সাত

বঙ্কিম

ছোটবেলার ঐ একটি ঘটনাতে—তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ প্রকাশের জন্য রবীন্দ্রের বক্তৃতা শুনতে যাওয়ায় বঙ্কিম নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। একটু বড় হলে কাশিয়াবাগানে তাঁর সব বইয়ের মধ্যে ‘ইন্দিরা’ বইখানি প্রথমে পড়ার রসভোগ করি। ক্রমে ক্রমে আর সব বই একে একে পড়তে অনুমতি পেলুম। তাঁর প্রতিভাচ্ছটা হৃদয় আলোকিত করতে থাকল।

 একবার একটা ১১ই মাঘের উৎসবে বাড়ির ছেলেমেয়ে-গায়নমণ্ডলী আমরা গান গাইতে গাইতে হঠাৎ অনুভব করলুম আমাদের পিছনে একটা নাড়াচাড়া সাড়াশব্দ পড়ে গেছে। কে এসেছেন? পিছন ফিরে ভিড়ের ভিতর হঠাৎ একটি চেহারা চোখে পড়ল—দীর্ঘনাসা, তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল দৃষ্টি, মুখময় একটা সহাস্য জ্যোতির্ময়তা। জানলুম তিনি বঙ্কিম। যে বঙ্কিম এতদিন তাঁর বইয়ে রচনামূর্তিতে আমাকে পেয়ে বসেছিলেন আজ পেলুম তাঁকে প্রকৃতির তুলিতে হাড়েমাসে রঞ্জনা মূর্তিতে।

 তারপরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ সংস্পর্শ আনলে আমার লেখা পড়ে তাঁর চিঠি। সে চিঠি ত যে সে চিঠি নয়। তার দুচারটি মাত্র সেণ্টেন্স বঙ্কিমেরই সেণ্টেন্স বটে!

 “ভারতী’’তে আমার আঠার ঊনিশ বৎসরের লেখা ‘রতিবিলাপ’ ও ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ পড়ে তাঁর লেখা চিঠি। সে চিঠি সাহিত্য দায়রায় দণ্ডায়মান একজন নবীনের উপর তাঁর রায়—বা তাকে দুই বাহু বাড়িয়ে আদর করে নেওয়া। যদিও রবিমামার চিঠিতে তাঁরও appreciation ব্যক্ত হয়েছিল, কিন্তু তাঁর চেয়েও সেদিন সাহিত্যসম্রাট ও সাহিত্যের ন্যায়াধীশ বঙ্কিমের রায়ে নিজেকে বেশি চরিতার্থ মনে করলুম। এই দুজনের অভিমত আমার সাহিত্যজীবনে আনন্দের যাত্রাপথে পর্যাপ্ত পাথেয় হল। কিন্তু হায়! এমন হাত দুটির চিঠিগুলি রক্ষা করে—সাহিত্যিক মিউজিয়মে সেগুলি উপঢৌকন দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হল না। আমার জীবন-নিয়ন্ত্রিণী দেবী ভগবতীর নির্দেশ হল—“খেয়ে নে, যত পারিস আনন্দ, তাতে পুষ্ট হয়ে এগিয়ে চল, জমা থাকবে না কিচ্ছু।”

 পঞ্জাবের পোলিটিকাল হোমাগ্নিতে আমার সব সঞ্চিত সাধের চিঠিপত্রগুলি ভস্মসাৎ হল। একটা ধরপাকড়ের আতঙ্কের দিনে একদিন বাড়িতে আমার অনুপস্থিতির সুযোগে আমাকে নিরাপদ করার শুভ ইচ্ছায় আমার যত কিছু বাঙলা চিঠিপত্র প্রবন্ধাদি—এমন কি বাক্সে রাখা ইংরেজি চিঠিগুলিও—কেম্ব্রিজ-কবি মনোমোহন ঘোষের কাব্যরসে সরস, সাধু তীর্থরামের দার্শনিক ও কথঞ্চিৎ স্বদেশী রসসঙ্কুল এবং জস্টিস উড্‌রফের অপূর্ব তন্ত্রদৃষ্টি-উদ্ভিন্ন সমুন্নত তথ্যময় এক এক তাড়া চিঠি আমার অজ্ঞাতেই হিতৈষী আত্মীয় সুহৃদেরা অগ্নিদেবতাকে উৎসর্গ করলেন। পঞ্জাবে আমার সারাটা বৈবাহিকজীবনই প্রায় যুদ্ধের ক্যাম্প লাইফবৎ ছিল। আগে চলা ও পিছনের সব কিছু পুড়িয়ে যাওয়া।

 শ্রীশ মজুমদার প্রভৃতি বন্ধুদের কাছে বঙ্কিম আমার লেখাগুলি সম্বন্ধে নাকি নিজের সবিস্ময় অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন—তা তাঁদের লিখিত বঙ্কিমের জীবন-প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু বঙ্কিমের লিপি আর অন্যের লিপিতে অনেক তফাৎ। বঙ্কিমের লিপিখানি ছিল পুরো বঙ্কিমী ঠাটের সাহিত্যের একখানি হীরের কুচি। বিদূষক সম্বন্ধে আমার মন্তব্যের সঙ্গে তাঁর মতের মিল হয়নি। তার উল্লেখ করে “গরীব বিদূষকের’’ পক্ষ নিয়ে তাঁর সরস লেখনী দুই এক ছত্রে কি হাস্যের ছটাই তুলেছিল। তাই বলছি তাঁর চিঠিখানি ছিল একটি সাহিত্যিক ক্ষুদ্র রসকুম্ভ। পলিটিক্স-দানবী সাহিত্য-দেবীর সঙ্গে আড়ি করে তাঁর ঘর-সাজান একটি সুশোভন কারুবস্তুকে ফেলে দিলে বিনাশের হুতাশন-গর্ভে।

 বঙ্কিমের চিঠির সাথী হয়ে এসেছিল সেদিন তাঁর নিজের এক সেট বই উপহার-অপ্রত্যাশিত স্নেহ-নিদর্শন। তাঁর হস্তলিপিযুক্ত সে বই-গুলিও রাখতে পারিনি শেষ পর্যন্ত। বঙ্কিম-রসলোলুপ পঞ্জাব-প্রবাসী বাঙালী বন্ধু, ও আগন্তুকেরা সেগুলি আমার লাইব্রেরীতে দেখে ধার চাইতেন পড়ার জন্যে। বই ধার নিয়ে ফিরিয়ে দেন কটা লোকে সেটার হিসেব কেউ করেছেন? এবিষয়ে দেশকাল জাতিভেদ নেই। প্রসিদ্ধ ডাক্তার কর্নেল ডেন্হাম হোয়াইটের পত্নীর কাছে গল্প শুনি তাঁদের এক বন্ধুর কবরের উপর এই স্তুতিলিপি খোদিত হয়েছিল—“He returned books”—“তিনি বই ফিরিয়ে দিতেন।” আমার কাছ থেকে বঙ্কিমের বই পড়তে নেওয়া কোন বন্ধই তাঁদের কবরে ঐ স্কুতিলিপি খোদিত হওয়ার যোগ্যতা দেখাননি। কাজেই বইগুলি একে একে আমার হগুচ্যুত হতে হতে একেবারে অন্তর্ধান হল।

 চিঠি ও বই উপহারের পর তিনি আমন্ত্রিত হয়ে এলেন একদিন আমাদের বাড়িতে। মানুষ বঙ্কিমের সঙ্গে আমাদের সংস্পর্শ আরম্ভ হল। মনে পড়ে তিনি চা-ভক্ত ছিলেন, আর আমার পিতা ছিলেন চায়ের একজন মর্মজ্ঞ। আমাদের বাড়ির চা বঙ্কিমের সুস্বাদু বোধ হল। তার পরদিন সেই চায়ের এক প্যাকেট এক গোচ্ছা গোলাপ ফুলের সঙ্গে তাঁর কাছে উপঢৌকন গেল। কোথায় বঙ্কিমের এক সেট বই—আর কোথায় দার্জিলিংয়ের এক প্যাকেট চা। কিন্তু দুইয়েরই পশ্চাতে প্রেরক ছিল যে দুটি ভাব—স্নেহ ও ভক্তি-তারা বোধ হয় সমানই অমূল্য।

 তিনি সেদিন আমায় ফরমাল করে গিয়েছিলেন তাঁর “সাধের তরণী” গানটিতে সুর বসাতে। থিয়েটারে দেওয়া সুর তাঁর পছন্দ হয়নি বললেন। সেটা শুনতে এলেন আর একদিন —শুনে খুব খুশী হয়ে গেলেন। বঙ্কিমের ফরমাসী এই গানের স্বরলিপি “শতগান” গ্রন্থে দেওয়া আছে।

 তারপরে আমাদের - আমার মাকে ও আমাকে - দিদি তখন বিয়ে হয়ে নিজের বাড়িতে থাকেন - নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়ি একদিন। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত হল। বঙ্কিমের স্ত্রীর সহিত বা তাঁর সম্পর্কীয় কথাবার্তায় একটি প্রীতিময় হাসিকৌতুকের ঢেউ খেলিয়ে যেত। আমরা যেন তাঁর নভেলেরই একটা দৃশ্যর মধ্যে পড়ে যেতুম। দুই দৌহিত্র দিব্যেন্দু ও পূর্ণেন্দুর সঙ্গে সপত্নীক বঙ্কিমের শুভাগমন অনেকবারই হতে থাকল আমাদের কাশিয়া-বাগান বাগানবাড়িতে।

 যে বাড়িতে শুধু বঙ্কিমের নয়, আমার ভক্তির টানে বিদ্যাসাগর মশায়ের পদধূলিও মাঝে মাঝে পড়তে থাকল, যে বাড়িতে আমার পিতামাতার থিয়সফি নিষ্ঠার দরুণ মাদাম ব্লাভাটস্কি ও কর্নেল অল্‌কটের প্রায়ই গতিবিধি হতে লাগল, যে বাড়ি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, আশুতোষ চৌধুরী, লোকেন পালিত ও অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবী-সহ মাতুলকুলের আবালবৃদ্ধবনিতা প্রায় সমস্ত আত্মীয়-আত্মীয়ার স্মৃতিভারে নমিত ছিল—সে বাড়ি আজ গুঁড়া হয়ে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীটের ধূলায় ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সে বাগানবাড়ির বকুলবীথি, পুকুর চাঁদনি ও ফলফুলের উপবনে যোড়াসাঁকোর শহুরে ছেলেমেয়েদের নতুন নতুন প্রাকৃতিক আবিষ্কারের বিস্ময়, পাড়ার বৌঝিদের মল ঝমঝম করে খিড়কি দরজা দিয়ে জল তুলতে আসা, তার পুকুরে কবি রবির সাঁতারকাটা ও ঘাটে উঠে কল্পনার বীণার ঝঙ্কারে নতুন নতুন কবিতা ও গান ফোটান, সে বাড়ির তেতালার ছাদের ঘরে বড়মামার প্রজ্ঞাঘন জীবনের অনুকূল নীরব প্রশান্ততা—এই সবই কর্পোরেশনের স্টীম রোলারের নীচে পড়ে চিরকালের জন্যে গেছে অন্তর্হিত হয়ে।

 বঙ্কিমের স্মৃতি প্রসঙ্গে “বন্দে মাতরম্‌” গান ও মন্ত্রের স্মৃতি ভেসে না উঠে যায় না। সে গান বঙ্কিম-ভক্তিতে ডোবা আমার প্রাণে প্রথম ফোটেনি। তার ফোটানতে ছিল রবীন্দ্রের হাত। জীবনের প্রথম দিকে কাব্য বা সঙ্গীতের রসগ্রাহিতায় রবীন্দ্রের আত্মপর বিচার ছিল না। যে কবির যেটি ভাল লাগত সেটিতে নিজের সুর বসিয়ে, গেয়ে ও গাইয়ে তার প্রচার করতেন। কোন কোন বৈষ্ণবপদাবলীতে, যেমন, “ভরা বাদর, মাহ ভাদর” এবং বিহারী চক্রবর্তীর দু-চারটি গানেও তাঁরই সুর দেওয়া “গাছে ফুল শোভা যেমন”, “পাগল মানুষ চেনা যায়’’, ‘‘বুঝতে নারি নারী কি চায়” ইত্যাদি, এমন কি “বাল্মীকি প্রতিভায়” বিহারী চক্রবর্তী রচিত একটি গান একেবারে সশরীরে সন্নিবিষ্ট।

 রবীন্দ্রনাথই “বন্দে মাতরম”-এর প্রথম সুর বসিয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া সুরে ঐ দুটি পদে গানটি সর্বত্র চলিত হল। একদিন মাতুল আমায় ডেকে বললেন—“তুই বাকিটুকুতে সুর দিয়ে ফেল্‌ না।” ওরকম ভার মাঝে মাঝে আমায় দিতেন। তাঁর আদেশে “সপ্তকোটিকণ্ঠ কলকলনিনাদ করালে” থেকে শেষ পর্যন্ত ভাবের সঙ্গে ও গোড়ার সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুর দিয়ে ফুটিয়ে নিলুম। দুই একটা জাতীয় উৎসবে সমস্বরে বহুকণ্ঠে বহুজনকে গাইতেও শেখালুম। সেই থেকে সভাসমিতিতে সমস্তটাই গাওয়া হতে থাকল।  “বন্দে মাতরম্” শব্দটি মন্ত্র হল সব প্রথম যখন মৈমনসিংহের সুহৃদ সমিতি আমাকে স্টেশন থেকে তাদের সভায় প্রোসেশন করে নিয়ে যাবার সময় ঐ শব্দ দুটি হংকার করে করে যেতে থাকল। সেই থেকে সারা বাঙলায় এবং ক্রমে ক্রমে সারা ভারতবর্ষে ঐ মন্ত্রটি ছড়িয়ে পড়ল—বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে যখন গবর্নর সাহেবের অত্যাচার আরম্ভ হল আহিমালয়কুমারিকা পর্যন্ত ঐ বোলটি ধরে নিলে।

 আমার বিয়ের পর গোখলের সভাপতিত্বে বেনারস কংগ্রেসে প্যাণ্ডালের দোতলায় মেয়েদের মঞ্চে আমি উপবিষ্ট ছিলুম। আমার পাশে ছিলেন লেডি অবলা বসু। হঠাৎ সভা থেকে গোখলের কাছে অনুরোধ গেল আমাকে দিয়ে “বন্দে মাতরম্” গাওয়ানর জন্যে। গোখলে পড়লেন বিপদে। তার কিছু আগে বাঙলাদেশে কোথাও কোথাও ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা “বন্দে মাতরম্” সভাসমিতিতে গাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে। তিনি সাবধানপন্থী। গবর্নমেণ্টের সঙ্গে ভাব রেখে কাজ করতে চান, গবর্নমেণ্টের আদেশের বিরুদ্ধে কিছু করতে চান না। কিন্তু কি করবেন? ভারতের সর্বপ্রদেশ থেকে সমাগত প্রতিনিধিদের “বন্দে মাতরম্” শোনার তীব্র ইচ্ছা কিছুতেই নিরোধ করতে পারলেন না। তখন গোখলে আমার কাছে একটি ক্ষুদ্র লিপি পাঠালেন গাইতে অনুরোধ করে—সঙ্গে সঙ্গে লিখলেন,—সময় সংক্ষেপ, সুতরাং দীর্ঘগানের সবটা না গেয়ে ছেঁটে গাই যেন। কোন্ অংশটা ছাঁটা তাঁর অভিপ্রেত ছিল জানি নে, আমি মাঝখানে একটুখানি ছেঁটে চট করে “সপ্ত কোটির” স্থলে “ত্রিংশ কোটি” বলে সমগ্রটা গাওয়ারই ফল শ্রোতাদের কাছে ধরে দিলুম, তাঁদের প্রাণ আলোড়িত হয়ে উঠল। ভারতের প্রান্ত প্রান্ত থেকে সমাসীন দেশভক্তদের মধ্যে আজও যাঁরা জীবিত আছেন—সেদিনকার গান ভুলতে পারেননি।

 আজ কংগ্রেস “High Command” থেকে কাটাছাঁটা “বন্দে মাতরম্” গাওয়ার হুকুম বেরিয়েছে। তা হোক্। হালফ্যাশনের ছাঁটা কুন্তলেও “বন্দে মাতরম্” তার তেজ ও দীপ্তিরসে ঢল ঢল করছে।

 যেদিন বঙ্কিমের মত্যু সংবাদ হঠাৎ কানে এল—মনে হল আমারই জীবনের একাংশ খসে গেল।