একুশ

সম্পাদকীয় জীবন—স্বামী বিবেকানন্দ

এই সময়ে আমি একদিকে যেমন নানা বর্ত্মে জাতীয় জীবনকে প্রবাহিত করতে নিযুক্ত ছিলুম—সাহস, বল, বিদ্যা, একতা, স্বাবলম্বন ও স্বায়ত্তশাসন এই ষড়মার্গে—অন্যদিকে ভারতীর মধ্য দিয়ে সাহিত্যসেবায়ও একান্তভাবে নিবিষ্ট ছিলুম। নিজের লেখার প্রাচুর্য সে সময় ত ছিলই, কিন্তু নিজের লেখার আভরণেই ভারতীর সর্বাঙ্গ ভরে দেওয়ার অভিমান আমার ছিল না। বাণীর একটি সেবকমণ্ডলীকে ভারতীর পার্শ্বে আকৃষ্ট করে সমাদৃত করার লক্ষ্য আমার ছিল। আমার সোফার সামনের দেওয়ালে একটি লিস্ট টাঙ্গান থাকত—প্রায় চল্লিশটি নাম, কলকাতায় বা কলকাতার বাইরে যাঁদের বঙ্গসাহিত্য চর্চার ও তাতে কৃতী হওয়ার পরিচয় বা ইঙ্গিতমাত্র কোনরকমে পেয়েছিলুম। পালা পালা করে মাসের মধ্যে একবার করে তাঁদের সঙ্গে আমার পত্রের আদানপ্রদান হত। কুশল-প্রশ্নময় সবিনয় স্মারকলিপি এক একখানি একটি লেখার জন্যে। তাঁদের সৌজন্যে তাঁরা কোনদিন আমায় নিরাশ করেননি। সাহিত্য-ক্ষেত্রে বাঙ্গালী যে পুরো মাত্রায় chivarlry-সম্পন্ন তার সাক্ষ্য আমি দিতে পারি। আধুনিক রাজনীতিক্ষেত্রে তার পরিচয় অনেক মেয়েই পান না শুনতে পাই। রাজনীতি এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে কোন পুরুষ কোন মেয়ের জন্য ‘seat’ ছাড়তে পরাঙ্ম‌ুখ, সবাই ‘আপ-কা-ওয়াস্তে’—তাই অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি থেকে আরম্ভ করে বেঙ্গল কৌন্সিল-এসেমব্লি পর্যন্ত মেয়েদের জন্যে গুটিকত আলাদা ‘seat’ নির্ধারিত করা হয়েছে, সেই কটি দখলের জন্যে মেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে যত চাও লড়াইদাঙ্গা আঁচড়া-আঁচড়ি কামড়াকামড়ি কর তাতে পুরুষদের আপত্তি নেই, তাতে বরঞ্চ এক একটি মেয়ের পিছনে এক এক দল পুরুষ তাঁদের পৃষ্ঠপোষক বা পৃষ্ঠত্রাণ হতে প্রস্তুত আছেন, দেবী ভগবতীর পিছনে দেবসৈন্যদলের মত। কিন্তু মেয়েরা যদি পুরুষ দেবতাদেরই বলে বসেন—“তোমার সিংহাসনটা আমায় ছেড়ে দাও না ভাই” —তাহলেই বিপদ, তাহলেই পুরুষের পৌরষ বেরিয়ে পড়ে চোখ রাঙা করে বলে “কভী নেই।” কর্পোরেশনের হলে যেখানকার কৌন্সিলার বা অল‍্ডারম্যানের নির্বাচনে মেয়েদের জন্যে কোন ‘রিজার্ভেশন’ নেই সেখানে মেয়েদের পদক্ষেপ অতি দুরুহ—যোগ্যতার সেখানে কোন আদর নেই, স্ত্রীত্বের কোন সমাদর নেই, পুরুষার্থ সেখানে কেবলই স্বার্থগত; রাজনৈতিক কোন প্রতিষ্ঠানের শিরোদেশে তখনই কোন মেয়েকে শিরোধার্য করা হয়, যখন তাঁর আড়ে কতিপয় পুরুষদের কর্তৃত্ব নির্বিবাদে বজায় রাখার প্রয়োজন বোধ হয়। সেটাও রাজনীতি। সাহিত্য-ক্ষেত্রে স্ত্রীপুরুষগত রেষারেষি দ্বেষাদ্বেষির সমস্যা আসে না—যদি না সাহিত্যকে একটি পণ্যক্ষেত্র করা যায়। যাঁরাই সাহিত্যকে নিজের জীবিকার্জনের একটি মুখ্য উপায়রুপে আঁকড়ে ধরেছেন তাঁরাই অন্য সমব্যবসায়ীদের প্রতি বিরুদ্ধেভাব ধারণ করেন। হোক সে পুরুষ হোক সে স্ত্রী। সেখানে কথাটা দাঁড়ায় “তোমার মুখে দুটো বেশী ভাত পড়বে না আমার।তোমার ঘরে দুখানা বেশী কাপড় আসবে না আমার।” সেখানে সাহিত্যসেবার অনাবিল আনন্দ চলে যায়, তাতে মিশে যায় স্বার্থহানিবৃদ্ধিগত উদ্বেগ, ভয়, আশা ও ক্ষোভ।

 আমার সাহিত্যসেবায় প্রয়োজনের তাগিদ ছিল না, তাই আমি অর্থলাভের দিক দিয়ে নিরুদ্বিগ্ন ছিলম। বরঞ্চ ভারতীর আয়ব্যয় খতিয়ে দেখতে পেলুম মাসে—মাসে কাগজ, ছাপা, ম্যানেজমেণ্ট প্রভৃতির সমস্ত খরচ নির্বাহ করেও যথেষ্ট আয় উদ্ব‌ৃত্ত থাকে। এটি স্বত্বাধিকারীর তহবিলে জমা হয়, এতে তারই পকেট ভরে। পত্রিকাখানির গৌরব ও কাটতি যে লেখকদের লেখার দরুন হয়, তাঁরা এর একটি কপর্দক পান না। আমার মনে হতে লাগল এটা ঠিক নয়। সম্পাদকের খাটনি আছে বটে, তার দরুন লাভের একটা নির্ধারিত অংশ সম্পাদকের প্রাপ্য, কিন্তু সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী যদি একই লোক হয়, তবে ম্যানেজমেণ্টের খরচ বাদে বাকী সব উদ্ব‌ৃত্তটা স্বত্বাধিকারী একাই কেন গলাধঃকরণ করবে? যে সব লেখকের সহযোগিতায় কাগজখানি গরীয়ান ও স্বত্বাধিকারী লাভবান, সেই লেখকেরা লভ্যাংশের কিছু কিছু পাবে না কেন? শ্রমিক ও মুল ধনিকের সমস্যাটা, Capital ও Labourএর দ্বন্দ্বটা এ বিষয়ে বই পড়াপড়ি করে নয়, স্বতঃই সহজভাবে এই রকম করে আমার মনে উঁকি মারলে। আমি একটা নিয়ম করলুম—ভারতীর প্রত্যেক লেখককেই কিছু না কিছু পারিশ্রমিক উপহার দেব। এখনকার অনেক লোকেদের শুনে আশ্চর্য লাগবে যে, সেকালে এমন লেখকও ছিলেন যাঁরা লিখে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা তাঁদের আত্মসম্মানের পক্ষে হানিজনক মনে করতেন। তাঁদের মত এই—লিখব, সাহিত্যসেবা করব নিজের মনের আনন্দে, তার দরুন অর্থ গ্রহণ কেন? তাঁরা বলতেন, এতদূর অর্থলিপ্সা এই ভারতে অশোভন। যাঁরা অন্যমত ছিলেন, তাঁদের সাধ্যমত অর্থদান করে আমি আনন্দ পেতুম এবং অর্থ গ্রহণ অনেচ্ছুদের কোন না কোন আকারে বাণীর প্রীতির নিদর্শন পাঠাতুম নববর্ষে বা আশ্বিনে, হয়ত একটি সোনার ফাউণ্টেন পেন, হয়ত একখানি ভাল বই।

 ভারতীর এই নিয়ম জারীর ফল এই হল যে, প্রত্যেক মাসিক পত্রিকার সম্পাদক, স্বত্বাধিকারীরাই ভাল লেখকদের লেখার জন্যে পারিশ্রমিকের খাতা খুলতে বাধ্য হলেন। এর ফলে লেখকজাতির উপকার হল বটে, কিন্তু আমি নিজে ঠকলুম—কারণ ভারতীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হবার জন্যে আমার চেয়ে অধিক বিষয়াদিসম্পন্ন বিজ্ঞ সম্পাদকেরা বিশেষ বিশেষ লেখকের পারিশ্রমিকের হার এত বাড়িয়ে দিলেন যে, তাঁরা তাঁদেরই একচেটে হয়ে গেলেন, আমি পড়লম ফাঁপরে।

 ‘ভারতী” হাতে নিয়ে মাসিক-পত্রিকাজগতে আরও একটি নতুনত্ব আমি ঢুকিয়েছিলাম, punctuality— যথাসাময়িকতা। দেখতুম তখনকার দিনে সাময়িক পত্রিকা কখনই ঠিক সময়ে বেরয় না—বৈশাখের পত্রিকা হয়ত আষাঢ়ে হস্তগত হল, আশ্বিনের অগ্রহায়ণে দেখা দিলে। আমার দৃঢ়পণ হল এই দোষটার সংশোধন করব। করলুমও। সময় অতিক্রান্ত করে বেরনর অপবাদ মুছে দিলমে মাসিক-পত্রিকা-জগৎ থেকে। দরোয়ান বেয়ারার হাতে প্র‌ুফ আনান ও পাঠানর অপেক্ষা না রেখে, নিজে গাড়ি করে গিয়ে গাড়িতে বসে বসেই শেষ প্র‌ুফটা দেখে ছাপাবার অর্ডার দিয়ে ছাপাখানার ‘ভূতদের' অস্থির করে তুলতুম। শুধু তাই নয়, দরকার হলে চামড়ার গন্ধে ভরপুর দপ্তরী পাড়ায় গিয়ে অপেক্ষা করে গাড়িতে করে দু-চারখানা ভারতী টাটকা বাঁধিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসতুম, তারপর ভরসা হত ম্যানেজারকে ছেড়ে আসতে—সন্ধ্যের মধ্যে সবগুলো বাঁধিয়ে ছ্যাকরা গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে আসবে। শুধ, ঠিক দিনে বেরন নয়, ঠিক দিনে গ্রাহকদের হাতে পৌঁছান চাই। ভারতী হাতে এলেই পাঠকরা সচেতন হয়ে বলতেন—“ওঃ আজ মাসের ১লা যে, ভারতী এসে গেছে।” দেখাদেখি অন্য পত্রিকাদেরও চটপটে হতে হল। যথাসময়ে বেরনই মাসিক-পত্রিকা-জগতের নিয়ম বেঁধে গেল। তার অন্যথা করাটা নিয়মের বাত্য়য়।

 লেখক তৈরি করা আমার আর একটি সম্পাদকীয় কাজ ছিল। তৈরি লেখকের লেখা দিয়ে পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরা অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্য সাধনা। কিন্তু তাতেই আমি সন্তুষ্ট থাকতুম না। কোন কোন লেখা প্রথম দৃষ্টিতে রদ্দির টুকরীতে ফেলে দেওয়ার উপযুক্ত হলেও, তার ভিতরকার কতকগুলি মশলা উল্টে পাল্টে সাজালে দিব্যি জিনিস দাঁড়াবে অনুমান করে নিতুম। যে লেখাটার শরীরখানা এখন মড়ার মত, টেবিল থেকে টেনে বাইরে ফেলে দেবার যোগ্য, তারই পা থেকে মাথা পর্যন্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগলি কাটা চেরা করে নতুন করে বসিয়ে খাড়া করলে জীবন্ত হয়ে উঠবে এই সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার উপর ‘অপারেশন' আরম্ভ করতুম—কঙ্কালের অস্থিগুলি reset করতুম, তার উপর মাংস ও চর্মের প্রলেপ দিয়ে রক্ত চলাচল করাতুম—হয়ে উঠত একটি জীবন্ত বস্তু। দুষ্টান্তস্বরুপ আমার চোখে ভেসে উঠছে একটি লেখা। বেহারের কোন বাঙালী বেহারী জীবনের দুই-একটা চিত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন। দেখলুম সেগুলিতে বস্ত‌ু আছে কিন্তু লেখার কুশলতা নেই। সিরিজগ‍ুলির প্রথমটির আমি নামকরণ করলুম—“রাম অনুগ্রহনারায়ণের জন্মকথা?” নামেতেই সকলের কৌতূহল আকর্ষণ করলে। ভিতরের বস্ত‌ু হচ্ছে বেহারী গৃহে শিশুর জন্ম হলে বেহারী মা—রা কি করেন না করেন। “রাম অনুগ্রহনারায়ণ” বেশ ঢাক পিটিয়েই জন্মালেন এবং পাঠকের মনোরঞ্জক তার কীর্তিকলাপ ভারতীতে চলতে থাকল। দু-একবারের পর লেখক নিজেই তৈরি হয়ে উঠলেন—পরের সংখ্যাগলিতে আর আমায় বেশি বেগ পেতে হল না। এই রকম করে আমার হাতে সেকালে অনেক চলনসই সুলেখক গড়ে উঠলেন। আজকালকার মত তাঁদের এত প্রাচুর্য ছিল না। কিন্তু geniusএর কুঁড়িও দুই-একটি আবিষ্কার করেছিলাম। মালীরা যেমন মুদিত পাপড়িগুলির এক একটি হাতে করে খুলে খুলে পূর্ণ প্রস্ফ‌ুটিত পদ্ম একটি লোকের সামনে ধরে, আমিও তেমনি এই প্রতিভা-পদ্মকুঁড়িগুলির পাপড়ি খুলে খুলে দিয়ে তাদের স্বর‍ূপট ফুটিয়ে ধরতুম। ভারতীতে তাই আমার সম্পাদন-ক্রিয়া কেবল mechanical ছিল না, শুধ, মেশিনের মত কাজ নয়, মানবীয় রসে ভরা ছিল আমার সম্পাদকীয় জীবন। অথচ আত্মীয় ছাড়া আর কোন লেখকের সঙ্গেই আমার চাক্ষুষ পরিচয় হত না। চিঠিতে পত্রেই দেখাশুনা। যাদের লেখা একেবারে অচল বুঝতুম তাদেরও লেখক-হৃদয়ের প্রতি একটা মায়াদয় রেখে সৌজন্যের ত্র‍‌ুটি না করে লেখা ফেরত দিতুম। তবু যা অপ্রিয় তা অপ্রিয়ই হত। লেখা ফেরত পাওয়ায় একজন আমায় ক্ষোভভরে লিখেছিলেন—"You are a past mistress in the art of denial.” এই রকম অনিচ্ছাকৃত আঘাতের প্রতিঘাত পরজীবনে যে পাইনি একেবারে তা বলতে পারিনে।

 আমার হাতের ভারতী শুধু, সুকুমার সহিত্যের রঙ্গভূমি ছিল না, বাহন হয়েছিল জাতীয়তার সে কথা আগেই বলেছি। আমার জাতীয়তা যখম জাতিকে আত্মমর্যাদার কণ্টকঘন সর্বাবস্থায় পথের কাঁটা তুলে তুলে চালাতে ব্যস্ত তখন স্বামী বিবেকানন্দের অভ্যুদয় হল। স্টার থিয়েটারে দেশবাসীর দ্বারা তাঁর অভিনন্দন ও তার উত্তরে তাঁর বক্ত‌ৃতা উপলক্ষ্য করে ভারতীতে আমার একটি লেখা বেরল। সেইটি পড়ে বিবেকানন্দ স্বামী আমায় একটি পত্র লিখলেন, সে পত্রের উত্তর দিলুম। ক্রমে ক্রমে দুটি একটি পত্রবিনিময় হতে হতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয়ের সচনা আরম্ভ হল। তাঁর দূতী হয়ে সিস্টার নিবেদিতা এলেন আমায় নিমন্ত্রণ করে বেলুড় মঠে নিয়ে যেতে। আমি আমার ঘরটির ভিতরে বসে বসেই সকল লক্ষ্যভেদে নিযুক্ত থাকতুম, বাইরে যেতুম না পারতপক্ষে আগে সে কথা বলেছি। আধুনিক মেয়েদের মত আমাদের বাইরে যাবার প্রবণতা ছিল না, তাতে সঙ্কুচিত বোধ করতুম—আজ পর্যন্ত এ যুগেও ট্রামে বাসে উঠে ঠেলাঠেলি করে কোথাও যাতায়াতের প্রবৃত্তি আমাদের নেই। সিস্টার নিবেদিতা আমায় নিমন্ত্রণ করে গেলে আমি কি করি কি করি ভেবে সুরেনকে ধরলুম আমায় সঙ্গে করে নিয়ে যেতে, একা একা যেতে কিছুতেই সাহসে কুলোল না। সুরেন গেল আমার সঙ্গে। প্রথমে ঘরের গাড়ি করে বাগবাজারে গিয়ে সেখানকার ঘাটে নিবেদিতার সঙ্গে মিলিত হয়ে নৌকা করে পাড়ি দেওয়া হল বেলুড়ে। গঙ্গার অব্যবহিত উপরেই ঘাটের ধাপের পাশে খানিকটা পেটান জমির উপরে বেতের চৌকি বিছিয়ে বসে আছেন জাপানী কিমোনো পরা মিসেস ওলেবুল ও মিস মাকলাউড, তাদের পাশে স্বামী বিবেকানন্দ সাধারণ সাধরণ গৈরিক বেশে, ছবিতে দেখা পোশাকে নয়, মাথায় পাগড়ি নেই। তবু তাঁকে দেখলেই একটা অসাধারণ দীপ্ত ভাব চোখে পড়ে। তাঁর সঙ্গে আছেন স্বামী স্বরুপানন্দ-যিনি পরে মায়াবতী অদ্বৈতাশ্রমের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। যেখানে মাটি ধ্বসে ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা নেই, সেই রকম একটা চওড়া মাটিপেটা জায়গা দেখে বসবার আয়োজন হয়েছে, চায়ের সরঞ্জাম সাজান হয়েছে। আমাদের পক্ষে এ রকম জায়গায় বসা একেবারে নতুন ও ভয়সঙ্ক‌ুল, এর নিরাপত্তা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ মনে উস‍্খুস্ করছিল। কিন্তু তার রমণীয়তাও যথেষ্ট অনুভব করছিলুম। মাথার উপর আবাধ আকাশ, পায়ের নীচে কলকলবাহিনী গঙ্গা, সামনে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, সাধক রামকৃষ্ণদেবের কাহিনীসঙ্ক‌ুল, পশ্চাতে বেলুড় মঠগৃহ। তখনও সে মঠের মঠত্ব শ‍ুধু ঘাটের উপর একটি ভগ্নপ্রায় বাড়িতে। সেটির জীর্ণ-সংস্কার হয়ে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে এখন, আদি মঠ ঐ। তারই একটি ঘরে যেটি স্বামী বিবেকানন্দের শয়নাগার ছিল তাঁর স্মৃতি সকল রক্ষিত আছে। আমেরিকান মেয়েরা ও নিবেদিতাই বেশি কথাবার্তা কইতে লাগলেন, স্বরুপানন্দ তাঁদের সঙ্গী। স্বামী বিবেকানন্দ বেশির ভাগ নীরব, আমরাও। ফেরবার সময় স্বামী স্বরুপানন্দ আমাদের সঙ্গে নৌকায় যাত্রা করলেন। নানারকম গল্প হতে থাকল, নিবেদিতাই সব গল্প উস্কিয়ে দিতে লাগলেন। এই গেল প্রথম দিনের ভিজিট। তারপরে আরও দু-চারবার নিবেদিতা এসে এসে আমায় নিয়ে গেলেন। প্রত্যেকবারই সুরেন সঙ্গে থাকত। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর “রাজযোগ” প্রভৃতি পুস্তিকাগুলির এক এক কপি আমায় উপহার দিলেন, বইয়ের ভিতর পৃষ্ঠায় তাঁর নিজের হাতে ইংরেজীতে লেখা তাঁর “ভালবাসা-সহ প্রদত্ত।” আমি ভারতীর দুখানি কপি তাঁকে পড়তে দিলুম একবার—যাতে ‘আহিতাগ্নিকা' ও আমার ‘ক্ষণ শেষের—বিলাপ' ছিল। আমরা বসে থাকতে থাকতেই এক নিঃশ্বাসে তিনি পড়ে ফেললেন। নিবেদিতা পরে গল্প করেন স্বামীজী তাকে বলেছেন-“সরলার ‘education perfect', এই রকম education ভারতের সব মেয়েদের হওয়া দরকার।” তারপরেই একটা প্রস্তাব নিয়ে এলেন—স্বামীজীর সঙ্গে তাঁর ‘next trip'এ আমারও বিলেত যাওয়ার জন্যে, সেখানে ভারতের মেয়েদের প্রতিনিধি হয়ে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক বার্তা প্রতীচ্যের মেয়েদের শোনাবার জন্যে। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পূর্বে যে পত্রাবলী আমায় লিখেছিলেন তার একখানিতেও তাঁর এ বিষয়ের কল্পনা জলন্ত ভাষায় ফুটে উঠেছিল—সেগুলি তাঁর জীবনচরিতে সন্নিবিষ্ট আছে। এমন অমূল্য সুযোগ গ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হল না। আমার নিজের মনের অপ্রস্তুততা, সঙ্কোচ এবং অভিভাবকদের অমত এই দুইই প্রবলভাবে বাধা দিলে। নিবেদিতাকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীজী চলে গেলেন। সে-ই তাঁর বাণী-বাহিনী হল। ফিরে এলে আর দুই একবার মাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। শেষ দেখা চিরস্মরণীয়—কি আতিথ্য, কি সম্মান, কি সৎকারে আমায় আপ্লুত করলেন। সেদিনকার ভোজ একটি ভৌগোলিক ভোজ, আর তার প্রত্যেক জিনিসটি তাঁর নিজের হাতে রাঁধা। নরওয়ে, কাশ্মীর, ফ্রান্স, আমেরিকা কোন দেশের সুস্বাদ, আহার্যের পরিচয়ের বাকী ছিল না। তাঁর শিষ্যেরাও সকলে শশব্যস্ত আমায় কি করে খাতির দেখাবেন, কি করে সেবা করবেন। খাওয়া শেষ হলে যখন তাঁদের একজন চিলিম্‌চি ও গাড়ু নিয়ে এসে আমার হাত ধোয়াতে দাঁড়ালেন আমি বিদ্রোহী হয়ে পড়লুম। তাঁদের এতদুর অবনত হতে দিতে পারিনে আমার কাছে। আমি কে? আমার ভিতর যে দেবীকে দেখেছেন তাঁরা, সে কে? আমি ত মানবী-তনয়া। সে তাঁদেরই কল্পনারই একটি সৃষ্টি।