জীবনের ঝরাপাতা/বাইশ
॥ বাইশ॥
ভারতী সম্পাদনসূত্রে অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানে প্রবেশ
অনেক দিক থেকে অনেক জলধারা এসে একটি স্রোতস্বতীকে ভরে তুলে। স্বামী বিবেকানন্দের সংস্পর্শে আমার জীবননদী আর একটা ভাবের ধারায় ভরাট হল। ভারতীর সম্পাদনসূত্রে কত অজানা লোকের সংস্পর্শে এসেছিলুম, তার মধ্যে স্বদেশে বিদেশে এক নবযুগের প্রবর্তক স্বামী বিবেকানন্দ আমারও অন্তরের উপাদানে এক নতুন তত্ত্বের সমাবেশ করলেন—সেটি হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবনের আকাঙ্ক্ষা। অনেকে অনেক কিছু মনে করত স্বামী বিবেকানন্দকে। জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে জাতীয়তার পতাকাধারী বলে দেখত, কর্মবাদীরা তাঁকে কর্মের প্রচণ্ড উত্তেজক বলে জানত। তাঁর শিষ্যেরাই কেউ কেউ বলতেন—“পরমহংসদেবের আমলে বেশ ছিলুম। ভগবানের ধ্যানে ভোঁ হয়ে থাকতুম, কোন বালাই ছিল না। স্বামীজীর কি হল—আমেরিকা থেকে ফিরে এসে খালি বলেন—কাজ, কাজ, কাজ—সেবা, সেবা, সেবা। একদণ্ড স্থির হয়ে বসার যো নেই, মহাবিপদেই পড়া গেছে।”
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই ভূখণ্ডের লোকের মধ্যে গভীরভাবে প্রবেশ করে দেখেছিলেন—যে সত্ত্ব রজ ও তম তিনটি গুণের মিশ্রণ এক একটি মানুষ—তাদের প্রত্যেকটির পরিমাণের তারতম্য আছে প্রতি মানুষে এবং সেই তারতম্য-ভেদে একটা দেশের মানুষদের বা একটা জাতির জাতীয় গুণের ভেদ হয়। ভারতবাসী আপাততঃ বহু পুরুষানুক্রমে স্তূপীকৃত তামসিকতার তলায় প্রোথিত হয়ে আছে। সেই স্তূপ ভেঙ্গে ভেঙ্গে, সরিয়ে সরিয়ে, রাজসিকতা ধরে ধাপে ধাপে উঠলেই তবে আবার আধ্যাত্মিকতার চরম শিখরে আরূঢ় হবে, এখন সেখান থেকে স্খলিত হয়ে আছে—এই তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল। তাই তিনি গীতার কর্মযোগের উপদেশ শিষ্যদের মধ্যে প্রচার করলেন এবং সাবেক গুরুভাইদের মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত করলেন। গুরু রামকৃষ্ণদেবের নামে উন্মুক্ত মিশনের ধর্ম হল আর্তের, দঃস্থের, বিপন্নের সেবাকার্য ও অতিথি সৎকার, শুধু ভগবদ্ধ্যানে ভোঁ হয়ে থাকা আর কলকে টানা নয়। আজ ভারতে বা ভারতের বাইরে যেখানে যেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের পতাকা উড়ছে, সেখানে সেখানেই দরিদ্রনারায়ণের সেবা বিশেষভাবে পরিদৃশ্যমান হচ্ছে। ভারতের সামাজিক বা রাজনৈতিক সংস্কাররূপ বিপ্লব-প্রবর্তক ও দ্বন্দ্বমূলক কর্ম তাঁদের প্রোগ্রামে নেই। মহাত্মা গান্ধী স্পষ্টাস্পষ্টি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্মশীল, সুতরাং বিপ্লবমুখী দ্বন্দ্বপরায়ণ কর্ম তাঁর। কিন্তু সে দ্বন্দ্বের বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলেছেন দ্বন্দ্বটাকে ‘নিরস্ত্র’ করে। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মত সেবা করেন, বিপ্লবের পাশ দিয়ে যান না। বরঞ্চ বিপ্লবের কাজে ধরা পড়া ও ছাড়া পাওয়া অনেক যুবকদের মিশনের ক্রোড়ে স্থান দিয়ে তাদের ক্ষতবিক্ষত জীবনকে শান্তির পথে নিয়ে যান। ভারতের জাতীয়তা বিবেকানন্দের শিষ্যদের প্রাণের মর্মমূলে বিরাজ করছে, কিন্তু সে জাতীয়তা বাহু প্রসার করে সর্বমানবিকতায় বিস্তৃত, সকল জাতির নরনারীকে তাঁদের জাতীয় কৃষ্টির অন্নে পুষ্ট করতে প্রস্তুত। সেই কৃষ্টির বীজ বোধ হয় আমার ভিতর লক্ষ্য করেছিলেন, তাই স্বামীজী নিবেদিতাকে বলেছিলেন, “সরলার education prefect”। আমার রচনায় যে আত্ম-অভিব্যক্তি পেয়েছিলেন, সে ভারতীয় আত্মা—ইংলণ্ডীয় নয়, ফরাসীয় নয়। ভারতীয় সভ্যতার বীজ তাতে নিহিত দেখেছিলেন। তাই ‘ভারতী’তে তাঁর সম্বন্ধে আমার প্রথম লেখাটি পড়েই তাঁর কল্পনার চোখে সে বীজের ভিতর অঙ্কুরিত ও পল্লবিত বৃক্ষকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তখনই তাঁর একান্ত উৎসাহ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল এই রকম ভারতীয় নারী, ভারতীয় বেশে বিদেশে গিয়ে ভারতীয় শিক্ষা প্রচার করুক। পরে আমাকে সাক্ষাতে দেখে শুনে, আমার কথায়-বার্তায়, আমার লেখা গদ্যে পদ্যে সেই ভাব স্থায়ী হয়ে তাঁকে পেয়ে বসেছিল, আমাকে তাঁর সঙ্গে প্রচারকার্যে বিদেশে নিয়ে যাবার জন্যে আগ্রহযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর আগ্রহের প্রাবল্যে আমার অপ্রস্তুততার মাত্রার প্রতি দৃষ্টি দেননি বোধ হয়। নিবেদিতা একেবারে আনকোরা পাশ্চাত্য মেয়ে ছিলেন, ভারতীয় ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা-দীক্ষা তাঁর একেবারেই ছিল না, তাঁকে যদি গড়ে তুলতে পেরে থাকেন তবে আমাকে প্রয়োজন মত গড়ে পিটে নেওয়া খুবই সহজসাধ্য এইটে অনুমান করেছিলেন বোধ হয়। নিবেদিতাকে যদি “কালীতত্ত্ব” বুঝিয়ে তাঁকে দিয়ে এলবার্ট হলে কালী সম্বন্ধে বক্তৃতা দেওয়ান সম্ভবপর হয়ে থাকে, তবে আমাকে বোঝান আরও সহজ হবার কথা। নিবেদিতার বক্তৃতা শুনে সায়ান্স এসোসিয়েশনের ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার ভীত হয়ে বলেছিলেন —“এতদিন কালো কালী ছিল—তাই রক্ষে, এ সাদা কালী এসে দাঁড়ালে দেশকে পৌত্তলিকতা থেকে আর বাঁচান যাবে না।’’ স্বামী বিবেকানন্দ জানতেন, আমি মহর্ষির দৌহিত্রী বটে, ব্রাহ্মভাবে মানুষ বটে, কালীদুর্গার বিদ্বেষপুষ্ট ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব আমার উপর খুব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বটে, এ সবই সত্য। কিন্তু তা হলেই বা? নরেন দত্তরূপে তিনি যখন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের অনুগামী ছিলেন, তিনিও কি তখন ব্রাহ্মভাবাপন্ন ছিলেন না? পরমহংসদেবের সংস্পর্শে এসে সাকার-নিরাকারভেদের পর্দা তাঁর জ্ঞানচক্ষু থেকে আস্তে আস্তে সরে যায় নি কি? আমারও যেতে বাধ্য। এই নিশ্চয়তায় প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি আমায় তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক হয়েছিলেন। এদিকে আমার এ বিষয়ে যে ততটা উৎসাহ হল না তার কারণ কতকগুলি চিরাগত তামসিক সংস্কারের বশে ও তার দরুন ভীরুতায়।
বিবেকানন্দ দেহরক্ষা করলেন। দেশ শোকসন্তপ্ত হল, কিন্তু দেশের ভিতর তাঁর কাজ চলতে থাকল। আমারও ভিতর বিবেকানন্দের কাজ চলতে থাকল। যেমন একটা ছোট্ট অশ্বত্থ বীচি দেওয়ালের একটা ফাটলে উড়ে পড়ে ক্রমে ক্রমে সে ফাটলকে ঠেলে ঠেলে বাড়িয়ে বাড়িয়ে একদিন ডালপালা বের করে গাছ হয়ে দেখা দেয়, তেমনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পথে চলার আকাঙ্ক্ষা আমার জীবনে অলক্ষ্যে সুড়ঙ্গ কাটতে থাকল। প্রথমে বিবেকানন্দের সঙ্গে পত্র-ব্যবহারে তাঁর একখানি পত্রে পাতঞ্জল যোগসূত্রের একটি বচনের উল্লেখে বইখানি আদ্যোপান্ত পড়ার উৎসাহ উদ্দীপ্ত হল। বাঙলা তর্জমাসমেত সূত্রগুলি একদিন হুহু করে পড়ে ফেল্লুম। রাজযোগশাস্ত্রের সঙ্গে একটা সাধারণ পরিচয় হল। তারপরে হঠযোগসমন্বিত রাজযোগের অনেকানেক পুস্তক অনুধাবন করেছি এবং যোগীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপও হয়েছে। স্বামীজীর কর্মযোগ পুস্তিকা উপহার পেয়ে ভগবদ্গীতার প্রতি প্রথম দুটি আকৃষ্ট হল—তার আগে এর একটি শ্লোকও পড়িনি—আমাদের পরিবারে শ্রীকৃষ্ণের গরিমা ছিল না। এই রকম করে করে নিজে নিজে অবগত হতে থাকলুম আমার শিক্ষার ভিৎটায় ভারতীয় আধ্যাত্মিক উপকরণ কিছুটা থাকলেও অনেকটার অভাব রয়ে গেছে। ভারতীয় কৃষ্টি যে হীরকখানি তার সব দিকের আলো ও ছায়া আমার বুদ্ধিতে হৃদয়ে ও আত্মায় সম্পতিত হয়নি। সেই হিসেবে আমার ‘education perfect’ হওয়া থেকে এখনো বহুদূরে। এই অভাব পূরণের একটা স্বতঃপ্রবণতা এল আমার। হিন্দুর হিন্দুত্ব জিনিসটি যে কি তা ভাল করে জানবার একটি প্রবৃত্তি জাগল। তার এক সীমায় ঔপনিষদিক বেদান্তের ব্রহ্মের উপাসনা, আর এক সীমায় পৌরাণিক প্রতিমার ধ্যানধারণা ও পুজার বিধান। আমাদের পূর্ব পুরুষ ঋষিদের মনীষায় এই দুই বিপরীতের স্থাপনা কেমন করে স্থান পেয়েছিল তাই জানতে আগ্রহ হল। যখন তাঁরা দুইকেই আসন দিয়েছেন তখন ফেলবার জিনিস নয় কোনটি—তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা আমায় এতে স্থিতধী করলে। ষড়দর্শনগুলি মোটামুটি অধ্যয়নের পর এক একখানি পুরাণ খুলতে খুলতে দৃঢ় অনুভূতি হল পুরাণগুলি parables, গল্পচ্ছলে গভীরতত্ত্ব—সেই বৈদান্তিক ব্রহ্মতত্ত্বই—তাদের ভিতর নিহিত। কোরাণ ও বাইবেলের দ্বারা প্রভাবিত রামমোহন রায় সাকার পুজার বিরোধী হয়ে কেবলমাত্র নিরাকার ব্রহ্মোপাসনার প্রচার করেন। খ্রীস্টীয় চিন্তাধারার টীকা নেওয়া ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে আকারবর্জিত নিরাকার ঈশ্বরের প্রণিধানের পক্ষপাতী হল। কিন্তু পারলে কৈ? ঈশ্বরের চরণকল্পনা ব্যতিরেকে তাঁকে প্রণিপাত করা যায় না, তাঁর হস্তকল্পনা ব্যতিরেকে তাঁর হাতে হাত রেখে চলা যায় না, তাঁর আঁখি কল্পনা ব্যতিরেকে দিবীব চক্ষুরাততং—আমাদের প্রতি তাঁর স্নেহমাখা নির্নিমেষ আঁখি দেখা যায় না—সে আঁখিতে আঁখি রাখা যায় না। কল্পনাতে তাঁকে ইন্দ্রিয়ময় রূপময় দেবমূর্তিতে দেখতে হয়, সাকার করতেই হয়। তা দোষের নয়, কেননা, খ্রীস্টানরাও তাই করেন। কিন্তু ছবিতে, মৃত্তিকায় বা প্রস্তরে আমার কাল্পনিক ভাবমূর্তিকে আকারযুক্ত করলেই Heathenism হল। নবযুগের খ্রীস্টান মিশনারির অঙ্কুশাঘাতে বিদ্ধ ভারতবর্ষ এই Heathenism-এর অপবাদ সহ্য করতে পারলে না। অথচ দেশের যুবকদের খ্রীস্টান হয়ে যাওয়াও সহ্য করতে পারলে না—তাতেও জাতীয় আত্মাভিমানে ঘা লাগে। তাই নিরাকার ব্রহ্মোপাসনার ঘোষণা হতে থাকল, তারই প্রচার ও প্রতিষ্ঠা চলল—দেশ থেকে প্রতিমা পূজা তুলে দেবার প্রচেষ্টা হল—না হলে যেন ‘অসভ্য’ ‘বর্বর’ আখ্যার যোগ্য হব আমরা। এই হল রামমোহনের বা ব্রাহ্মধর্মের যুগ। কিন্তু শীঘ্রই নবতর যুগ দেখা দিল—এবার নিরাকারের সঙ্গে সঙ্গে সাকারের যুক্তিপূর্ণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হল, কেননা এ যুক্তির যুগ। শুধু উপনিষদ নয়, হিন্দুর সকল ধর্মপুস্তক—সকল ‘scriptures’-গুলিই আবার সকলে ভাঁজতে লাগল, সেগুলি ঘেঁটে ঘেঁটে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। দেখলে অমূল্য রত্নরাজিতে ভরা, বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার মত একেবারে নয়। অনেক ব্রাহ্মসমাজীরাও আবার ‘হিন্দু’ বলে নিজেদের পুনরাখ্যাত করলেন, সাধনার সহায়স্বরূপ গৃহে প্রতিমার পুনঃস্থাপনা করলেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যিনি ব্রাহ্মসমাজের একজন নেতা ছিলেন—দলভঙ্গ করে বেরিয়ে এলেন, দলে দলে ব্রাহ্মরাই তাঁর শিষ্য হলেন। তারপরে এলেন এক ‘dynamic personality’—স্বামী বিবেকানন্দ। ‘Dynamic’ সেই—যার ভিতর বারুদের ধর্ম আছে, প্রচণ্ড তেজ, প্রচণ্ড ভাঙ্গাগড়ার শক্তি। সেই বারুদের আগুন থেকে একটা স্ফুলিঙ্গ আমার ভিতর এসে পড়েছিল—আমায় ভেঙ্গে গড়ে তুলছিল। আমার আধ্যাত্মিক পিপাসা আমায় শৈশবের গতানুগতিক ‘ব্রাহ্মধর্ম’ থেকে অনেক দূরের পথে নিয়ে চলছিল।