জীবনের ঝরাপাতা/চার
আমি সাড়ে সাত বছরে বেথুন ইস্কুলে ভর্তি হই সব নীচের ক্লাসে—আর ক্লাসের মধ্যে সব চেয়ে ছোটও আমি। লজ্জাবতী—রাজনারায়ণ বসুর ছোট মেয়ে—আমার চেয়ে বয়সে অন্তত চার বছরের বড়—সেও ঐ ক্লাসে। আমি তার ভারি স্নেহ ও যত্নের একটি পুতুল হলুম। ইস্কুলে বছরের পর বছর ক্লাসের পর ক্লাসে সকলের প্রিয় হতে থাকলুম। ক্রমে এমন হতে লাগল এক এক ব্যাচের পর ব্যাচে এক একটি মেয়ে আমার ঘোরতর প্রেমিকা হতে থাকল। যখন বাড়ির গাড়ি বন্ধ হয়ে আমাদের ইস্কুলের বাসে যাতায়াত হল—“সরলা দিদির” বইখাতা কে তাঁর হাত থেকে নিয়ে নিজেদের হাতে ধরে থাকবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ হল। ইকুলে টিফিনের ছুটির সময় বা বাসের ক্ষেপের প্রতীক্ষায় যখন বসে থাকতে হত—তখন “সরলা দিদি”কে নিয়ে দুটি খেলা করা বা তাঁকে ঘিরে ইংরেজী রূপকথা শোনা—এই হল তাদের কাজ। মাঝে মাঝে “সরলা দিদিকে” বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা ও প্রত্যেকের যেটি সবচেয়ে প্রিয় ও রুচিকর জিনিস সেইটি তাঁকে খাওয়ান।
সেই ঘুঁটি খেলার একটি বুলি এখনও মনে পড়ে—কি জানি আজকালকার মেয়েরা আর সেই বুলি বলে সেইরকম ঘুঁটি খেলে কিনা।
“ও দোলন দোলন ও দোলনটি
এক তুলব দোলের নোটনটি
নোটনধাম নোটনধাম নোটনধামটি।”
আজকাল মেয়েদের মধ্যেও indoor games বলতে “লুডো” “ক্যারাম” এইসব বোঝায়। এই বিজাতীয়দের মধ্যে স্বজাতীয় ঘুঁটিকে ঢোকালে কেমন হয়?
কথামালার ক্লাস থেকে আমি প্রায় সাত বছরে ঢুকেছি, আর সতের বছরে বি-এ পাস করে বেরিয়েছি এই বিদ্যালয় থেকে। এর মধ্যে কত সঙ্গিনী, কত প্রণয়িনী, কত স্থায়ী বান্ধবী লাভ করেছি। পাস করে বেরোনর পরও বছর বছর প্রাইজের পূর্বে আমার ডাক পড়ত—মেয়েদের এ উপলক্ষে গান ও অভিনয়াদি শিখিতে সাজিয়ে গুজিয়ে তৈরি করার জন্যে। শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদেরও আমি খুব প্রিয় ছিলুম। যখন বি-এ পাস করলুম সব শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীরা মিলে আমায় অভিনন্দন করে এক সেট ভাল ইংরেজ কবিদের গ্রন্থাবলী উপহার দিলেন।
অনেক এগিয়ে এসে পড়েছি। আবার পিছিয়ে বলি। যোড়াসাঁকোয় থাকতে ইস্কুল যেতুম পাল্কীতে চড়ে। ইস্কুলের রাস্তা ছিল যোড়াসাঁকো থেকে চিৎপুর রোডে বেরিয়ে বারাণসী ঘোষ স্ট্রীট দিয়ে মাণিকতলা স্ট্রীটে পড়া। মাণিকতলা স্ট্রীটের ছোট রাস্তার উপর একটা দোকান ছিল, সেখানে বেহারাদের কাঁধে পাল্কী থামিয়ে “gem” বিস্কুট ও লজঞ্জুস কেনা অমাদের জীবনে প্রথম shopping রসের অনুভূতি।
সেকালে পাল্কীর সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত সংযোগ ছিল। দুচারখানা পাল্কী বাড়ির ভিতরের দেউড়ীতে সর্বদাই মজুদ থাকত। দরকার হলে শুধু বেহারাদের তাদের বাড়ি থেকে ডেকে পাঠালেই হল।
বারাণসী ঘোষ স্ট্রীট থেকে চাষা-ধোপা পাড়া বেরোত। সেখানে থাকতেন মাদের মামা ও মামী এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা। ছুটির দিন দু-আনার পাল্কী ভাড়া করে সেখানে যাওয়া আমাদের মস্ত একটা outing ছিল। ঐ দুটি আনা যোগাড় হলেই কি আনন্দের ডাকে আমরা সেখানে ছুটতুম, কি রসহ্রদে ডুবে মজে থাকতুম। ছোট্ট দোতালা বাড়ি, ছোট্ট উঠান, ছোট্ট পূজার দালান, ছোট্ট ছাদ—তার ভিতর বিশালহৃদয়া, সরল, সহাস্য, নাতিসুন্দরী মাদের মামী, আমাদের দিদিমা। মাদের মামা খাস যশুরে পিরিলি, দেখতে অতি সুন্দর, ধবধবে রঙ। নীচের ঘরেই পড়ে থাকেন। এঁদের বড় মেয়ে বিনোদা মাসি আমাদের ছোট মাসিমা বর্ণকুমারীর সমবয়সী ও বন্ধু। এঁদের বড় ছেলে বিমান মামা কিন্তু নীতু দাদাদের সমবয়সী। আমরা এখানে এসে কি করতুম? হড়োহুড়ি, গান, বাজনা, বড়দের দেখা অভিনয়ের নকল। আমাদের এক মামীর একটি বোনঝিও আসত আমাদের সঙ্গে। তার বেসুরা গলায় গান গাওয়ান ও তাতে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়া ছিল আর এক মজা। কিন্তু তাকে জানতে দেওয়া হত না যে তার গানের জন্যে আমরা হেসে অস্থির। এ বিষয়ে নেত্রী ছিলেন সরোজা দিদি বা বড়দের কোন একজন। তাঁরা কেউ তাকে গান গাইতে উৎসাহ দিলে সে যখন গান ধরত আর উৎসাহদাত্রী হাসি সামলাতে অক্ষম হতেন, তখন ছোটদের একজনের উপর একটা দোষ চাপাতেন, “ও কি! দেখেছ! কি রকম সুড়সুড়ি দিচ্ছে!” বলে তখন খোলাখুলি সবাই মিলে হেসে বাঁচতেন। গায়িকা স্বপ্নেও সন্দেহ করত না যে তার গানই সবায়ের হাসির প্রবর্তক।
এখানে আসা সম্বন্ধে আর একটি কথা মনে পড়ে। ছোটদের মনে কি রকম করে একটা ধারণা উপ্ত হয়েছিল যে, এঁদের অবস্থা ভাল নয়, যা মাসহারা পান তাতে বহুসন্তানিক এঁদের কষ্টে খরচ নির্বাহ হয়। সেইজন্যে শিশু হলেও বড়দেরই শিক্ষায় আমাদের মনে একটা কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়েছিল যে, এখানে আমোদ করতে এসে যেন এঁদের ঘাড়ে কোন খরচ না চাপাই। তাই আমরা নিজেরাই পয়সা দিয়ে দোকান থেকে সখের খাবারাদি আনাতুম, দিদিমার উপর কোন বোঝা চাপাতুম না। চাষা-ধোপা পাড়ার গলিটিতে যাতায়াত আমাদের ইস্কুল-জীবনেরই এক অঙ্গ ছিল। যেমন যেমন বড় হতে লাগলুম সেটা আস্তে আস্তে খসে যেতে লাগল। মেজ মামী বিলেত থেকে ফিরলে আর এক দিদিমার বাড়ি—তাঁর মায়ের বাড়ি যাতায়াত আমাদের ধরলে—তাঁরই ছেলেমেয়ের সঙ্গে। সে কথা পরে বলব।
ইস্কুলে পড়াশুনায় যে আমি খুব নিবিষ্টমনা ছিলুম তা নয়। তবে বাড়ির থেকে পণ্ডিত মশায়ের কাছে একদফা পড়া তৈরি করে আসায় ক্লাসে মোটের উপর ভালই থাকতুম। ইস্কুলে যাবার পর পড়াশুনার মধ্য দিয়ে মার সঙ্গে আমার একটু যোগাযোগ আরম্ভ হল। এই সময়কার একটি কথা মনে পড়ে। একদিন ইংরেজী grammar-এ আমার বিদ্যার দৌড় পরীক্ষা করছিলেন মা। Common noun ও Proper noun-এর প্রভেদ কি তার দৃষ্টান্তস্বরূপ জিগ্যেস করলেন—‘‘‘গঙ্গা’ Common noun না Proper noun?” আমি বল্লুম—‘‘Common noun’’! সরোজাদিদির স্বামী মোহিনীবাবু তখন সেই ঘরে ছিলেন, তিনি মার সঙ্গে সঙ্গে বল্লেন—“এই ত তাহলে কিচ্ছু বোঝনি? ভুল বল্লে।”
আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলুম, নিশ্চয় জানি আমার ভুল হয়নি। অসহায়ভাবে বল্লুম—“কেন? ভুল কোথায়? গঙ্গা ত নদী, তাইত Common noun।”
দাসীদের কথায়বার্তায় ‘গঙ্গা’ শব্দ যে ‘নদী’রই পারিভাষিক, যে-সে-নদীই যে গঙ্গাপদবাচ্য এই ধারণাই আমার মনে বসা ছিল। সেটা আমি কিছুতেই মাদের বোঝাতে পারছিলুম না। তাই তাঁরা যখন বল্লেন—‘ভুল’ আমার মন বলতে লাগল, “বাঃ, আমি যেটা ঠিকই বল্লুম—তাঁরা বল্লেন ‘ভুল’!”
বিয়ের পর পঞ্জাবে গিয়ে দেখলুম, সেখানেও মেয়েরা গঙ্গা-শব্দ ‘নদী’মাত্রের পরিকল্পে ব্যবহার করেন। তাই গঙ্গা Common noun ও Proper noun দুই-ই। আমিও ভুল বলিনি, আমার গুরুজনেরাও আমার ঠিককে ভুল বলায় ভুল করেননি।
পড়াশুনায় নিতান্ত মন্দ না হলেও সেলাইয়ে আমার রুচি মোটেই ছিল না। সে বিষয়ে ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে পরজীবনে নিজেই খুব ফাঁকিতে পড়েছি। মনে পড়ে সেলাইয়ের ঘণ্টা পড়লে Gallery ঘরে গিয়ে সবাই সেলাই হাতে নিয়ে বসত। আমিও Gallery-র সর্বোচ্চ থাকে গিয়ে বসতুম, কিন্তু খালি গল্প করতুম, সেলাই বিশেষ করতুম না। একদিন পাশের মেয়ের সঙ্গে খুব গল্প জমিয়ে দিয়েছি, হঠাৎ চুপচুপ করে উঠে এসে সেলাইয়ের শিক্ষয়িত্রী মিস্ মুখার্জি অতর্কিতে ঠাস করে আমার গালে একটি চড় মেরে আমায় কর্তব্যে সজাগ করলেন। বাড়িতে মঙ্গলা দাসীর মত স্কুলে এই খ্রীস্টান মহিলাটির চড়চাপড়ের বিশেষ খ্যাতি ছিল। একদিন একটি ছোট মেয়েকে এমন জোরে চড়িয়েছিলেন যে তাঁর পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ দুদিন ধরে তার গাল লাল করে বিরাজমান ছিল। কমিটির কাছে তার অভিভাবকের নালিশে এই শিক্ষয়িত্রী কর্মচ্যুত হলেন। ইস্কুলে আর কারো কাছে কোন শাস্তিই পাইনি। নীচে থেকে উপর পর্যন্ত সকলের কাছেই আদর-যত্ন পেয়েছি। তাই কি পড়াশুনায় বেশি মন না দিয়েও মন্দ হইনি, আর এই শিক্ষয়িত্রীর অকুশল ব্যবহারেই কি সেলাই আমায় পেয়ে বসেনি?
দু-চার ক্লাস উপরে উঠে নতুন একটি পড়ুয়া মেয়ের আবির্ভাবে পড়ায় নিবিষ্টচিত্ততা যে কি তার পরিচয় পেলুম। সে হচ্ছে হেমপ্রভা-জগদীশ বসুর একটি বোন। সে এসে অবধি সেই বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট থাকে, তাকে ডিঙ্গোনর কথা কারো কল্পনায়ও আসে না। সে কিন্তু আমার প্রতি খুব আকৃষ্ট হল—আমাদের দুজনের গাঢ় বন্ধুত্ব হল। তখন মাঝে মাঝে তার অভিভাবিকা বড় বোন লাবণ্য-দিদির অনুমতি নিয়ে শনি রবিবারে সে বোর্ডিং থেকে আমাদের বাড়িতে এসে থাকত। তখন আমরা যোড়াসাঁকো ছেড়ে কাশিয়াবাগানে এসেছি। এই সময় দিদির বন্ধু দুর্গামোহন দাসের কনিষ্ঠা কন্যা, শৈল বা ‘খুসী’, শিবনাথ শাস্ত্রী মশায়ের কন্যা হেম এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আমার সহপাঠী লাহোরের নবীন রায়ের কন্যা হেমন্ত—এরাও পালা করে আসত। আমাদের বন্ধু-জীবন খুব ভরাট হতে লাগল।