন্ত বিষয়রস পরায়ণ নগরে থাকিয়াও, তিনি লোরেনের অরণ্যে যেৰূপ ঋজুস্বভাব ও বিদ্যোপার্জ্জনে একাগ্র ছিলেন, সেই ৰূপই রহিলেন। রাজা ও রাজ্ঞী তাঁহার রমণীয় গুণগ্রামের নিমিত্ত অত্যন্ত প্রীত ও প্রসন্ন ছিলেন; এবং তাহার প্রমাণ স্বৰূপ তাঁহাকে ১৭৫১ খৃঃ অব্দে, আপন পুত্রের উপাচার্য্য়ের পদ প্রদান করেন। কিন্তু তিনি কোন কারণ বশতঃ এই সম্মানের পদ অস্বীকার করিলেন। রাজসংসারে তাঁহার গতিবিধি এত অল্প ছিল যে, কোন কোন রাজকুমারীকে কখন নয়নগোচর করেন নাই, সুতরাং তিনি তাঁহাদিগকে চিনিতেন না। পরে সময় বিশেষে এই কথা উত্থাপন হইলে এক রাজকুমার কহিয়াছিলেন ডুবাল যে আমার ভগিনীদিগকে জানেন না ইহাতে আমি আশ্চর্য্য বোধ করি না, কারণ আমার ভগিণীরা পৌরাণিক পদার্থ নহেন।

 এক দিবস তিনি অনুমতি গ্রহণ ব্যতিরেকে চলিয়া যাইতেছেন দেখিয়া, সম্রাট্‌ জিজ্ঞাসা করিলেন আপনি কোথায় যাইতেছেন। ডুবাল কহিলেন গাব্রিলির গান শুনিতে। নরপতি কহিলেন সেত ভাল গাইতে পারে না। কিন্তু বাস্তবিক সে ভাল গাইত, অতএব ডুবাল উত্তর দিলেন আমি মহারাজের নিকট বিনয় বাক্যে প্রার্থনা করিতেছি এ কথা উচ্চ স্বরে কহিবেন না। রাজা কহিলেন কেন। ডুবাল কহিলেন কারণ এই যে, মহারাজের পক্ষে ইহা অত্যন্ত আবশ্যক যে সকলে আপনকার কথায় বিশ্বাস করে; কিন্তু এই কথায় কোন ব্যক্তি বিশ্বাস করিবেক না। বাস্তবিক ডুবাল কোন কালেই প্রসাদাকাঙ্ক্ষী চাটুকার ছিলেন না।

 এই মহানুভাব ধর্ম্মাত্মা, জীবনের শেষদশা সচ্ছন্দে ও সম্মানপূর্ব্বক যাপন করিয়া ১৭৭৫ খৃঃ অব্দে, একাশীতি বৎসর বয়ঃক্রমে কলেবর পরিত্যাগ করিলেন। যাঁহারা ডুবালকে বিশেষ রূপে জানিতেন এক্ষণে তাঁহারা সকলেই তাঁহার দেহাত্যয় বার্তা শ্রবণে শোকাভিভূত হইলেন। এম ডি রোশ নামক তাঁহার এক বন্ধু তাঁহার মৃত্যুর পর তল্লিখিত সমুদায় গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়া দুই খণ্ড পুস্তকে মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলেন। মাম্‌স‌ল এনষ্টেশিয়া সোলোফক্‌ নাম্নী সরকেশিয়া দেশীয় এক সুশিক্ষিত যুবতী,দ্বিতীয় কাথিরিনের শয়নাগার পরিচারিকা ছিলেন তাঁহার সহিত ডুবালের জীবনের শেষ ত্রয়োদশ বৎসর যে লেখালেখি চলিয়াছিল সে সমুদায়ও মুদ্রিত হইল। সকলে স্বীকার করেন তাহাতে উভয় পক্ষেরই অসাধারণ বুদ্ধিনৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে। বৃদ্ধবয়সে ৰূপবতী যুবতীদিগকে প্রিয় বিবি বলিয়া সম্বোধন করা দূষণাবহ নহে; এই নিমিত্ত তিনি পূর্ব্বোক্ত রমণী ও অন্যান্য যে যে গুণবতী কামিনীদিগকে ভাল বাসিতেন সকলকেই উক্ত বাক্যে সম্বোধন করিতেন।

 এই সকল দেখিয়া যদিও নিশ্চিত বোধ হইতে পারে ডুবাল কামিনীগণ সহবাসে পরাঙ্মুখ ছিলেন না; কিন্তু তাহাদের অধিকতর মনোরঞ্জন হইবে বলিয়া কখন পরিচ্ছদ পরিপাটীর চেষ্টা করেন নাই। ফলতঃ অন্তিম কাল পর্য্য়ন্ত তাঁহার বেশ ও চলন প্রায় পূর্ব্বের ন্যায় গ্রাম্যই ছিল। কৃষকদিগের ন্যায় চলিতেন এবং সর্ব্বদা কৃষ্ণপিঙ্গল অঙ্গাবরণ, সামান্য পরিধান, ঘন উপকেশ, কৃষ্ণবর্ণ রোমজ চরণাবরণ পরিতেন এবং লৌহকণ্টকাবৃত স্থূল উপানহ ধারণ করিতেন। তিনি যে পরিচ্ছদ পরিপাটী বিষয়ে এৰূপ অনাদর করিতেন তাহা কোন ৰূপেই কৃত্রিম নহে। তাহার জীবনের পূর্ব্বাপর অবেক্ষণ করিলে, স্পষ্ট বোধ হয় যে কেবল নির্ম্মল জ্ঞানালোকসহকৃত ঋজ স্বভাব বশতই এৰূপ হইত। এই বিষয়ে এক উদাহরণ প্রদর্শিত হইলেই পর্য্য়াপ্ত হইতে পারিবেক। তাঁহার এক জন কর্ম্মকর ছিল তিনি তাহাকে ভৃত্য বোধ না করিয়া বন্ধুমধ্যে গণনা করিতেন। সে ব্যক্তি বিবাহিত পুরুষ; অতএব তিনি প্রতিদিন সকালরাত্রেই তাহাকে গৃহ গমনের অনুমতি দিতেন, এবং তৎপরে যথাকথঞ্চিৎ স্বহস্তেই সামান্য রূপ কিঞ্চিৎ আহার প্রস্তুত করিয়া লইতেন।

 ডুবাল স্বীয় অসাধারণ পরিশ্রম ও অধ্যবসায় মাত্র সহায় করিয়া ক্রমে ক্রমে অনেকবিধ জ্ঞানোপার্জ্জন দ্বারা তৎকালীন প্রায় সমস্ত ব্যক্তি অপেক্ষা সমধিক বিদ্যাবান্ হইয়াছিলেন। আর রাজসংসারে ব্যাপক কাল অবস্থিতি করিলে মনুষ্যমাত্রই প্রায় আত্মশ্লাঘা ও দুষ্ক্রিয়াসক্তির পরতন্ত্র হয়; কিন্তু তিনি তথায় অর্দ্ধ শতাব্দীর অধিক কাল যাপন করিয়াছিলেন তথাপি অতিদীর্ঘ জীবনের অন্তিম ক্ষণ পর্য্য়ন্ত এক মূহুর্ত্তের নিমিত্তেও চরিত্রের নির্ম্মলতা বিষয়ে লোরেনাবস্থানকালের রাখাল ভাব পরিত্যাগ করেন নাই। তাহার পূর্ব্বতন হীন অবস্থার দুঃসহ ক্লেশ প্রপঞ্চমাত্র অতিক্রান্ত হইয়াছিল; সরলহৃদয়তা, যদৃচ্ছালাভসন্তোষ ও প্রশান্তচিত্ততা অন্তিম ক্ষণ পর্য্য়ন্ত অবিকৃতই ছিল।