জীবনের ঝরাপাতা/ষোল
॥ ষোল॥
বাড়ি-ফেরা
কলকাতায় সংস্কৃতে এম-এ পড়তে পড়তে যে চলে এসেছিলুম, এখানে সে ক্ষতি পূরণ হতে থাকল। এখানকার সংস্কৃত কলেজের আধুনিক প্রিন্সিপ্যাল নিজে ডবল এম-এ—স্বয়ং আমায় অধ্যাপনার ভার নিলেন। এঁরই সাহায্যে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে সংস্কৃত পুস্তকে প্রবেশলাভ হতে লাগল। মহীশূরের ওরিয়েণ্টাল লাইব্রেরীর কিউরেটার মহাদেব শাস্ত্রী এম-এ-ও আমার সাহায্যার্থে অগ্রসর হলেন। এই ওরিয়েণ্টাল লাইব্রেরী একটি প্রকাণ্ড ব্যাপার, মহীশূর রাজ্যের একটি ভারতবিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। গবেষণাপূর্বক নানারকম প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের এখানে পুনরুদ্ধার ও পুনর্মুদ্রণ হয়। অনেক গ্রন্থে মহাদেব শাস্ত্রীর অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের ইংরেজী ভূমিকায়। এই সকল পুস্তকের সেট উপহার দেওয়া হয় তাঁদের যাঁদের মহাদেব শাস্ত্রী জ্ঞানী বা জ্ঞান-পিপাসু এবং উপহারের যোগ্য পাত্র বিবেচনা করেন। আমার জ্ঞান-পিপাসায় তিনি নিঃসন্দেহ হওয়ায় একদিন তাঁর কাছে থেকে প্রায় এক ট্রাঙ্ক-ভরা পুস্তকাবলী এসে উপস্থিত হল। তাঁর নিজের শুভাগমনও প্রায়ই হত। আর একজন মধ্যে মধ্যে আসতেন—মাইসোর সিভিল সার্ভিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী—রামচন্দ্র রাও। খুব তীক্ষ্ণবুদ্ধি, সব সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তীব্র দৃষ্টিবান, নিঃশঙ্ক সমালোচক ও হাসিখুশিভরা। সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপ্যাল একজন আয়েঙ্গার, ওরিয়েণ্টাল লাইব্রেরীর কিউরেটার একজন আয়ার ও রামচন্দ্র রাও শিবাজীর ভাইয়ের সঙ্গে সমাগত দাক্ষিণাত্য প্রদেশে ঔপনিবেশিক মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের উত্তরপুরুষ—এখন দক্ষিণী বলেই গণ্য। মহীশূরের হোম-পলিটিক্সের আভাস এঁর কাছে পাওয়া যেত। এই তিনটিকেই আমার বিশেষ করে মনে পড়ে যাঁদের নিয়ে একটি বন্ধুমণ্ডলী গড়ে উঠল। পূর্ব-পরিচিত ডাক্তার রামস্বামী আয়েঙ্গার—নরসিং আয়েঙ্গারের ভাগিনেয়ও অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু তিনি intellectual আলোচনার বিশেষ ধার ধারতেন না—সেবাই ছিল তাঁর প্রধান ধর্ম। ফুলটি এটি ওটি সেটি নিয়ে আসতেন, যা আমার নয়নরুচিকর বা কাজে লাগার বস্তু হতে পারে। কলকাতায় মিসেস পি কে রায়দের গৃহে বাসজনিত এই শিক্ষা ও অভ্যেস তাঁর জন্মেছিল।
মহীশূরে আমার আসল বন্ধুত্ব হল এখানকার ডিরেক্টর অব পাব্লিক ইন্সট্রাকশন মিস্টার ভাভার পত্নী ও মেয়ের সঙ্গে। ভাভারা পার্শি। তাঁদের মেয়েটি—মেহেরবাঈ পরমা সুন্দরী ও সুশিক্ষিতা। বম্বে-পুণা-সাতারায়ও পার্শিদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের মেয়েদের সহজেই খাপ খেয়ে যেত—মেজমামী ও মার অনেক পার্শি বান্ধবী হয়েছিলেন। আমারও এঁদের সঙ্গে মিল হয়ে গেল খুব। মেহেরবাঈকে দেখে আমি মধ্যে মধ্যে আশ্চর্য হতুম—বম্বের মত বৃহৎ শহরের বাইরে, পার্শি-অপ্রতুল মহীশূরের নিভৃত বনে তাঁদের অজ্ঞাতে এমন ফুলটি ফুটে আছে—কোন পার্শি দুষ্মন্ত এসে এই শকুন্তলাটিকে দেখবে কি একদিন? তাই হল। রূপকথার Prince Charming এল একদিন।
স্যার জামশেদজী টাটার জ্যেষ্ঠপুত্র দোরাব টাটা পার্শি সমাজে একটি মস্ত বড় রুইকাৎলা জাতীয় পাত্র। স্ব স্ব মেয়ের হিতকল্পে বম্বের বড় বড় পার্শি ক্রোড়পতির পত্নীরা তাঁকে ধরার জন্যে অনেকদিন ধরে জাল পেতে আছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি ধরা দেননি। বয়স হয়ে যাচ্ছে, হবু শাশুড়ীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এমন সময় নিয়তি নিজের হাত খেললে। টাটা স্কীমের কার্য উপলক্ষে বৃদ্ধ পিতা জামশেদজীকে দিয়ে দোরাবকে মহীশূরে পাঠালে। সেখানে মেহেরবাঈকে দেখে দোরাবজী প্রেমপাশে ধরা পড়ে গেলেন। এ মায়েদের হাতেফেলা ছিপ নয়—একেবারে বিধির নিয়ন্ত্রণে ছোঁড়া কন্দর্পের পঞ্চবাণ। মেয়ের বাপ-মার মনে একটা বাধা খট্কা দিলে—দুজনের বয়সের অনেক পার্থক্য। কিন্তু প্রেমপথে সে বাধা টিকল না। শীঘ্রই তাদের engagement হল। সে সম্বাদ বম্বেতে যখন প্রচার হল, মহীশূরের মত অজানা শহরে অজ্ঞাতকুলশীলের কন্যার প্রতি দোরাবজীর অনুরাগের কথা বম্বের মায়েরা যখন শুনলেন তাঁর মনোনয়নকে ধিক্কার দিতে লাগলেন। তাতে তাঁদের বিবাহ বন্ধ হল না। শুভদিনের শুভক্ষণে মহীশূরে মেহেরবাঈয়ের পাণিগ্রহণ করে তিনি পত্নীসহ যখন বম্বেতে এলেন এবং অচিরে “স্যার দোরাব” হলেন, তখন বম্বের পার্শিসমাজ লেডি দোরাব টাটাকে তাঁদের একজন মূখ্যা বলে গ্রহণ করতে বাধ্য হল।
যে সময় মেহেরার engagement হয়, আমি মহীশূরে ছিলুম না। তার চিঠিতে খবর পেলুম। দোরাবজীর মহীশূরে আসা ও তাঁদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় ভরা সে বিশ পৃষ্ঠার চিঠিখানা একটি ষোড়শী বালিকার প্রথম প্রণয়োল্লসিত হৃদয়ের মুক্ত ছবি। বোধ হয় তাঁর আর কোন সমবয়সী বন্ধ ছিল না যাকে এমন করে হৃদয় ভরে লিখে আরাম পান। এমন নবপুলকের দিনে একজন কাউকে চাই—যাকে সব বলেই সুখ—আনন্দ ও ভয় দুই-ই।
এর অনেক বৎসর পরে একবার মাত্র এ‘র সঙ্গে আমার বম্বেতে দেখা হয়। তখন তিনি পুরামাত্রায় বম্বে সমাজের অঙ্গীভূত লেডি টাটা—অনেকানেক কমিটির মধ্যে একটি স্বদেশী এক্জিবিশন কমিটির সদস্যা—মহীশূরের সেই বালিকা “মিস্ ভাভা” আর নয়। দোরাব টাটা ও লেডি টাটা দুজনেই এখন গতায়ু। তাঁরা শেষ পর্যন্ত নিঃসন্তানই ছিলেন। দোরাবের ছোট ভাই রতন টাটাও নিঃসন্তান অবস্থায় ১৯১৪-র জগৎ-যুদ্ধে জার্মান টর্পেডোর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মত্যু-কবলিত হন। বদ্ধ জামশেদজীর বংশে বাতি দিতে কেউ নেই। তাঁর কীতিই তাঁর বাতি।
মহীশূর প্রবাসকালে আর একটি পরিবারের সঙ্গে আমার সৌহার্দ্য হল—তাঁরা মুসলমান ও বাঙ্গালোরে থাকেন। স্বামী ডেপুটি কলেক্টর মিস্টার সুজাতালি-ইউ পি-তে আদিবাস। স্ত্রী বাঙলার মেয়ে, তাঁর ভাইরা বাঙলায় উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। মিসেস্ সুজাতালি আমার কথা জানতে পেরে স্বয়ং একদিন বাঙ্গালোর থেকে মহীশূরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে একটা শনি-রবিবারে তাঁদের ওখানে আমার যাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করে গেলেন। একবার নয়—তাঁর পীড়াপীড়িতে এমন দু-চার বার শনি-রবিবারে তাঁদের ওখানে আমার যাওয়া-আসা ও থাকা হয়েছিল। শিক্ষিত মুসলমান পরিবারের সঙ্গে সহজেই আমার মিত্রতা জমে গেল। এস্থলে এ সৌহার্দ্যের মূলে ছিল মিসেস্ সুজাতালির বাঙলার প্রতি টান। অনেককাল পরে যখন আলিগড়ে আলিগড় ইউনিভার্সিটি দেখার জন্যে সেখানকার কর্তৃপক্ষরা আমাকে আমন্ত্রণ করেন— একটি প্রকাণ্ড শহরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যেন তার প্রতি অংশ পর্যটন করানর মত করে আমাকে সব কিছু দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় লক্ষ্য করলুম একটি যুবক সব সময়ই আমাদের সঙ্গে রয়েছে। পরে সে নিজের পরিচয় দিলে—সে বাঙলা দেশ থেকে আসা একটি মুসলমান ছাত্র। বাঙলার একজন মহিলাকে তার ইউনিভার্সিটিতে দেখে তার যে আনন্দ হয়েছে—ঘণ্টা কতকের মত তাঁর সঙ্গলাভে সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে পারছে না নিজেকে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। আর একবার বর্মায় রেঙ্গুনের নিকটবতী পেগু শহরে প্রসিদ্ধ শয়ান বুদ্ধের মূর্তি দেখে মধ্যাহ্ন অতীত হলে রেলওয়ে রেস্তরাঁতে গিয়ে বসলুম, আমার গুজরাটি সহচর কিছু আহার্যের বন্দোবস্তর জন্যে রেস্তরাঁর রন্ধনশালায় গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন। শুনলেন, সেদিন যা কিছু রান্না হয়েছিল, সব শেষ হয়ে গেছে—এত বেলায় আর কিছু পাবার যো নেই একটু শুকনো পাউরুটি ছাড়া। এই সময় দুজন ‘boy’ বা খানসামা এল—পরস্পরের সঙ্গে বাঙলায় কথা কইছে। আমি তাদের বাঙলায় জিজ্ঞেস করলুম—“তোমাদের বাড়ি কোথায়? বাঙলা দেশে?” তারা বিস্মিত হয়ে বললে—“হ্যাঁ, ঢাকায়। আপনিও কি বাঙালী? এত দেরি করে এসেছেন—সব ত ফুরিয়ে গেছে। আচ্ছা, তবু দেখি কি করতে পারি।” ঘণ্টাখানেক বসতে হল, কিন্তু তার মধ্যে দাল ভাত মাছ তরকারি সব সুচারুরূপে রান্না হয়ে টেবিলে হাজির। বাঙালী খানসামার বাঙালীত্ব সেদিন আমার আতিথ্যসৎকারে পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করলে। যখন দাম দিতে গেলুম, মনমরা হয়ে গ্রহণ করলে—রেলওয়ে কোম্পানী নয়ত তার উপর নারাজ হতে পারে, জরিমানা করতে পারে—আমি এই ভয়ের ছবি দেখানতে নিলে।
সুজাতালিদের অনেকটা ইংরেজী রকম রওয়া সওয়া হলেও মেয়েদের পোশাকে-পরিচ্ছদে আচার-ব্যবহারে একটা নিজস্বতা আমায় আকৃষ্ট করেছিল—যেমন অনেক বছর পরে বম্বের তায়েবজী পরিবারেও তাই দেখেশুনে আকৃষ্ট হই। মহীশূরের হিন্দুজগৎ আমার পক্ষে একটি অভিনব জগৎ, অতীতের জগৎ, কাব্য ও চিত্রের জগৎ—আমি তার মুগ্ধ দর্শক মাত্র, মানবিকতায় তার অঙ্গীভূত নই। এখানে এক পার্শি ও এক মুসলমান গৃহের গৃহীদের সঙ্গেই আমার আধুনিকতা ও মানবিকতার জীবন্ত সংযোগ হল। দেখলুম যে, ধর্মের প্রভেদে মানুষে মানুষে মিলের কিছু আসে যায় না—মনের মানুষ তারাই হয় যাদের মনের সঙ্গে মন মেলে, ধর্মের ধ্বজা সেখানে আপনাকে খাড়া করে মানুষকে ধমক দেয় না।
মহীশূর প্রবাসে দু-চার মাস পরে সেখানে দৃষ্ট অতীতের নূতনত্ব ও মোহ যত কমে আসতে লাগল, ততই একটু একটু মন কেমন করতে আরম্ভ করল নিজের বর্তমানের জন্যে, নিজের পারিবারিক আবেষ্টনের জন্যে, পারিপার্শ্বিকের জীবন্ততার জন্যে। এখানে ১লা বৈশাখের দিন কলকাতায় নববর্ষের উৎসবের কথা মনে পড়ে, ভ্রাতৃ-দ্বিতীয়ায় নিজেদের বাড়িতে ভাইবোনের মিলনের কথা মনে পড়ে। ‘নৌরাত্রে’ বাঙলা দেশে দুর্গাপূজার ধুমধাম ও ভাসানের ঘটা মনে পড়ে। খুসী—মিসেস ডি এন রায়—কেন যে স্বামীর সঙ্গে প্রথম প্রথম বম্বে গিয়ে তাঁর প্র্যাক্টিস সেখানে খুব জমে উঠলেও, বাঁধা আয় ও আয়েস ছেড়ে কলকাতায় স্বামীকে ফেরানর জন্যে ছট্ফট্ করে অবশেষে ডাক্তারী তল্পিতল্পাসমেত তাঁকে ফিরিয়ে এনে কলকাতায় স্বগৃহে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তা কতকটা বুঝতে পারলুম।
আর একটা প্রবল ধাক্কা এল। আমার বাড়ির সামনেই রাস্তার ওপারে একজন কণ্ট্রাক্টর একখানা বড় বাড়ি তুলছে—একটা ছোট বাড়ি হয়ে গেছে, তাতে কিছু কিছু লোকজন থাকে। কণ্ট্রাক্টরের একমাত্র ছেলে দূর্বৃত্ত, বাপের পয়সা দুহাতে ওড়ায়। বাপ-মা তাকে শাসনে আনতে পারে না—তারা থাকে শহরের ভিতর ছেলের বৌকে নিয়ে, ছেলে কখন কোথায় থাকে, কোথায় যায় আসে খোঁজ পায় না। একদিন গভীর রাত্রে আমি ঘুমিয়ে আছি—আমার পরিচারিকা—মাদ্রাজী আয়া আমার ঘরে না শুয়ে সিঁড়ির উপরেই ল্যাণ্ডিংয়ে শুয়েছে সেখানে বেশী হওয়া যাবে বলে। হঠাৎ ভয়ানক চীৎকার স্বরে কাঁউ মাউ করে উঠল—তাকে মাড়িয়ে কে পাশের ঘরে ঢুকেছে—যেটা ড্রেসিংরুম। তার চেঁচামেচিতে আমি জেগে উঠে তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলুম—কি হয়েছে? সে বললে পাশের ঘরে লোক ঢুকেছে। ফুটপাতের ওধারে পুলিসের একটা আউটপোস্ট ছিল—কণ্ট্রাক্টরের বাড়িরই পাশে। আমি বারান্দায় গিয়ে ‘পাহারাওয়ালা’ বলে ডাক দিতে দুজন বাড়ির নীচে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে কি হয়েছে? আয়া যা বলেছিল, আমি তাই বললুম। ঠিক সেই সময় ঘর থেকে নীচে লাফাতে গিয়ে পা-ভাঙ্গা লোকটাকে দেখতে পেয়ে তারা ধরে ফেললে। আমার বাড়িতে স্টেট থেকে দেওয়া দুজন সেপাই বা পিয়ন রাত্রে শুত। কলকাতা থেকে আমার সঙ্গে আসা বিপিন বলে একজন পুরানো বাঙালী চাকরও নীচে শুত। তারা এতক্ষণ নিদ্রামগ্ন ছিল, পুলিশের গোলমালে তিনজন সবে জেগেছে। একজন সেপাইকে নরসিং আয়েঙ্গারের বাড়ি ও একজনকে মিস্টার ভাভার বাড়ি খবর দিয়ে পাঠালুম। তাঁরা দুজনেই এলেন সেই রাত্রে, মিস্টার ভাভার সঙ্গে তাঁর কন্যা মেহেরবাঈও এল। এঁরা আমাকে তাঁদের বাড়ি নিয়ে গেলেন তখনি—বাকী রাতটা সেখানেই কাটল। কণ্ট্রাক্টরের ছেলেটার নামে পুলিস কেস হল, তার জেল হল ছমাসের। ব্যাপারটা ঐখানেই শেষ হল, কিন্তু মনে এর রেশের একটা বড় রকম ঢেউ অনেকদিন ধরে খেলতে লাগল। নিউজ-এজেন্সীর মারফৎ খবরটা কলকাতার সংবাদপত্র মহলেও পৌঁছেছিল। ‘বঙ্গবাসী’তে একটা লম্বা মন্তব্য বেরল—মর্ম তার—“এ ঘরের মেয়ের একলা একলা বিদেশে চাকরি করতে যাওয়ার দরকারটা কি? খাওয়াপরার অভাব তো নেই; কেন খামকা নিজেকে এমন বিপদগ্রস্ত করা? এ খালি বিলিতী সভ্যতার অনুকরণ।”
ভেবে দেখলাম কথাটা কতকটা সত্য। বিলিতী গল্প পড়ে পড়ে মনের ভিতর জমে ওঠা একটা সখের হাওয়ার ঘূর্ণিতে অনেকদূর এসে পড়া আমার। দাদাদের সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষায় সমান সুযোগ লাভ করে নরনারীর স্বায়ত্ত জীবিকা অর্জনে সমান দাবী প্রতিপন্ন করাই আমার চাকরী করতে আসার মূল প্রেরণা ছিল না—চেতনার তলায় তলায় সেটা থাকলেও উপর উপর অতি প্রবলভাবে সখই তার প্রধান উপাদান ছিল। একটা cause ধরলে মানুষ তার উপর মজবুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাক্তে পারে—তাতেই তার মনুষ্যত্ব। কিন্তু সখের ভিত্তি, বালুর ভিত্তি—ধ্বসে ধ্বসে যায়, সরে সরে যায়, সখ কিছুদিন পরে মিটে যায়। আমারো ছমাসের পরে মিটে আসতে লাগল।
এর উপর আর একটা দৈব উৎপাত এল—ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলুম। এখানকার সাহেব সিভিল সার্জেনের চিকিৎসা ও ঔষধপত্র চলতে থাকল। বাড়িতে এত বয়স পর্যন্ত এলোপ্যাথী ওষুধ কখনও খাইনি, তার কি রকম স্বাদ, তা জানতুমই না। বাবামহাশয় হোমিওপ্যাথির ঘোরতর বিশ্বাসী ও ভক্ত। আমাদের অল্পস্বল্প অসুখ হোক বা বেশী হোক, ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার বা ডাক্তার সল্জার ছাড়া কাউকে ডাকা হয় না। বিশ বৎসর বয়সের পর জীবনে প্রথম এলোপ্যাথী ওষুধের সঙ্গে আমার শারীরিক পরিচয় হল। মা-দের কাছে টেলিগ্রাম গেল। মা তখনো সাতারায় ছিলেন। সেখান থেকে তিনি এলেন অসুখে আমার তত্ত্বাবধানের জন্যে। একটু ভাল হলে সিভিল সার্জেন মাকে বললেন, আমায় মহীশূরে রাখা এখন সমীচীন নয়, স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া উচিত—এখানে এই সময় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশী। তিন মাসের ছুটি নিয়ে মা-র সঙ্গে প্রথমে সাতারায় গেলুম আমি। তিন মাসের পর মহীশূরে এসে আর তিনমাস থেকে এক বছর পূর্ণ হলে কাজে ইস্তফা দিয়ে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরলুম। কলকাতায় যেখানে যাই, যার সঙ্গে দেখা হয়, সে-ই ঠাট্টা করে—“চাকরীর সখ মিটল? স্বাধীন হবার সখ মিটল?’’
চাকরীর সখ মিটেছিল বটে, কিন্তু স্বাধীন হবার সখ মেটেনি। শুধ, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সখ ব্যাপক হয়ে জাতি ও দেশগত স্বাধীনতার সখের রূপ নিলে। সখ আর সখমাত্র রইল না, cause-এর আকার ধারণ করলে। আমার নিজের পায়ে ভর করে দেশান্তরে গমন ও অবস্থানে যে মানসিক পুষ্টিবর্ধন হল, সে পুষ্টি যাঁর ইচ্ছায় সাধিত হয়েছিল, তারই ইচ্ছায় যন্ত্রচালিতবৎ হয়ে আমার জীবনতরী চলল ও দেশকে চালনা দিলে এক নুতন অজানিত পথে, যার শেষ আজও দুর্লক্ষ্য।