॥ আট ॥

জন্মদিন

মেজমামী বিলেত থেকে ফিরে আসার পর থেকে ‘জন্মদিন’ বলে একটা ব্যাপারের সঙ্গে পরিচয় হল আমাদের—সে বিলাতী ধরনে সুরেন বিবির জন্মদিন উৎসব করার উপলক্ষ্যে। তার আগে এ পরিবারে জন্মদিন কেউ কারো জন্যে করেনি। আমাদের জ্ঞানগোচরে হিন্দু ঘরের ‘জন্মতিথি’ পূজা এ বাড়িতে প্রচলিত ছিল না, তার কারণ প্রতিমা পূজার সঙ্গে সঙ্গে সব রকম পূজা এ গৃহে বর্জিত হয়ে গিয়েছিল, কোন পুরানো পার্বণই আর টেঁকেনি। সরস্বতী পূজাটা পরিষদের মহলে সারস্বত সম্মিলনীতে পরিণত হয়েছিল। দোলের সময় আবীর ছোঁড়ার নিছক আমোদটুকুও চলত। শ্রীপঞ্চমীতে বড় মেয়েরা কাপড় রঙিয়ে পরতেন, আর পৌষপার্বণে পিঠে গড়ার ধুম লেগে যেত বাড়ির ভিতরে কিন্তু পূজা-আর্চা কিছু, হত না। তাই ঘরে ঘরে ছেলেমেয়ের জন্মতিথি পূজার অনুষ্ঠান না থাকায় আমরা কে যে কবে জন্মেছি তার ধার ধারতুম না। আমাদের জন্মের তারিখ বা তিথি ঠিকুজি বা কুষ্ঠিতে তোলা থাকত, লোকের মনে বছর বছর তুলে ধরা হত না। বিলেত-ফের্তা মেজমামী যে জন্মদিন করাতে লাগলেন তা তিথি পূজার মত নয়, বিলিতী রকমের। মেজমামী এ পরিবারের একটি বিশাল-হৃদয়া বধূ, সেমন বিশাল-হৃদয় ছিলেন তাঁর স্বামী আমাদের মেজমামা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মেজমামী যদিও একান্ত নিজ সন্তান-দুটিগত-প্রাণ তবু পরিবারস্থ সকলের প্রতি ভাসুর দেবর ননদ নন্দাই জা ও তাদের সকলেরই সন্তানদের প্রতি অতি প্রীতিপরায়ণা। তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে বাড়িশুদ্ধ সকলকে বৈকালিক জলযোগে নিমন্ত্রণ করতেন, আর প্রতি ঘরের ছেলেমেয়েরা হাতে কিছু উপহার নিয়ে আসত। যারা আসত তাদের মা-বাপরা তাদের জন্মদিন কখনো করাতেন না, সুতরাং তারা দিতেই শিখল, তারাও যে পেতে পারে, সে ভাবনা তাদের মাথায় এল না, নিজেদের সম্বন্ধে সন্তান হিসেবে নগণ্যতার ভাবটাই তাদের রয়ে গেল। মেজমামীর দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে সন্তানমাহাত্ম্যে প্রতিযোগিত্যর স্পর্ধা তাদের হৃদয়কে এতটুকু স্পর্শ করলে না। এমত স্থলে আমার একটি বাল্যবন্ধু যখন একবার আমার জন্মদিনের খোঁজ নিয়ে হঠাৎ সেদিন আমায় একটি উপহার দিলে আমি একটু অপ্রতিভই হয়ে পড়লুম। বন্ধুটি হচ্ছে হেমপ্রভা—জগদীশ বসুর ছোট বোন। বলেছি শনি রবিবারে মাঝে মাঝে সে স্কুলের বোর্ডিং থেকে আমাদের বাড়িতে আসত। দুদিন আমাদের কাছে থেকে আবার সোমবারে আমাদের সঙ্গে স্কুলের বোর্ডিংয়ে ফিরে যেত।

 জগদীশ বসুর পিতা ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট ভগবান বসু ছিলেন ব্রাহ্ম। তাঁর সর্বজ্যেষ্ঠা কন্যা স্বর্ণপ্রভা ছিলেন ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসুর পত্নী। দ্বিতীয়া কন্যা সুবর্ণপ্রভা ছিলেন তাঁরই অনুজ ডাক্তার মোহিনীমোহন বসুর পত্নী। তার পরের তিনটি কন্যা অনূঢ়া, তাঁদের মধ্যে লাবণ্যপ্রভা বড়। এঁরা তিনজনেই মফঃস্বল থেকে এসে বেথুন স্কুলের বোর্ডিংয়ে ভতি হন। কাদম্বিনী বসু (পরে গাঙ্গুলী), কামিনী সেন (পরে রায়), অবলা দাস (পরে বসু) ও কুমুদিনী খাস্তগিরি (পরে দাস) এবং শিবনাথ শাস্ত্রী মশায়ের কন্যা হেমলতা (পরে সরকার) প্রভৃতি ব্রাহ্মসমাজের বড় বড় মেয়েরাই উপরের দিকের ক্লাসে ছিলেন। কিন্তু জগদীশ বসুর ভগ্নীদের আবির্ভাবে ব্রাহ্ম পরিবারের একটা বিশেষত্ব স্কুলে বেশী করে ফুটে উঠল—একটা সহজ স্বাধীন গতিবিধির ভাব, পড়াশুনায় মার্জিত রুচি, এবং কোন কোন বিষয়ে ইংরেজিয়ানার বিশেষ অনুবর্তন। সেকালের ব্রাহ্মরা জীবনের কতকগুলি অনুষ্ঠানে একেবারে ইংরেজী ধাঁচা অবলম্বন করেছিলেন। সমাজে তাঁদের উপাসনা মাতৃভাষায় না হয়ে অনেক সময়ে ইংরেজীতে হত; বিবাহের সময় কনের বসন সাদা রঙের হত। গাউন না পরে শাড়ি পরলেও ইংরেজদের অনুকরণে কনে শাড়ির উপর আমস্তকপাদ একটি সাদা নেটের veil বা অবগুণ্ঠনে আবৃত হতেন, তাতে ‘অরেঞ্জব্লসম্’ অর্থাৎ কমলানেবুর ফুল লাগান থাকত এবং bride বা কনের পিছনে brides-maids বা কনের পশ্চাৎচারিণী একই রকম সাজে সাজা দুচারটি কুমারী বালিকাদের শোভাযাত্রা অবশ্যকর্তব্য হত। আমি দুটি ব্রাহ্ম বিবাহে brides-maid হই—এক শিবনাথ শাস্ত্রীর জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমের বিয়েতে—আর এক দুর্গামোহন দাসের কনিষ্ঠা কন্যা খুসীর বিয়েতে। হেমের বিয়ে হল ইংরেজদের church বিয়ে হওয়ার মত—সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে। হেম প্রায় সাদা ক্রীম রঙের শাড়ির উপর আগাগোড়া ইংরেজী রকমে veilএ আচ্ছাদিত। কিন্তু খুসীর বেলায় ব্রাহ্মদের ঘোরতর ইংরেজী অনুকরণ-প্রিয়তা অনেকটা শিথিল হয়ে এসেছে। খুসী আমাদের সঙ্গে খুব বেশী রকম মিশে গিয়েছিল। সে তার বিয়েতে সাদা রঙের রেশমী শাড়ির পরিবর্তে সনাতন লাল বেনারসী শাড়ি পরলে আর veilএর দস্তুর বর্জন করে আমাদের বাড়ির মেয়েদের মত ওড়না পরলে। কিন্তু brides-maid প্রথা বজায় রইল। তবে তারও সংখ্যা এক আমাতেই পর্যবসিত হল, খুসী আর কাউকে চায় না। Brides-maidsদের পোশাক সরবরাহ করেন বা তার খরচা বহন করেন বর এই হল দস্তুর। ডাক্তার ডি এন রায়ের খরচায় দিব্যি সেজেগুজে আমি চললম খুসীর পিছনে পিছনে, গিয়ে বসলুম বিবাহ সভায় গুরুগম্ভীরভাবে তার কাছাকাছি।

 পশ্চিমে নিতবরের প্রথা প্রচলিত আছে। বাঙলায় নিতবরের সঙ্গে সঙ্গে নিতকনেও হয়। আমি একবার সেই সত্যিকার বাঙালী দস্তুরের নিতকনেও হয়েছিলুম—প্রতিভা দিদির বিয়েতে। প্রতিভা দিদির নিজের ছয়টি সহোদরা ছোটবোন থাকতে আমাকে যে নিতকনে করতে চাইলেন তার কারণ এই যে, আমি তাঁর ভাবী স্বামী আশু চৌধুরীর একটি অতি প্রিয় বোনের মত ছিলুম—তাঁর নিজের ছোট বোন ও বোনঝি মেনা ও প্রিয়ম্বদার সখী হিসেবে। কনের মত লাল টুকটুকে পাৎলা বেনারসী শাড়ি পরে, কনের সঙ্গে সঙ্গে যোড়াসাঁকোর উপাসনার দালানে বিবাহসভায় গিয়ে তাঁকে বসান উঠান এই ছিল আমার নির্ধারিত কর্তব্য। সেদিন কনের পরই আমারই প্রতি সবায়ের দৃষ্টি। হঠাৎ খুব একটা আত্মগৌরবের আনন্দ অনুভব করলুম।

 ‘জন্মদিন’-এর কথা দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম। ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মদিন করা চালু হয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মেমেরা যেমন সেদিন পাদরীকে দিয়ে প্রার্থনার দ্বারা অনুষ্ঠানের আরম্ভ করতেন, সাধারণ ব্রাহ্মেরাও তেমনি তাঁদের আচার্যদের দিয়ে প্রথমে উপাসনা করিয়ে শেষে খাওয়া-দাওয়ান ও উপহার দেওয়াদেয়ির ব্যবস্থা করতেন। কর্তাদাদামশায়কৃত ব্রাহ্ম অনুষ্ঠান পদ্ধতিতে জন্মদিন উল্লিখিত না হওয়ায় যোড়াসাঁকোয় মেজমামীর ছেলেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানও উপাসনা-বর্জিত হয়ে শুধু আমোদপ্রমোদ, মেলামেশা ও খাওয়া-দাওয়ার উৎসব-মুর্তিতে দেখা দিয়েছিল। হেমপ্রভা সে বছর আমার জন্মদিন খুঁড়ে বের করলে। আমার জন্যে আমাদের বাড়িতে যা কস্মিনকালে হয়নি তা সেবারও হয়নি। বাড়ির কারোই খোঁজখবরে আসেনি সেদিনটা আমার জন্মদিন বলে। কিন্তু আমার প্রতি স্নেহমুগ্ধ হেমপ্রভা সেদিনটাকে গৌরব দিয়ে ভোর হতেই একখানি ইংরেজী গল্পের বই আমার হাতে উপহার দিলে, ভিতরে তার লেখা—“সরলার জন্মদিনে হেমপ্রভার ভালবাসার সহিত উপহার।” সে বইখানির নাম—“Lamplighter”—চমৎকার বই। জানি না আজকালকার মেয়েরা সে বই পড়েছে কিনা। সেই পর্যন্ত নিজের জন্মদিন সম্বন্ধে আমার মনে একটা জাগ্রতি এল। আর সেটা পুষ্ট করলেন আমার দিদি হিরন্ময়ী। আমাদের নিজস্ব পারিবারিক সংহত জীবনের কর্তা তিনি। পরিবারের মধ্যে আমার নিজের সম্বন্ধে একটা ন্যূনতা জ্ঞান সদা বর্তমান ছিল। দিদির ছিল না। তিনি মা-বাপের আদরে বর্ধিত। নিজে ও নিজের মা-বাবা, ভাইবোনরা যে কেউকেটা নয় এমনি একটা হামবড়াইতে ভরা ছিলেন। যোড়াসাঁকো ছেড়ে কাশিয়াবাগানে এলে তিনি ভাইবোনদের ও মায়ের জন্মদিন উৎসব প্রবর্তন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও তাঁর করতে থাকলুম। হয়নি শুধু বাবামশায়ের, কারণ তিনি তাঁর জন্ম মাস, বৎসর, তিথি বা তারিখ জিজ্ঞেস করলেও বলতেন না।

 আমার ষোড়শ জন্মদিনের কথা বেশ মনে পড়ে। লম্বা খাবার টেবিলে নানারকম মিষ্টান্ন ফল ফলু সাজান—মাঝখানে একটা ঝকঝকে রূপার থালার উপর একটি বড় কেকের পাশে পাশে গোল করে ষোলটি মোমবাতি দীপ্যমান। আজ যত বছরের হলুম, এ গৃহে ততগুলি দীপ জ্বলে উঠল আজ—এই সুন্দর ইংরেজী প্রথাটির অনুসরণ দিদির নতুনত্ব—যতদূর মনে পড়ে মেজমামীও কোনদিন এটা করেন নি।

 মেজমামা বিলেত হয়ে আসার পূর্বে যোড়াসাঁকোয় কারো জন্যেই ‘জন্মদিন’ করান হত না বলেছি। আজ যে দেশব্যাপী রবীন্দ্র-জন্মদিন অনুষ্ঠান, তাও মেজমামীদের সঙ্গে রবিমামা ফেরার পরও সেকালে যোড়াসাঁকোয় কোনদিন হয়নি। সেটি ধরালাম আমি আমার ভক্তিপ্রাবল্যে। তখন তিনি ও নতুন মামা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থাকেন মেজমামীদের সঙ্গে ৪৯নং পার্ক স্ট্রীটে। এ বিষয়ে পূর্বে যা লিখেছি, তার থেকে উদ্ধৃত করছি—“রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা ও নতুনমামার সঙ্গে তিনি ৪৯নং পার্ক স্ট্রীটে থাকেন। অতি ভোরে উল্টাডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রীটে নিঃশব্দে তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনান বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন—পাশেই নতুনমামার ঘর। “রবির জন্মদিন” বলে একটি সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।

 জান্‌তে পেলুম, নতুনমামা ও রবিমামার জন্মদিন কাছাকাছি তারিখে। রবিমামার হল ইংরেজি ৭ই মে, আর নতুনমামার বোধহয় ৫ই মে। তাই পরের বছর থেকে নতুনমামার জন্মদিনও আরম্ভ হল। সেটা মেজমামীই করলেন। নতুনমামীর মৃত্যু কয়েক বৎসর পূর্বে হয়েছে, সেই পর্যন্ত নতুনমামা ওঁদের সঙ্গেই থাকেন। এসবের অনেক পরে কর্তাদাদামহাশয়ের জন্মদিন যোড়াসাঁকোর উঠানে উপাসনাপূর্বক প্রচলিত হল।

 গৃহের ভিতর গৃহনির্মাত্রী মেয়েরাই। তাঁরাই পরিবারটিকে কতকগুলি আচার-অনুষ্ঠানের বন্ধনীতে বাঁধেন, আরম্ভে সেগুলি কেবলমাত্র মেয়েলী হলেও ক্রমে তারাই সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। মেজমামীর প্রবর্তিত নিজের ছেলেমেয়ের জন্মদিনটুকু ক্রমে যোড়াসাঁকোর ঘরে ঘরে সঙ্গোপনে বা প্রকাশ্যে প্রতি মায়ের ছেলেমেয়ের জন্যে প্রসারিত হতে হতে এ পরিবারে একটি পারিবারিক আচারের মত হয়ে উঠল এবং নিম্নমুখিতা থেকে ঊর্ধ্বমুখিতা নিলে, একপুরুষে বড়দের জন্মদিনও প্রবর্তিত হল।

 মেজমামী আর একটি জিনিসের প্রবর্তক—এই পরিবার থেকে আরম্ভ করে সমস্ত বাঙলাদেশে। সেটি শাড়ি পরার ভঙ্গিমা পরিবর্তন। দাদামশায়ের আমল থেকেই মেয়েদের পোশাক সম্বন্ধে এ পরিবারের মস্তিষ্কে নানারকম আন্দোলন চলছে। শুনতে পাই, অনেক পরখ করে করে দাদামহাশয় তাঁর বাড়ির কুমারী মেয়েদের জন্যে বাইরের পোশাক ‘পেশোয়াজ’ হওয়াই সাব্যস্ত করেছিলেন। বড়মাসিমার জ্যেষ্ঠা কন্যা ইরুদিদির বিবাহপূর্বের সেই পোশাকপরা সুন্দর অয়েল পেণ্টিং অবনদাদাদের বাড়িতে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ইংরেজি ফ্রকটা সহজসাধ্যতায় পেশোয়াজকে পদচ্যুত করলে। বিবাহিত মেয়ে ও বউদের শাড়ি পরার ভঙ্গিমার সমস্যা তাতে মিটল না। এ-বাড়ির বড়রা কেউ ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষ প্রভৃতির পত্নীদের মত গাউন পরতে রাজি নয়। অথচ বাঙালীকেতায় শাড়ি জড়ানতে সৌষ্ঠব নেই। মেজমামী যখন স্বামীর সঙ্গে বোম্বাই গেলেন, সেখানে পার্শী ও গুজরাটি মেয়েদের শাড়ি পরার ধরন তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেটি পশ্চিমের মেয়েদেরই ধরন—যা ভারতের চিত্রকলায় চির-আদৃত। মেজমামী সেটি গ্রহণ করলেন—খালি আঁচলের ধাঁচটা বাঙালী রকমই রাখলেন। যখন আমার মায়ের সঙ্গে মেজমামী দেশে ফিরলেন, দুইজনেই সেই রকমে শাড়িপরা—তাই বাড়িশুদ্ধ সকলেই সেই ধাঁচটাই ধরে নিলেন। ক্রমে তাঁদের দেখাদেখি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের রুচিশালিনী কতকগুলি মেয়েরাও এটা গ্রহণ করলেন। পরে সব ব্রাহ্মপরিবারে এটা ছড়িয়ে পড়ল। এই রকমে পরা শাড়ির নাম ব্রাহ্মরা রেখেছিলেন ‘ঠাকুরবাড়ির শাড়ি’। ব্রাহ্ম মেয়েরা সবাই পরতে আরম্ভ করায় দেশের লোক তার নাম দিলে ‘ব্রাহ্মিকা শাড়ি’।

 বাঙালী মেয়ের শাড়ি পরার ক্রমবিবর্তনের দ্বিতীয় ধারা এল দিল্লীদরবারের পর। সেই দরবারে সমস্ত ভারতবর্ষের রাণী-মহারাণী সম্মেলনে তাঁদের সঙ্গে সাজের সঙ্গতি রাখার জন্যে কুচবেহার মহারাণী সুনীতি দেবী ও ময়ূরভঞ্জ মহারাণী সুচারু দেবী অধুনাতন নবীনতম পন্থায় শাড়ি পরতে লাগলেন এবং পরে দেশে ফিরে এসেও সেটি জারী রাখলেন। এ নাকি কুচবেহারের ও উড়িষ্যার—তাঁদের স্ব স্ব শ্বশুরকুলের নিজস্ব পন্থা, এতদিন তার থেকে নিজেদের বাঙালীর অভিমানে নিজেদের দূরে দূরে রেখেছিলেন। আজ ভারতের রাজকুলের সঙ্গে সাম্যে সেটি গ্রহণ করলেন। এই পরিধানপন্থার সুশ্রীতা বাঙালীমাত্রের মনোগ্রাহী হল, এই হয়ে গেল বাঙলাদেশের শাড়ির ফ্যাশন এবং এ ফ্যাশন সমগ্র ভারতবর্ষের সঙ্গে বাঙলার একতা এনে দিলে। বাঙালী মেয়েদের পরিচ্ছদে ভারতীয় ঐক্যসাধনে মেজমামী প্রথমে পথপ্রদর্শিকা। এই দ্বিতীয় রকমটি সেই ঐক্যেরই আর এক পদক্ষেপ মাত্র। কিন্তু পুরুষদের পরিচ্ছদে এখনও সে ঐক্যের অভাব রয়ে গেছে। বাঙালীর সামাজিক সাজ যে পাৎলা ধুতি, চাদর ও পাঞ্জাবী—শীতকালে শাল, সেটা অন্য প্রদেশে সব সময় চলতে পারে না। উত্তর-পশ্চিমের পুরুষদের সামাজিক সাজ যে চুড়িদার পাজামা ও আচকান বা সেরবানি—সেটা বাঙালীর বিবাহ বা শ্রাদ্ধসভায় অচল হলেও অন্য সভায় চলে। আমাদের পরিবারে বোধহয় নবাবদের আমল থেকেই সেইটিই পুরুষদের বাইরের পোশাকস্বরূপ গাত্রভুষণ হয়ে চলে আসছে। শিরোভূষণটি পাগড়ি বা টুপির মধ্যে দোলায়মান থেকেছে। রবিমামার ও তাঁর অগ্রজদের বিভিন্ন ফটো থেকে তা সুস্পষ্ট হবে। পাগড়ীটি সচারু করে বেঁধে দেওয়ার জন্যেও দেবরদের মাথার উপর মেজমামীর হস্তচারণা অনেকবার হয়েছে। যোড়াসাঁকোর পরিবারকে আমোদ-উৎসবে সাজসজ্জায় এক করে বাঁধতে মেজমামীর অনেক দিকে অনেকটা হাত ছিল—তার একটুখানির উল্লেখ করলুম। কিন্তু মেজমামারও কম ছিল না। তিনি বোম্বাইপ্রবাসে থাকতে অধিকাংশ আত্মীয়ই তাঁর ওখানে মাঝে মাঝে গিয়ে কাটিয়ে আসতেন। তাঁদের মধ্যে হংসপ্রকৃতির যাঁরা—নীর থেকে ক্ষীর নিতে জানতেন— গুজরাটি, মারাঠী, পার্শী, সিন্ধীদের কাছ থেকে অনেক কিছু সংগ্রহ করে আনতেন। মেজমামা যখন ছুটিতে বাড়ি আসতেন, বাড়িশুদ্ধ ছোট ছেলেমেয়েদের জন্যে খেলনা সঙ্গে করে আনতেন। সব সাজিয়ে রাখা হত একটা জায়গায়, যার যেটা পছন্দ তুলে নিত, কোন বাধানিষেধ থাকত না। আমার মনে পড়ে, একটি খুব বড় মোমের পুতুলের জন্যে আমি লুব্ধ হই। কিন্তু পেতে পারি বলে ভরসা ছিল না, হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে সাহস হচ্ছিল না। মেজমামার সঙ্গে বড়দের আর একজন কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি চুপ করে সব খেলনার দিকে চেয়ে আছি দেখে জিজ্ঞেস করলেন—“কোন্‌টা চাই তোমার?” আমি নীরবে পুতুলটার দিকে দেখালুম। মেজমামা তৎক্ষণাৎ সেটা তুলে আমার হাতে দিলেন। তাই তাঁর ছুটিতে বাড়ি আসার জন্যে আমরা ছোটরা সবাই উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকতুম।