জীবনচরিত/সর আইজাক নিউটন

১৮

সর আইজাক নিউটন




 যে বৎসর গালিলিয় কলেবর পরিত্যাগ করেন সেই বৎসরেই আইজাক নিউটনের জন্ম হয়। তিনি, লিঙ্কলনসায়রের অন্তঃপাত,কোল্ট‌র্স‌ওয়ার্থ নামক গ্রামে ১৬৪২ খৃঃ অব্দের ২৫এ ডিসেম্বর, শরীর পরিগ্রহ করেন। তাঁহার পিতা তাদৃশ সঙ্গতিপন্ন ছিলেন না, কেবল যৎকিঞ্চিৎ ভূমি কর্ষণ দ্বারা জীবিকা সম্পাদন করিতেন। নিউটন সুবিখ্যাত কোপর্নি‌কস ও গালিলিয়ের উদ্ভাবিত বিষয় সমূহের প্রামাণ্য সংস্থাপনার্থেই জন্ম গ্রহণ করিয়া ছিলেন।

 তিনি প্রথমতঃ মাতৃ সন্নিধানে কিঞ্চিৎ শিক্ষা করিয়া দ্বাদশবর্ষ বয়ঃক্রম কালে গ্রন্থাম নগরের লাটিন পাঠশালায় প্রেরিত হন। তথায় তাঁহার, শিল্প‌বিষয়ক নব নব কৌশল প্রকাশ দ্বারা, শৈশবকালেই অসাধারণ বুদ্ধির লক্ষণ প্রদর্শিত হয়। ঐ সকল শিল্পকৌশল দর্শনে তত্রত্য‌ লোকেরা চমৎকৃত হইয়াছিল। পাঠশালার সকল লোকেই, বিরামের অবসর পাইলে, খেলায় আসক্ত হইত; কিন্তু তিনি সেই সময়ে নিবিষ্টমনা হইয়া ঘরট্ট প্রভৃতি যন্ত্রের প্রতিরূপ নির্ম্মাণ করিতেন। একদা তিনি একটা পুরাণ বাক্স‌ লইয়া জলের ঘড়ী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। ঐ ঘড়ীর শঙ্ক, বাক্স মধ্য হইতে অনবরত বিনির্গ‌ত জলবিন্দু পাত দ্বারা নিমগ্ন কাষ্ঠখণ্ড প্রতিঘাতে, পরিচালিত হইত; আর বেলাবোধনার্থ তাহাতে একটি প্রকৃত শঙ্কু‌পট্ট ব্যবস্থাপিত ছিল।

 নিউটন পাঠশালা হইতে বহির্গত হইলে ইহাই স্থির হইয়াছিল যে, তাঁহাকে কৃষিকর্ম্ম অবলম্বন করিতে হইবেক। কিন্তু অতি ত্বরায় ব্যক্ত হইল তিনি এরূপ পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপারে কোন ক্রমেই সমর্থ নহেন। সর্ব্বদাই এরূপ দেখা যাইত, যে সময়ে তাঁহার পশুরক্ষণ ও ভৃত্যগণের প্রত্যবেক্ষণ করিতে হইবেক তখন তিনি নিশ্চিন্তমনে তরুতলে উপবিষ্ট হইয়া অধ্যয়ন করিতেন। কৃষিলব্ধ দ্রব্যজাত বিক্রয়ার্থে গ্রন্থমের আপণে প্রেরিত হইলে, তিনি স্বসমভিব্যাহারী বৃদ্ধ ভূত্যের উপর সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহের ভার সমর্পণ করিয়া, পরিশুষ্ক তৃণরাশির উপর উপবেশন পূর্ব্বক গণিতবিষয়ক প্রশ্ন সমাধান করিতেন। জননী, তাঁহার বিদ্যাভ্যাস বিষয়ে এইরূপ স্বাভাবিক অতি প্রগাঢ় অনুরাগ দর্শনে, সমুৎসুক হইয়া পুনর্ব্বার আর কয়েক মাসের নিমিত্ত তাঁহাকে পাঠশালায় পাঠাইয়া দিলেন। পরে, ১৬৬০ খৃঃ অব্দের ৫ই জুন, তিনি কেম্ব্র‌িজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ব্বত্তী ত্রিনীতি নামক বিদ্যালয়ে বিদ্যার্থী রূপে পরিগৃহীত হইলেন।

 নিউটন, পরিশ্রম প্রজ্ঞা সুশীলতা ও অহমিকাশূন্য সদাচরণ দ্বারা, আইজাক বারো প্রভৃতি অধ্যাপকবর্গের অনুগৃহীত ও সহাধ্যায়িগণের প্রশংসাভূমি ও প্রণয়ভাজন হইয়াছিলেন। তিনি কেম্ব্র‌িজে প্রবিষ্ট হইয়া প্রথমতঃ সর্গু‌সন রচিত ন্যায়শাস্ত্র, কেপ্লরপ্রণীত দৃষ্টিবিজ্ঞান, ওয়ালিস লিখিত অস্থিতপাটীগণিত, এই কয়েক গ্রন্থ পাঠ করেন; সাতিশয় পরিশ্রম সহকারে ডেকার্ট রচিত রেখাগণিত গ্রন্থও অধ্যয়ন করেন; আর তৎকালে নক্ষত্রবিদ্যারও কিছু কিছু চর্চা থাকাতে তাহারও অনুশীলন করিয়াছিলেন। তিনি ইউক্লিডের গ্রন্থ অত্যল্প‌মাত্র পাঠ করেন। এরূপ প্রসিদ্ধ আছে যে তিনি, প্রাচীন গণিতজ্ঞদিগের গ্রন্থ উত্তম রূপে পাঠ করা হয় নাই বলিয়া, উত্তর কালে অনুতাপ করিয়াছিলেন।

 নিউটন, কেম্ব্র‌িজে অধ্যয়নকালে, আলোক পদার্থের তত্ত্বনির্ণয়ার্থ অত্যন্ত যত্নবান্ হইয়াছিলেন। ইহার পূর্ব্ব‌ে এই বিষয়ে লোকের অত্যল্প‌ জ্ঞান ছিল। বিখ্যাত পণ্ডিত ডেকার্ট এই সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে অন্তরিক্ষব্যাপী স্থিতিস্থাপক গুণোপেত অতি বিরল পদার্থবিশেষের সঞ্চালন বিশেষ দ্বারা আলোকের উৎপত্তি হয়। নিউটন এই মত খণ্ডন করিলেন। তিনি অন্ধকারাবৃত গৃহ মধ্যে প্রবেশ পূর্ব্বক বহুকোণবিশিষ্ট এক খণ্ড কাচ লইয়া কপাটের ক্ষুদ্র ছিদ্র দ্বারা তদুপরি সূর্য্য‌েরকিরণ পাতিত করিতে লাগিলেন। এইরূপ পরীক্ষা দ্বারা দেখিতে পাইলেন আলোক কাচের মধ্য দিয়া গমন করিয়া এ প্রকার ভঙ্গুর হইয়াছে যে, ভিত্তির উপর সপ্তবিধ বিভিন্ন বর্ণ প্রকাশ পাইয়াছে। অনন্তর অসাধারণ কৌশল পূর্ব্বক অশেষ প্রকারে পরীক্ষা করিয়া এই কয়েক মহোপকারক বিষয় নিৰ্দ্ধারিত করিলেন; আলোকপদার্থ কিরণাত্মক; ঐ সকল কিরণকে বিভক্ত করিয়া অণু করা যাইতে পারে; শুক্ল আলোকের প্রত্যেক কিরণে রক্ত, পীত, নীল, এই তিন মূলীভূত কিরণ আছে; এই ত্রিবিধ কিরণ অপেক্ষাকৃত ন্যূনাধিক ভঙ্গুর হইয়া থাকে। নিউটনের এই অসাধারণ অভিনব আবিষ্ক‌্র‌িয়াকে দৃষ্টিবিজ্ঞান শাস্ত্রের মূলসূত্র স্বরূপ গণনা করিতে হইবেক।

 ১৬৬৫ খৃঃ অব্দে, কেম্ব্র‌িজ নগরে অকস্মাৎ ঘোরতর মারী ভয় উপস্থিত হওয়াতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদায় ছাত্রকে স্থান ত্যাগ করিতে হইয়াছিল। নিউটনও ঐ সময়ে আত্মরক্ষার্থে আপন আলয়ে পলায়ন করিলেন। তথায় পুস্তকালয়ের অসদ্ভাব প্রযুক্ত ইচ্ছানুরূপ পুস্তক পাঠ করিতে পাইতেন না; এবং পণ্ডিতবর্গের অসন্নিধান প্রযুক্ত শাস্ত্রীয় আলাপেরও সুযোগ ছিল না। তথাপি, তিনি ঐ সময়ে গুরুত্বের নিয়ম অর্থাৎ বস্তুমাত্রের ভূতলাভিমুখে পাতপ্রবণতার বিষয় প্রথম প্রকাশ করিয়াছিলেন। উক্ত মহত্তর আবিষ্ক‌্র‌িয়া দ্বারা নিউটনের এই অনধ্যায় বৎসর সকল, তাঁহার জীবনের শ্লাঘ্যতম ভাগ ও বিজ্ঞানশাস্ত্রীয় ইতিবৃত্তেরও চিরস্মরণীয় ভাগ বলিয়া  এক দিবস তিনি উপবন মধ্যে উপবিষ্ট আছেন; এমন সময়ে দৈবযোগে তাঁহার সম্মুখবর্তী আতাবৃক্ষ হইতে এক ফল পতিত হইল। তদ্দ‌র্শনে তিনি তৎক্ষণাৎ বস্তুমাত্রের পতননিয়ামক সাধারণ কারণ বিষয়ক পর্য্য‌ালোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন। অনন্তর এই বিষয় পুনর্ব্ব‌ার আলোচনা করিয়া স্থির করিলেন, যে কারণানুসারে আতা ভূতলে পতিত হইল সেই কারণেই চন্দ্র ও গ্রহমগুলী স্ব স্ব কক্ষে ব্যবস্থাপিত আছে এবং তাহাই পরমাদ্ভুত শক্তি সহকারে অতি সহজে সমুদায় জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর গতি নিয়মিত করিতেছে। এইরূপে গুরুত্বের নিয়ম প্রকাশিত হইল। এই নিয়মের জ্ঞান দ্বারা জ্যোতির্ব্বিদ্যার অপেক্ষাকৃত অনেক শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছে।

 নিউটন, ১৬৬৭ খৃঃ অব্দে, কেম্ব্র‌িজে প্রত্যাগমন করিয়া ত্রিনীতি বিদ্যালয়ের ছাত্রবৃত্তি প্রাপ্ত হইলেন। দুই বৎসর পরে, তাঁহার বন্ধু ডাক্তর বারো গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপক পদ পরিত্যাগ করিলে, তিনি তাহাতে নিযুক্ত হইলেন। তিনি দৃষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ে যে সকল অভিনব মহত্তর নিয়ম প্রকাশ করিয়াছিলেন প্রথমতঃ কিছুকাল তদ্বিষয়েই অধিকাংশ উপদেশ প্রদান করেন। আলোক ও বর্ণ বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকাতে আপনার নূতন মত এমন পরিষ্কার রূপে বুঝাইয়া দিলেন যে শ্রোতৃবর্গেরা সন্তুষ্ট চিত্তে ভূরি ভূরি প্রশংসা করিয়াছিলেন।

 ১৬৭১ খৃঃ অব্দে, রএল সোসাইটী[] নামক রাজকীয় সমাজের ফেলো অর্থাৎ সহযোগী হইলেন। কিন্তু প্রসিদ্ধ আছে অন্যান্য সহযোগীর ন্যায় সভার ব্যয় নিৰ্বাহার্থে প্রতি সপ্তাহে রীতিমত এক এক সিলিং দিতে অসমর্থ হওয়াতে তাঁহাকে অগত্যা অদানের অনুমতি প্রার্থনা করিতে হইয়াছিল। যেহেতু, তৎকালে বিদ্যালয়ের বৃত্তিও অধ্যাপকতার বেতন এতদ্ব্যতিরিক্ত তাঁহার আর কোন প্রকার অর্থাগম ছিল না। আর পৈতৃক বিষয় হইতে যে কিছু কিছু উৎপন্ন হইত তাহা তাঁহারর জননী ও অন্যান্য পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনেই পর্য্যবসিত হইত। তাহার ভোগভৃষ্ণা এত অল্প ছিল যে আবশ্যক পুস্তকের ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের ক্রয় এবং অন্যের দারিদ্র্য দুঃখ বিমোচন এই উভয় সম্পন্ন হইলেই সন্তুষ্ট হইতেন, এতদ্ব্যতিরিক্তবিষয়ে অর্থাভাব জন্য ক্ষুণ্ণমনা হইতেন না।

 ১৬৮৩ খৃঃ অব্দে, তিনি প্রিন্সিপিয়া নামক অতি প্রধান গ্রন্থ রচনা করেন। ঐ পুস্তকে গণিত শাস্ত্রানুসারে পদার্থবিদ্যার মীমাংসা করা হইয়াছে। ১৬৮৮ খৃঃ অব্দে, যখন রাজবিপ্লব ঘটে কেম্ব্রি‌জ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিরূপ হইয়া পার্লি‌মেণ্ট[]নামক সমাজে উপস্থিত হইবার নিমিত্ত সকলে তাঁহাকে মনোনীত করিয়াছিল; এবং ১৭৩১ খৃঃ অব্দেও ঐ মর্য্যাদার পদ পূনর্ব্বার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। যে সকল ব্যক্তির যথার্থ উপকার ও পুরস্কার করিবার ক্ষমতা ছিল; নিউটনের অসাধারণ গুণ তাঁহাদের গোচর হওয়াতে তিনি তদীয় আনুকূল্য বলে টাকশালের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হইলেন। সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম অনুসন্ধান বিষয়ে অত্যন্ত সহিষ্ণুতা ও সবিশেষ নৈপুণ্য থাকাতে তিনিই সর্ব্বাপেক্ষায় ঐ পদের উপযুক্ত ছিলেন। নিউটন মৃত্যুকাল পর্যন্ত ঐ কার্য্য সম্পাদন করিয়া সর্ব্বত্র সূখ্যাতি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

 অতঃপর নিউটন বহুতর প্রশংসা ও পুরস্কার প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন। লিবনিজ নামক এক জন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত, নিউটনের নব নব আবিষ্ক‌্র‌িয়ানিবন্ধন অসাধারণ সন্মান দর্শনে ঈর্ষ্যাপরবশ হইয়া তদ্বিলোপবাসনায় তাঁহার নিকট এক প্রশ্ন প্রেরণ করেন। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন নিউটন কোন রূপেই ইহার সমাধান করিতে পারবেন না তাহা হইলেই আমার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হইবেক। নিউটন টাকশালের সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর সায়াহ্নে ঐ প্রশ্ন পাইলেন এবং শয়নের পুর্ব্বেই তাহার সমাধান করিয়া রাখলেন। তৎপরে আর কোন ব্যক্তিই কখন নিউটনের কীর্ত্তিবিলোপের চেষ্টা করে নাই। ১৭০৫ খৃঃ অব্দে ইংলণ্ডেশ্বরী এন, নিউটনের মানবৰ্দ্ধনার্থে, তাহাকে নাইট্‌[] উপাধি প্রদান করেন।

 নিউটন উদারস্বভাবতা প্রযুক্ত সামান্য সামান্য লৌকিক ব্যাপারেও বিশেষ অবহিত ছিলেন। সর্ব্বদা আত্মীয়গণের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেন এবং তাঁহারাও সাক্ষাৎ করিতে আসিলে সমুচিত সমাদর করিতেন। কথোপকথন কালে আত্মপ্রাধান্য প্রখ্যাপন করিতেন না। তিনি স্বভাবতঃ সুশীল, সরল ও প্রফুল্লচিত্ত ছিলেন; এই নিমিত্ত সকল ব্যক্তিই তাঁহার সহবাস বাসনা করিত। লোকের সর্ব্ব‌দা যাতায়াত দ্বারা মহার্ঘ‌্য‌ সময়ের অপক্ষয় হইলেও তিনি কিঞ্চিম্মাত্র বিরক্তভাব প্রকাশ করিতেন না। কিন্তু প্রত্যূষে গাত্রোত্থা‌নের নিয়ম এবং বিশেষ বিশেষ কার্য্যে বিশেষ বিশেষ সময় নিরূপিত থাকাতে, অধ্যয়ন ও গ্রন্থরচনার নিমিত্ত সময়াল্প‌তানিবন্ধন কোন ক্ষোভ থাকিত না। তিনি অবসর পাইলেই হস্তে লেখনী ও সম্মুখে পুস্তক লইয়া বসিতেন।

 নিউটন অত্যন্ত দয়ালু ও দানশীল ছিলেন এবং কহিতেন যাহারা জীবদ্দশায় দান না করে তাহাদের দান দানই নয়। অত্যন্ত বৃদ্ধ বয়সেও তদীয় অদ্ভুত ধীশক্তির কিঞ্চিন্মাত্র বৈলক্ষণ জন্মে নাই। আর আহারনিয়ম সার্ব্বকালিক প্রফুল্লচিত্ততা ও স্বাভাবিক শরীরপটুতা প্রযুক্ত জরা তাঁহাকে পরাভূত করিতে পারে নাই। তিনি নাতিদীর্ঘ, নাতিখর্ব্ব, কিঞ্চিৎ স্থূলকায় ছিলেন। তাঁহার নয়নে সজীবতা, তীক্ষ্ণতা ও বুদ্ধিমত্তা স্পষ্ট প্রকাশ পাইত। দেখিলেই তাঁহার আকৃতি সজীবতা ও দয়ালুতাতে পরিপূর্ণ বোধ হইত। অন্তিম ক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার দর্শনশক্তি অব্যাহত ছিল। কেশ সকল শেষ বয়সে তুষারের ন্যায় শুভ্র হইয়াছিল। চরম দশাতে তাঁহার অত্যন্ত অসহ্য দৈহিক যাতনা ঘটে। কিন্তু তিনি স্বভাবসিদ্ধ সহিষ্ণুতা প্রভাবে তাহাতে নিতান্ত কাতর হয়েন নাই। অনন্তর ১৭২৭ খৃঃ অব্দের ২০এ মার্চ্চ‌ চতুরশীতি বর্ষ বয়ঃক্রম কালে কলেবর পরিত্যাগ করিলেন।

 নিউটনের চরিত্র সাধারণ লোকের চরিত্রের ন্যায় নহে। উহা এমন সুন্দর যে চরিতাখ্যায়ক ব্যক্তি লিখিতে লিখিতে পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হন। এবং যে উপায়ে তিনি মনুষ্য মণ্ডলী মধ্যে অবিসংবাদিত প্রাধান্য প্রাপ্ত হইয়াছিলেন তাহা পর্য্যালোচনা করিলে মহোপকার ও মহার্থ লাভ হইতে পারে। নিউটন অত্যুৎকৃষ্ট বুদ্ধিশক্তি সম্পন্ন ছিলেন; কিন্তু তদপেক্ষায় স্থানবুদ্ধিরাও তদীয় জীবনবৃত্ত পাঠে পদে পদে উপদেশ লাভ করিতে পারেন। তিনি অলৌকিক বুদ্ধিশক্তি প্রভাবে গ্রহগণের গতি, ধূমকেতুদিগের কক্ষ, সমুদ্রের জলোচ্ছাস এই সকল বিষয়ের মীমাংসা করিয়াছেন। নিউটন আলোক ও বর্ণ এই উভয় পদার্থের স্বরূপ নির্ণয় করিয়াছেন। তাঁহার পুর্ব্বে এই বিষয় কোন ব্যক্তির মনেও উদয় হয় নাই। তিনি সাতিশয় পরিশ্রম ও দক্ষতা সহকারে অদ্ভুত বিশ্বরচনার যথার্থ তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন; আর তাঁহার সমুদায় গবেষণা দ্বারাই সৃষ্টিকর্ত্তার মহিমা, প্রজ্ঞা, ও অনুকম্পা প্রকাশ পাইয়াছে।  এইরূপ লোকোত্তর বুদ্ধি বিদ্যা সম্পন্ন হইয়াও তিনি স্বভাবতঃ এমন বিনীত ছিলেন যে আপন বিদ্যার কিঞ্চিন্মাত্র অভিমান করিতেন না। তাঁহার এই এক সুপ্রসিদ্ধ কথা ধরাতলে জাগরূক আছে যে আমি বালকের ন্যায় বেলাভূমি হইতে উপলখণ্ড সঙ্কলন করিতেছি; কিন্তু জ্ঞানমহার্ণব পুরোভাগে অক্ষুণ্ণ‌ রহিয়াছে।



  1. ইংলণ্ডের অধীশ্বর দ্বিতীয় চালর্স্‌ পদার্থবিদ্যার উন্নতি নিমিত্ত, সপ্তদশ শতাব্দীতে, ইংলণ্ডের রাজধানী লণ্ডন নগরে এই সমাজ স্থাপন করেন। এই সমাজের লোকদিগকে ফেলো বলে। যাহার অসাধারণ বিদ্যাসম্পন্ন হয়েন তাঁহারাই এই সমাজের ফেলো হইতে পারেন। সমুদায়ে সমাজের ফেলে একুশ জন; তন্মধ্যে এক জন সভাপতি, এক জন সহকারী সভাপতি, এক জন ধনাধ্যক্ষ, এবং দুই জন সম্পাদক। এই রাজকীয় সমাজ দ্বারা পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে অশেষবিধ মহোপকার জন্মিয়াছে।
  2. ইংলণ্ডের রাজকার্য্য কেবল রাজার ইচ্ছানুসারে সম্পন্ন হয় না; রাজা এই সমাজের মতানুসারে যাবতীয় রাজকার্য্য নির্ব্ব‌াহ করিয়া থাকেন। এই সমাজ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত; এক শ্রেণীতে দেশের কতকগুলি সম্ভ্রান্ত লোক থাকেন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে সামান্য লোকেরা। এক এক প্রদেশের সামান্য লোকেরা আপনাদিগের এক এক জন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। ইংলণ্ডের যাবতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হইতেও এই সমাজে এক এক জন প্রতিনিধি প্রেরিত হইয়া থাকেন। সন্ত্রান্ত লোকেরা এবং সামান্য লোকদিগের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োজিত প্রতিনিধিরা রাজকীয় আদেশানুসারে সময়ে সময়ে এই সমাজে সমাগত হইয়া রাজকার্য্য চিন্তা করিয়া থাকেন। ইঁহারা যে নিয়ম নিৰ্দ্ধারিত করেন রাজার সম্মতি হইলেই সমুদায় রাজ্য মধ্যে সেই নিয়ম প্রচলিত হয়।
  3. বহুকাল পূর্ব্ব‌ে, ইয়ুরোপে যে সকল ব্যক্তিরা কোন সৈন্যসংক্রান্ত পদে অধিরূঢ় হইত, তাহাদিগকে নাইট্‌ বলিত। যাহার প্রধানবংশজাত ও ঐশ্বর্য্যশালী লোকের সন্তান, তাহারাই নাইট্‌ হইত। এই নিমিত্ত উহা এক্ষণে সন্ত্রম ও মর্য্য‌াদাসূচক উপাধি হইয়া উঠিয়াছে। যাঁহারা অসাধারণ গুণসম্পন্ন অথবা ক্ষমতাপন্ন হয়েন, তাঁহারাই অধুনা রাজপ্রসাদে এই মর্য্য‌াদার উপাধি পাইয়া থাকেন। এই উপাধি প্রাপ্ত ব্যক্তিরা আনুষঙ্গিক সর এই উপাধিও প্রাপ্ত হয়েন। এই উপাধি নাইটদিগের নামের পুর্বে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। যথা; সর আইজাক নিউটন, সর উইলিয়ম হর্শেল, সর উইলিয়ম জোন্স ইত্যাদি।