জীবনের ঝরাপাতা/কুড়ি
॥ কুড়ি॥
বিদেশী-শোষণ, একতা-সাধন
যে সব জাপানীরা সরেনদের বাড়ি এসে থাকতেন, তাঁরা সকলেই তাঁদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসই নিজের দেশ থেকে এনেছিলেন—এমনকি, বাড়িতে চিঠি লেখবার কাগজ পর্যন্ত। আমি জিজ্ঞেস করলুম—“এত কাগজ লগেজের ভিতর ঠেসে সঙ্গে বয়ে এনেছেন কেন?” তাঁদের একজন উত্তর দিলেন—“এ আমাদের বাড়ির মেয়েরা পূরে দিয়েছেন। তাঁরা জানেন, ভারতবর্ষে কিছুই পাওয়া যায় না; কাগজও নয়, সুতরাং কাগজের অভাবে তাঁদের চিঠি লেখা আমাদের বন্ধ হয়ে না যায়।” হায়রে! এরা সেই কবি হেমচন্দ্রের—‘অসভ্য জাপান!’—যাদের চোখে পরাধীন ভারতবর্ষ এত বড় একটা অসভ্য দেশ—যেখানে কিছু নেই, যে দেশের লোকে কিছুই করতে জানে না, পারে না—একটুকরো কাগজ পর্যন্ত পাবার আশা নেই যেদেশে।
সত্যিই ত! আছে বটে সবই, কাগজও আছে—জাহাজে ভরে ভরে আসা বস্তা বস্তা বিদেশী কাগজ। তারই গর্বে ভারতবাসী গর্বিত— তাতে যে নিজের মুখে চুণ-কালি পড়েছে, তা ভাবি না। একটা ভারি ধাক্কা লাগল মনে। আমি এর পর থেকে ভারতীর মলাট আরম্ভ করলুম হলদে রঙের তুলট কাগজে—যাতে আজ পর্যন্ত পাঁজিপুঁথি লেখা হয়—ভিতরের কাগজ বদলাবার সাধ্য নেই, তাহলে ভারতীই বন্ধ হয়ে যায়। তখনও টিটাগড়ের বিদেশীয় মূলধনে পরিচালিত তথাকথিত স্বদেশী কাগজও এদেশে সুপ্রাপ্য নয়। ভারতীয় তুলট কাগজের মলাটকে প্রথম প্রথম সকলে আমার ঊনপঞ্চাশ-বায়ুগ্রস্ততার আর একটি পরিচয়রূপে গ্রহণ করলে, কিন্তু ক্রমে ক্রমে দেখতে পেলুম, দেশে সেই বায়ুটা সংক্রামক হতে থাকল। গোবিন্দচন্দ্র রায়ের গান আমার মন তোলপাড় করতে লাগল—
কত কাল পরে, বল ভারত রে!
দুখসাগর সাঁতারি পার হবে!
অবসাদ হিমে, ডুবিয়ে ডুবিয়ে,
ওকি শেষ নিবেশ রসাতল রে!
নিজ বাসভূমে পরবাসী হলে,
পর দাসখতে সমুদায় দিলে!
পর হাতে দিয়ে, ধনরত্ন সুখে,
বহ লৌহবিনির্মিত হার বুকে!
পর ভাষণ আসন আনন রে,
পর পণ্যে ভরা তনু আপন রে!
পর বেশ নিলে, পর দেশ গেলে,
তবু ঠাঁই নাহি মিলে দাস বলে!
তব নির্ভর নিত্য পরের করে,
অশনে বসনে গমনের তরে!
পর দীপ-মালা নগরে নগরে—
তুমি যে তিমিরে তুমি সে তিমিরে!
এরই কাছাকাছি সময়ে নিজের খরচে কর্নওআলিস স্ট্রীটের উপর “লক্ষীর ভাণ্ডার” খুললুম। সেটি বাঙলা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা শুধু মেয়েদের জন্যে একটি স্বদেশী বস্ত্রের ও দ্রব্যের ভাণ্ডার। একজন বিধবা ব্রাহ্ম মেয়েকে মাইনে দিয়ে তার বিক্রেত্রী নিযুক্ত করলুম। আশুবাবুর ভাইয়েদের মধ্যে যোগেশ চৌধুরী খুব স্বদেশী ছিলেন। তাঁর রুচিও সুন্দর ছিল। তখন তিনি ব্যারিস্টার হয়ে এসেছেন, হাইকোর্টের কাছে ‘চেম্বার্স’ নিয়েছেন। একদিন তাঁর চেম্বার্সে আমাদের সকলকে চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন। তাঁর ঘরখানি আগাগোড়া স্বদেশী জিনিসে সাজান। পরদাগুলি ভারতবর্ষের নানা প্রদেশের ছাপান কাপড়, ঘরের টেবিল, টি-পয়, চেয়ার, সোফা কিছুই ল্যাজারসের বাড়ির নয়, কিন্তু সবই মনোরম খাঁটি স্বদেশী জিনিস, দেখে সকলের চোখ তৃপ্ত হল। তারপরে অনেকে মিলে একটি লিমিটেড কোম্পানী করে যোগেশবাবুর পরিচালনায় বৌবাজারে ‘স্বদেশী স্টোরস’ নাম দিয়ে একটি দোকান খুলিয়ে দিলেন। আমার ও যোগেশবাবুর স্বদেশী-প্রচেষ্টা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বহু পূর্বেই। এই সময় বম্বেতে কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিরাট স্বদেশী একজিবিশন হয়। কোন কোন বম্বে বন্ধুর অনুরোধে আমি তাতে ‘লক্ষী-ভাণ্ডার’ থেকে অনেকানেক জিনিস পাঠাই—তার দরুন একটি মেডেল পাই। সে মেডেলটিকে পিন লাগিয়ে আমি ব্রোচ করে পরতুম। প্রায় পনর বৎসর পরে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, তখনও আমার শাড়ি এই ব্রোচে আটকান থাকত। তাই দেখে তিনি চিনেছিলেন, তাঁর ভারতে অভ্যূদয়ের অনেক পূর্ব থেকেই আমি ‘স্বদেশী’। তাঁর সঙ্গে অনেক সভাস্থলে যখন নিয়ে যেতেন, সেই পরিচয়ই আমার দিতেন। সে মেডেলটির design অতি সুন্দর, সেটি এখনও আমার কাছে আছে। সে সময় কলকাতায় ১১ই মাঘের রাত্রে বা বিবাহাদি উৎসবে এ-বাড়ি সে-বাড়িতে আমার আপাদমস্তক স্বদেশী বৈশভূষার লালিত্যে লোকেদের চোখ খুলে গেল যে, কিছুমাত্র বিদেশী পরিধেয়ের সংস্রব না রেখে, কেবলমাত্র ‘স্বদেশী’তেই যথেষ্ট সৌখীনতা ও ফাশনের পরাকাষ্ঠা দেখান যেতে পারে। মনে পড়ে আমাদের আত্মীয় মেয়েদের মধ্যেও কেউ কেউ তখনো পর্যন্ত আমার পায়ের দিশী নাগরা জুতোটা সইতে পারতেন না—বিদেশী গোড়ালিওয়ালা জুতোতে সকলেই এত অভ্যস্ত। যাঁরা গোড়ায় গোড়ায় বিমুখ ছিলেন—এমন একদিন এল যখন তাঁরাই নামজাদা ‘স্বদেশী’ হয়ে পড়লেন, নাগরা ছাড়া আর কিছু তাঁদের শ্রীচরণে-শু হল না।
লাঠি গৎকার ক্লাবে যোগদানের উপলক্ষে নানা লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত ও নানা আলোচনা করত বলেছি। একদিন দুইজন সিলেটি ভদ্রলোক এসে চা-বাগানের কুলিদের উপর সাহেব প্ল্যাণ্টারদের অত্যাচারের কথা বললে। সাহেবদের এজেণ্ট দিশী রঙরুটেরাই অজ্ঞ কুলিদের কি রকম মিথ্যা কথা বলে প্রলুব্ধ করে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাগজে সই করিয়ে দাস্য-বৃত্তিতে ভর্তি করে, সেই সকল লোমহর্ষকর কাহিনী বর্ণনা করলে, ডাক্তার সুন্দরীমোহন দাস প্রমুখ একদল দেশভক্তেরা এ বিষয়ে নেতাদের সচেতন করবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়েছেন শোনালে, এবং ‘চা-পান না রক্তপান’ এই ছাপান প্লাকার্ড দেখালে সুন্দরীবাবুই তাঁদের আমার কাছে পাঠিয়েছেন জানালে। ছেলেবেলায় ইস্কুলে সুর করে করে পড়া কবিতা মনে পড়ল—
স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়।
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।
সে কবিতার গুনগুনানি আজ মনের ভিতর ঝনঝনানি হয়ে উঠল। স্বাধীনতার স্বপ্নে ভরপর আমার দৃষ্টি পরাধীনতার সহস্রফণা সর্পের প্রতি পড়ল। ভীরুতা ও কাপুরুষতার কলঙ্ক অপনোদন করে জাতিকে আত্মসম্মানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা স্বাধীনতার পথে আরোহণের প্রথম সোপান বটে। কিন্তু স্বাধীনতা একখানি হীরক-খণ্ডের মত, নানা facets দিয়ে নানা রঙের আলো প্রতিফলন করে। স্বাধীনতার ডায়মণ্ডকাটে স্বায়ত্তশাসনই প্রধান কাট—তারই আলো প্রধান আলো। শাসন স্ব-আয়ত্তে থাকা চাই, নয়ত স্বাধীনতা কিসের? আইনকানুন গড়ার প্রতিষ্ঠান নিজেদের আয়ত্তে হওয়া চাই, তবেই ত একটা জাতি স্বাধীন। যে জাতির ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কৃষিকার্য বিদেশীকৃত আইনের শাসনের দ্বারাই বিদেশীর হস্তগত সে জাতি কোনক্রমেই স্বাধীনতার গৌরবে গৌরবান্বিত হতে পারে না। যে জাতি জাতি হিসাবে hewers of wood and drawers of water থাকতে চিরবাধ্য হবে, যে জাতিকে শাসনের নামে তার রক্ত অনায়াসে শোষণ করে পরজাতি সমৃদ্ধ হতে থাকবে, যে জাতির কৃষকরা সোনার ফসল উৎপাদন করেও দুবেলা দুমঠো অন্ন পাবে না নিজের পেট ভরাতে বা স্ত্রী ছেলের মুখে তুলতে; ক্ষেতে বীজ বপন করতে না করতে বিদেশীর দাদন এসে তাদের যা-কিছু, সব পরের করে দেবে—সে জাতির স্বাধীনতা সুদূরপরাহত। পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিয়ে একখানা শরীর, একটা জাতি। পায়ের, হাতের, মাঝার কষ্টে মাথা যদি টনটন না করে, মাথা কাটা বাকী সব অঙ্গ হয়-তবে মাথার ব্যথায় হাত-পা নড়বে না, কোমর নিজেকে বাঁধবে না। তাই স্বাধীনতার প্লাটফর্মে সবচেয়ে বড় তক্তা জাতির পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঐক্যবুদ্ধি। শুধু মাথাগুলো একাট্টা হলে হবে না, পা-হাত-কোমরসমেত মাথাদের খাড়া হতে হবে। বুকখানা যে সকলের একই তা বুঝতে হবে—একই জায়গা থেকে সর্বদেহে রক্ত চলাচল হচ্ছে তার ধারণা করতে হবে। কুলিদের উপর অত্যাচারের কথা শুনতে শুনতে আমার মনে এতগুলো কথা খেলে গেল। আজ অনুভব করলাম আমরা যারা আরামে আয়েশে মানুষ তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা একটা ভাবের বিলাস মাত্র। পরাধীনতার বা “দাসত্ব-শৃঙ্খলের’’ প্রকৃত মর্ম আমরা কি জানি? হাড়ে হাড়ে জেনেছিল আমাদের এক পুরুষ আগে নীলকুঠির ক্রীতদাসেরা, যার ফলে নীল-বিদ্রোহ হয়েছিল; আর এখন জানছে এই ‘indented’ চাবাগানের কুলিরা। উৎপীড়ক লুণ্ঠকদের পশ্চাতে আছে প্রথমত তাদের স্বজাতির বন্দুক ও কামান, দ্বিতীয়ত ইংলণ্ডের প্রজারই হিতকল্পে ও ভারতীয় প্রজার ক্ষতিকল্পে গঠিত ভারত গবর্নমেণ্টের আইন-কানুন। যতদিন না এই দুটোর উপরই আমাদের দখল আসবে, ততদিন ‘নিজ বাসভূমে আমরা পরবাসী’। যতদিন ‘অশনে বসনে গমনের তরে রবে নির্ভর নিত্য পরের করে’—ততদিন হে ভারত আমার, হে আমার মাতৃভূমি, যদিও ‘পর দীপমালা নগরে নগরে তুমি যে তিমিরে তুমি সে তিমিরে’।
এই ইংলণ্ডের ইতিহাসই আমাদের গুরু হয়ে শেখাচ্ছে—একটা অত্যাচারী রাজের বিরুদ্ধেও দাঁড়াবার শক্তি আসে, একজন King Johnএর কাছ থেকেও Magna Charta আদায় করা যেতে পারে প্রজাশক্তি সংহত করতে পারলে, জাতির আপামর সাধারণের ছিন্নভিন্নতা দূর করে যৌথবল গড়ে তুলতে পারলে। ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়—কংস ও জরাসন্ধের মত অত্যাচারী রাজার হাত থেকে প্রজাদের উদ্ধারের জন্য শ্রীকৃষ্ণের উদয়ের অপেক্ষা করতে হয়। ইংলণ্ডের ইতিহাস শেখায়—দৈবলীলার অপেক্ষা না রেখে একজন স্বার্থপর, অত্যাচারী নিষ্ঠুর King Charles-এর মুণ্ডপাতের পাতকীবৎ বুদ্ধি ক্রমওয়েলের মত এক একটা মানুষের মত মানুষকেই পোষণ ও সাধন করতে হবে, তার জন্য দল সষ্টি করতে হবে। তারই নাম দৈবলীলা, মানুষের ভিতর দিয়েই দৈবশক্তির ক্রিয়া ইংলণ্ডের ইতিহাস শেখায়। পার্লামেণ্ট বা প্রজাদের প্রতিনিধি সভা যা, তা দেশের সর্বসাধারণের পঞ্চায়েৎ, House of Lords ও House of Commons এই দুই ভাগে বিভক্ত হলেও সাধারণী প্রজাবলই বলীয়ান হয়ে জমিদারদের কাছ থেকে সাধারণ্যের স্বার্থ-বিরোধী Corn Law-র ‘Repeal’ করাতে সক্ষম হয়।
সব দাঁড়াচ্ছে গিয়ে একতা-সাধনায়। একতা কিসে হয়; স্বার্থ যদি এক হয়, তবে লক্ষ্যও এক হবে। যাতে তোমার অপকার তাতে আমারও অপকার যদি প্রত্যক্ষ করি, তোমার ঘর পুড়লে আমারও ঘর পোড়া যদি অবশ্যম্ভাবী জানি, তাহলে তোমার ঘরখানা নিরাপদ রাখার জন্যে আমারও চেষ্টা থাকবে। আমার লাভ হলে তুমিও যদি নিশ্চয়ই সে লাভের অংশীদার হবে জান, তবে সেটা সাধনের ভার তুমিও বহন করবে। নয়ত যে যার ছাড়াছাড়ি, ছিন্নভিন্ন থাকব। স্বার্থগত একতাবুদ্ধি তাই সকল ঐক্যের মূল। ইংলণ্ডের প্রত্যেকের জাতি হিসাবে পরস্পরের সঙ্গে ঐক্য সেই স্বার্থবুদ্ধিপ্রসূত। সেইটেই তাদের ঐক্য-ইমারতের ভিত্তি। দেশহিতৈষিতা শুধু, সেণ্টিমেণ্টের উপর, শুধু ভাবের একটা ধোঁয়ার উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তার নজরে একটা স্পষ্ট solid বস্তুর ছবি ফুটে ওঠা চাই—
সর্বহিতে আত্মহিত, আত্মহিতে সর্বহিত।