জীবনের ঝরাপাতা/তিন
॥ তিন॥
বাইরে আমাদের পড়ার ঘরের পাশেই ছিল বড়মামা দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলেমেয়ের পড়ার ঘর। সেখানে পড়তেন নীতুদাদা, সুধীদাদা ও ঊষাদিদি এবং শেষে তাঁর কনিষ্ঠ ছেলে কৃতী। ওদের মাস্টারমশায় ছিলেন “স্যর্”—মেট্রপলিটনের হেডমাস্টার ব্রজবাবু। অতি সরস, অতি সহাস্য, অতি মজাড়ে লোক। তাঁর কোনোই শাসন ছিল না, বরঞ্চ অহেতুক পুরস্কার ছিল। তাঁর শাসনপ্রবৃত্তি মেট্রপলিটনের ছাত্রদের উপর দিয়েই নিঃশেষিত হত। তাদের কাছ থেকে শাস্তিস্বরুপ বাজেয়াপ্ত করা ছুরি, রঙীন পেন্সিল প্রভৃতি কিছু না কিছু পকেট থেকে ফস করে বাড়ির পড়ুয়াদের দেখিয়ে ও দিয়ে তিনি তাদের আনন্দে আনন্দ পেতেন। মাঝে মাঝে আমাদের পড়ার ঘরে এসে এই মাস্টারমশাই আমাদের পণ্ডিতমশায়ের সঙ্গে ভদ্রতার বিনিময় করতেন, তখন আমরাও পড়াশুনা থেকে খানিকক্ষণের জন্যে ছুটি পেতুম, আর পেন্সিল বা পকেট-ছুরির ভাগও পেতুম। একদিন পণ্ডিতমশায় আমাকে ও দাদাকে কোণে দাঁড়ানর বদলে শাস্তি দিলেন পড়ার টেবিলের তলায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে বসতে। আর হুকুম করলেন—“আজ ব্রজবাবু যখন আসবেন, আমার সঙ্গে গল্পসল্প করবেন, তখন তোমরা ঐখান থেকে তার পায়ে চিমটি কাটবে, তাঁর খুব আমোদ হবে।” একে শাস্তি পাওয়ার লজ্জা তার উপর সেটা নিজে জাহির করা বেহায়াপনার দ্বারা—এই শাস্তির উপর শাস্তি; এই রকম নির্লজ্জ ব্যবহারশীল হতে হওয়া—এইটে ভয়ানক বাজল। পণ্ডিতমশায় মধ্যে মধ্যে আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে গল্প করতেন সেকালের পাঠশালায় গুরুমশায়দের উর্বর মাথায় কত রকমের রোমাঞ্চকর শাস্তির উদ্ভাবনা হত। সে সবের তুলনায় আমরা যে সব শাস্তি পাচ্ছি, এ ত কিছুই নয়। তাঁর রুলের স্পর্শ তো ফুলের স্পর্শ।
এ-বাড়ির আর এক ঘরেও ছেলেমেয়েরা কড়া শাসনে পালিত হয়েছেন, সে কিন্তু তাঁদের স্বয়ং বাপমায়ের—ঝি মাস্টারের নয়। সেজমামা হেমেন্দ্রনাথের কন্যা প্রতিভাদিদি ও তাঁর ভাইবোনেরা পড়াশুনা ও সঙ্গীত অভ্যাসের নিয়মনিগড়ে একেবারে বদ্ধ থাকতেন। নিয়ম থেকে একটু বিচ্যুত হলে সেজমামার হাতে উত্তম-মধ্যম পেতেন। বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার তাঁদের সময় হত না, জীবনের প্রথম দিকটায় প্রবৃত্তিও ছিল না। তাঁদের মহলের কবাট কি ভিতরের, কি বাইরের—অর্গলবদ্ধই থাকত, অবাধ গতিবিধি ছিল না কারো। যত বড় হতে লাগলেন এক-একজনের কবাট খুলতে লাগল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই-একজন কুনো রইলেন। আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিভাদিদির বিবাহের সূত্রে তাঁদের মহলের মনের ঘর সব প্রথম খুলল। প্রতিভাদিদিরা সাত বোন। তাঁদের কারো সঙ্গে বাড়ির আর কোনো সমবয়সী ভাইবোনের ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তিনটি মেয়ে আমরা সঙ্গিনী ছিলাম, সেজ মাসিমার দ্বিতীয় কন্যা সুপ্রভা দিদি, বড়মামার কনিষ্ঠা কন্যা ঊষা দিদি ও আমি। বিকেলে হল-ঘরের বাইরে বারান্দায় ছেলের দলের সঙ্গে অনেক সময় খেলায় যোগ হত আমাদের। সে দলে ছিলেন বড়মামার দুই ছেলে নীতুদাদা ও সুধীদাদা, আমার দাদা জ্যোৎস্নানাথ ও বিমানমামাদের মামাতো ভাই। নীতুদাদা ছিলেন দলের কাপ্তেন। একটা বাঁধা গালাগালির ছড়া ছিল তাঁর— “ইস্টুপিড-গাধা-ড্যাম-শুয়ার-পাজি-রাস্কেল-ফুল।” তাড়াতাড়ি গড়গড়িয়ে সবগুলো একসঙ্গে একটা কথার মত বলতে হবে। আহা, সে অপরুপ কথার বিনাস—কর্ণে কি মধু ঢেলে দিত! জিভ কেমন লেলিহান হত তার উচ্চারণের জন্যে! একটা গোল লোহার চাকা পিটিয়ে বারান্দায় চালাতে চালাতে রোজই এক-আধবার এটা আবৃত্তি করতেন দাদারা। খেলতে খেলতে কারো সঙ্গে ঝগড়া হলে বা চাকাখানার উপর কোন কারণে রাগ হলেই এ গালির বর্ষাপাত হত। সুপ্রভাদিদি ও ঊষাদিদিও নির্বিবাদে এই ছড়াটি মধ্যে মধ্যে কাজে লাগাতেন। কিন্তু আমি যদি কোন দিন এটিকে জিহ্বানিঃসরণ করতুম, অমনি দাদা-দিদিরা সকলে মিলে আক্রোশ করতেন—“অ্যাঁ! গালাগালি দেওয়া হচ্ছে! দাঁড়াও বলে দিচ্ছি সতীশ পণ্ডিতকে।”
সতীশ পণ্ডিত শুধু আমাদের মাস্টার ছিলেন না, তিনি ছিলেন অভিভাবক। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দুধ খেয়েই বাইরে পড়ার ঘরে তাঁর কাছে আসতে হত। দাসীদের যদি বা ফাঁকি দেওয়া যেত, তাঁকে ফাঁকি দেবার যো নেই। বাড়ির ভিতরের hurdleটা পেরিয়ে আবার বাইরে আর একটা hurdle-এর সম্মুখীন হতে হত। তিনি প্রথমেই আমাদের দাঁত দেখতেন ভাল করে মাজা হয়েছে কি না। যদি পাস হতুম রক্ষে— নয়ত রুলের বাড়ির মার, কিম্বা অন্য শাস্তি।
ইস্কুলে ভর্তি হবার পর থেকেই যত দিন যেতে লাগল, আমাদের উপর পড়াশুনার চাপ বেশি করে পড়তে থাকল। স্কুলে যাতায়াত আরম্ভের পর স্কুল থেকে ফিরেই আর খেলাধুলার তত সময় হত না। আমরা বাড়ি ফিরতে না ফিরতে সংস্কৃতের জন্যে বাইরে পড়ার ঘরে শশী পণ্ডিতমশায় এসে বসে থাকতেন। সংস্কৃত পড়তে ভালই লাগত, কারণ তখনো ব্যাকরণের নীরসতায় ঢোকান হয়নি—‘ঋজুপাঠে’র গল্পগুলি শুধু সাহিত্য হিসেবে পড়িয়ে যাওয়া হত। শশী পণ্ডিত যেতে না যেতে কবাটের বাইরে গান ও সেতারের মাস্টার ভীমবাবুর মুখসূর্য উদীয়মান হত। সতীশ পণ্ডিত তাঁকে গৃহমধ্যে অভ্যর্থনা করে ডেকে নিতেন। সতীশবাবুর পর্যবেক্ষকতায়ই আমাদের সব শিক্ষা চলত।
গান শেখার হাতেখড়ি হয় আমাদের অব্জবাবুর কাছে, বিষ্ণুবাবুর পরে যিনি ব্রাহ্মসমাজের গায়ক হয়েছিলেন। অব্জবাবু তাল ও মাত্রা শেখানর জন্যে একটা কৌশল অবলম্বন করেন। একটা কালো বোর্ডে এই রকম ধরনের আঁক কেটে—স।র॥ম।র॥। আমাদের বুঝিয়ে দেন যে, সুরের পর যটা দাঁড়ি থাকবে, সুরটা মুখে গেয়ে পরে দাঁড়ির বদলে হাতে ততগুলি তালি দিতে হবে। দিদি দাদার একটু দেরি হল জিনিসটা ধরতে। আমি কি জানি কেমন সৌভাগ্যবলে তাঁদের আগেই সুরগুলো চটপট ঠিকঠাক গেয়ে, তালিগুলো হাতে ঠিকঠিক দিয়ে ফেল্লুম। অব্জবাবু ভারি খুশি হলেন। মার কাছে আমার ভাল রিপোের্ট গেল। রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্কুল থেকে আগত ভীমবাবুও আমায় ভাল মার্ক দিতে থাকলেন। খবরটা মায়ের কাছে পৌঁছাল। সেই পর্যন্ত আমার প্রতি মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ হল। এর মানে নয় যে, হৃদয় দিয়ে তাঁর হৃদয়ে বেশি যুড়লম। শুধু শিক্ষা সম্বন্ধে কোন কোন বিষয়ে তাঁর সাক্ষাৎ পরিদর্শকতার গণ্ডির ভিতর এলুম। একটি পিয়ানো বাজনা বাইরের তেতালায় মায়েরই বসবার ঘরে থাকত। শুধু আমাকে শেখানর জন্যে একজন পিয়ানো শিক্ষয়িত্রী মেম হপ্তায় দুদিন করে নিযুক্ত হলেন। মায়ের ঘরে গিয়েই শিখতুম। মেম যতক্ষণ শেখাতেন বেশ লাগত, কিন্তু মা একটা কঠিন নিয়ম করলেন যে, শেখান জিনিসটা রোজ এক ঘণ্টা করে তাঁর ঘরে বসে প্র্যাকটিস করতে হবে—সেইটে বড় নীরস বোধ হতে লাগল। বাজিয়ে বাজিয়ে আঙুল ব্যথা হয়ে যায়, মন শ্রান্ত হয়ে যায়, ঘণ্টা আর শেষ হয় না। এই বিপদে সুপ্রভাদিদি এলেন আমায় বিপদ থেকে উদ্ধারকর্ত্রী হয়ে।
সুপ্রভাদিদি এ বাড়ির মধ্যে একটি ব্যক্তিত্বশালিনী কন্যা। সেজ মাসিমার ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার বেশি ধার ধারতেন না। সেকালের ‘চারুপাঠে’র উপরে আর উঠেছিলেন কি না সন্দেহ। কিন্তু জাগতিক অনেক বিষয়ে সুপ্রভাদির অশিক্ষিত পাণ্ডিত্য ও অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। সর্বনীচের তলার বামুন ও দাসী মহল থেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চতলার বড়দের মহলে কি ঘটছে না ঘটছে, সে সবের খবর তিনি রাখেন। সারা দিনরাত ধরে চরকির মত ঘুরছেন একবার নীচে একবার ওপরে। এর পিতা—আমাদের সেজ মেসোমশায়—যদুনাথ মুখোপাধ্যায়ের মত ইনি রঙ্গরসে ভরা। হাসিয়ে হাসিয়ে কথা কইতে, সভা জমকাতে ইনি অদ্বিতীয়। সুকুমার হালদারের সঙ্গে বিবাহের পর ডেপুটিগৃহিণী হয়ে মহকুমায় এর অন্দরে মেয়েদের একটি খাস এজলাস বসত। মজলিসের সদস্যাদের সঙ্গদোষে বা সঙ্গগুণে তথাকথিত অপৌত্তলিক ব্রাহ্মমন্ত্রদীক্ষিতা মেয়ে হয়েও তিনি সে দীক্ষার বন্ধন ছিন্ন করে পৌত্তলিক গুরুর কাছে মন্ত্রগ্রহণ করলেন, শিবপ্রতিমার পূজারত হলেন। বড় মাসিমার জ্যেষ্ঠা কন্যা ইরুদিদিও কাশীতে শ্বশুরগহে নিত্য শিবদুর্গার সেবাপরায়ণা ছিলেন; কারণ, তাঁর বিবাহ হয়েছিল সেই রকম ঘরে—কাশীর নিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের পর নিত্যরঞ্জন বাবার সঙ্গে—যাঁদের নিজ বাড়িতেই শিবমন্দির ছিল। ইরুদিদিকে তাঁরা ষোল-সতের বৎসর আর মায়ের কাছে মাতুলালয়ে পাঠাননি। অত বছর পরে ইরুদিদি যেদিন প্রথম আবার যোড়াসাঁকোয় পা ফেললেন, সেদিনটি সকলেরই একটি স্মরণীয় দিন—আমাদের ছোটদেরও। সুপ্রভাদিদির বিবাহ হয়েছিল ব্রাহ্মমতে ব্রাহ্মমতাবলম্বী রাখালদাস হালদারের পুত্র ব্রাহ্ম সুকুমার হালদারের সঙ্গে। তৎসত্ত্বেও সুপ্রভাদিদি নিজের স্বাধীন অভিরুচির অনুসরণ করলেন। কিন্তু যোড়াসাঁকোয় মাতুলালয়ে আনাগোনা সমান বজায় রাখলেন—এ বাড়ির সংস্কার ভঙ্গ করেছেন বলে তিলমাত্র অপ্রতিভ হলেন না।
এহেন সুপ্রভাদিদি ছেলেবেলায় ছিলেন আমাদের নেত্রী। নিজের মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ-সমর তার প্রায়ই বাধত। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন—“অতক্ষণ ধরে প্র্যাকটিস করতে যদি না ভাল লাগে, দরকার কি করবার?” “না করে উপায় ত নেই!” “আছে বৈকি। ঐ সময়ে ঘড়ির কাঁটাটা রোজ একবার করে এগিয়ে দিলেই হল।” আমি শুনে ভয় পেয়ে গেলুম। বল্লুম, “আমি পারব না।” তিনি বল্লেন—“কুছ পরোয়া নেই—আমি করে দেব।”
একদিন আমার প্র্যাকটিসের সময় মা যখন গৃহান্তরে আছেন, সুপ্রভাদিদি একটা চেয়ারের উপর চড়ে ঘড়ির কাঁটা মিনিট কুড়ি এগিয়ে দিয়েই নিজে সরে পড়লেন।
খানিক বাদে এ ঘরে এসে ঘড়ির দিকে চেয়ে মা যখন দেখলেন ঘণ্টা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তাঁর কেমন সন্দেহ হল। চৌকিতে চড়লেও আমার হাত ঘড়িতে নাগাল পাবে না তা অনুমান করলেন। সুপ্রভাদিদিকে খানিক আগে এ অঞ্চলে উসখুস করতে দেখেছেন, বুঝে নিলেন এ তাঁরই কীর্তি। তবু দিদির মেয়েকে বকাঝকার অধিকার তাঁর নেই, আর প্রকৃত দোষী ত আমি—তাঁর নিজের মেয়েই; সুতরাং শাস্তি আমারই প্রাপ্য। তাই আমাকে একটি চড় মেয়ে শাস্তি দিতে কৃতসংকল্প হলেন। কিন্তু ঘরে তখন অন্য লোকেরাও এসেছেন। কারো সামনে চড় তোলাটা অশোভনতা বলে মা তাঁদের সরে যেতে অনুরোধ করে একটি কোমল চপেটাঘাত আমার গালে স্পর্শ করালেন।
মঙ্গলা দাসীর বিরাশী সিক্কার ওজনের চড় ও মায়ের এই চড়ে কত তফাৎ! লোকের সামনে রাগ করায়, ছেলেপিলেকে মারায় আত্মমর্যাদার হানি হয়-এই যে সৌকুমার্য মা সেদিন প্রকটিত করলেন, পরজীবনে তাঁর অনেকানেক সুকুমার ব্যবহারের তা অগ্রপরিচয়।
পরোপকারী সুপ্রভাদিদির চেষ্টা কিন্তু নিষ্ফল হল না। সেদিন থেকে আমার প্র্যাকটিসের সময় এক ঘণ্টা হতে আধ ঘণ্টায় নেমে গেল।
বলেছি, উত্তরোত্তর আমাদের উপর লেখাপড়ার চাপ বেশি করে পড়তে লাগল। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সন্ধাবেলায় গানবাজনার মাস্টার ভীমবাবু চলে গেলেই খাস হোম-টিউটরের কাছে ইস্কুলের পড়া তৈরি আরম্ভ হত। রাত ৯টা পর্যন্ত তিনজনকে পালা করে পড়ান চলত। দেউড়িতে ঢং ঢং করে ৯টার ঘণ্টা বাজলে আমাদের ছুটি দেওয়া হত। ঘুমে চোখ ঢুলঢুল করে বাড়ির ভিতরে নিজেদের ঘরে দাসীদের কাছে খেতে-শুতে আসতুম।
সেই সময় সেজমামার বাইরের ঘরটার পাশ দিয়ে আসতে গা ছম্ছম্ করত। তিনি নাকি যখন একবার ডাক্তারি পড়তেন, সেই ঘরটায় মড়া কাটতেন, তাই ঘরে ভূত ভরা। সুপ্রভাদিদি সব-জানতা, সব ভয়ের প্রতিকারও তাঁর জানা বিদ্যের মধ্যে। তিনি আমাদের গুরু হয়ে শেখালেন ‘রাম’ ‘রাম’ বল্লে ভুতের ভয় কেটে যায়, আর একটু লোহা গায়ে রাখলেও ভূত একেবারে পালায়। দিদি তখন খোঁপা বাঁধতে আরম্ভ করেছেন, মাথায় লোহার কাঁটা থাকে, সুতরাং তাঁর নিজের গায়েই অস্ত্র রয়েছে। আমি নিরস্ত্র, টুপ্ করে পার হয়ে বাড়ির ভিতরের মোহনায় খড়খড়িঘরে ঢুকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতুম। দাদা নির্ভীক, ভূতের ভয় ছিল না তাঁর।
নিজেদের ঘরে এসে খেয়েই যে তৎক্ষণাৎ ঘুমুতে যেতুম সব সময় তা নয়। সেজমাসিমাদের ‘দশ-পঁচিশ’ ও ‘তাসে’র আড্ডা জমত ঐ সময়। প্রায়ই একবার করে সেখানে ঢুঁ মেরে, তাঁদের খেলা দেখে দেখে খেলা শিখতুম, দু-একহাত তাঁদের সঙ্গে খেলতুমও। এই ছিল night-club সেকালের মেয়েদের যতক্ষণ না তাঁদের স্বামীরা বাড়ির ভিতরে না আসতেন। এই clubএ গিয়ে গিয়ে দশ-পঁচিশ ও তাসের বিন্তি খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলুম—এক এক সময় মাসিদেরও হারিয়ে দিতুম। কিন্তু তদূর্ধ্বে উঠতে পারি নি—গ্রাবুর ছক্কা পাঞ্জা আমার পক্ষে রহস্যলোকই রয়ে গেল। গ্রাবুটা একালের ব্রিজের অগ্রদূত। এ দুয়েতেই আমার কোন দক্ষতা হল না কোনকালে। এতে যতটা মাথা খেলাতে হয়, ততটার অবসর এবং রুচিও হয়নি আমার—না ছেলেবেলায় না বড় হয়ে।
বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড়মামার ছোট মেয়ে ঊষাদিদির সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি ভাব। যোড়াসাঁকোর ছেলেমেয়েদের এক একটা group ছিল। আমাদের সাথী ছেলেদের মধ্যে নীতুদাদা, সুধীদাদা, বলুদাদা ও দাদা একদল এবং মেয়েদের মধ্যে সুশীলাদি ও দিদি একদল এবং তার চেয়ে আর একটি ছোট দলে ছিলুম সুপ্রভাদিদি, ঊষাদিদি ও আমি। সুপ্রভাদিদি আসলে সব দলেই ভুক্ত ছিলেন—তাই ঊষাদিদি ও আমি বেশি বন্ধু ছিলুম। ভয়ানক ভালবাসতুম তাঁকে। তিনি সুভাদিদির মত জীবন্ততায় ভরা নয়, অতি ঠাণ্ডা, সরল, সাদাসিদে। শিশুর ভালবাসা যে বড়দের মতই প্রগাঢ় হতে পারে তা বড়রা অনুমান করতে পারে না। ঊষাদিদির দাসী ছিল শঙ্করী—আমার যেমন মঙ্গলা। শঙ্করী খুব রুপকথা জানত। যখনই মঙ্গলার হাতছাড়া হয়ে পালিয়ে আসতে পারতুম ঊষাদিদিদের ঘরে গিয়ে তাঁদের প্রকাণ্ড তক্তপোষের বিছানায় মশারির ভিতর ঢুকে জড়াজড়ি করে শুয়ে শঙ্করীর রুপকথা শুনতুম। খুব ভোরে উঠে দুজনে গলা ধরাধরি করে বাড়ির ভিতরের বাগানে গিয়ে শিউলিফুল কুড়িয়ে আনতুম। শুকিয়ে গেলে তার বোঁটা জলে সিদ্ধ করে কাপড় ছোপান হত। সুপ্রভাদিদি ও ঊষাদিদি পরতেন শাড়ি—আমার পরিধান তখনও ইজের জামা। কাপড় রঙাবার জন্যে আর একটি জিনিসও পাওয়া যেত কখনো কখনো বাগানে—নটকানে। কিন্তু তাতে বড়রা দখল জমিয়ে রাখতেন—আমাদের তোলা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। সুন্দর হালকা নটকানে রঙের শাড়ি তাঁদের প্রায়ই অপরাহ্রে সাজ হত। বাগানে আমরা দল না বেঁধে যেতুম না, একা একা যেতে ভয় করত, সুপ্রভাদিদি দলপতি হয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন। পাঁচিলের ওধারে সিংহীবাগান—পাছে সেখান থেকে কোন চোর পাঁচিল টপকে লাফিয়ে পড়ে সেই ভয়। একবার নাকি তাই হয়েছিল, আমাদের সংবাদদাতা সুপ্রভাদিদির জ্ঞাপিত এই সংবাদ।
ছুটির দিন ঊষাদিদির লুচি আলুভাজির সঙ্গে আমার লুচিগুড় মিশিয়ে পরস্পরের মুখে তুলে দিয়ে খেতে পরম তৃপ্তিলাভ হত দুজনের। সাত-আট বছরের বালিকাদের পরস্পরের প্রতি টানটা একটা বড় বিদ্ঘুটে ভাষায় একদিন ব্যক্ত হল। কথাটার ওজন না বুঝে ভাবে গদগদ হয়ে একদিন বল্লুম—তোমার মা-বাবা যখন থাকবেন না তোমাকে আর তোমাদের ঘরে গিয়ে শুতে হবে না, সারা দিনরাতই আমাদের কাছে থাকতে পারবে, কখ্খনও আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে না।
কথাটা ঊষাদিদির বড়বোন সরোজদিদির কানে উঠল। উঠতেই চারিদিকে রটে গেল—“কি সর্বনেশে কথা! কি দুষ্টু মেয়ে! এমন কথা মুখে আনে।” যে কথাটা নিছক ভালবাসার একটা চরম ব্যঞ্জনারূপে মুখ দিয়ে ফুটেছিল, যার ভিতর প্রেমিক হৃদয়ের ক্ষণমাত্র বিরহহীন মিলনের আকাঙ্ক্ষাটা শিশুর হৃদয় ভেদ করে ব্যক্ত হয়েছিল—তার মর্ম কেউ ধরলে না। চারদিক থেকে ধিক্কার আসতে লাগল। একটা ভয়ানক অকথনীয় কিছু বলেছি অনুমান করলাম। এতটুকু মেয়ের মুখে একথা বেরল কি করে? সে ভিতরে ভিতরে কত স্নেহক্ষুধায় ভরা ছিল, তারই বাইরে প্রকাশ এটা। যে মাকে আঁকড়াতে পারে না, মায়ের কোলে ঝাঁপাতে পারে না, সে কাউকে আঁকড়াতে চায়। এত বড় প্রকাণ্ড বাড়িতে যেখানে বড়দের সবই চলছে—আমোদপ্রমোদ ও স্নেহ-ভালবাসা অন্য ছেলেমেয়েদের জন্যে—সেখানে নতুন মামী ছোট বোন ঊর্মিলাকে যেমন ভালবাসতেন, তাকে যেমন বুকে করে নিয়েছিলেন, আমাকে যদি তেমনি কেউ স্নেহ দিয়ে ঘিরত, তাহলে ঊষাদিদিকে যে বড্ড ভালবাসি, সেইটে এই রকম ভাষায় ফুটে উঠত না। তাই অপরাধের গুরুত্বটা ঠিক কোন্খানটায় তা ধরতে পারলাম না। “বাবা-মা না থাকার” মানে যে ঘরে একেবারে মৃত্যুর করালমূর্তিকে ডেকে আনা—তা কল্পনায়ও আনতে পারলাম না। কেউ না থাকার মানে যে আপন জনের মৃত্যু-কালিমায় গৃহ আচ্ছন্ন হওয়া, সেটা যে কতদূর শোচনীয় ব্যাপার—যার দরুন বলে শত্রুরও মৃত্যু কামনা করতে নেই,—তা তখন আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধারণার অতীত।
মৃত্যুছায়ার একটা আভাস এল আমার জীবনে আমাদের সব ছোটবোন উর্মিলার হঠাৎ মৃত্যুতে। ঊর্মিলা ছিল নতুন মামীর আদুরে। তিনিই তাকে দেখতেন শুনতেন খাওয়াতেন পরাতেন। তাঁর সঙ্গে সে বাইরের তেতালাতেই থাকত—আমাদের তিনজনের সঙ্গে বাড়ির ভিতরে নয়। নিঃসন্তান নতুন মামীরই মেয়ে যেন সে। শুধু, আমরা যখন ইস্কুলে যেতে লাগলুম তাকেও আমাদের সঙ্গে ইস্কুলে পাঠান হল। এক পাল্কীতে চড়ে যাওয়ার সেই সময়ে মাত্র তার সঙ্গে আমাদের যোগ। তার সঙ্গে আর কোন সংস্রব আমার মনে পড়ে না। আমার চেয়ে দু বছরের ছোট সে। ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার দুই এক মাস পরেই একদিন নতুন মামীর ছাদের বাঁকা সিড়ি দিয়ে গোলাবাড়ির দিকে আপনাআপনি নামতে গিয়ে নীচে পড়ে গিয়ে brain concussionএ মৃত্যু হয় তার। বাবামশায় তখন বিলেতে।
সারা বাড়িতে সেদিন এক ঘোর কালোছায়া। মা উপরে আছেন, আমাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি—আমাদের উপরে নিয়ে যাওয়া হয়নি। সেদিন শুধু সতীশ পণ্ডিত আমাদের আগলিয়ে বসে আছেন। বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েরা সেদিন খেলতে আসেনি—সবাই নিজেদের ঘরে ঘরে আছে। পণ্ডিতমশায়ের উপর ভার দেওয়া হয়েছিল আমাদের নানা কথায় ভুলিয়ে রাখা, মৃত্যু জিনিসটা যে কি তা না জানতে দেওয়া। ঊর্মিলা কোথায় বেড়াতে গেছে—এই বলা হল আমাদের। আর যে কখনও ফিরবে না তা অনেক দেরীতে ক্রমে ক্রমে উপলব্ধি করলুম।