জীবনের ঝরাপাতা/তেইশ
॥ তেইশ॥
ভারতীতে বিদেশী লেখক ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সমস্যা
আজকাল ‘বিদেশী’ কথাটায় শুধু পাশ্চাত্যদেশ য়ুরোপ আমেরিকার লোক বোঝায়। সেকালে বাঙালীর পক্ষে ভারতের অন্যান্য প্রান্তের লোকও বিদেশী ছিল—অবাঙালীমাত্রে তখন বাঙালীর চোখে বিদেশী। অর্ধশতাব্দী ব্যাপক কংগ্রেসের কার্যপ্রভাবে ভারতবর্ষ আজ সত্যিই একটি মহাদেশ বলে গণ্য; এক প্রান্তের ভারতীয় আজ অন্য প্রান্তের ভারতীয়র ধারণায় স্বদেশী। পূর্বে কয়েক শতাব্দীতে বাঙলার এক জেলার লোকের সঙ্গেও আর এক জেলার লোকের বিষম ভেদজ্ঞান ছিল—তাইতে বরেন্দ্রভূমি ও রাঢ়ভূমিবাসীদের পরস্পরের প্রতি বিদেশীয়তা-বুদ্ধি প্রবল ছিল, তাইতে একই জেলাভুক্ত এক গ্রামের কায়স্থদের সঙ্গে অপর গ্রামের কায়স্থদের কন্যা-ব্যবহার হত না—“ভিন্-গাঁ” বলে অবহেয়তার ভাব আসত। সেই অনেকানেক ক্ষুদ্রানুক্ষুদ্র ভেদজ্ঞতা এখনো নিম্নস্তরে কিছু কিছু থাকলেও শিক্ষিত সমাজ থেকে অনেক পরিমাণে চলে গেছে। তাই বাঙলার বাইরের যে কোন ভারতীয় ব্যক্তিকে ‘বিদেশী’ বলে আখ্যাত করা এখনকার দিনে দোষাবহ হবে। কিন্তু আমি যেকালে ভারতী সম্পাদন করতুম, সেকালে এ দুর্ভেদ্য দুর্গ মাথা তুলে খাড়া ছিল। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুটা নুইয়ে আনলুম। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রান্তের দু-একটি প্রসিদ্ধ পুরুষের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয়ের সুযোগে তাঁদের অনুরোধ করে যে যে ক্ষেত্রে তাঁরা প্রতিষ্ঠাবান, সেই সেই ক্ষেত্রবিষয়ক এক একটি মৌলিক প্রবন্ধ আনালুম। বম্বে হাইকোর্টের জজ মহাদেব গোবিন্দ রাণাডের লেখনী হতে পেশোয়াদের আমলে ধর্মচ্যুত হিন্দুদের স্বধর্মে ফিরিয়ে তাদের অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ সম্বন্ধে একটি মৌলিক প্রবন্ধ যোগাড় করলুম। তিনি লিখেছিলেন ইংরেজীতে—ভারতীতে বেরল বাঙলায়—আমার হাতে অনুবাদিত হয়ে। আর একজন ‘বিদেশী’ও সেই সময় ভারতীয় লেখক-তালিকায় ধরা পড়লেন—নাম তাঁর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তখনও তিনি ‘মহাত্মা গান্ধী’ হননি, আফ্রিকায় কার্যকলাপের সূচনায় তাঁর নাম-যশ সবেমাত্র আরম্ভ হয়েছে। সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কলিকাতা কংগ্রেসে এসেছেন। আমাদের বাড়িতে একদিন একটি সায়াহ্ন পার্টিতে অন্যদের সঙ্গে এলেন। দেখতে শুনতে চটকদার মোটেই নয়—তবে গালভরা হাসিতে ভরা—মাথায় ‘পিরিলি পাগড়ী’ পরা। নানা প্রান্ত থেকে সমাগত অতিথিবহুল পার্টিতে অল্পক্ষণের জন্য মাত্র তাঁর সঙ্গে আমার সেদিন পরিচয় হল। পরে তিনি আমায় গল্প করেন, আমায় কি রকম সমীহের চক্ষে দেখলেন সেদিন,—কেননা আমার পিতা—যিনি কংগ্রেসের অক্লান্তকর্মী জেনারেল সেক্রেটারী তাঁর কন্যা আমি, আমার নিজস্ব কার্যকলাপের বিশেষ কোন পরিচয় পাননি। আমি তখন ভারতীর জন্যে মৃগয়াপরায়ণ, সিংহান্বেষী—সেই চোখেই মোহনদাস গান্ধীকে দেখেছিলুম। ইনি ভারতবাসীর হয়ে বিদেশে কাজ করায় নামকরা একটি সিংহ হয়েছেন, এঁর কাছ থেকে একটা লেখা আদায় করে ভারতীর কলেবর পুষ্ট করতে পারলে বেশ হয়—এই প্রয়োজন-বুদ্ধিতে মাত্র আমি তখন তাঁকে দেখেছিলুম।
আর একজন আমায় ইংরেজিতে মৌলিক প্রবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন। তাঁকে ঠিক ‘বিদেশী’ বলতে পারিনে, অথচ আমাদের পক্ষে ঠিক বিদেশীতুল্যই ছিলেন—হাইকোর্টের জজ হওয়া ব্যারিস্টার সৈয়দ আমীর আলি—যাঁর ইংরেজ পত্নীজাত পত্রও এখন দ্বিতীয় জাস্টিস আমীর আলি। তিনি তাঁর “Spirit of Islam”এর এক কপি আমায় উপহার দিয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সম্বন্ধে আমার পক্ষপাতিত্য তখন থেকেই প্রকট ছিল। একবার শ্রীশ সেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের “দেবালয়”-এর কোন অধিবেশনে আমায় একটি বক্তৃতা দিতে অনুরোধ করেন। আমি “হিন্দুমুসলমানের ঐক্য” সম্বন্ধে বলতে প্রস্তুত আছি বল্লুম—আর কোন বিষয়ে নয়। তাঁদের কমিটি তাতেই স্বীকৃত হলেন। হ্যারিসন রোডের ‘মিত্র ইনস্টিটিউটে’ বক্তৃতার স্থান নির্দিষ্ট হল। বলেছি, কোন সভায় নিজে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করা আমার বড় অস্বস্তিকর ঠেকত। সেবারও আমি নিজে গেলুম না, বক্তৃতা লিখে পাঠিয়ে দিলুম। শুনলুম, লোক ভেঙে পড়েছিল মিত্র ইনস্টিটিউটের হলে। কিন্তু আমি আসব না, শ্রীশবাবু আমার হয়ে বক্তৃতা পড়ে শোনাবেন জানতে পেরে ছেলের দল ক্ষেপে উঠেছিল—শ্রীশবাবুকে মারতেই বাকী রেখেছিল। হ্যাণ্ডবিলের দ্বারা আমি বক্তৃতা দেব ঘোষণা করায় মিথ্যাবাদী, প্রতারক প্রভৃতি বলে শ্রীশবাবুর প্রতি কোনরকম গালিবর্ষণের ত্রুটি করেনি তারা। পরের দিন শ্রীশবাবু এসে আমাকে হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করলেন—আর একদিন মিটিং করতেই হবে এবং তাতে আমায় নিজে উপস্থিত হতেই হবে—নয়ত শ্রীশবাবুর মান থাকে না। আমি অগত্যা স্বীকার করলুম। এবার এলবার্ট হলে মিটিংয়ের আয়োজন হল—জগদীশ বসু তার প্রেসিডেণ্ট, বিপিন পাল তাতে অন্যতম বক্তা। আমি গেলুম, নিজেই বক্তৃতা পড়ে শোনালুম। লোকে লোকারণ্য। মুসলমান শ্রোতাও অনেক।
বক্তৃতার সারমর্ম এই ছিল যে, ভারতবর্ষে আবহমানকাল নবাগতের সঙ্গে পুরানো বাসিন্দাদের স্বার্থ নিয়ে ঝগড়া চলে এসেছে—আর্যঅনার্যর যুগ থেকেই। যখন সেই এককালীন ‘নব’রা পুরানো হয়ে যায়, বিদেশী আর থাকে না, দেশস্থ হয়ে যায়, দেশের পূর্বলোকদের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়, সমস্বার্থ হয়, তখন তাদের সন্তানেরা সবাই একই ভারতমাতার সন্তানস্বরূপ নবতর অভিযাত্রীর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ইংলণ্ডের আদিম বাসীরা ব্রিটনের অ্যাঙ্গলস ও স্যাক্সনেরা ক্রমাগত বিদেশী অভিপ্লবে প্লাবিত হয়ে হয়ে, পরাহত হয়ে হয়ে ক্রমে মিলেমিশে ঐক্যসাধন করে, আজ এক ইংলিশ বা ব্রিটিশ জাতিতে পরিণত হয়েছে। অতীতে যা যা ঘটেছিল, তা বিস্মৃতির গর্ভে ডুবিয়ে দিয়ে অতীতের দ্বন্দ্ববিবাদ অনৈক্য মিটিয়ে আজ দম্ভভরে ঐকজাত্য অভিমানে গান গাইছে—“Britons never shall be slaves.”
আর্য অনার্য, হুন-শক ও আর্য, রাজপুত পাঠান এবং পাঠান ও মোগলের যে দ্বন্দ্বধারায় ভারতের ইতিহাস-কলেবর গঠিত তারও শিক্ষা এই। স্বার্থগত একতাবুদ্ধিই সকল ঐক্যের মূল, সেই স্বার্থের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়ায় তারাই বাকী সকলের শত্রু হয়। একসময় ভারতবাসী অনার্যদের শত্রু ছিল অভারতীয় আর্যরা। সেই আর্যেরা যখন ভারতসন্তান হয়ে গেলেন তাঁদের শত্রু হল ভারতসীমার বাইরে থেকে আসা তাঁদেরই এককালীন জ্ঞাতিগোত্র হুন-শকেরা। তারাও ভারতীয় হয়ে গেলে তাদের রক্তে আর্যদের রক্ত মিলিত হলে, তারাও আপন হয়ে গেল, আর পর রইল না। তখন পর হল আরও পরন্তন আগন্তুকেরা—নূতন মহম্মদীয় ধর্মাবলম্বীরা। এইবার বিরোধের শিকড়টা অনেক গভীরে প্রবেশ করলে। সেমিটিক আরবের বর্বর মূর্তি-পূজকদের মূর্তি সম্বন্ধে পরিকল্পনার সঙ্গে অসূক্ষ্মদৃষ্টিতে ভারতীয় আর্য ঋষিদের মূর্তিপূজাতত্ত্ব একই পর্যায়ে ফেলা হল, দুই একই নজরে দৃষ্ট হল। মূর্তিমাত্রকে মারমার কাটকাট করতে করতে এবার বিদেশীরা এসে হাজির হল। এবার শুধু খাদ্যান্বেষীরা এল না, তাদের পিছনে এল ধর্মধ্বজীরা—নিজের ধর্ম প্রচারই যাদের জীবিকা। এখন থেকে শুধু স্বার্থে স্বার্থে দ্বন্দ্ব বাধালে না, দেশস্থ ভারতীয়দের আত্মাভিমানে বিষম ঘা দিলে বিদেশীয়েরা। সেই ঘা দেওয়াটা পুনঃ পুনঃ নানাভাবে চালাতে থাকল। ঘাতের প্রতিঘাতও চলল। এই বিদেশীয়দের সঙ্গে দেশস্থদের পূর্ববৎ “রুটি ও বেটি ব্যবহার’’ অসম্ভব হল। আর একটা ব্যাপার দেখা দিলে। বিদেশীরা ভারতের প্রতি প্রান্তে প্রান্তিক ভারতীয় ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হলেও, তাদের ছেলেমেয়ের মাতৃভাষা ভারতীয় হয়ে গেলেও—পঞ্জাবে পাঞ্জাবী, গুজরাটে গুজরাটী, মাদ্রাজে তামিলতেলেগুমলয়ালম্, ইউ-পিতে খিচুড়ি হিন্দী এবং বঙ্গদেশে বাঙলা—ছেলেদের নামকরণ আরবী, ফার্সি ভাষাতেই হতে থাকল। মুল্লাদের কৃপায় মাথা ন্যাড়া বৌদ্ধ, বাগদী, ডোম, মেথর, মুচি বা অন্যান্য ইতর জাতির বাঙ্গালীরাও নামের গৌরবে যেন আরব পারস্য বা তুরস্ক দেশ থেকে সদ্য চালান বলে প্রতীয়মান হতে লাগল। পৌত্তলিকতী-দ্বেষে হিন্দু দেবদেবীর অভিধা প্রথম প্রথম ব্রহ্মসমাজীরাও বর্জন করে ছেলেমেয়ের নামকরণপরায়ণ হয়েছিলেন, তাঁরা নানারকম কবিত্বরসে ভরা সুন্দর সুন্দর ভাব বা প্রাকৃতিক বস্তু খুঁজে খুঁজে নাম দিতে লাগলেন। কিন্তু খ্রীস্টান মিশনারীদের হাতে কনভার্ট হওয়া ‘নেটিভ খ্রীস্টান’দের বিদেশীয় নামের আবরণের মত, মল্লাদের হাতে কনভার্ট হওয়া “নেটিভ মুসলিম’’দেরও নেটিভত্ব ঢাকা পড়তে লাগল বিদেশীয় নামের উত্তরীয়ে। সেটি খুলে ফেললেই তারা যে এদেশী নেটিভ, সেই এদেশী নেটিভ। এবার প্রধানত এই দুটি কারণে—নামগত ও ধর্মের আদর্শগত বা কৃষ্টির স্তরগত প্রভেদে আরবের মরুভূমিজাত অনেকগুলি প্রথা কনভার্ট মুসলমানেরা গ্রহণ করায় ভারতীয়দের শুচিজ্ঞানে খটকা দিলে। তেলেজলে মিশ খেলে না। দুদিকেই গোঁড়ামি পরস্পরের সঙ্গে ব্যবচ্ছেদ বাড়িয়ে দিলে। “সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ”—সুতরাং সেই গোঁড়ামিরূপ অর্ধটা ত্যাগ না করলে ভারতবাসীর আজ রক্ষা নেই। এই ছিল আমার সেদিনকার বক্তৃতার মূল কথা।
যে ‘জিনা’ আজ হিন্দুস্থানের বুকে বসে হিন্দুস্থানের মহা শত্রু হয়ে তার বুক চিরতে উদ্যত হয়েছেন—তাঁর নামই পরিচয় দিচ্ছে যে তিনি হিন্দুস্থানের বুকের সন্তান। ‘জিনা’ শব্দটি একটি গুজরাটি শব্দ, অর্থ তার ‘ছোট্ট’। দুই-এক পুরুষ আগে থেকে যদি ‘জিনা’ শব্দটি এই পরিবারে পদবীস্বরূপ চলে এসে থাকে, তাতে দেখায় কনভার্ট হওয়া পরিবারের কর্তাটি মায়ের কোলে যখন শিশু ছিলেন—মা যখন তাঁকে ‘জিনা’ বলে ‘আমার খুদু’ ‘আমার খোকন’ বলে আদর করতেন, মুখে চুমু খেতেন, তখন থেকেই ‘জিনা’ নামটি লেগে গেছে এই পরিবারে— বাঙলায় যেমন বাড়ির খোকা বড় হয়ে গেলেও পাড়াপড়শী সকলেই তাকে ‘খোকা’ বলেই ডাকে। গুজরাটি হিন্দু মা-বাপেরই এই খোকাটি, হিন্দুস্থানের ছেলেটিই আজ হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত, উদ্যত-আয়ুধ। এতে যে তাঁর কতদূর আত্মাবমাননা করা হচ্ছে, তা তিনি উপলব্ধি করছেন না কিসের প্রেরণায়, কিসের উত্তেজনায়? বলাৎ চালাচ্ছে তাঁকে কি? ‘‘কাম এষ ক্রোধ এষঃ!” নেতৃত্ব-কামনা, একটা দল গড়ে দলপতিত্ব কামনা। আমার হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবাদে এ কথা ছিল না যে, কেউ কারো অন্যায় আবদার বরদাস্ত করে যাবে। গান্ধীর অহিংস অসহযোগে যেমন নেই ইংরেজ গবর্নমেণ্টের পতাকাতলায় থেকে প্রজাবংশের প্রতি রাজবংশের অন্যায় অসম-আচরণ সহ্য করা, বরঞ্চ অসহযোগের প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে এই অন্যায়কারী গবর্নমেণ্টের বিরুদ্ধে দাঁড়ানর জন্যে একটা উত্তেজনাময় কর্মপ্রেরণায়, চুপচাপ বসে থেকে সহ্য করার উপদেশ নয় সেটা।
যখন এক রাত্রিতে “ঔরঙ্গজেব” অভিনয়ের সময় হঠাৎ একদল বঙ্গীয় মুসলমান যুবক এসে পশ্চিমী গুণ্ডাদের দিয়ে মিনার্ভা থিয়েটার ঘেরাও করলে এবং অমর দত্ত স্টেজ ছেড়ে পিছনের দরজা দিয়ে পলাতক হলেন, তখন অমর দত্তের কাপুরুষতায় আমার ধিক্কার ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল ভারতীর পষ্ঠায়।
ময়মনসিংহে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সের সম্পর্কে সুহৃদ সমিতি আমাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যায় তাদের সাম্বৎসরিক উৎসবে। সেই সময় তাদের ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি কালে সমগ্র ভারতের জাতীয় ধ্বনিতে পরিণত হল, সে কথা আগে বলেছি। সেই সময় আমার সম্বর্ধনার জন্যে তারা যে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল তার মধ্যে “আনন্দমঠ’’-এর অভিনয় অন্যতম ছিল। প্রাদেশিক কনফারেন্সে সুরেন্দ্র বাড়ুয্যে প্রমুখ অনেক বড় বড় নেতারা সমাগত হয়েছিলেন, আমার পিতাও এসেছিলেন। আমি ও আমার পিতা স্যার টি পালিতের ভ্রাতুষ্পুত্র ব্যারিস্টার নৃপেন পালিতের বাড়িতে ছিলুম।
প্রথম দিন সুহৃদ সমিতির অধিবেশনে যখন নানাবিধ অশ্বক্রীড়ার প্রদর্শনী চলছে, আমি সভানেত্রীর আসনে আসীন রয়েছি, হঠাৎ কেদার চক্রবর্তী আমায় একটু উঠে অন্তরালে যেতে অনুরোধ করলেন। আমি গেলে বললেন,—‘‘আপনার কাছে একটা বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। আমরা আপনাকে দেখানোর জন্যে “আনন্দমঠ” অভিনয়ের আয়োজন করেছি। তাতে মুসলমান শ্রোতাদের ধর্মপ্রাণে আঘাত লাগার মত কথা যেখানে যেখানে আছে বলে সন্দেহ হয়েছে, তা আমরা নিজে হতেই বাদ দিয়েছি। তবু প্রাদেশিক কনফারেন্সের কর্তা-ব্যক্তিরা আমাদের বলে পাঠিয়েছেন—“এবার কলকাতা থেকে অনেক কষ্ট করে কয়েকটি মুসলমান বন্ধুদের যোগাড় করে এনেছেন সুরেন্দ্রবাবু কনফারেন্সে যোগ দিতে। তোমরা ময়মনসিংহের হিন্দু ছেলেরা যদি এই সময় ‘আনন্দমঠ’ কর তারা থাকবে না বলছে, কনফারেন্সে যোগ দেবে না, কলকাতায় ফিরে যাবে। সুতরাং তোমাদের ‘প্লে’ বন্ধ কর, আমাদের সিরিয়স কাজে বাধা দিও না।” দুই-একটি সহকর্মী সহ কেদার চক্রবর্তী। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমায় বললেন—“আপনি উপদেশ দিন, আমরা কি করি এস্থলে।”
আমি বললুম-“লীডারদের ডেকে তাঁদের সামনে রিহার্সাল করে দেখাও। তাঁদের মতে তোমাদের অলক্ষ্যে এখনো যদি আপত্তিকর কোন ভাষা কোন শব্দ প্রয়োগ থেকে গিয়ে থাকে ওর ভিতর তা ছেঁটে দাও।”
তারা বললে—“সে প্রস্তাব করেছি আমরা। তাতে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। তাঁরা বলেন—অংশবিশেষ ছাঁটলে, শুধু দুচারটে কথা বা সেণ্টেন্স ছাঁটলে হবে না, মুসলমানদের ও বইখানার আগাগোড়াতেই আপত্তি। সুতরাং ন্যায় হোক অন্যায় হোক তাদের আপত্তি এস্থলে মানতেই হবে, ময়মনসিংহে এখন ওর অভিনয় বন্ধ রাখতেই হবে।”
আমি শুনে বললুম—“বল কি? সুরেনবাবুর অনুগামী চেলাদের এই কথা? যে সুরেন্দ্রনাথের motto হচ্ছে ‘Surrender not!’ আমারও সেই motto—অন্যায় আবদারের কাছে ভয়বশে surrender কোরো না। আমার উপদেশ এই—অভিনয় তোমাদের জারী রাখ। এ স্থলে তোমাদের কর্তব্যই তাই।”
তার পরদিন সকালে গৃহস্বামী নৃপেন পালিত আমার কাছে এসে জানালেন-“অনাথ গুহ প্রভৃতি এখানকার পোলিটিকাল লীডাররা, ও শহরের বড় বড় মাতব্বর ব্যক্তিরা সবাই আপনার কাছে ডেপুটেশনে এসেছেন।’’ আমার মতো বয়ঃকনিষ্ঠের কাছে পিতৃতুল্য বয়োজ্যেষ্ঠদের ডেপুটেশনে আসা কি কারণে? আমি কৌতুহলী হয়ে তাঁদের কাছে গেলুম। আমার পিতাও সেখানে উপস্থিত। আমি যেতে তাঁদের মুখপাত্ররূপে অনাথবাবু বললেন—“আপনার কাছে আমাদের একটি বিনীত অনুরোধ আছে।” আমি লজ্জিত হয়ে বললুম—“সে কি? কিসের অনুরোধ?”
তিনি বললেন—“সুহৃদ সমিতির ছেলেরা ‘আনন্দমঠ’ অভিনয় করতে যাচ্ছে, আপনি সেটি বন্ধ করে দিন।”
‘সুহৃদ সমিতির ছেলেরা ত আপনাদেরই শহরের ছেলে, আপনাদেরই কর্তৃত্ব তাদের উপর। আমি ত একদিনের অতিথি অভ্যাগত। আমার কথার চেয়ে আপনাদের কথারই ত বেশী জোর হবে তাদের উপর। আপনারাই বলুন না, আপনারাই তাদের আদেশ করুন না অভিনয় বন্ধ করতে।”
হেমন্ত বসু নামক ব্যারিস্টার—ডাক্তার ধর্মদাস বসুর পুত্র ও রজনী রায়ের জামাতা—উষ্ম হয়ে বলে উঠলেন—“ওসব চালাকির কথা রেখে দিন। আপনি বেশ জানেন, তারা আমাদের কথা শুনবে না, আপনার ইঙ্গিতেই চলবে।”
“তাই যদি সতাই হয়, তাহলে তাদের বারণ করবার আগে আমি নিজে বুঝে নিই বারণ করার কারণটি কি?”
‘‘বারণ করার কারণ মুসলমানদের আপত্তি। ঐ বইখানার অভিনয় হলে মুসলমানরা আমাদের ত্যাগ করবে, কনফারেন্সে ঢুকবে না, সুরেনবাবু, অনেক সাধ্য সাধনা করে রেলভাড়া দিয়ে তাদের এনেছেন। তাঁর সব পরিশ্রম পণ্ড হবে।”
“বইখানা যদি নির্দোষ করে অভিনয় করা হয়, তবুও?”
হাঁ, তবুও।”
“এটা কি ঠিক? তাদের কনফারেন্সে যোগ দেওয়ানর জন্যে তাদের প্রত্যেক অন্যায় আবদারটাও মেনে চলতে হবে কি? তাহলে আবদারের আর শেষ থাকবে কি কোনদিন? তার চেয়ে তাদেরই অনুরোধ করুন না রিহার্সাল দেখুন, যেখানে যেখানে বর্জনীয় মনে করেন—বলুন, ছেলেরা নিশ্চয় তাতে আপত্তি করবে না।”
হেমন্তবাবু, গর্জে উঠলেন—“তা হবে না। ও অভিনয়টাই সুহৃদ সমিতির প্রোগ্রাম থেকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দিতে হবে।”
“ছেলেরা যদি রাজী না হয় তাতে?”
“তাহলে রক্তের স্রোত বইবে—খুনোখুনি হবে।”
“তাই যদি হয়, এই ডরাও যদি দেয় আপনাদের মুসলমান বন্ধুরা, আমি সুহৃদ সমিতির ছেলেদের বলব—“ডোরো না, অন্যায়ের পায়ে মাথা নত কোরো না, বহুক রক্ত—লড়, মরতে হয় মর।”
ডেপুটেশনের লীডাররা, মাতব্বর মৈমনসিংহবাসীরা কন্যার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় আমার পিতা অপ্রতিভ হয়ে বলতে লাগলেন—“ও পাগলী, ওর কথা ধরবেন না।”
হেমন্ত বসু গর্জাতে গর্জাতে ও অনাথ গুহ প্রমুখ বাকী সকলে মিষ্ট হাসি হেসে আমায় নমস্কার করতে করতে চলে গেলেন। কিন্তু ব্যারিস্টার হেমন্ত বসুরই জয় হল। তিনি তখনি তাঁর বন্ধু পুলিস সাহেবের কাছে গিয়ে একটা ‘Breach of the peace’-এর সম্ভাবনা হবে জানিয়ে পুলিসের হুকুম পাঠিয়ে অভিনয় বন্ধ করালেন এবং জয়গর্বে স্ফীত হলেন। অনাথবাবু কিন্তু সেই পর্যন্ত আমার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাসম্পন্ন ও আমার নানাকার্যে সাহায্যদাতা হলেন।
এইখানে একটা কথা বলি। আমি যে বাড়িতে ছেলেদের ক্লাবখোলা, তাদের হাতে লাঠি-ছোরা ধরান, ধুমধামে বীরাষ্টমীর উৎসব করা প্রভৃতি নানা কারখানা চালাচ্ছিলুম, তাতে আমার বাবা-মা-রা কি বলতেন? কিছু না—কোন বাধাই দিতেন না। তাঁদের মৌন সম্মতিই আমার পশ্চাতে বল ছিল—না হলে এসব কাজে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারতুম না।