জীবনের ঝরাপাতা/নয়
দিদি হিরন্ময়ীর স্মৃতি আমার মনে একটি সুবাসের মত ভরা আছে। যেমন হাসানুহানা গাছের কাছ দিয়ে গেলে সন্ধ্যাবেলা একটা সুবাস বয়ে আসে, যেমন যুঁই বেল ক্ষেতের হাওয়া ভোরের বেলায় একটি সুবাসস্নিগ্ধতা আনে—ঠিক তেমনি যেন। তাঁর রক্তচর্মের শরীরটি ছেড়ে ভিতরকার স্নেহ-ভক্তি-প্রীতিময়তার সুবাসই তাঁকে আমার মনে জাগরূকে রেখেছে।
কাশিয়াবাগানে এসে অবধি দিদিই আমাদের পরিবারের কর্ণধার হন। তাঁর আমাদের জন্মদিনের উৎসব প্রবর্তনের কথা বলেছি। অন্য অনেক রকমেও তিনি যেন বড়-ছোট সকলের অভিভাবিকা হলেন। ভক্তি-প্রীতি-সেবায় তাঁর সহজ তৎপরতা রোজ দেখা দিতে লাগল। যেমন মায়ের প্রতি তেমনি বাবামশায়ের প্রতিও কি যত্ন ছিল তাঁর। একটা পুরানো চাকর—আমাদের ঠাকুরদাদার আমলের—একবার বাবামশায়ের কাছে কি লাগিয়ে দিদির সঙ্গে বাবামশায়ের একটু মনান্তর সাধন করে। দিদি জন্মে সেটা ভুলতে পারেননি। বাবামশায়ের সঙ্গে মন-ভাঙ্গভাঙ্গি! এতদূর ক্ষতি করা!
দিদির স্নেহে আমার মাতৃস্নেহের অভাব অনেকটা পূরণ হয়েছিল। আমার যখন যা সাধ হত তাঁকে ধরলেই পেতুম। একবার জানালুম, রোজ সন্ধ্যেবেলা একটি করে বেলফুলের মালা পেলে ভারি মন খুশী হয় আমার। অম্নি বাজার থেকে সেটা নিয়মমত আসার বন্দোবস্ত করে দিলেন দিদি। একবার যোড়াসাঁকোর একটি মেয়ের গলায় একটি অভিনব প্যাটার্নের সুন্দর সোনার নেকলেস দেখে আমারও সখ হল সেই রকম নেকলেস পরতে। কে দিলে স্যাক্রাকে দিয়ে গড়িয়ে ঠিক সেই রকম নেকলেস আমায়? মা নয়—দিদি। তখন তাঁর বিয়ে হয়েছে—নিজের সংসারের নিজে হর্তাকর্তা। যাকে যা খুশী দিতে পারেন, যেমন ইচ্ছে খরচ করতে পারেন।
দিদির বিয়ে হয় ষোল বৎসর বয়সে আমাদের পিসেমশায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সিমলার বাড়িতে থাকতেই ফণিদাদা পিসেমশায়ের সঙ্গে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। তখন থেকেই তাঁর দিদিকে বিয়ে করবার ইচ্ছা হয়। সেই অভিলাষ পূর্ণ করার জন্যে গিলক্রিস্ট স্কলারশিপের প্রচেষ্টায় কৃতকার্য হয়ে বিলেত যান। সেখান থেকে গবর্নমেণ্টের এডুকেশন সার্ভিস নিয়ে এসে প্রথমে প্রেসিডেন্সী কলেজে বোটানির অধ্যাপক হন। তার পরে রাজশাহী ও হুগলী কলেজে বদলি হন। শেষজীবনে প্রেসিডেন্সী ও বর্ধমান ডিভিসনে ইন্সপেক্টর হন। যতদিন কলকাতায় ছিলেন দিদিরা কাশিয়াবাগানেই থাকতেন।
দাদামশায়ের নাত্নীদের সবায়ের যেমন হয়, দিদিরও বিয়ে তেমনি হয়েছিল যোড়াসাঁকোর উপাসনার দালানে। আমরা সকলে সেই উপলক্ষে কাশিয়াবাগান থেকে যোড়াসাঁকোয় গিয়ে ছিলাম কিছুদিন ধরে। দিদির বিয়েতে দিদির পরম বন্ধ, খুসী নিতকনে হয়ে দিদির সঙ্গে সভায় গিয়ে বসেছিল। তখনো আমাদের বাড়ির মেয়েদের দালানে বিয়ের সভায় যাওয়া দস্তুর হয়নি। খুসীর পরনে সবুজ রঙের পাৎলা বেনারসী। ঐ রঙটা তার পছন্দ। আমরা সবাই বল্লুম, “অন্য রঙ পর, সবুজ রঙে তোমায় ভাল লাগে না।” সে বল্লে, “আমার সবুজ রঙ ভাল লাগে, নাইবা সবুজ রঙে আমায় ভাল লাগল।” বাসরের আমোদ-উৎসবস্বরপ রবিমামা ‘বিবাহোৎসব’ বলে একটি গীতি-নাটিকা রচনা করে অভিনয় করালেন দিদির সমবয়সী বা তাঁর চেয়ে কিছু বড় বোনেদের দিয়ে। এতে দিদির খুসীও ছিল। সরোজাদিদি তাতে ছিলেন নায়িকা—অন্যরা সব তাঁর সখী। দুজন পুরুষ ছিল, একজন নায়ক ও একজন তার আমুদে সখা। দ্বিপুদাদার প্রথমা স্ত্রী দিনুর মা—সুশীলা বৌঠান ও সুপ্রভাদিদি—এই দুজনে ঐ দুই পুরুষ সেজেছিলেন।
বিয়ের পর থেকে দিদির বাপ-মা ও ভাই-বোনের প্রতি টান বিশেষ করে প্রকট হল। সব বিষয়ে মায়ের সাহচর্য করতে লাগলেন। সে সময় থিয়সফির খুব প্রচার। আমাদের বাড়িতে মহিলা-থিয়সফিক্যাল সভা হত, তার প্রেসিডেণ্ট মা। যাঁদের স্বামী বা বাড়ির পুরুষেরা থিয়সফিস্ট, তাঁদেরই স্ত্রী ও বাড়ির মেয়েরা আসতেন। কলকাতার নানা পরিবারের মেয়েদের আনাগোনায় মায়ের সঙ্গে তাঁদের বেশ সখিত্ব স্থাপন হল। মাদাম ব্লাভাটস্কি ও কর্নেল অল্কটের শুভাগমনও প্রায়ই হতে থাকল আমাদের বাড়িতে। তাঁরা এসে মেয়েদের দীক্ষা দিতেন।
একদিন সবাই হলঘরে বসে আছেন। অল্কট সাহেব একটা কি কথা কইতে কইতে হঠাৎ উঠে সোঁ করে চলে গেলেন পাশের ঘরে। সেটা আমাদের ছেলেদের শোবার ঘর। দুই-এক মিনিট সেখানে থেকে আবার হলঘরে ফিরে এলেন। সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল—কি ব্যাপার? অল্কট বল্লেন- মহাত্মা কূথোমির আবির্ভাব হয়েছিল ঐ ঘরে, তাঁকে একটা বার্তা দিতে এসেছিলেন। তাঁর ডাক পেয়ে অল্কট গিয়েছিলেন ঐ ঘরে। যা শোনাবার তা শুনিয়ে চলে গেছেন কূথোমি। আমরা বিস্ময়ে আনন্দে শিউরে উঠলাম। আমাদের শোবার ঘর পবিত্র হয়ে গেছে মনে হল। মহাত্মা কূথোমি এসেছিলেন ঐ ঘরে? কি সৌভাগ্য আমাদের। আমি থিয়সফিতে দীক্ষা পাবার জন্যে আকুল হলুম। দিদি দীক্ষিত হয়েছেন, কিন্তু আমার বয়স কম বলে তখনও অনধিকার। আমি ভাবতে লাগলুম কবে বড় হব, কবে দীক্ষার অধিকার হবে! অল্কট সাহেব একদিন কূথোমির একখানি ছবি—অয়েল পেণ্টিং নিয়ে এলেন। ছবির চোখে একটি অসাধারণত্ব আছে বটে। সে চোখ তোমার বাহির-অন্তর ভেদ করে তোমাতে প্রবেশ করছে যেন। অনেকদিন ধরে সে চোখের দৃষ্টি আমায় haunt করত।
একবার সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে হঠাৎ আমার ঘাড়ে একটা মোচড় আসে, ঘাড় তুলতে পারি না আর, বিছানা থেকে উঠতে পারি না। একটু নড়লে-চড়লে ব্যথা হয় ভয়ানক। বাবামহাশয় অল্কট সাহেবকে আনালেন—তিনি মেস্মেরাইজ করে সারিয়ে দেবেন বলে। মেস্মেরিস্ট বলে অল্কট সাহেবের বিশেষ খ্যাতি ছিল। তিনি এসে দুটো-চারটে ‘পাস’ দিয়ে আমায় বল্লেন—‘ওঠ!’ আমি বল্লম—‘অসম্ভব। ঘাড় তুলতে পারছিনে, এপাশ-ওপাশ করতে পারছি নে, উঠব কি করে?’ তিনি বল্লেন—‘পারবে। ওঠ।’ বলে আমার হাত ধরলেন। আমি ভয়ে ভয়ে মাথা তুলতে চেষ্টা করলুম—দেখলুম, আশ্চর্য—পারছি ত; ঘাড়ে লাগল না ত! আমার হাতে হাত রেখে অল্কট আমায় একেবারে উঠিয়ে বসালেন—ঘাড়ে তখন খট্ করে একটা শব্দ হল, এক মুহূর্তের জন্যে তীব্র ব্যথা বোধ হল, কিন্তু উঠতে পারলুম। অল্কট একটা গ্লাসে খানিকটা জল মন্ত্রপূত করে রেখে গেলেন, দু-তিন ঘণ্টা অন্তর একটু একটু খেতে বল্লেন। তার পরদিন সন্ধ্যেবেলায় আর একবার এলেন, বল্লেন—“ভাল হয়ে গেছ। দেখ কিচ্ছু ব্যথা নেই।” সত্যিই তাই দেখলুম। মেস্মেরিজমের উপর বাড়িসুদ্ধ সকলের শ্রদ্ধা খুব বেড়ে গেল। তখন থেকে মেস্মেরিজমের নানারকম phenomena পরখ করার জন্যেও সকলের ভারি আগ্রহ হল। থিয়সফির সভায় যেসব মেয়েরা আসতেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন—ভবানীপুরের নবীন বাঁড়ুয্যের বোন বলে প্রখ্যাতা। তিনি সন্ন্যাসিনীর বেশ ধারণ করতেন। তাঁর একটি ভাইঝি সঙ্গে আসত, সে তার স্বামীকে ত্যাগ করেছিল, স্বামী তাকে চায়; কিন্তু সে স্বামীকে চায় না—সে চায় নির্বাণের পথে যেতে। এই পরিবারের সবাই অদ্ভুত। নবীন বাঁড়ুয্যের ছেলেটি মেস্মেরিজমে সিদ্ধপুরুষ হয়ে গিয়েছিল। সে এক একদিন এসে তার কেরামতি দেখাত। একজন ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে আধঘুমন্ত অবস্থায় সাপ-ব্যাঙ যা খুশি দেখাত, নিজের ইচ্ছামত উঠাত বসাত, হাসাত কাঁদাত।
দিনুর মা সুশীলা বৌঠানও থিয়সফিক্যাল সোসাইটির মেম্বর ছিলেন। একদিন আবিষ্কার হল যে তাঁর ভিতরও মেস্মেরাইজ করার ক্ষমতা আছে। তাঁর একটি পালিতা দাসীপুত্রী ছিল—নাম তার নির্মলা। তাকে তিনি মাঝে মাঝে মেস্মেরাইজ করতে লাগলেন। বৌঠান আড়াল থেকে তিত-মিষ্টি যা কিছু খেতেন—ঘুমন্ত নির্মলার মুখে সেই স্বাদ আসত। এ বিষয়ে যাতে সে ঠকাতে না পারে, যাতে মট্কা মেরে পড়ে থেকে মিট্মিট্ করে চেয়ে দেখে টের না পায় কি খাওয়ান হল বৌঠানকে, তার জন্যে আমরা অনেক কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করতুম। ঠকাবার উপায়ই ছিল না। সত্যি-সত্যিই সে মেস্মেরিক নিদ্রাগ্রস্ত অবস্থাতেই সব কিছু করত, বলত। বৌঠান কোন কোন দিন তাকে আদেশ দিতেন—“হিমালয়ে চলে যাও, সেখান থেকে ঘুরে এস।” সে খানিকক্ষণ পরে যেন অত্যন্ত শীতার্ততা প্রকাশ করত। ক্রমে বাড়িশুদ্ধ সকলে বৌঠানকে এই বশীকরণক্রিয়া থেকে নিরস্ত করতে লাগল। ইচ্ছাশক্তির এরূপ অযথা অপব্যয়ে নিজের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা।
মাদাম ব্লাভাটস্কির প্রতি শ্রদ্ধায় যখন মান্দ্য পড়ল, থিয়সফির দল ভঙ্গ হল, তখন থিয়সফির সূত্রেই যাঁদের সঙ্গে পরিচয় আরম্ভ হয়েছিল, সেই সব মহিলাদের নিয়ে ‘সখি-সমিতি’ নাম দিয়ে মা একটি সমিতি স্থাপন করলেন। ‘সখি-সমিতি’ নামটি রবিমামার দেওয়া। কুমারী ও বিপন্না বিধবাদের বৃত্তি দিয়ে পড়ান, পড়া সাঙ্গ হলে তাদের শিক্ষয়িত্রীরপে বেতন দিয়ে অন্তঃপুর-মহিলাদের শিক্ষার জন্যে নিযুক্ত করা, মফঃস্বলে ধর্ষিতা নারীদের জন্যে প্রয়োজন হলে উকিল ব্যারিস্টার নিযুক্ত করে মোকদ্দমা চালান, বাঙলার বিভিন্ন জেলা থেকে শিল্প সংগ্রহ করে মেলা করা, তাতে মেয়েদের দ্বারা অভিনয় করান প্রভৃতি নানা আয়োজনে ‘সখি-সমিতি’ বিখ্যাত হয়ে উঠল। ‘মায়ার খেলা’র প্রথম অভিনয় ‘সখি-সমিতি’তে হয়। সেবার দাদা ও সুরেন স্টেজ ম্যানেজার ছিলেন। মায়াকুমারীদের মাথায় অলক্ষ্য তারে বিজলীর আলো জ্বালান তাঁদের একটি বিশেষ কারিগরি ছিল। আর সবাই অতি ভয়ে ভয়ে ছিল—পাছে বিজলীর তার জ্বলে উঠে মায়াকুমারীদের shock লাগে! কিন্তু তাঁরা নতুন বৈজ্ঞানিক, নির্ভীক! আশুবাবুর বিয়ের বাসরেও তাঁরা মসলন্দের তলায় বিজলীর তার পেতে তাঁকে চমক দিয়ে দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন—জামাইবাবু স্থির হয়ে বসতেই পারছেন না—শ্যালীরা হেসে হেসে অস্থির। মেলাটি বেথুন স্কুলের চাতালে হয়। মেলা সুন্দর করে সাজান, স্টেজ বাঁধা, স্টল ঘেরা প্রভৃতি সব কাজেই দাদাদের ব্যাপৃত থাকতে হয়েছিল কদিন ধরে। তাতে তাঁর পড়ায় খুব অমনোযোগ হত।
আমাদের সংস্কৃতের চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত বলতেন,—মা, পড়ার ক্ষতি করে ছেলেকে এই সব কাজে লাগিয়ে ছেলের মাথাটি খাচ্ছেন। সত্যি দাদা সেবার এণ্ট্রান্স ফেল করলেন। আমি পাস হয়ে গেলুম। আমরা সমান ক্লাসে পড়তুম, দাদা আমার চেয়ে এক ক্লাস নীচে হয়ে গেলেন। পরের বছর এণ্ট্রান্স দেবার সময় সময় দাদার হল বিষম জ্বর। দাদা আরও এক বছর পেছিয়ে গেলেন। আমি যে বছর দিলুম এফ-এ, তিনি সে বছর দিলেন এণ্ট্রান্স। যাহোক সব ক্ষতি পুষিয়ে গেল যখন সেই বছর তাঁকে বিলেত পাঠান হল, আর কয়েক বছর পরে তিনি সেখান থেকে সিভিল সাভির্স পাস হয়ে এলেন।
দিদির বিয়ের পূর্বে কাশিয়াবাগানে পাড়ার মেয়েদের জন্য আমরা দুজনে মিলে একটা পাঠশালা খুলেছিলুম। দিদি হলেন প্রধানা শিক্ষয়িত্রী, আমি হলুম তাঁর এসিস্ট্যাণ্ট। তখন তাঁর বয়স চৌদ্দ-পনের, আমার বয়স দশ-এগার। আমরা নিজেরা তখন দিনের বেলা বেথুন স্কুলে যাই, সকালে-সন্ধ্যায় বাড়িতে সতীশ পণ্ডিতের কাছে স্কুলের পড়া তৈরি করি, সংস্কৃতের পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত, ওস্তাদ ও মেমের কাছে গান, সেতার ও পিয়ানো শিখি, আর ইস্কুল থেকে ফিরেই তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে সাড়ে চারটে থেকে সাড়ে ছটা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা রীতিমত ইস্কুল চালাই। বাঙলা, ইংরেজি, অঙ্ক ও সেলাই—এই চারটি বিষয়ই শেখাতুম আমরা নিজে। প্রায় কুড়িটি মেয়ে আসত, কেউ কুমারী, কেউ বা বাল-বিধবা। চাঁদনির সিঁড়ির উপর ধাপে ধাপে বসান হত তাদের ঠিক যেন কোন বড় ইস্কুলের গ্যালারীতে বসেছে। তারা যখন খিড়কির দুয়োর দিয়ে পুকুরে জল তোলার জন্য নিত্য আনাগোনা করত, তখনি তাদের দেখে আমাদের মনে তাদের জড় করে পড়ানর কল্পনা উদয় হয়। সন্ধ্যের পূর্বে যোড়াসাঁকোর আত্মীয়দের প্রতিদিনই সমাগম হত। আমরা তাঁদের কারো কারো দ্বারা মেয়েদের পরীক্ষা গ্রহণ করাতুম—একবার রবি-মামার হাত দিয়ে প্রাইজ দেওয়ার সমারম্ভেরও ত্রুটি হয়নি। দিদির বিয়ের পর আমি কিছুকাল একলা সে স্কুল চালালুম। যখন আমার এণ্ট্রান্স পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এল, তখন সে স্কুল বন্ধ করতে হল।
উপর্যুপরি অনেকগুলি সন্তানবিয়োগ হয় দিদির। তাঁর হৃদয় স্নেহদানের জন্য বুভুক্ষিত ছিল। তিনি সখি-সমিতির আশ্রিত কোন কোন অনাথ বালিকাদের নিজের কাছে রেখে পালনের জন্য উন্মুখ হলেন। তারাই তাঁকে “মা” বলে। ঠিক নিজের মেয়ের মতো তাদের জন্যে সব করেন তিনি। এই সময় বরানগরে শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত বিধবাশ্রমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মায়ের প্রতিষ্ঠিত সখি-সমিতি যখন কাল-প্রভাবে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল, তখন তাকে সঞ্জীবিত রাখার চেষ্টায় দিদি তাকে নাম ও আকারের নানা পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে চালিয়ে বর্তমান বিধবা শিল্পাশ্রমে পরিণত করলেন। এই শিল্পাশ্রমটি তাঁর একান্ত উদ্যম, বিপুল অধ্যবসায় অনেক দ্বন্দ্ব ও অনেক প্রীতি দিয়ে গড়া। তাঁর দেশসেবার অনুপ্রেরণা মাতৃভক্তি হতে এসেছিল; মাতার কীর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্যে সখি-সমিতিকে কালোপযোগী রূপান্তর দেওয়ার প্রচেষ্টায় বিধবা শিল্পাশ্রমের জন্ম। নিজের বলে যা কিছু তার প্রতি তাঁর যেমন অনুরাগ, সেই নিজের কিছুটার বিরুদ্ধে যে কেউ এতটুকু হাত তুলতে আসছে বলে সন্দেহ হয়েছে, তাঁর তার প্রতি তেমন খরদৃষ্টি, তার বিরুদ্ধতা থেকে নিজেরটিকে বাঁচানর দৃঢ়তা। তাই প্রখরে-মধুরে মিশ্রিত ছিলেন দিদি। যারা তাঁর মাধুর্যের স্পর্শে এসেছে, তারা চিরমুগ্ধ, অন্যেরা চিরক্ষুব্ধ।
একবার মা যাচ্ছিলেন মেজমামার সঙ্গে কারোয়ারে। কতদিন ধরে তার জন্যে উদ্যোগ-আয়োজন চলছিল। বাড়িতে দর্জি বসে গিয়েছিল, মায়ের জন্যে নতুন নতুন কাপড় সেলাই চলছিল। সঙ্গে সঙ্গে দিদিরও দু-চারখানা হয়ে যাচ্ছিল। মা যাবার দুদিন আগে থেকে দিদির চোখে জল এল। মা তাঁর সঙ্গিনী ছিলেন—তাই মায়ের সঙ্গহীন দিনগুলোর কল্পনায় তাঁর চোখ জলে ভরল। আমার পক্ষে মা এ-বাড়ি থাকুন বা মেজমামার বাড়িতে কারোয়ারে গিয়ে থাকুন—কোন তফাৎই হয় না। তাঁর সঙ্গ আমি কখনো পাইনে—দূরে দূরে ঝি-চাকর, পণ্ডিত-মাস্টার, পড়াশুনার মধ্যেই থাকি। তাই তাঁর বিরহ-সম্ভাবনা আমার মনে কোন ঢেউ তুললে না। দিদি বিয়ের কয়েক বছর পরে নিজের বাড়ি চলে গেলে আমি একা যখন মায়ের কাছে থাকতে লাগলুম—দাদাও যখন বিলেতে, তখন থেকে মায়ের বেশী কাছাকাছি হলুম। সেদিন কিন্তু দিদির কান্নায় ও আমার চোখ শুকনো থাকায় প্রমাণ হয়ে গেল, আমি ভালবাসতে জানিনে। দিদিই খোঁটা দিলেন।
মার জন্যে সব করতে পারেন বলে সকলের জন্যেই কি পারেন? তা নয়। মা ছাড়া অধিকাংশেরই প্রতি দিদি পরম উদাসীন। কলকাতায় যে বছর জুবেয়ার সাহেবের অনুষ্ঠিত প্রকাণ্ড প্রদর্শনী হয়—মা তাঁর ‘বকুলফুল’কে তাতে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দিদির কাছাকাছি থাকতে বলেন—দিদি ভাল করে সব দেখাতে শুনতে পারবেন বলে। এদিকে সে প্রদর্শনী এত বড়, আর তাতে চিত্তাকর্ষক এত কিছু দ্রষ্টব্য রয়েছে যে, সেসব ফেলে বকুলফুলকে গাধাবোটের মত টেনে বেড়ান তাঁর পক্ষে কতক্ষণ সম্ভব? দিদি আপন মনের বেগে এ-ঘর ও-ঘর এ-আঙ্গিনা ওআঙ্গিনায় ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এদিকে হেঁটে হেঁটে বকুলফুলের পা ব্যথা হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে বেঞ্চে বসে যে বিশ্রাম করে করে যেতে পারেন সে খেয়াল তাঁর মাথায় আসেনি। হঠাৎ আমাকে এক জায়গায় দেখতে পেয়ে ডাকতে আমি তাঁর কাছে গেলুম, আমার হাত ধরে ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুরোধে আমি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে রইলুম। কিছু অসাধারণ কাজ করিনি, এ ছাড়া আর কিছু করা সম্ভবই ছিল না এ অবস্থায়। বাড়ি ফিরে গিয়ে বকুলফুল মার কাছে দিদির বিরুদ্ধে নালিশ আর আমার সম্বন্ধে তারিফ করলেন। উল্টো পূরাণ হল। আমি পেলুম ভীষণ লজ্জা—যেন দিদি ও মার কাছে অপরাধী! জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বকুলফুলের আমার প্রতি টান ও দিদির প্রতি মান যায়নি।
দিদির ভিতর নেতৃত্ব ভাব ছিল বলেছি—সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাশক্তিও ছিল। তাঁর প্ল্যান করা, তাঁর দ্বারা “Conducted tour”এ ফণিদাদার কলেজের ছুটির সময় আমরা বছর বছর দেশভ্রমণে বেরতে লাগলুম। ফণিদাদাকে টেনে হিচ্ড়ে দিদিই নিয়ে যেতেন। যা-কিছু বন্দোবস্ত করার দিদিই করতেন—স্টেশনে স্টেশনে নামা, ব্রেকভ্যান থেকে লগেজ নামান, সঙ্গী চাকরকে দিয়ে খাওয়া-দাওয়ার যোগাড় করা—এ সবেরই কর্তা দিদি। ফণিদাদা বড় স্টীমারে জোড়া ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধাক্কা খাওয়া একখানা জলিবোটের মত বিরক্ত হয়ে গজর গজর করতে করতে চলতেন। শেষ গন্তব্যে পৌঁছে থিতিয়ে বসে তবে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচতেন। আমি দিদিকে ঝঞ্ঝাট পোহাবার কতকটা সাহায্য করতুম। দাদা বিলেত চলে যাওয়ায় আর বাবামহাশয় আমাদের সঙ্গে যেতে অনিচ্ছুক হওয়ায় মা ও আমি এই দুজনেই কেবল দিদিদের সহযাত্রী হতুম। আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে দিদির সুখই হত না।
দিদি “ভারতী”তে মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখে মায়ের সাহায্য করতেন। মৌলিক প্রবন্ধ তিনি লিখতেন না, কিন্তু প্রয়োজনীয় সাময়িক তথ্যের ইংরেজি হতে অনুবাদ করে বাঙলা পাঠকের সহজসাধ্য করা তাঁর কাজ ছিল। তাঁর নিজস্ব মৌলিক রচনা ছিল কতকগুলি সনেট। যেমন কারো কারো গানের গলা মিষ্টি ও করুণ, অথচ সে বড় গাইয়ে নয়—তাঁর কবিতাগুলি ছিল সেই রকম সুমিষ্ট ও সকরুণ।
আমি যখন বি-এ পাসের পর মহীশূরে যাবার জন্যে ধরাধরি করলুম, আর অতিকষ্টে বাবামহাশয়ের সম্মতি পেয়ে সেখানে যাত্রা করলুম, দিদির প্রাণের সৌরভ আমার জন্যে দুটি সনেটের আকারে ‘ভারতী’তে বেরিয়ে আমার হাতে মহীশূরের প্রবাসে পৌঁছল। দিদি কিন্তু আমাকে ছাড়া দিলেন না—“ভারতী’র যুগ্ম-সম্পাদকের কাছি ফেলে আমাকে দূর থেকে বাঁধলেন ঘরের সঙ্গে।
তাঁর হৃদয়ের কোরকে যে মাতৃস্নেহ আত্মোৎসর্গের জন্যে নিজের ছেলেমেয়ের অপেক্ষা করছিল, তার চরিতার্থতা হল অনেক বছর পরে। জগতের কাছে তাঁর শেষ মূর্তি তাঁর ‘মা’ মূর্তি। তাঁর ঘর আলো-করা বুকে ভরা দুটি ছেলে ও একটি মেয়েকে রেখে তিনি অনন্তশয়নে গেলেন।