ছয়

রবীন্দ্র-বঙ্কিম বিতর্ক

রবিমামার সঙ্গে ছেলেবেলায় একটি সভায় যাওয়া আমার মনে পড়ে। জীবনে এই প্রথম সভ্যগমন। কি excitement, কি উদ্দীপনা আমাদের—সুরেন বিবি সুধীদাদা বলুদাদারাও আছেন। সভাটি আদি ব্রাহ্মসমাজের হলে আহূত। উদ্দেশ্য সে সভায় বঙ্কিমের একটি মতের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের তীব্র প্রতিবাদ পাঠ। বঙ্কিমের যশ ও কীর্তি তখন মধ্যাহ্ন গগনে সমুদিত আর রবি সবেমাত্র উদীয়মান। লোকদের মধ্যে একটা হলচল পড়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের নাম তখন তাঁর গানের ভিতরে রবিছায়াতেই প্রায় নিবদ্ধ। এই বক্তৃতায় যে ওজস্বী গদ্যে, যে যুক্তিতর্কে তাঁর শ্রোতাদের মন আকৃষ্ট করলেন তা ইতিপূর্বে তাঁর সম্বন্ধে অভাবনীয়।

 সংক্ষেপে ব্যাপারটি এই—রবীন্দ্রনাথের প্রতিপাদ্য এই যে, মিথ্যা কোন অবস্থাতেই কোন সময়েই কথনীয় নয়। এ বিষয়ে ধর্মশাস্ত্রকারকৃত ব্যতিক্রম বিধিগুলি তিনি সমর্থন করেন না, বঙ্কিম করেন—এই প্রভেদ। রবীন্দ্রনাথের দুই অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ বিষয়ে শাস্ত্রকারদের ও বঙ্কিমের পক্ষাবলম্বী হলেন, তাঁরা বক্তৃতা-সভায় যোগদান করলেন না। কিন্তু ছোটরা তাঁর hero-worshipper হল।

 তর্কের বিষয়টি বড় সূক্ষ্ম ও চিরকাল মানবসমাজের আলোচ্য। একপক্ষের অস্ত্রধারী হয়ে রবীন্দ্রনাথ যেন এইটিতে বঙ্কিমের Achilles' heel আবিষ্কার করে সেইখানে খোঁচা দিলেন। রবীন্দ্রের বক্তৃতা তৎকালীন ‘‘ভারতী”তে বেরিয়েছিল, বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্র রচনা সংগ্রহে সেইটি নিশ্চয়ই সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকবে। কিন্তু বঙ্কিমকে বাঙালীর মনে চিরজাগরুক রাখবার কোন প্রতিষ্ঠান নেই। তাঁর যে শুধু ঔপন্যাসিক প্রতিভা ছিল না, সংস্কারের ও ভাবের গতানুগতিকতায় বাহিত না হয়ে বুদ্ধির প্রখর বিচারশীলতায় তিনি যে কত বড় ‘আধুনিক’, রবীন্দ্রের গুরু ও মার্গদর্শী তিনিই যে,—সে কথা এই পুরুষের বাঙ্গালীরা প্রায় জানে না। ‘সত্য’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রের uncompromising আপোষশূন্য মনোভাবের অভিব্যক্তিতে সেদিন আমরা বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ হলুম। সত্যভক্তি আমাদের বুকে ক্ষোদিত করে দেওয়া হল। শিশুদের পক্ষে এইটেই দরকার। তাদের মনে ধর্মের নিয়মগুলির সংস্কারই বসিয়ে দেওয়া উচিত, ব্যতিক্রমের গহনে আগে থেকেই পা ফাঁসালে তাদের দুর্বল মন কথায় কথায় ব্যতিক্রমবিধির আড়ে মিথ্যাভাষণ ও মিথ্যা আচরণের আশ্রয় নেবে। শোনা যায় বিদ্যাসাগরমশায় তাঁর স্কুলের কোন পড়ুয়াকে মিথ্যা কথা কইতে শুনে বলেছিলেন,—“যাও বাবা, এখানে তোমার জায়গা হবে না, সেই আলিপুরের বটতলায় ‘টুর্নি’ বাবুদের কাছে গিয়ে বোসো।” কি শিশু, কি বড়, সকল মানুষেরই অন্তরের গভীর স্তরে কতকগুলি উচ্চ ভাব বসবাস করে। একখানা ব্রিটিশ Military Manual-এ পড়েছিলুম—“সৈন্যদের কেবলমাত্র হুকুমের দ্বারা চালাবে না। তাদের ভিতরকার সাহস প্রভৃতি উচ্চতম ভাব ও আদর্শের প্রতি appeal করে শত্রুজয়ে উদ্দীপিত করবে।” সত্যই পরম ধর্ম। কখনো কখনো অসত্যও ধর্মেরই রূপ; সুতরাং মার্জনীয়—এই কথা শাস্ত্রকাররা বলেছেন। সত্যই পরম ধর্ম। সত্যমিথ্যার ব্যবচ্ছেদ রেখাটি সুস্পষ্ট। কিন্তু কোন কোন অবস্থায় দেখতে অসত্য হলেও, তা ধর্মেরই রূপান্তর ও সেস্থলে ধর্মার্থে অসত্যই বিহিত—এই কথাটিই শ্রীকৃষ্ণের মুখে বঙ্কিম আমাদের শুনিয়েছেন।  বড় হয়ে যখন বিচার-বিবেচনা-শক্তি খানিকটা উদ্বুদ্ধ হল, তখন বঙ্কিমকে পড়ে দেখে অনুভব করলুম, বঙ্কিমের প্রতি সুবিচার করিনি আমরা, সেদিন মাতুলভক্তিতে অযথা বঙ্কিম-মতদ্বেষী হয়ে পড়েছিলুম। সেই অন্যায় ক্ষালনের জন্যে একালের পাঠকদের কৌতুহল নিবৃত্তির জন্যে ও বিষয়টির মাহাত্ম্য তাঁদের সমক্ষে ধারণের জন্যে “কৃষ্ণকথিত ধর্মতত্ত্ব” থেকে নিম্নে উদ্ধৃত করছি।

 “কথাটা এই। সত্য পরম ধর্ম। যদি অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বধ না করেন, তবে তাঁহাকে সত্যচ্যুত হইতে হয়। অর্জুনের প্রশ্ন এই যে, সত্যরক্ষার্থ যুধিষ্ঠিরকে বধ করা তাঁহার কর্তব্য কি না। অর্জুন কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“তোমার মতে এক্ষণে কি করা কর্তব্য?”

 কৃষ্ণ যে উত্তর দিলেন, তাহা বুঝাইবার পূর্বে, আমরা পাঠককে অনুরোধ করি যে, আপনিই ইহার উত্তর দিবার চেষ্টা করুন। বোধ করি, সকল পাঠকই একমত হইয়া উত্তর দিবেন যে, এরূপ সত্যের জন‍্য যুধিষ্ঠিরকে বধ করা অর্জুনের কর্তব্য নহে। কৃষ্ণও সেই উত্তর দিলেন। কিন্তু পাশ্চাত্যনীতিপণ্ডিত আধুনিক পাঠক যে কারণে এই উত্তর দিবেন, কৃষ্ণ সেই কারণে এ সকল উত্তর দিলেন না। তিনি প্রাচ্যনীতির বশবর্তী হইয়াই এই উত্তর দিলেন। তাহার কারণ বুঝাইতে হইবে না,—বুঝাইতে হইবে না যে, শ্রীকৃষ্ণ ভারতবর্ষে অবতীর্ণ—ইংলণ্ডে নহে। তিনি ভারতবর্ষের নীতিতে সুপণ্ডিত, ইউরোপীয় নীতি তখন হয়ও নাই, এবং কৃষ্ণ তন্মতাবলম্বী হইলে অর্জুনও তাহার কিছুই বুঝিতেন না।

 কৃষ্ণ অর্জুনকে বুঝাইবার জন্য যে সকল তত্ত্বের অবতারণা করিলেন, এক্ষণে তাহার স্থূল মর্ম বলিতেছি—অন্ততঃ যে অংশ বিবাদের স্থল হইতে পারে, তাহা উদ্ধৃত করিতেছি।

 তাঁহার প্রথম কথা, “অহিংসা পরম ধর্ম।” ইহাতে প্রথম আপত্তি হইতে পারে যে, সকল স্থানে অহিংসা ধর্ম নহে। দ্বিতীয় আপত্তি এই হইতে পারে যে, কৃষ্ণ স্বয়ং গীতাপর্বাধ্যায়ে অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত করিয়াছিলেন, এ উক্তি তাহার বিপরীত।

 যিনি অহিংসাতত্ত্বের মর্ম না বুঝেন, তিনিই এরূপ আপত্তি করিবেন। অহিংসা পরম ধর্ম, একথায় এমন বুঝাইবে না যে, কোন অবস্থায় কোন প্রকারে প্রাণিহিংসা করিলে অধর্ম হয়। প্রাণিহিংসা ব্যতীত আমরা ক্ষণমাত্র জীবনধারণ করিতে পারি না, ইহা ঐশিক নিয়ম। যে জল পান করি, তাহার সঙ্গে সহস্র সহস্র অণুবীক্ষণদৃশ্য জীব উদরস্থ করি; প্রতিনিশ্বাসে বহুসংখ্যক তাদৃক্‌ জীব নাসাপথে প্রেরিত করি, প্রতি পদার্পণে সহস্র সহস্রকে দলিত করি। একটি শাকের পাতা বা একটি বেগুনের সঙ্গে অনেকগুলিকে রাঁধিয়া খাই। যদি বল, এ সকল অজ্ঞানকৃত হিংসা, ইহাতে পাপ নাই; আমি তাহার উত্তরে বলি যে, জ্ঞানকৃত প্রাণিহিংসা ব্যতীতও আমাদের প্রাণরক্ষা নাই। যে বিষধর সর্প বা বৃশ্চিক আমার গৃহে বা শয্যাতলে আশ্রয় করিয়াছে, আমি তাহাকে বিনাশ না করিলে সে আমাকে বিনাশ করিবে। যে ব্যাঘ্র আমাকে গ্রহণ করিবার জন্য লম্ফনোদ্যত, আমি তাহাকে বিনাশ না করিলে সে আমাকে বিনাশ করিবে। যে শত্রু আমার বধসাধনে কৃতনিশ্চয় ও উদ্যতায়ুধ, আমি তাহাকে বিনাশ না করিলে সে আমাকে বিনাশ করিবে। যে দস্যু ধৃতাস্ত্র হইয়া নিশীথে আমার গৃহে প্রবেশপূর্বক সর্বস্ব গ্রহণ করিতেছে, যদি বিনাশ ভিন্ন তাহাকে নিবারণের উপায় না থাকে, তবে তাহাকে বিনাশ করাই আমার পক্ষে ধর্মানুমত। যে বিচারকের সম্মুখে হত্যাকারিকৃত হত্যা প্রমাণিত হইয়াছে, যদি তাহার বধ্যদণ্ড রাজনিয়োগসম্মত হয়, তবে তিনি তাঁহার বধাজ্ঞা প্রচার করিতে ধর্মতঃ বাধ্য। এবং যে রাজপুরুষের উপর বধার্হের বধের ভার আছে, সেও তাহাকে বধ করিতে বাধ্য। সেকেন্দর বা গজনবী মহম্মদ, আতিলা বা জঙ্গেজ, তৈমূর বা নাদের, দ্বিতীয় ফ্রেড্রিক্‌ বা নেপোলেয়ন্‌ পরস্ব ও পররাষ্ট্রহরণ জন্য যে অগণিত শিক্ষিত তস্কর লইয়া পররাজ্যপ্রবেশ করিয়াছিলেন, তাহা লক্ষ লক্ষ হইলেও প্রত্যেকেই ধর্মতঃ বধ্য। এখানে হিংসাই ধর্ম।

 পক্ষান্তরে, যে পাখীটি আকাশে উড়িয়া যাইতেছে, ভোজন জন্যই হউক বা খেলার জন্যই হউক, তাহার নিপতি অধর্ম। যে মাছিটি মিষ্টবিন্দুর অন্বেষণে উড়িয়া বেড়াইতেছে, ক্রীড়াশীল বালক যে তাহাকে ধরিয়া টিপিয়া মারিল, তাহা অধর্ম। যে মৃগ বা যে কুক্কুট তোমার আমার ন্যায় জীবনযাত্রা-নির্বাহের জন্য জগতে আসিয়াছে, উদরস্তরী যে তাহাকে বধ করিয়া খায়, সে অধর্ম। আমরা বায়ুপ্রবাহের তলচারী জীব; মৎস্য জলপ্রবাহের উপরিচর জীব; আমরা যে তাহাদের ধরিয়া খাই, সে অধর্ম।

 তবে অহিংসা পরম ধর্ম, এ বাক্যের প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, ধর্ম্য প্রয়োজন ব্যতীত যে হিংসা, তাহা হইতে বিরতিই পরম ধর্ম। নচেৎ হিংসাকারীর নিবারণ জন্য হিংসা অধর্ম নহে, বরং পরম ধর্ম। এই কথা স্পষ্টীকৃত করিবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলাকের ইতিহাস শুনাইলেন। তাহার স্থূল তাৎপর্য এই যে, বলাক নামে ব্যাধ প্রাণিগণের বিশেষবিনাশহেতু এক শ্বাপদকে বিনাশ করিয়াছিল, করিবামাত্র তাহার উপর “আকাশ হইতে পুষ্পবৃষ্টি নিপতিত হইতে লাগিল; অপ্সরোদিগের অতি মনোরম গীতবাদ্য আরম্ভ হইল, এবং সেই ব্যাধকে স্বর্গে সমানীত করিবার নিমিত্ত বিমান সমুপস্থিত হইল।” ব্যাধের পূণ্য এই যে, সে হিংসাকারীর হিংসা করিয়াছিল।

 অহিংসা পরম ধর্ম, এই অর্থে বুঝিতে হইবে। তবে, ধর্ম্য প্রয়োজন ভিন্ন হিংসা করিবে না, একথায় একটা ভারি গোলযোগ হয়, এবং জগতে চিরকাল হইয়া আসিতেছে। ধর্ম্য প্রয়োজন কি? ধর্ম কি? Inquisition কর্তৃক মনুষ্যবধে ধর্ম্য প্রয়োজন আছে বলিয়া কোটি কোটি মনুষ্য যমপুরে প্রেরিত হইয়াছিল। ধর্মার্থই St. Bartholomew হত্যাকাণ্ড। ধর্মাচরণ বিবেচনাতেই ক্রুসেদ্‌ওয়ালাদিগের দ্বারা পথিবী নরশোণিতপ্রবাহে পঙ্কিল হইয়াছিল। ধর্মবিস্তারের জন্য মুসলমানেরা লক্ষ লক্ষ মনুষ্য হত্যা করিয়াছিল। বোধ হয়, ধর্ম্য প্রয়োজন সম্বন্ধে ভ্রান্তিতে পড়িয়া মনুষ্য যত মনুষ্য নষ্ট করিয়াছে, তত মনুষ্য আর কোন কারণেই নষ্ট হয় নাই।

 অর্জুনেরও এখন সেই ভ্রান্তি উপস্থিত। তিনি মনে করিয়াছেন যে, সত্যরক্ষাধর্মার্থ যুধিষ্ঠিরকে বধ করা কর্তব্য। অতএব কেবল অহিংসা পরম ধর্ম, একথা বলিলেও তাঁহার ভ্রান্তির দূরীকরণ হয় না। এই জন্য কৃষ্ণের দ্বিতীয় কথা।

 সে দ্বিতীয় কথা এই যে, বরং মিথ্যাবাক্যও প্রয়োগ করা যাইতে পারে কিন্তু কখনই প্রাণিহিংসা করা কর্তব্য নহে।[১] ইহার স্থূল তাৎপর্য এই যে, অহিংসা ও সত্য, এই দুইয়ের মধ্যে অহিংসা শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইহার অর্থ এইঃ— নানাবিধ পুণ্য কর্মকে ধর্ম বলিয়া গণনা করা যায়; যথা—দান, তপ, দেবভক্তি, সত্য, শৌচ, অহিংসা ইত্যাদি। ইহার মধ্যে সকলগুলিই সমান নহে; ইতরবিশেষ হওয়াই সম্ভব। শৌচের মাহাত্ম্য বা দানের মাহাত্ম্য কি সত্যের সঙ্গে বা অহিংসার সঙ্গে এক? যদি তাহা না হয়, যদি তারতম্য থাকে, যে সর্বশ্রেষ্ঠ কে? কৃষ্ণ বলেন, অহিংসা। সত্যের স্থান তাহার নীচে।

 আমরা পাশ্চাত্যের শিষ্য। অনেক পাঠক এই কথায় শিহরিয়া উঠিবেন। পাশ্চাত্যেরা নাকি বলিয়া থাকেন, কোনও অবস্থাতেই মিথ্যা বলা যাইতে পারে না। তা না হয় হইল; সে কথা এখন উঠিতেছে না। কিন্তু এমন কেহই বলিবেন না যে, পাশ্চাত্যদিগের মতে একজন মিথ্যাবাদী একজন হত্যাকারীর অপেক্ষা গুরুতর পাপী, অথবা মিথ্যাবাদী ও হত্যাকারী তুল্য পাপী। তাঁহারা যে তাহা বলেন না, সমস্ত ইউরোপীয় দণ্ডবিধিশাস্ত্র তাহার প্রমাণ। যদি তাই হইল, তবে এখন কৃষ্ণের সঙ্গে পাশ্চাত্যের শিষ্যগণের মতভেদের এখানে কোন লক্ষণ দেখা যায় না। এখানে কেবল পাপের তারতম্যের কথা হইতেছে। কোন অধর্মই কোন সময়ে করিতে নাই। নরহত্যাও করিতে নাই, মিথ্যা কথাও বলিতে নাই। কৃষ্ণের কথার ফল এই যে, যদি এমন অবস্থা কাহারও ঘটে যে, হয় তাহাকে মিথ্যা কথা বলিতে হইবে, নয় নরহত্যা করিতে হইবে, তবে সে বরং মিথ্যা কথা বলিবে, তথাপি নরহত্যা করিবে না। যদি এরূপ ধর্মাত্মা নীতিজ্ঞ কেহ থাকেন যে, বলেন যে বরং নরহত্যা করিবে, তথাপি মিথ্যা কথা বলিবে না, তবে আমাদের উত্তর এই যে, তাঁহার ধর্ম তাঁহাতেই থাক, এ নারকী ধর্ম যেন ভারতবর্ষে বিরলপ্রচার হয়।

 কৃষ্ণের এই মত। যদি অর্জুন ইহার অনুবর্তী হইবেন, তবে ভ্রাতৃবধ-পাপ হইতে তাঁহাকে বিরত করিবার পক্ষে ইহাই যথেষ্ট। কিন্তু অর্জুন বলিতে পারেন, “এ ত গেল তোমার মত। কিন্তু লৌকিক ও প্রচলিত ধর্ম কি? তোমার মতই যথার্থ হইতে পারে, কিন্তু ইহা যদি প্রচলিত ধর্মানুমোদিত না হয়, তবে আমি জনসমাজে সত্যচ্যুত পাপাত্মা বলিয়া কলঙ্কিত হই।’’ এজন্য কৃষ্ণ আপনার মত প্রকাশ করিয়া প্রচলিত ধর্মমত যাহা, তাহা বুঝাইতেছেন। তিনি বলিলেন, “হে ধনঞ্জয়! কুরুপিতামহ ভীষ্ম, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, বিদুর ও যশস্বিনী কুন্তী যে ধর্মরহস্য কহিয়াছেন, আমি যথার্থরূপে তাহাই কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।” এই বলিয়া বলিলেন,

 “সাধু ব্যক্তিই সত্য কথা কহিয়া থাকেন, সত্য অপেক্ষা আর কিছুই শ্রেষ্ঠ নাই।[২] সত্যতত্ত্ব অতি দুর্জ্ঞেয়। সত্যবাক্য প্রয়োগ করাই অবশ্য কর্তব্য।”

 এই গেল স্থূল নীতি। তারপর বর্জিত তত্ত্ব বলিতেছেন,

 “কিন্তু যে স্থানে মিথ্যা সত্যস্বরূপ ও সত্য মিথ্যাস্বরূপ হয়, সে স্থলে মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করা দোষাবহ নহে।”

 কিন্তু কখনও কি এমন হয়? একথাটি আবার উঠিবে, সেই সময়ে আমরা ইহার যথাসাধ্য বিচার করিব। তারপর কৃষ্ণ বলিতেছেন,

 “বিবাহ, রতিক্রীড়া, প্রাণবিয়োগ ও সর্বস্বাপহরণকালে এবং ব্রাহ্মণের নিমিত্ত মিথ্যা প্রয়োগ করিলেও পাতক হয় না।”

 এখানে ঘোর বিবাদের স্থল, কিন্তু বিবাদ এখন থাক। কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদে উল্লিখিতরূপ আছে। উহা একটি শ্লোকের মাত্র অনুবাদ, কিন্তু মূলে ঐ বিষয়ে দুইটি শ্লোক আছে। দুইটিই উদ্ধৃত করিতেছি:

১। প্রাণাত্যয়ে বিবাহে চ বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ।
সর্বস্যাপহারে চ বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ॥

২। বিবাহকালে রতিসম্প্রয়োগে প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে।
বিপ্রস্য চার্থে হ্যনৃতং বদেত পঞ্চানৃত্যাহূরপাতকানি॥

 এই দুইটি শ্লোকের একই অর্থ; কেবল প্রথম শ্লোকটিতে ব্রাহ্মণের কথা নাই, এই প্রভেদ। এখন পাঠকের মনে এই প্রশ্ন আপনিই উদয় হইবে, একই অর্থবাচক দুইটি শ্লোকের প্রয়োজন কি?

 ইহার উত্তর এই যে, এই দুইটিই অন্যত্র হইতে উদ্ধৃত—Quotation—কৃষ্ণের নিজোক্তি নহে। সংস্কৃত গ্রন্থে এমন স্থানে স্থানে দেখা যায় যে, অন্যত্র হইতে বচন ধৃত হয়, কিন্তু স্পষ্ট করিয়া বলা হয় না যে, এই বচন গ্রন্থান্তরের। এই মহাভারতীয় গীতাপর্বাধ্যায়েই তাহার উদাহরণ গ্রন্থান্তরে দিয়াছি।

 আমি আন্দাজের উপর নির্ভর করিয়া বলিতেছি না, এ বচন দুইটি অন্যত্র হইতে ধৃত। দ্বিতীয় শ্লোকটি, যথা—“বিবাহকালে রতিসম্প্রয়োগে” ইত্যাদি— ইহা বশিষ্ঠের বচন। পাঠক বশিষ্ঠের ১৬ অধ্যায়ে ৩৫ শ্লোকে তাহা দেখিবেন; ইহা মহাভারতের আদিপর্বে, ৩৪১২ শ্লোকে, যেখানে কৃষ্ণের সঙ্গে কোন সম্বন্ধ নাই, সেখানেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হইয়া উদ্ধৃত হইয়াছে, যথা—

ন ধর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি ন স্ত্রীষু রাজন্ন বিবাহকালে।
প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে পঞ্চানৃতাহূরপাতকানি॥

 চারিটি ভিন্ন পাঁচটির কথা এখানে নাই, তথাপি বশিষ্ঠের সেই “পঞ্চানৃতান্যাহূরপাতকানি” আছে। প্রচলিত বচন সকল মুখে মুখে এইরূপ বিকৃত হইয়া যায়।

 প্রথম শ্লোকটির পূর্বগামী শ্লোকের সহিত লিখিতেছি;

(ক) ভবেৎ সত্যমবক্তবং বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ॥
(খ) যত্রানৃতং ভবেৎ সত্যং সত্যঞ্চাপ্যনৃতং ভবেৎ॥
(গ) প্রাণাত্যয়ে বিবাহে চ বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ।
(ঘ) সর্বস্বস্যাপহারে চ বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ॥

 এক্ষণে মহাভারতের সভাপর্ব হইতে একটি (১৩৮৪৪) শ্লোক উদ্ধৃত করিতেছি—কৃষ্ণের সহিত সেখানে কোন সম্বন্ধ নাই।

(চ) প্রাণান্তিকে বিবাহে চ বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ।
(ছ) অনৃতেন ভবেৎ সত্যং সত্যেনৈবানৃতং ভবেৎ॥

 পাঠক দেখিবেন, (গ) ও (চ), আর (খ) ও (ছ) একই। শব্দগলিও প্রায় একই। অতএব ইহাও প্রচলিত পুরাতন বচন।

 ইহা কৃষ্ণের মত নহে; নিজের অনুমোদিত নীতি বলিয়াও তাহা বলিতেছেন না; ভীষ্মাদির কাছে যাহা শুনিয়াছেন, তাহাই বলিতেছেন; নিজের অনুমোদিত হউক বা না হউক, কেন তিনি অর্জুনকে ইহা শুনাইতে বাধ্য, তাহা বলিয়াছি। সুতরাং কৃষ্ণচরিত্রে এ নীতির যাথার্থ্যাযাথার্থ্য বিচারে কোন প্রয়োজন হইতেছে না।

 কিন্তু আসল কথা বাকি আছে। আসল কথা, কৃষ্ণের নিজের মতও এই যে, অবস্থাবিশেষে সত্য মিথ্যা হয় এবং মিথ্যা সত্য হয় এবং সে সকল স্থানে মিথ্যাই প্রযোক্তব্য। একথা তিনি পরে বলিতেছেন।

 প্রথমে বিচার্য, কখনও কি মিথ্যা সত্য হয় এবং সত্য মিথ্যা হয়? ইহার স্থূল উত্তর এই যে, যাহা ধর্মানুমোদিত তাহাই সত্য, আর যাহা অধর্মের অনুমোদিত, তাহাই মিথ্যা। ধর্মানুমোদিত মিথ্যা নাই, এবং অধর্মানুমোদিত সত্য নাই। তবে সত্যাসত্য মীমাংসা ধর্মাধর্ম মীমাংসার উপর নির্ভর করিতেছে। অতএব শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে ধর্মতত্ত্ব নির্ণয় করিতেছেন। কথাগুলোতে গীতার উদার নীতির গম্ভীর শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়। বলিতেছেন,

 “ধর্ম ও অধর্ম তত্ত্ব নির্ণয়ের বিশেষ লক্ষণ নির্দিষ্ট আছে। কোন কোন স্থলে অনুমান দ্বারাও নিতান্ত দুর্বোধ ধর্মের নির্ণয় করিতে হয়।”

 ইহার অপেক্ষা উদার ইউরোপেও কিছু নাই। তারপর—

 ‘‘অনেকে শ্রুতিরে ধর্মের প্রমাণ বলিয়া নির্দেশ করেন। তাহাতে আমি দোষারোপ করি না; কিন্তু শ্রুতিতে সমস্ত ধর্মতত্ত্ব নির্দিষ্ট নাই; এইজন্য অনেক স্থলে অনুমান দ্বারা ধর্ম নির্দিষ্ট করিতে হয়।”

 এই কথাটা লইয়া আজিও সভ্যজগতে বড় গোলমাল। যাঁহারা বলেন যে যাহা দৈবোক্তি, বেদই হউক, বাইবেলই হউক, কোরাণই হউক—তাহাতে যাহা আছে, তাহাই ধর্ম, তাহার বাহিরে ধর্ম কিছুই নাই—তাঁহারা আজিও বড় বলবান্‌। তাঁহাদের মতে ধর্ম দৈবোক্তিনির্দিষ্ট, অনুমানের বিষয় নহে। একথা মনুষ্যজাতির উন্নতির পথে বড় দুরুত্তীর্য কণ্টক। আমাদের দেশের কথা দূরে থাকুক, ইউরোপেও আজিও এই মত উন্নতির পথ রোধ করিতেছে। আমাদের দেশের অবনতির ইহা একটি প্রধান কারণ। আজিও ভারতবর্ষের ধর্মজ্ঞান বেদ ও মনুযাজ্ঞবল্ক্যাদি স্মৃতির দ্বারা নিরুদ্ধ;—অনুমানের পথ নিষিদ্ধ। অতি দূরদর্শী মনুষ্যাদর্শ শ্রীকৃষ্ণ লোকোন্নতির এই বিষম ব্যাঘাত সেই অতি প্রাচীনকালেও দেখিয়াছিলেন। এখন হিন্দুসমাজের ধর্মজ্ঞান দেখিয়া বিষণ্ন মনে সেই শ্রীকৃষ্ণেরই শরণ লইতে ইচ্ছা করে।

 কিন্তু অনুমানের একটি মূল চাহি। যেমন অগ্নি ভিন্ন ধূমোৎপত্তি হয় না, এই মূলের উপর অনুমান করি যে, সম্মুখস্থ ধূমবান্‌ পর্বত বহ্নিমান্‌ও বটে, তেমনই একটা লক্ষণ চাহি যে, তাহা দেখিলেই বুঝিতে পারিব যে, এই কর্মটা ধর্ম বটে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁহার লক্ষণ নির্দিষ্ট করিতেছেন।

 “ধর্ম প্রাণিগণকে ধারণ করে বলিয়া ধর্মনামে নির্দিষ্ট হইয়াছে। অতএব যদ্দ্বারা প্রাণিগণের রক্ষা হয়, তাহাই ধর্ম।”

 এই হইল কৃষ্ণকৃত ধর্মের লক্ষণ-নির্দেশ। একথাটায় এখনকার Herbert Spencer, Bentham, Mill ইতি সম্প্রদায়ের শিষ্যগণ কোনপ্রকার অমত করিবেন না জানি। কিন্তু অনেকে বলিবেন, এ যে ঘোরতর হিতবাদ—বড় Utilitarian রকমের ধর্ম। বড় Utilitarian রকম বটে, কিন্তু আমি গ্রন্থান্তরে বুঝাইতেছি যে, ধর্মতত্ত্ব হিতবাদ হইতে বিযুক্ত করা যায় না; জগদীশ্বরের সার্বভৌমিকত্ব এবং সর্বময়তা হইতেই ইহাকে অনুমিত করিতে হয়। সঙ্কীর্ণ খ্রীষ্টধর্মের সঙ্গে হিতবাদের বিরোধ হইতে পারে, কিন্তু যে হিন্দুধর্মে বলে যে, ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন, হিতবাদ সে ধর্মের প্রকৃত অংশ। এই কৃষ্ণবাক্যই যথার্থ ধর্মলক্ষণ।

 পূর্বে বুঝাইয়াছি, যাহা ধর্মানুমোদিত তাহাই সত্য; যাহা ধর্মানুমোদিত নহে, তাহাই মিথ্যা। অতএব যাহা সর্বলোকহিতকর, তাহাই সত্য, যাহা লোকের অহিতকর, তাহাই মিথ্যা। এই অর্থে, যাহা লৌকিক সত্য, তাহা ধর্মতঃ মিথ্যা হইতে পারে; এবং যাহা লৌকিক মিথ্যা, তাহা ধর্মতঃ সত্য হইতে পারে। এইরূপ স্থলে মিথ্যাও সত্যস্বরূপ এবং সত্যও মিথ্যাস্বরূপ হয়।

 উদাহরণস্বরূপ কৃষ্ণ বলিতেছেন, ‘‘যদি কেহ কাহারে বিনাশ করিবার মানসে কাহারও নিকট তাহার অনুসন্ধান করে, তাহা হইলে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির মৌনাবলম্বন করাই উচিত। যদি একান্তই কথা কহিতে হয়, তবে সে স্থলে মিথ্যা বাক্য প্রয়োগ করাই কর্তব্য। ঐরূপ স্থলে মিথ্যা সত্যস্বরূপ হয়।”

 এই প্রস্তাব উত্থাপিত করিবার পূর্বেই, কৃষ্ণ কৌশিকের উপাখ‍্যান অর্জুনকে শুনাইয়া ভূমিকা করিয়াছিলেন। সে উপাখ্যান এই,—

 ‘‘কৌশিক নামে এক বহশ্রুত তপস্বিশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ গ্রামের অনতিদূরে নদীগণের সঙ্গমস্থানে বাস করিতেন। ঐ ব্রাহ্মণ সর্বদা সত্য বাক্য প্রয়োগরূপ ব্রত অবলম্বনপূর্বক তৎকালে সত্যবাদী বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছিলেন। একদা কতকগুলি লোক দস্যুভয়ে ভীত হইয়া বনমধ্যে প্রবেশ করিলে, দস্যুরাও ক্রোধভরে যত্নসহকারে সেই বনে তাহাদিগকে অন্বেষণ করত সেই সত্যবাদী কৌশিকের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিল, হে ভগবন্‌! কতকগুলি ব্যক্তি এই দিকে আগমন করিয়াছিল, তাহারা কোন্‌ পথে গমন করিয়াছে, যদি আপনি তাহা অবগত থাকেন, তাহা হইলে সত্য করিয়া বলুন। কৌশিক দস্যুগণকর্তৃক এইরূপ জিজ্ঞাসিত হইয়া সত্যপালনার্থে তাহাদিগকে কহিলেন, কতকগুলি লোক এই বৃক্ষ, লতা ও বৃক্ষপরিবেষ্টিত অটবীমধ্যে গমন করিয়াছে। তখন সেই ক্রুরকর্মা দস্যুগণ তাহাদের অনুসন্ধান পাইয়া তাহাদিগকে আক্রমণ ও বিনাশ করিল। সূক্ষ্মধর্মানভিজ্ঞ সত্যবাদী কৌশিকও সেই সত্যবাক্যজনিত পাপে লিপ্ত হইয়া ঘোর নরকে নিপতিত হইলেন।”

 এস্থলে ইহা অভিপ্রেত যে, কৌশিক অবগত হইয়াছিলেন যে, ইহারা দস্যু; পলায়িত ব্যক্তিগণের অনিষ্ট ইহাদের উদ্দেশ্য,—নহিলে তাঁহার কোন পাপই নাই। যদি তাহা অবগত ছিলেন, তবে তিনি কৃষ্ণের মতে সত্যকথনের দ্বারা পাপাচরণ করিয়াছিলেন। এ বিষয়ে প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যে ঘোরতর মতভেদ। আমাদের প্রতীচ্য শিক্ষকদিগের নিকট শিখিয়াছি যে, সত্য নিত্য, কখনও মিথ্যা হয় না, এবং কোনও সময়ে মিথ্যা প্রযোক্তব্য নহে। সুতরাং কৃষ্ণের মত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নিকট নিন্দিতই হইতে পারে। যাঁহারা ইহার নিন্দা করিবেন (আমি ইহার সমর্থনও করিতেছি না), তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, কৌশিকের এ অবস্থায় কি করা উচিত ছিল। সহজ উত্তর, মৌনাবলম্বন করা উচিত ছিল। সে কথা ত কৃষ্ণ নিজেই বলিয়াছেন—সে বিষয়ে মতভেদ নাই। যদি দস্যুরা মৌনী থাকিতে না দেয়? পীড়নাদির দ্বারা উত্তর গ্রহণ করে? কেহ কেহ বলিতে পারেন যে, পীড়ন ও মৃত্যু স্বীকার করিয়াও কৌশিকের মৌন রক্ষা করা উচিত ছিল। তাহাতেও আমরা সম্পূর্ণ অনুমোদন করি। তবে জিজ্ঞাসা এই, ঈদৃশ ধর্ম পৃথিবীতে সাধারণতঃ চলিবার সম্ভাবনা আছে কি না? ইহাতে সাংখ্যপ্রবচনকারের একটি সূত্র আমাদের মনে পড়িল। মহর্ষি কপিল বলিয়াছেন, “নাশক্যোপদেশবিধিরূপদিষ্টেহপানুদেশঃ।”[৩] এরূপ ধর্মপ্রচার চেষ্টা নিষ্ফল বলিয়া বোধ হয়। যদি সফল হয়, মানবজাতির পরম সৌভাগ্য।

 কথাটা এখানে ঠিক তাহা নয়। কথাটা এই যে, যদি একান্তই কথা কহিতে হয়,

অবশ্যং কূজিতব্যে বা শঙ্কেরন্‌ বাপাক্‌জতঃ।

তাহা হইলে কি করিবে? সত্য বলিয়া জ্ঞানতঃ নরহত্যায় সহায়তা করিবে? যিনি এইরূপ ধর্মতত্ত্ব বুঝেন, তাঁহার ধর্মবাদ যথার্থই হউক, অযথার্থই হউক, নিতান্ত নৃশংস বটে।

 প্রতিবাদকারী বলিতে পারেন যে, কৃষ্ণোক্ত এই নীতির একটি ফল এমন হয় যে, হত্যাকারীর জীবন রক্ষার্থ মিথ্যা শপথ করাও ধর্ম। যিনি এরূপ আপত্তি করিবেন, তিনি এই সত্যতত্ত্ব কিছুই বুঝেন নাই। হত্যাকারীর দণ্ড মনুষ্যজীবন রক্ষার্থ নিতান্ত প্রয়োজনীয়, নহিলে যে যাহাকে পাইবে, মারিয়া ফেলিবে। অতএব হত্যাকারীর দণ্ডই ধর্ম; এবং তাহার রক্ষার্থ যে মিথ্যা বলে, সে অধর্ম করে।

 কৃষ্ণোক্ত এই সত্যতত্ত্ব নির্দোষ এবং মনুষ্যসাধারণের অবলম্বনীয় কি না, তাহা আমি এক্ষণে বলিতে প্রস্তুত নহি। তবে কৃষ্ণচরিত্র বুঝাইবার জন্য উহা পরিস্ফুট করিতে আমি বাধ্য। কিন্তু ইহাও বলিতে আমি বাধ্য যে, পাশ্চাত্যেরা যে কারণে বলেন যে, সত্য সকল সময়েই সত্য, কোন অবস্থাতেই পরিহার্য নহে, তাহার মূলে একটি গুরুতর কথা আছে। কথাটা এই যে, ইহাই যদি ধর্ম—সত্য যেখানে মনুষ্যের হিতকারী, সেইখানেই ধর্ম, আর যেখানে মনুষ্যের হিতকারী নয়, সেখানে অধর্ম, ইহাই যদি ধর্ম হয়, তাহা হইলে মনুষ্যজীবন এবং মনুষ্যসমাজ অতিশয় বিশৃঙ্খল হইয়া পড়ে,—যে লোকহিত তোমার উদ্দেশ্য, তাহা ডুবিয়া যায়। অবস্থাবিশেষ উপস্থিত হইলে, সত্য অবলম্বনীয় বা মিথ্যা অবলম্বনীয়, একথার মীমাংসা কে করিবে? যে সে মীমাংসা করিতে বসিলে, মীমাংসা কখনও ধর্মানুমোদিত হইতে পারে না। শিক্ষা, জ্ঞান, বুদ্ধি অনেকেরই অতি সামান্য; কাহারও সম্পূর্ণ নহে। বিচারশক্তি অধিকাংশেরই আদৌ অল্প, তার উপর ইন্দ্রিয়ের বেগ, স্নেহমমতার বেগ, ভয়, লোভ, মোহ ইত্যাদির প্রকোপ। সত্য নিত্যপালনীয়, এরূপ ধর্মব্যবস্থা না থাকিলে মনুষ্যজাতি সত্যশূন্য হইবার সম্ভাবনা।

 প্রাচীন হিন্দু, ঋষিরা যে তাহা বুঝিতেন না, এমত নহে। বুঝিয়াই তাঁহারা বিশেষ করিয়া বিধান করিয়া দিয়াছেন, কোন্‌ কোন্‌ সময়ে মিথ্যা বলা যাইতে পারে। প্রাণাত্যয়ে ইত্যাদি সেই বিধি আমরা উদ্ধৃত করিয়াছি। মনু, গৌতম প্রভৃতি ঋষিদিগেরও মতও সেই প্রকার। তাঁহারা যে কয়টি বিশেষ বিধি বলিয়াছেন, তাহা ধর্মানুমত কি না, তাহার বিচারে আমার প্রয়োজন নাই। কৃষ্ণকথিত সত্যতত্ত্ব পরিস্ফূট করাই আমার উদ্দেশ্য। কৃষ্ণও আধুনিক ইউরোপীয়দিগের ন্যায় বুঝিয়াছিলেন যে, বিশেষ বিধি ব্যতীত, এই সাধারণ বিধি কার্যে পরিণত করা সাধারণ লোকের পক্ষে অতি দুরূহ। কিন্তু তাঁহার বিবেচনায় প্রাণাত্যয়ে প্রভৃতি কয়েকটি বিশেষ অবস্থা নির্দেশ করিলেই লোককে ধর্মানুমত সত্যাচরণ বুঝান যায় না। তিনি তৎপরিবর্তে কি জন্য এবং কিরূপ অবস্থায় সাধারণ বিধি উল্লঙ্ঘন করা উচিত, তাহাই বলিতেছেন। আমরা তাহা স্পষ্টীকৃত করিতেছি।

 দান, তপ, শৌচ, আর্জব, সত্য প্রভৃতি অনেকগুলি কার্যকে ধর্ম বলা যায়। ইহার সকলগুলিই সাধারণতঃ ধর্ম, আবার সকলগুলিই অবস্থাবিশেষে অধর্ম। অনুপযুক্ত প্রয়োগ বা ব্যবহারই অধর্ম। দান সম্বন্ধে উদাহরণ প্রয়োগপূর্বক বলিতেছেন, “সমর্থ হইলেও চৌরাদিকে ধনদান করা কদাপি কর্তব্য নহে। পাপাত্মাদিগকে ধন দান করিলে অধর্মাচরণ নিবন্ধন দাতাকেও নিতান্ত নিপীড়িত হইতে হয়।” সত্য সম্বন্ধেও সেইরূপ। শ্রীকৃষ্ণ তাহার যে দুইটি উদাহরণ দিয়াছেন, তাহার একটি উপরে উদ্ধৃত করিয়াছি, আর একটি এই,—

 “যে স্থলে মিথ্যা শপথ দ্বারাও চৌরসংসর্গ হইতে মুক্তিলাভ হয়, সে স্থলে মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করাই শ্রেয়ঃ। সে মিথ্যা নিশ্চয়ই সত্যস্বরূপ হয়।”

 ইহা ভিন্ন প্রচলিত ধর্মশাস্ত্র হইতে প্রাণাত্যয়ে বিবাহে ইত্যাদি কথা পুনরুক্ত হইয়াছে।

 কৃষ্ণকথিত সত্যতত্ত্ব এইরূপ। ইহার স্থূল তাৎপর্য এইরূপ বুঝা গেল যে,

১। যাহা ধর্মানুমোদিত, তাহাই সত্য, যাহা ধমবিরুদ্ধ, তাহা অসত্য।
২। যাহাতে লোকের হিত, তাহাই ধর্ম।
৩। অতএব যাহাতে লোকের হিত, তাহাই সত্য। যাহা তদ্বিরুদ্ধ, তাহাই অসত্য।
৪। এইরূপ সত্য সর্বদা সর্বস্থানে প্রযোক্তব্য।

 কৃষ্ণভক্ত বলিতে পারেন যে, ইহার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সত্যতত্ত্ব কোথাও কথিত হইয়াছে, এমন যদি দেখাইতে পার, তবে আমরা কৃষ্ণের মত পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছি। যদি তাহা না পার, তবে ইহাই আদর্শ মনুষ্যোচিত বাক্য বলিয়া স্বীকার কর।

 উপসংহারে আমার ইহাও বক্তব্য যে, যদ্দ্বারা লোকরক্ষা বা লোকহিত সাধিত হয়, তাহাই ধর্ম, আমরা যদি ভক্তিসহকারে এই কৃষ্ণোক্তি হিন্দুধর্মের মূলস্বরূপ গ্রহণ করিতে পারি, তাহা হইলে হিন্দুধর্মের ও হিন্দুজাতির উন্নতির আর বিলম্ব থাকে না। তাহা হইলে, যে উপধর্মের ভস্মরাশির মধ্যে পবিত্র এবং জগতে অতুল্য হিন্দুধর্ম প্রোথিত হইয়া আছে, তাহা অনল্পকালে কোথায় উড়িয়া যায়। তাহা হইলে শাস্ত্রের দোহাই দিয়া কুক্রিয়া, অনর্থক সামর্থ্যব্যয় ও নিষ্ফল কালাতিপাত দেশ হইতে দুরীভূত হইয়া সৎকর্ম ও সদনুষ্ঠানে হিন্দুসমাজ প্রভান্বিত হইয়া উঠে। তাহা হইলে ভণ্ডামি, জাতিমারামারি, পরস্পরের বিদ্বেষ ও অনিষ্টচেস্টা আর থাকে না। আমরা মহতী

কৃষ্ণকথিতা নীতি পরিত্যাগ করিয়া শূলপাণি ও রঘুনন্দনের পদানত—লোকহিত পরিত্যাগ করিয়া তিথিতত্ত্ব, মলমাসতত্ত্ব প্রভৃতি আটাইশ তত্ত্বের কচকচিতে মন্ত্রমুগ্ধ। আমাদের জাতীয় উন্নতি হইবে ত কোন্‌ জাতি অধঃপাতে যাইবে? যদি এখনও আমাদের ভাগ্যোদয় হয়, তবে আমরা সমস্ত হিন্দু একত্র হইয়া, ‘‘নমো ভগবতে বাসুদেবায়” বলিয়া কৃষ্ণপাদপদ্মে প্রণাম করিয়া, তদুপদিষ্ট এই লোকহিতাত্মক ধর্ম গ্রহণ করিব।[৪] তাহা হইলে নিশ্চিতই আমরা জাতীয় উন্নতি সাধিত করিতে পারি।

  1. যে বচনের উপর নির্ভর করিয়া কৃষ্ণকথিত এই ধর্মতত্ত্ব সংস্থাপিত হইতেছে, তাহার মূল সংস্কৃত উদ্ধৃত করা কর্তব্য।

    ‘‘প্রাণিনামবধস্তাত সর্বজ্যায়ান্মতো নমম।
    অনৃতাং বা বসেদ্ধাচং নতু হিংসাৎ কথঞ্চন॥’’

     পাঠক দেখিবেন, অহিংসা পরম ধর্ম, এটা কৃষ্ণবাক্যের ঠিক অনুবাদ নহে। ঠিক অনুবাদ—‘‘আমার মতে প্রাণিগণের অহিংসা সর্ব হইতে শ্রেষ্ঠ।’’ অর্থগত বিশেষ প্রভেদ নাই বলিয়া ‘‘অহিংসা পরম ধর্ম’’ ইতি পরিচিত বাক্যই ব্যবহার করিয়াছি।

  2. ‘‘ন সত্যাদ্বিদ্যতে পরম্‌।’’ ইতিপূর্বে কৃষ্ণ বলিয়াছেন, ‘প্রাণিনামবধস্তান সর্বজ্যায়ান্মতো মম।” এই দুইটি কথা পরস্পরবিরোধী। তাহার কারণ, একটি কৃষ্ণের মত, আর একটি ভীষ্মাদিকথিত প্রচলিত ধর্মনীতি।
  3. প্রথম অধ্যায়, ৯ সূত্র।
  4. বেন্থামের কথা ইংলণ্ড শুনিল—কৃষ্ণের কথা ভারতবর্ষ শুনিবে না?