জীবনচরিত/সর উইলিয়ম হর্শেল
সর উইলিয়ম হর্শেল।
কোপর্নিকসের সময়াবধি টাইকো ব্রেহি, কেপ্লর, হিগিন্স, নিউটন, হেলি, ডিলাইল, লেলণ্ড ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ জ্যোতির্ব্বিদবর্গের প্রযত্ন ও পরিশ্রম দ্বারা জ্যোতির্ব্বিদ্যার ক্রমে ক্রমে উন্নতি হইয়া আসিতেছিল। পরে যে চিরস্মরণীয় মহানুভাবের আবিষ্ক্রিয়া দ্বারা উক্ত বিদ্যার এককালে ভূয়সী শ্রীবৃদ্ধি হয় এক্ষণে তদীয় জীবনবৃত্ত লিখিতে প্রবৃত্ত হইতেছি।
উইলিয়ম হর্শেল, ১৭৩৮ খৃঃ অব্দের ১৫ই নবেম্বর, হানোবরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহারা চারি সহোদর; তন্মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ছিলেন। তাঁহার পিতা তূর্য্যাজীব ব্যবসায় দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিতেন। সুতরাং তাঁহারাও চারি সহোদরে উত্তরকালে ঐ ব্যবসায়ে ব্রতী হইবার নিমিত্ত তাহাই শিক্ষা করেন। হর্শেলের অল্প বয়সেই বিদ্যানুশীলন বিষয়ে সবিশেষ অনুরাগ প্রকাশ হওয়াতে, পিতা তাঁহাকে শিক্ষা দিবার নিমিত্ত এক শিক্ষক নিযুক্ত করেন। তিনি তাঁহার নিকট ন্যায়, নীতি ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ক প্রথমপাঠ্য গ্রন্থ সকল অধ্যয়ন করিয়া উক্ত দুরূহ বিদ্যাত্রিতয়ে এক প্রকার ব্যুৎপন্ন হইয়া উঠিলেন।
কিন্তু পিতা মাতার অসঙ্গতি ও অন্যান্য কতিপয় প্রতিবন্ধক প্রযুক্ত ত্বরায় তাঁহার বিদ্যানুশীলনে ব্যাঘাত জন্মিল। তৎপরে চতুর্দশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে এক সৈনিক দলসংক্রান্ত বাদ্যকর সম্প্রদায়ে নিয়োজিত হইলেন; এবং ১৭৫৭, অথবা ১৭৫৯, খৃঃ অব্দে ঐ সৈনিক দল সমভিব্যাহারে ইংলণ্ড যাত্রা করিলেন। তাঁহার পিতাও সেই সঙ্গে ইংলণ্ড গমন করিয়াছিলেন; পরে কতিপয় মাসান্তে স্বদেশে প্রত্যাগমন করেন। কিন্তু হর্শেল,ইংলণ্ডে থাকিয়া ভাগ্য পরীক্ষা করিয়া দেখিবার নিমিত্ত পিতার সম্মতি লইয়া তথার অবস্থিতি করিলেন। এইরূপ অনেকানেক ধীসমৃদ্ধ বৈদেশিকের স্বদেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক ইংলণ্ডে বাস্তব্য করিয়া থাকেন।
হর্শেল কোন সময়ে ও কি প্রকারে উক্ত সৈনিক দল সংক্রান্ত সম্প্রদায় পরিত্যাগ করেন আমরা তাহা অবগত নহি। কিন্তু তাঁহাকে যে প্রথমতঃ কিয়ৎকাল দুঃসহ ক্লেশ পরম্পরায় কালযাপন করিতে হইয়াছিল, এবং ইঙ্গরেজী ভাষায় বিশিষ্টরূপ জ্ঞান না থাকাতে যে অত্যন্ত বিরক্ত হইতে হইয়াছিল, তাহার সন্দেহ নাই। পরিশেষে সৌভাগ্যক্রমে অরল অব ডার্লিংটনের অনুগ্রহোদয় হওয়াতে তিনি তাঁহাকে এক সৈনিক বাদ্যকর সম্প্রদায়ের অধ্যক্ষতা ও উপদেশকতা কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন। পরে এই কর্ম্ম সমাধান করিয়া ইয়র্কসরে তুর্য্যাচার্য্যের কার্য্যে নিযুক্ত হইয় কতিপয় বৎসর অতিবাহন করিলেন। তিনি প্রধান প্রধান নগরে শিষ্যদিগকে উপদেশ দিতেন; এবং দেবালয় সম্পৰ্কীয় তুর্য্যাজীব সম্প্রদায়ের অধ্যক্ষের প্রতিনিধি হইয়া তদীয় কার্য্য নির্ব্বাহ করেন। এই কর্ম্মে জর্ম্মন জাতীয়েরা বিশেষ নিপুণ; যেহেতু তাঁহারা তুর্য্য বিদ্যায় বিশেষ অনুরক্ত।
হর্শেল এবম্বিধ অনিন্দিত পথ অবলম্বন করিয়া অন্ন চিন্তায় একান্ত ব্যাসক্ত হইয়াও আর আর চিন্তা একবারেই পরিত্যাগ করেন নাই। বিষয় কর্ম্মে অবসর পাইলেই, তিনি একচিত্ত হইয়া, আগ্রহাতিশয় সহকারে, ইঙ্গরেজী ও ইটালিক ভাষার অনুশীলন এবং বিনা সাহায্যে লাটিন ও গ্রীক ভাষা অভ্যাস করিতেন। তৎকালে তিনি এই মুখ্য অভিপ্রায়েই উক্ত সমস্ত বিদ্যার অনুশীলন করিতেন যে উহা নিজ ব্যবসায়িকী বিদ্যার আলোচনা বিষয়ে বিশেষ উপযোগিনী হইবেক; এবং উত্তর কালেও, এই উদ্দেশ্যেই ডাক্তর রবর্টস্মিথ রচিত তুর্য্যবিষয়ক গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন, সন্দেহ নাই। তৎকালে ইঙ্গরেজী ভাষাতে তুর্য্য বিদ্যা বিষয়ে যত গ্রন্থ প্রচলিত ছিল ইহা তাহার মধ্যে এক অতি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ।
কিন্তু এই পুস্তকের অনুশীলন, অনতিবিলম্বে তাঁহার বর্তমান ব্যবসায় পরিত্যাগের এবং ব্যবসায়ান্তরাবলম্বনের কারণ হইয়া উঠিল। তিনি ত্বরায় বুঝিতে পারিলেন গণিত বিদ্যায় ব্যুৎপন্ন না হইলে ডাক্তর স্মিথের গ্রন্থের অনুশীলনে বিশেষ উপকার দর্শিবেক না। অতএব স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ অনুরাগ ও অধ্যবসায় সহকারে এই নূতন বিদ্যার অনুশীলনে নিবিষ্টমনা হইলেন; এবং অল্প দিনের মধ্যেই তাহাতে এমন আসক্ত হইয়া উঠিলেন যে অবসর পাইলে অন্যান্য যে যে বিষয়ের আলোচনা করিতেন সে সমুদায় এই অনুরোধে এক বারেই পরিত্যক্ত হইল।
ইতিপূর্ব্বে হর্শেল, বেটস নামক এক ব্যক্তির নিকট বিশিষ্টরূপ পরিচিত হইয়াছিলেন। এক্ষণে তাঁহার প্রযত্নে ও আনুকূল্যে ১৭৬৫ খৃঃ অব্দের শেষ ভাগে হালিফাক্লের দেবালয়ে তূর্য্যাজীবের পদে নিযুক্ত হইলেন। পর বৎসর সামান্য রূপ তূর্য্য কর্ম্মের অনুরোধে জ্যেষ্ঠ সহোদরের সহিত বাথ নামক নগরে গমন করেন। তথায় অসাধারণ নৈপুণ্য প্রকাশ দ্বারা শুশ্রূষুদিগকে পরম পরিতোষ প্রদান করাতে, সেই নগরের এক দেবালয়ে তুর্য্যাজীবের পদ প্রাপ্ত হইলেন। অতএব তদবধি সেই স্থানে গিয়া অবস্থিতি করিলেন।
তিনি এক্ষণে যে পদে নিযুক্ত হইলেন তাহ নিতান্ত সামান্য নহে। এতদ্ব্যতিরিক্ত রঙ্গভূমি ও অন্যান্য স্থানে তুর্য্যপ্রয়োগ এবং শিষ্যমণ্ডলীকে শিক্ষাপ্রদানাদির উত্তম রূপ অবকাশ ও সুযোগ ছিল। অতএব অর্থে পার্জন যদি তাঁহার মুখ্য অভিপ্রায় হইত, তাহা হইলে, তিনি অবলম্বিত ব্যবসায় দ্বারা বিলক্ষণ সঙ্গতি করিতে পারিতেন। এইরূপে কর্ম্মের বাহুল্য হইলেও, বিদ্যানুশীলন বিষয়ে তাঁহার যে গাঢ়তর অনুরাগ ছিল, তাহার কিঞ্চিন্মাত্রও ব্যতিক্রম হইল না। প্রত্যহ তুর্য্য বিষয়ে ক্রমাগত দ্বাদশ অথবা চতুর্দ্দশ হোরা পরিশ্রম করিয়া অত্যন্ত ক্লান্ত হইতেন; কিন্তু তৎপরে এক মুহূর্ত্তও বিশ্রাম না করিয়া পুনর্ব্বার বিশুদ্ধ ও বিমিশ্র গণিত বিদ্যার অনুশীলন আরম্ভ করিতেন।
এইরূপে ক্রমে ক্রমে রেখাগণিতে ব্যুৎপন্ন হইয়া উঠিলেন এবং তখন আপনাকে পদার্থবিদ্যার অনুশীলনে সমর্থ জ্ঞান করিলেন। পদার্থবিদ্যার নানা শাখার মধ্যে জ্যোতিষ ও দৃষ্টিবিজ্ঞান এই দুই বিষয়ে তাঁহার সবিশেষ অনুরাগ জন্মে। ঐ সময়ে জ্যোতিষসংক্রান্ত কতিপয় অভিনব আবিস্ক্রিয়া দর্শনে তাঁহার অন্তঃকরণে অত্যন্ত কৌতুহল উদ্বুদ্ধ হইল। তদনুসারে তিনি অবকাশ কালে উক্ত বিদ্যাবিষয়ক গবেষণাতে মনোনিবেশ করিলেন।
গ্রহমণ্ডলীবিষয়ক যে যে অদ্ভুত ব্যাপার পুস্তকে পাঠ করিয়াছিলেন, সে সমস্ত স্বয়ং পর্য্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত, কোন প্রতিবেশবাসীর সন্নিধান হইতে, একটি দ্বিপাদপ্রমিত দূরবীক্ষণ চাহিয়া আনিলেন। তদ্দর্শনে অপরিসীম হর্ষ প্রাপ্ত হইয়া, ক্রয় করিবার বাসনায়, অবিলম্বে ইংলণ্ডের রাজধানী লণ্ডন নগর হইতে, তদপেক্ষায় অনেক বড় একটা আনাইবার উদ্যোগ করিলেন। কিন্তু তিনি যত অনুমান করিয়াছিলেন ও তাঁহার যত দিবার সঙ্গতি ছিল, তাহার মূল্য তদপেক্ষায় সমধিক হইবাতে ক্রয় করিতে পারিলেন না; সুতরাং যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ পাইলেন। ক্ষোভ পাইলেন বটে; কিন্তু ভগ্নোৎসাহ হইলেন না—তৎক্ষণাৎ সেই অক্রেয় দূরবীক্ষণের তুল্যবল দূরবীক্ষণান্তর নির্ম্মাণ স্বহস্তেই আরম্ভ করিলেন। এই বিষয়ে বারম্বার বিফলপ্রযত্ন হইয়াও তিনি পরিশেষে চরিতার্থতা লাভ করিলেন। প্রযত্ব বৈফল্য দ্বারা তাহার উৎসাহের উত্তেজনাই হইত।
যে পথে হর্শেলের প্রতিভা দেদীপ্যমান হইবেক, এক্ষণে তিনি সেই পথের পথিক হইলেন। ১৭৭৪ খৃঃ অব্দে, তিনি স্বহস্তে নির্ম্মিত প্রাতিফলিক পাঞ্চপাদিক দূরবীক্ষণ দ্বারা শনৈশ্চর গ্রহ নিরীক্ষণ করিয়া অনির্ব্বচনীয় আনন্দ প্রাপ্ত হইলেন। দূরবীক্ষণ নির্ম্মাণ ও জ্যোতিষসংক্রান্ত আবিষ্ক্রিয়া বিষয়ে যে এতাবতী সাধীয়সী সিদ্ধিপরম্পরা ঘটিয়াছে এই তার সূত্রপাত হইল। হর্শেল অতঃপর, বিদ্যানুশীলন বিষয়ে পূর্ব্বাপেক্ষায় অধিকতর অনুরাগসম্পন্ন হইয়া সমধিক সময় লাভ বাসনায়, অর্থলাভপ্রতিরোধ স্বীকার করিয়াও, স্বীয় ব্যবসায়িক কর্ম্ম ও শিষ্যসংখ্যার ক্রমে ক্রমে সঙ্কোচ করিতে লাগিলেন; এবং সর্ব্ব প্রথম যাদৃশ যন্ত্র নির্মাণ করিয়াছিলেন, অবকাশ কালে ব্যাপারান্তর বিরহিত হইয়া, তদপেক্ষায় অধিকশক্তিক যন্ত্রনির্ম্মাণে ব্যাপৃত রহিলেন। এইরূপে অচির কালের মধ্যেই সপ্ত, দশ ও বিংশতি পাদ আধিশ্রয়ণিক ব্যবধি বিশিষ্ট কতিপয় দূরবীক্ষণ নির্ম্মিত হইল।
এইসকল যন্ত্রের মুকুর নির্ম্মাণে তিনি অক্লিষ্ট অধ্যবসায় প্রদর্শন করিয়াছেন। সাপ্তপাদিক দূরবীক্ষণের জন্যে মনোমত একখানি মুকুর প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত, তিনি ক্রমে ক্রমে অন্যূন দুই শত খান গঠন ও একে একে তৎপরীক্ষণ অবিরক্ত চিত্তে করিয়াছিলেন। যখন তিনি মুকুর নির্ম্মাণে বসিতেন ক্রমাগত দ্বাদশ চতুর্দশ হোর পরিশ্রম করিতেন, মধ্যে এক মুহর্ত্তের নিমিত্তেও বিরত হইতেন না। অন্য কথা দূরে থাকুক আহারানুরোধেও প্রারব্ধ কর্ম্ম হইতে হস্তোত্তোলন করিতেন না। ঐ কালে তাঁহার সহোদরা যৎকিঞ্চিৎ যাহা মুখে তুলিয়া দিতেন তন্মাত্রই আহার হইত। তিনি এই আশঙ্কা করিতেন যে কর্ম্ম আরম্ভ করিয়া মধ্যেক্ষণমাত্রও ভঙ্গ দিলে সম্যক্ সমাধানের ব্যতিক্রম ঘটিতে পারে। তিনি মুকুর নির্ম্মাণ বিষয়ে প্রচলিত নিয়মের নিতান্ত অনুবর্ত্তী না হইয়া স্বীয় বুদ্ধিকৌশলেই অধিকাংশ সম্পাদন করিতেন।
হর্শেল, ১৭৮১ খৃঃ অব্দের ১৩ই মার্চ, যে নুতন গ্রহের আবিষ্ক্রিয়া করেন বোধ হয় সর্ব্বাপেক্ষা তদ্দ্বারাই লোক সমাজে সমধিক বিখ্যাত হইয়াছেন। তিনি ক্রমাগত প্রায় দেড় বৎসর রীতিমত নভোমণ্ডলের পর্য্যবেক্ষণে ব্যাপৃত ছিলেন। দৈবযোগে উল্লিখিত দিবসের সায়ং সময়ে সেই স্বহস্তবিনির্ম্মিত অত্যুৎকৃষ্ট সাপ্তপাদিক প্রাতিফলিক দূরবীক্ষণ নভোমণ্ডলৈকদেশে প্রয়োগ করিয়া এক নক্ষত্র দেখিতে পাইলেন। বোধ হইল, তৎসন্নিহিত সমুদায় নক্ষত্র অপেক্ষা তাহার প্রভা স্থিরতর। উক্ত হেতু প্রযুক্ত ও তদীয় আকারগত অন্যান্য বৈলক্ষণ্য দর্শনে, সংশয়ান হইয়া তদ্বিষয়ে সবিশেষ অভিনিবেশ পুর্ব্বক পর্যবেক্ষণ আরম্ভ করিলেন। কতিপয় হোরার পর পুনর্ব্বার পর্যবেক্ষণ করাতে উহা স্থান পরিত্যাগ করিয়াছে ইহা স্পষ্ট অনুভব করিয়া, তিনি সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। পর দিন এই বিষয়ে অনেক সন্দেহ দূর হইল। প্রথমতঃ তাঁহার অন্তঃকরণে এই সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল যে পূর্ব্ব পূর্ব্ব বারে যাহা দেখিয়াছি ইহা সেই নক্ষত্র কি না। কিন্তু ক্রমাগত আর কয়েক দিবস পর্য্যবেক্ষণ করাতে তদ্বিষয়ক সমুদায় দ্বৈধ অন্তৰ্হিত হইল।
অনন্তর এই সমুদায় ব্যাপার রাজকীয় জ্যোতির্ব্বিদ ডাক্তর মাস্কিলিনের গোচর করিলেন। তিনি আদ্যোপান্ত বিবেচনা করিয়া এই সিদ্ধান্ত করিলেন ইহা নূতন ধূমকেতু না হইয়া যায় না। কিন্তু আর কয়েক মাস ক্রমিক পর্য্যবেক্ষণ করাতে এই ভ্রান্তি নিরাকৃত হইল। এবং তখন স্পষ্ট বোধ হইল যে ইহা এক অনাবিষ্কৃতপূর্ব্ব নুতন গ্রহ, ধূমকেতু নহে। আমাদের অধিষ্ঠানভূতা পৃথিবী যে সৌর জগতের অন্তর্গত এই নূতন গ্রহও তদন্তর্ব্বর্ত্তী[১]। তৎকালে তৃতীয় জর্জ ইংলণ্ডের অধীশ্বর ছিলেন। হর্শেল তাঁহার মর্য্যাদা নিমিত্ত তদীয় নামানুসারে স্বাবিষ্কৃত নক্ষত্রের নাম জর্জিয়ম সাইডস্ অর্থাৎ জর্জ নক্ষত্র রাখিলেন। কিন্তু ইয়ুরোপের প্রদেশান্তরীয় জ্যোতির্ব্বিদেরা ইহার যুরেনস্ এই নাম নির্দেশ করিয়াছেন। আর আবিষ্কর্ত্তার নামানুসারে এই গ্রহকে হর্শেলও বলিয়া থাকেন। তদনন্তর হর্শেল ক্রমে ক্রমে স্বাবিষ্কৃত নূতন গ্রহের ছয় পারিপাশ্বিক অর্থাৎ চন্দ্র প্রকাশ করিলেন।
জর্জিয়ম সাইডসের আবিষ্ক্রিয়া বার্তা প্রচার হইলে, হর্শেলের নাম একবারে জগদ্বিখ্যাত হইল। কয়েক মাসের মধ্যেই ইংলণ্ডেশ্বর এই অভিপ্রায়ে তাহার বার্ষিক ত্রিসহস্র মুদ্রা বৃত্তি নিৰ্দ্ধারিত করিয়া দিলেন, যে তিনি বাথ নগরীর কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া নিশ্চিন্ত মনে বিদ্যানুশীলনে রত থাকিতে পারবেন। হর্শেল তদনুসারে ঐ কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া উইণ্ডসর সন্নিহিত স্লো নামক স্থানে অবস্থিতি নিরূপণ করিলেন। অতঃপর তিনি অনন্যকর্ম্মা ও অনন্যমনা হইয়া কেবল পদার্থ বিদ্যার অনুশীলনেই রত হইলেন। বাস্তবিকও, ক্রমাগত দূরবীক্ষণ নির্ম্মাণ ও নভোমণ্ডলী পর্য্যবেক্ষণ দ্বারাই জীবনের শেষ ভাগ যাপন করিয়াছিলেন।
আমরা পূর্ব্বে যে নূতন গ্রহের আবিষ্ক্রিয়া নির্দ্দেশ করিয়া আসিলাম তদ্ব্যতিরিক্ত নানাবিধ মহোপকারক অভিনব আবিষ্ক্রিয়া ও অতর্কিতচর বহুতর নিপূণ প্রগাঢ় কম্পনা দ্বারা জ্যোতির্ব্বিদ্যার বিশিষ্টরূপ শ্রীবৃদ্ধি সম্পাদন করিয়াছেন। তিনি পূর্ব্ব পূর্ব্ব অপেক্ষায় অধিকায়ত ও অধিকশক্তিক প্রাতিফলিক দূরবীক্ষণনির্ম্মণবিষয়ে কতিপয় মহোপকারিণী সুবিধা প্রদর্শন করেন। তিনি স্লোনামক স্থানে, ইংলণ্ডেশ্বরের নিমিত্ত চত্বারিংশৎ পাদ দীর্ঘ যে দূরবীক্ষণ প্রস্তুত করেন তাহাই সর্ব্বাপেক্ষায় বৃহৎ। ১৭৮৫ খঃ অব্দের শেষে, তিনি এই অতিবৃহৎ নল নির্ম্মাণ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। পরে, ১৭৮৯ খৃঃ অব্দে ২৭এ আগষ্ট, এক যন্ত্রোপরি সন্নিবেশিত হইয়া ব্যবহারযোগ্য হইল। ঐ যন্ত্র অতিশয় জটিল বটে কিন্তু প্রগাঢ়তর বুদ্ধিকৌশলে সম্পাদিত। উহা দ্বারা ঐ নলের সঞ্চালনাদি ক্রিয়া নিয়মিত হইত। শনৈশ্চরের ষষ্ঠ পারিপার্শ্বিক বলিয়া যাহাকে সকলে অনুমান করিত সন্নিবেশ দিবসেই সেই দূরবীক্ষণ দ্বারা তাহা উদ্ভাবিত হইল। কিয়দ্দিনানন্তর ঐ নল দ্বারা শনৈশ্চরের সপ্তম পারিপার্শ্বিকও আবিষ্কৃত হয়। এক্ষণে ঐ নল স্বস্থান হইতে অপসারিত হইয়াছে এবং তৎপরিবর্তে হর্শেলের সুবিখ্যাত পুত্রের হস্তবিনির্ম্মিত অত্যুৎকৃষ্ট অন্য এক দূরবীক্ষণ তথায় স্থাপন করা গিয়াছে। ইহা দৈর্ঘ্যে পুর্ব্বযন্ত্রের অৰ্দ্ধেকের অধিক নহে।
ইহা নির্দিষ্ট আছে এই প্রধান জ্যোতির্ব্বিদ, স্বাভিলষিত বিদ্যার আলোচনা বিষয়ে এমন অনুরক্ত ছিলেন যে অনেক বৎসর পর্য্যন্ত নক্ষত্রদর্শনযোগ্য কালে কখনই শয্যারূঢ় থাকিতেন না; আর কি শীত কি গ্রীষ্ম, সকল ঋতুতেই নিজ উদ্যানে অনাবৃত প্রদেশে প্রায় একাকী অবস্থিত হইয়া সমুদায় পর্য্যবেক্ষণ সমাধান করেন। তিনি এই সমস্ত গবেষণা দ্বারা দূরতরবর্ত্তী নক্ষত্র সমূহের ভাব অবগত হইয়। তদ্বিষয়ের সবিশেষ বিবরণ স্বাভিপ্রায় সহিত পত্রারূঢ় করিয়া প্রচার করেন।
হর্শেল তৎকালজীবী প্রধান প্রধান জ্যোতির্জ্ঞবর্গের মধ্যে গণনীয় হইয়াছিলেন এবং পণ্ডিতসমাজে ও রাজসন্নিধানে যথেষ্ট মর্য্যাদা পাইয়াছিলেন। ১৮১৬ খৃঃ অব্দে, যুবরাজ চতুর্থ জর্জ তাঁহাকে নাইটের পদ প্রদান করেন। হর্শেল, প্রথমে সেনাসম্পৰ্কীয় তুর্য্যসম্প্রদায়নিযুক্ত এক দরিদ্র বালকমাত্র ছিলেন; কিন্তু বহুমঙ্গলহেতুভূত জ্যোতির্ব্বিদ্যার শ্রীবৃদ্ধি বিষয়ে দীর্ঘ কাল পর্যন্ত গরীয়সী আয়াসপরম্পর স্বীকার করাতে, পরিশেষে এই রূপে পুরস্কৃত হইলেন। হর্শেল, মৃত্যুর কতিপয় বৎসর পূর্ব্ব পর্যন্তও জ্যৌতিষিক পর্য্যবেক্ষণে ক্ষান্ত হয়েন নাই। অনন্তর ১৮২২ খৃঃ অব্দে আগষ্ট মাসের ত্রয়োবিংশ দিবসে ত্র্যশীতি বর্ষ বয়ঃক্রম কালে লোকযাত্রা সম্বরণ করিলেন। তিনি যথেষ্ট বয়স্ ও যথেষ্ট মান প্রাপ্ত হইয়া এবং পরিবারের নিমিত্ত অপ্রমিত সম্পত্তি রাখিয়া তনুত্যাগ করিয়াছেন। ঐ পরিবার, তদীয় অপ্রমিত ধন সম্পত্তির ন্যায় তদীয় অদ্ভুত ধীসম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হইয়াছেন।
- ↑ সূর্য্যসিদ্ধান্ত প্রভৃতির মতে পৃথিবী স্থিরা; আর সূর্য্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ প্রভৃতি গ্রহগণ তাহার চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করে। কিন্তু অধুনাতন ইয়ুরোপীয় পণ্ডিতেরা যে অখণ্ডনীয় অভ্রান্ত সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাহা পূর্ব্বোক্ত মতের নিতান্ত বিপরীত। তাঁহাদের মতে সূর্য্য সকলের কেন্দ্র অর্থাৎ মধ্যবর্তী আর গ্রহগণ তাহার চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করে সূর্য্য গ্রহ মধ্যে পরিগণিত নহে; যাহারা সূর্য্যের চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করে তাহারাই গ্রহ। পৃথিবীও বুধ, শুক্র প্রভৃতি গ্রহের ন্যায় যথা নিয়মে সূর্য্যের চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করে; এই নিমিত্ত উহাও গ্রহ মধ্যে পরিগণিত। আর যাহারা কোন গ্রহের চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করে, তাহাদিগকে উপগ্রহ ও সেই সেই গ্রহের পারিপার্শ্বিক বলে। চন্দ্র পৃথিবীর চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করে এই নিমিত্ত চন্দ্র স্বতন্ত্র গ্রহ নহে, ইহা এক উপগ্রহ, পৃথিবী গ্রহের পারিপার্শ্বিক মাত্র। এক সূর্য্য ও তাহার চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণকারী যাবতীয় গ্রহ, উপগ্রহ ও ধূমকেতুগণ লইয়া এক সৌর জগৎ হয়। সূর্য সকলের কেন্দ্র; আর বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বেষ্টা, পল্লস্, জুনো, অস্ট্রিয়া, হীবি, আইরিস্, ফ্লোরা, ডায়েনা, বৃহস্পতি, শনৈশ্চর, যুরেনস্ ও নেপচুন এই সপ্তদশ গ্রহ সুর্য্যের চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করে। পৃথিবীর একমাত্র পারিপার্শ্বিক, বৃহস্পতির চারি, শনৈশ্চরের আট, যুরেনসের ছয়, আর নেপচুনের এপর্য্যন্ত একটা মাত্র বিজ্ঞাত হইয়াছে। এই সপ্তদশ ভিন্ন আরো অনেক গ্রহ আবিষ্কৃত হইবার সম্ভাবনা আছে। অনুমান হয়, এই সৌর জগতে বহু সহস্র ধূমকেতু আছে। গ্রহ উপগ্রহগণ নিজে তেজোময় নহে, তেজোময় সূর্য্যের আলোকপাত দ্বারা ঐরূপ প্রতীয়মান হয়। জ্যোতিৰ্বিদেরা ইহা প্রায় এক প্রকার স্থির করিয়াছেন, যে সকল নক্ষত্রের প্রভা চঞ্চল তাহারা এক এক সূর্য্য, নিজে তেজোময় এবং এক এক জগতের কেন্দ্র। এই অপরিচ্ছিন্ন বিশ্বমধ্যে আমাদের এই সৌর জগতের ন্যায় কত জগৎ আছে, তাহার ইয়ত্তা করা কাহারও সাধ্য নহে।