পনর

মহীশূর

মহীশূর বাসে যে ভারত আমার হৃদয়ে প্রতিভাত হল সে এক অপূর্ব নূতন। “একালে সেকাল” নাম দিয়ে তার ছবি এঁকেছিলুম তখন ‘ভারতী’তে। এ যুগের ভারত নয় যেন সে, সেই সংস্কৃত নাটক ও কাব্যের যুগের।

 মহারাণী গার্লস স্কুলের সঙ্গীতাচার্যের কাছে আমি নিজেই বীণা শেখার প্রার্থী হলুম। এমন সুযোগ কি ছাড়তে পারি? প্রথমদিন যখন তাঁর কাছে গেলুম—দেখলুম মাটিতে বড় মাদুর বিছান রয়েছে, তার একধারে তিনি বসে আছেন, একধারে আমার জন্যে জায়গা খালি রয়েছে—মাঝখানে দুটি রুদ্রবীণা। একটি হাতে তুলে নিয়ে—হিন্দী ইংরেজী অনভিজ্ঞ আচার্য সংস্কৃতে “তত্র ভবতি” বলে আমায় অভিবাদন করে বল্লেন—“তন্ত্রী-ত্রুটিতা।” চমকে গেলুম। কালযন্ত্র কি চার-পাঁচশত বছর পিছিয়ে গেছে? আমি কি সংস্কৃত সাহিত্য কাব্য থেকে বেরিয়ে আসা একটি নায়িকা? আমার আশেপাশে সব মেয়েদের বেণীতে কুন্তলে ফুল জড়ান, সুগন্ধি দ্রব্য দিয়ে মাথা ঘষে একটা হালকা যন্ত্রে অল্প অগ্নি রেখে যন্ত্রটি হাতে করে চুলের ভিতর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চুল শুকন—এ সবে কি মেঘদূতের এক একটি বর্ণনা চোখের উপর ভেসে উঠল না? এমন আরও কত কি! যাঁরা কবি কালিদাসকে বাঙালী বলে দাবী করতে চান দক্ষিণ ভারত অঞ্চলে আজ পর্যন্ত প্রবহমান অনেক কিছু আচার ও রীতি দেখে আমার ত মনে হল না তাঁদের দাবী সমূলক। বাঙালীর লোভটা বড় বেশী! কাজ কি আমাদের টানাবোনা করে, নানা কুতর্কে কষ্টপ্রমাণে প্রমাণিত করার চেষ্টায় যে কালিদাস বা ভবভূতি—সবাই বাঙালীর পূর্বপুরুষ—ভারতের অন্য প্রদেশবাসীর নয়? কবি জয়দেবের মত অত বড় ভারতবিশ্রুত কবি থাকতে আমরা আরো কাউকে আমাদের বংশাবলীভুক্ত করতে কেন লালায়িত হব? এ যেন প্রসন্নকুমার ঠাকুরের চেষ্টারই সমতুল্য প্রয়াস যে, শাণ্ডিল্য গোত্রের কবি ভট্টনারায়ণ কেবল শাণ্ডিল্য ‘ঠাকুর’দেরই পূর্বপুরুষ—সারা বঙ্গদেশব্যাপী শাণ্ডিল্য গোত্রের বন্দ্যোপাধ্যায় মাত্রের নয়? আশা করি এমন একদিন আসবে না যেদিন বাঙালী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথে সন্তুষ্ট না থেকে সেক্সপীয়র বা গেটেকে ধরেও টানাটানি করবে বাঙালী বলে প্রতিপাদন করতে।

 আমি মহীশূরে যেদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করি সেই দিকেই দেখি অতীত আজও মূর্ত হয়ে আছে। আমার মুগ্ধতায় প্রীত হয়ে দরবার বক্সি সাহেব আমার showman হয়ে আমায় চারিদিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি একজন সংস্কারক। যেখানে অতীত সংস্কারের প্রাচীর এখনও অত্যন্ত দৃঢ় প্রথমেই সেইখানে আমায় নিয়ে গেলেন—মহারাজার কাছ থেকে খাস অনুমতি নিয়ে—পুরুষদের সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শনে। ঘোর সনাতনী পণ্ডিতগণের মধ্যে আমাকে নিয়ে গিয়ে ফেলে অনুরোধ করলেন—“উপনিষদ থেকে দু-একটা মন্ত্র শোনাবেন এঁদের।” দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ সংস্কৃত-অধ্যাপকেরা স্তম্ভিত। প্রথমত এক স্ত্রীলোকের দ্বারা তাঁদের অধ্যাপনাগৃহের দূর্গভেদ—তার উপর তার মুখে বেদ উপনিষদের আবৃত্তি শ্রবণ! স্বয়ং ব্রাহ্মণ নরসিং আয়েঙ্গারের এই অব্রাহ্মণ্য প্রস্তাবে তাঁরা চঞ্চল হয়ে পড়লেন। কিন্তু দরবার বক্সি তিনি, মহারাজের দক্ষিণ হস্ত, তাঁর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কোন আপত্তি তুলতে সাহস পেলেন না। স্ত্রীমুখে বেদপাঠ তাঁদের শুনতেই হল। আমি ব্রাহ্মধর্মগ্রন্থে কর্তাদাদামশায়ের সঙ্কলিত মন্ত্র থেকে দু-চারটি শোনালুম। সৌভাগ্যবশত আমার বৈদিক উদাত্ত অনুদাত্তাদি স্বর ও সংস্কৃত বর্ণমালার উচ্চারণ বাঙালী সংস্কৃতজ্ঞসুলভ অশুদ্ধ ছিল না। তার কারণ যোড়াসাঁকোতে অনেকগুলি দাদাদের একত্রে উপনয়ন সংস্কারের সময় যখন গুরু হেমচন্দ্রের সমীপে কয়দিন বাসকালে এবং তার পূর্বে ও পরেও দুই একমাস ধরে তাঁদের এই মন্ত্রগুলি সম্পূর্ণরূপে কণ্ঠস্থ করান হয়— আমি কর্তদাদামশায়ের কাছে আবদার ধরেছিলুম—“আমাকেও শেখান হোক।” ছেলেদের শিক্ষা সমাপ্ত হলে ওঁদের মধ্যে এ বিষয়ে যিনি শ্রেষ্ঠ গণ্য হয়েছিলেন সেই ন-মামার একমাত্র পুত্র বলুদাদাকে কর্তাদাদামশায় আদেশ করেছিলেন আমায় বাড়িতে এসে নিখুঁতভাবে ঐ মন্ত্রগুলি পড়তে শেখাতে। আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যেরা যে স্বরে ও প্রকারে বেদীতে বসে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতেন—তা দক্ষিণী ও বেনারসী পণ্ডিতদের স্বর ও প্রকার—বাঙালী অধ্যাপক পণ্ডিতের নয়। দাদামশায় বহুব্যয়ে তাঁদের আনিয়ে আচার্যপদে নিযুক্ত করেছিলেন। সুতরাং মহীশূরের পণ্ডিতেরা আমার উচ্চারণে তাঁদের উচ্চারণ থেকে কোন প্রভেদ পেলেন না। একালে মেয়ের মুখে উপনিষদ শোনায় একটা সংস্কারগত আঘাত লাগলেও শ্রতিগত ব্যথা পেলেন না। শুক্ল না যজুর্বেদীয় মন্ত্র বল্লুম—সেই সম্বন্ধে আমার সঙ্গে সংস্কৃতে খানিকক্ষণ আলোচনা করলেন। আমি ব্যাকরণ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে যতটা পারি উত্তর দিলুম। নরসিংহ আয়েঙ্গার মহা খুশী হয়ে আমায় তারপর নিয়ে গেলেন সাংখ্যের ক্লাসে। সাংখ্যের পণ্ডিত আমায় অপ্রতিভ করার জন্যে আমন্ত্রণ করলেন শিষ্যদের কোন প্রশ্ন করতে। আমি তাতে প্রথমে অগ্রসর হলুম, কারণ আমার সংস্কৃতে কথোপকথন চালানর শক্তির উপর বেশী জোরজুলুম করতে ভীত হচ্ছিলুম। কিন্তু অবশেষে নরসিং আয়েঙ্গারের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে সাংখ্যকারিকা থেকে একটি প্রশ্ন করলুম। অধ্যাপক বলে উঠলেন—‘সাধু! সাধু!” কিন্তু শিষ্যেরা তাঁর উত্তর দিতে একটু থতমত খেয়ে গেল। নরসিং আয়েঙ্গার গর্বে ফুলে উঠলেন, সেদিনকার মত আমার পর্যটন শেষ হল।

 মহীশূরে গিয়ে ঠেকে অনুভব করেছিলুম বাঙলার স্কুল কলেজে বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের যে সংস্কৃতে কথাবার্তা কওয়ানর অভ্যেসটা একেবারে বাদ দেওয়া হয় সেটা একটা মস্ত ত্রুটি। বিদ্যাসাগর মশায়ের উপক্রমণিকা থেকে সেকালে সংস্কৃতের শিক্ষারম্ভ হত আমাদের। তাতে ফলং ফলে ফলানি, জলং জলে জলানি—এইসব আওড়িয়ে আওড়িয়ে মুখস্থ করাই ছিল কাজ। বিশেষ্য বিশেষণ ও ক্রিয়াপদ জুড়ে এক একটা সেণ্টেন্স রচনা করার পন্থাই ছিল না তাতে। মহীশূর স্কুলে মহারাষ্ট্রীয় স্কলার ভাণ্ডারকারের যে বই সংস্কৃতের প্রথম পাঠ্য তাতে দেখলুম আরম্ভ থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা সংস্কৃতে অল্প অল্প কথোপকথনে অভ্যস্ত হয়। ঠিক য়ুরোপের অলেনার্ফের বইয়ের মত এটি। সে বইখানি য়ুরোপের সর্বভাষায়—ফ্রেঞ্চ জার্মান ইতালীয়ান প্রভৃতিতে ইংরেজদের কথোপকথন চালাতে শেখানর জন্যে প্রসিদ্ধ। প্রথমেই কানে শোনার মত ‘direct method’এ কতকগুলি সেণ্টেন্সের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়—তারপরে ব্যাকরণের জটিলতায় প্রবেশ করান হয়। বাঙলা স্কুলকলেজেও এই দরকার।

 দ্বিতীয় ত্রুটি-কলকাতা যুনিভার্সিটির অধীনে সংস্কৃত প্রথম পাঠ্য পুস্তক থেকে আরম্ভ করে শেষ পাঠ্য পুস্তক পর্যন্ত সবই দেবনাগরী লিপিতে নয়—বাঙলা লিপিতেই লিপিবদ্ধ। ছাত্র-ছাত্রীরা এমন কি টোলের পণ্ডিতেরাও দেবনাগরী অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত নন। য়ুনিভার্সিটির পরীক্ষায় বাঙলা অক্ষরে লিপিবদ্ধ প্রশ্নের উত্তরও তাতেই দেওয়া হয়। কোন সংস্কৃত পুস্তক আসল সংস্কৃত অক্ষরে পড়তে গেলেই তাঁদের আটকে যায়। দেবনাগরী অক্ষর পড়তেই পারেন না, ত লিখতে পারা ত আরো দুঃসাধ্য। আমি পড়তে পারতুম—কিন্তু লেখা আমারও অভ্যেস হল অনেক বিলম্বে মহাত্মা গান্ধীর তত্ত্বাবধানে। তিনি এ বিষয়ে রীতিমত taskrmaster হলেন আমার—চরখা কাটার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে প্রতিদিন খানিকটা সময় যাপন করতে হত।

 তৃতীয় ত্রুটি—বিকৃত উচ্চারণের। বাঙলার টোলের পণ্ডিতদের কেউ কেউ সংস্কৃতে অনর্গল ব্যাকরণশুদ্ধ কথা কইতে পারেন দেখেছি। কিন্তু কি কর্ণ-পীড়ক অবিশুদ্ধ উচ্চারণ! অ-আর ভেদ নেই, লম্বা টান ছোট টানের ভেদ নেই, হ্রস্বদীর্ঘর ভেদ নেই, ই-ঈর ভেদ নেই, বর্গীয় ‘ব’ ও অন্তঃস্ত ‘ব’য়ের ভেদ নেই, শ ও স-এর ভেদ নেই, ন ও ণ-য়ের ভেদ নেই। ‘ভেদরিপুনাশিনী মম বণী’ বলা যেতে পারে বাঙালীর কণ্ঠনিঃসৃত সংস্কৃতকে। কিন্তু এটা স্থল নয় অভেদবুদ্ধি চর্চার। তাতে শুধু সারা ভারতবর্ষের কাছে হাস্যাস্পদ হতে হয়। মনে পড়ে আমি ছাড়া একমাত্র হেম—শিবনাথ শাস্ত্রীর কন্যা—ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে পঞ্জাবে ও পশ্চিমে যাওয়া উপলক্ষে ওদেশী মেয়েদের সংস্রবে আসায়—ক্লাসে বিশুদ্ধ উচ্চারণে সংস্কৃত পড়ার বিষয়ে অবহিত ছিল। বেথুন স্কুলে, ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে ও সঙ্গীত সম্মিলনী প্রভৃতি নানা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃপক্ষরা যখনই মেয়েদের বেদগানে প্রস্তুত করার ভার আমার উপর দিয়েছেন—তখনই এই চিরাভ্যস্ত বিকৃত উচ্চারণের সংকীর্ণ বাঙালীপথ থেকে বিশুদ্ধ উচ্চারণের ভারতীয় রাজপথে আনতে অনেকটা কষ্ট পেতে হয়েছে। ভারত স্ত্রী-শিক্ষা-সদনে আমি এ বিষয়ে সংস্কৃত অধ্যাপককে পুনঃ পুনঃ সতর্ক করে দিয়েছি।

 স্টেট থেকে আমি যে বাড়ি পেয়েছিলুম থাকার জন্যে, ভারী সুন্দর, ছোটখাট, দোতালা। নীচে ড্রইং রুম ও খাবার ঘর, উপরে দুটি শোবার ঘর—যার একটি ড্রেসিংরুমে পরিণত হয়েছে, স্নানের ঘর ও বারান্দা। সব ঘরগুলিতেই সুন্দর ওয়াল-পেপার লাগান। কাছেই ব্রাহ্মণদের ‘অগ্রহার’—অর্থাৎ রাজ সরকারের দান, নিষ্কর ব্রাহ্মণ-পল্লী। মহীশূরের ক্ষত্রিয় রাজবংশের অধিকাংশ প্রজাই হয় শিবোপাসক ব্রাহ্মণ বা লিঙ্গায়ৎ এবং জৈনী। দুই শ্রেণীর মেয়েদের শাড়ি পরার ধরনে ও কপালে তিলকচর্চায় পার্থক্য আছে—দেখলেই চেনা যায় কে কোন্‌ ঘরের মেয়ে। ইস্কুল দুবার করে বসে—একবার সকালে, একবার বিকেলে। অধিকাংশই

বিবাহিত মেয়ে, কেউ বা অনেক ছেলের মা। সকালে মেয়েরা প্রায়ই বাসী সূতির ছাপান কাপড়ে আসে। দুপরে বাড়ি ফিরে স্নানাদি করে শুচি হয়ে মৈসোরি সুন্দর সুন্দর পাকা রঙের রেশমী কাপড় পরে আসে। যাই পরুক একটা পারিপাট্য, একটা সহজ সৌষ্ঠবে ভরা। কোমরে সকলেরই প্রায় শাড়ির উপর একটা রূপার ঘুঙ্গুরদার বেল্ট। কারো কারো সেটা খাঁটি সোনার। গায়ে খুব বেশী গয়না নয় -নাকে কানে হীরা বা মুক্তার ফুল ও নাকছাবি, হাতে দু-একগাছি চুড়ি। সোনা মোতি হীরের চুড়ি হোক আর না হোক সধবাদের হাতে কাঁচের চুড়ি থাকতেই হবে—আমাদের নোয়ার মত—সেইটিই তাদের সধবাত্বের লক্ষণ। বিধবারা কাঁচের চুড়ি পরে না, সোনার পরতে পারে। শ্রেণীবিশেষে কিছু কিছু পার্থক্যও দেখা যায়। পূজাপার্বণের দিন মন্দিরে গিয়ে পূজা দেওয়া ও দেবতা দর্শন মেয়েদের নিয়মিত কাজ। রাস্তায় মেয়েদের হাঁটা, চলাফেরা অন্যান্য দৈনিক দৃশ্যের একটি অন্যতম। কোন পথেচলা মেয়ের প্রতি কোন পথেচলা পুরুষের বাঁকা দৃষ্টি নেই। যা নিত্যনৈমিত্তিক সাধারণ ঘটনা, সেটা অসাধারণ শূন্যতায় কোন পুরুষ বা বালকের ঠাট্টা-বিদ্রুপ বা টিটকারির কারণ হয় না। এদের বার মাসে হিন্দুর তের পাবণ ত বাঁধা আছেই—উপরন্তু সম্প্রদায়-বিশেষের অতিরিক্ত বিশেষ পর্বদিনও আছে। এই পর্বগুলি ভারতবর্ষকে কেমন একসূত্রে গেঁথে রেখেছে সেইটে লক্ষ্য করলুম।

 বাঙলার গৃহে গৃহে যেদিন বোনেরা ভাইদের কল্যাণ কামনায় ভাই দ্বিতীয়া করে—এখানেও সেদিন সেই উৎসবের আনন্দ। ঘরে ঘরে বিশেষ পক্কান্ন প্রস্তুত হচ্ছে, ঘরে ঘরে ভাইরা বোনদের আশীর্বাদী বা প্রণামী দিচ্ছে, ঘরে ঘরে এক মা-বাপের সন্তানদের—পুত্র ও কন্যার জন্মগত ঐক্যবন্ধনে আর একটি করে গাঁট বাঁধা হচ্ছে। নব্যসভ্যতার যুগে খ্রীস্টান জগতের অনুকরণে ভারতবর্ষের এই সকল পারিবারিক প্রীতিবর্ধক উৎসবগুলি অনেক পরিবার থেকে উঠে যাচ্ছে। আমাদের কালেও দেখছি কোন কোন স্থলে এটা একটা লেনদেনের মধ্যে গণ্য হয়ে হিসেব খতিয়ে দেনাপাওনা মেটান হয়, বোনের বাড়ি গিয়ে তার স্নেহমাখা অন্ন ও বস্ত্র গ্রহণ না করেই তাকে হিসেব কাটাকাটি করে টাকা ধরে দেওয়া হয়। হায় এ কালের অভাগ্য ভাই ও অভাগিনী বোন। যে নিঃস্বার্থ নিগূঢ় নির্মল ভালবাসার দুটি স্রোত হৃদয়ে সারা বছর সঞ্চিত মালিন্যের মাটি খুঁড়ে দুদিক দিয়ে বের হয়ে বিশুদ্ধ মিলন চাইছিল—বছরের একটি দিনও আর সে অবসর পেলে না।

 বাঙলা দেশেই বোনেরা সেদিন ভাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান, কিছু না কিছু উপহার দেন। কিন্তু বাকি সারা ভারতবর্ষে—দক্ষিণে উত্তরে পশ্চিমে—সেদিন ভাইরাই বিশেষ করে বোনকে কিছু না কিছু দ্রব্য বা অর্থ দেন। বোন শুধু সিদুঁর চন্দনের টিপ এবং মিষ্টান্ন ভাইয়ের জন্যে প্রস্তুত রাখেন, আর একগাছি মঙ্গলসূত্র ভাইয়ের হাতে বেঁধে দেন। যদি ভাই বিদেশে থাকেন, তবে ডাকযোগে যথাদিনে তাঁর হাতে পৌঁছিয়ে দেন—খ্রীশ্চানদের নিউ-ইয়ার্স বা ক্রীসমাস কার্ডের মত। বাঙলার দায়ভাগ ও অন্যান্য প্রদেশের মিতাক্ষরাজনিত উত্তরাধিকারগত পার্থক্যের সঙ্গে ভ্রাতৃ-দ্বিতীয়াতে ভাইবোনদের পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিকোণের পার্থক্যের সূক্ষ্ম যোগ আছে কি? মোটের উপর দেখেছি, বঙ্গেতর বাকি ভারতবর্ষে কন্যা ও ভগ্নীর প্রতি পিতামাতা ও ভাইয়ের স্নেহশীলতা ও দেওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। যেন যত দাও কিছুতেই পর্যাপ্ত দেওয়ার তৃপ্তিবোধ হয় না। সে-সব দেশে আমাদের দেশের মত বরপণ-প্রথা ছিল না, শ্বশুরকুল থেকে কোন রকম দাবী আসত না, কারণ দেশাচার ও কুলাচার দাবীর অপেক্ষা না রেখে স্বতই মেয়েদের যথাসাধ্য দিত। শুধু বিয়ের সময় নয়, মেয়ে যতবার পিতৃগৃহে আনাগোনা করত ততবারই। মেয়েকে দেওয়ার রীতির এত বাড়াবাড়ি ছিল যে, রাজপুতবংশে সেই জন্যে মেয়েকে একবার জামাতার হস্তে সমর্পণ করে আর কোন দিন বাড়ি আনতে সাহস করত না, পাছে তাতে বাপের আত্মসম্মান রক্ষার্থে প্রায় সর্বস্বান্ত হতে হয়। অবস্থা বুঝে পিতৃভক্ত মেয়েও সেইজন্যে আসতে চাইত না—জানত তাতে মা-বাপকে কত বিপন্ন করা হবে। আর ‘কুমারী’ অবস্থায় কন্যার আদরের কথা বলেই শেষ হয় না। দুর্গাপূজায় যে ‘কুমারীপূজা’ বিহিত আছে সেই—দেবীপ্রতিমা চক্ষেই হিন্দু-ভারতে কন্যাকে দেখা হয়। এমন কি, কন্যা পিতামাতা বা বড়ভাইদের পাদস্পর্শ করে কখনো প্রণাম করে না—তাতে তাঁদেরই অকল্যাণ-ভয়—পুত্রবধূরা বা ছোটভাজেরা করে। ছোট ছোট খুঁটিনাটির পার্থক্যগুলির ভিতর দিয়ে যে একটি সাধারণ ঐক্যসূত্র দেখা যায়, সেই ঐক্যে হিন্দু-ভারত পালপার্বণে বাঁধা।

 মহীশূরে দেওয়ালীতে আর একটি মিলনসূত্র পেলুম, যদিও তারও ভিতর পার্থক্য আছে। বঙ্গেতর ভারতের সর্বত্র দেওয়ালী শুধু রাত্রে আলো জ্বালান ও বাজি-পোড়ানর দিন নয়—এটি নতুন খাতার দিন। আর আমাদের বিজয়াদশমী দিনের মত এটি আত্মীয়-বন্ধুদের পরস্পরের মনোমালিন্য মুছে ফেলে সৌহার্দ্যে পুনর্মিলনের দিন। আরও একটি অনুষ্ঠানে সেদিনটি সকলের বুক ভরে দেয়—লক্ষ্মীর পূজায়। দেওয়ালীতে জুয়াখেলা স্বগহে লক্ষ্মীর আবাহনেরই প্রকারান্তর। প্রতি গৃহটি সেদিন খোলার ঘর হোক বা অট্টালিকা হোক নিকিয়ে সারাদিন ধরে সারা বছরের সঞ্চিত আবর্জনা সাফ করে, আলপনায় গহখানি সুচিত্রিত করে, রাত্রে লক্ষ্মীর শুভাগমনের জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়। একে বলে “দেওয়ালী কি সফাই।” ইংরাজদের ‘Spring cleaning’-এর আর এক রূপ। একজনের কাছে গল্প শুনলুম, সে বছর এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে এই রকম ঘরে ঘরে দেওয়ালিকি সফাই হয়েছে। এক গরীব ব্রাহ্মণ ও তার ব্রাহ্মণী দুজনে অতি ভক্তিভরে গোবর দিয়ে তাদের ঘরখানি নিকিয়ে উঠানের জঞ্জাল পরিষ্কার করে লক্ষ্মীর প্রতীক্ষায় জেগে বসে আছে। সে গ্রামখানির ছোট-বড় প্রতি ঘরে ঘরে এইরূপ জাগরণ চলেছে। এদিকে লক্ষ্মীঠাকরুণ তাঁর ঝাঁপি হাতে করে চুপি চুপি এসে প্রতি ঘরের জানলা দিয়ে ভিতরে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখছেন। কোনটিই তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। অবশেষে সেই গ্রামের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের খানার ঘরের টেবিলের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ল। কি শুভ্র শ্বেত চাদরখানি বিছান মেজে, কি ঝকঝকে কাঁচের গেলাসে ও রূপার কাঁটা চামচেতে সাজান ভোজন স্থান, কি সুন্দর আলোতে ও ফুলেতে সুশোভিত। দেখে দেখে মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্মী সে রাত্রি সাহেবের সেই ভোজন-মন্দিরে ঢুকে সেইখানেই বসে পড়লেন। গরীব ব্রাহ্মণদের গোবর নিকিয়ে লক্ষ্মীর আশাপথ চেয়ে চেয়েই রাত্রি কাটল।

 পঞ্জাবে দেখেছি দেওয়ালীতে লক্ষীপূজার সময় কোন কোন গৃহে পুরোহিতের সাহায্য ব্যতিরেকে গৃহস্বামী ও গৃহিণী নিজেরাই পূজা নির্বাহ করেন। যেখানে স্ত্রী নিজেই পুরোহিত, সেখানে পূজার পদ্ধতিটিও মেয়েলী, সহজ, সাদাসিদে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা বড় বড় সংস্কৃত মন্ত্রে যা বলেন মাতৃভাষায় তারই সরল ভাষান্তর। একবার একটি পরিবারে বসে দম্পতির দুজনে মিলে পূজা করা দেখেছিলুম। তাঁদের দুজনের আসনের সামনে লক্ষ্মীর একটি প্রতিমা অর্থাৎ মাটির একটি ছোট পুতুল, তাঁর আশেপাশে অন্যান্য নানা পতুল নানা দেবদেবীর মূর্তি—যা দেওয়ালীর বাজারে পাওয়া যায়, বাড়ি বাড়িতে সবাই কিনে রাখে। মাটির এক পঞ্চপ্রদীপ—তাতে তেল সলতে দিয়ে আলো ধরান। একখানা রূপার থালায় অনেকগুলি চকচকে রূপার টাকা, আর একখানিতে ফুল, জল, ধান্য, খই, মিষ্টান্ন প্রভৃতি। গৃহিণী একটি ফুল তুলে লক্ষ্মীমূর্তির দিকে চেয়ে বল্লেন—লক্ষ্মী আয়ি! স্নানং! নমা।

 লক্ষীর একেবারে সাক্ষাৎকরণ হচ্ছে—আসার প্রতীক্ষা মাত্র নয়, একেবারে এসেছেন, ঐ যে দেখা যাচ্ছে! অভ্যাগতের সৎকার হোক। স্নান করাও!

 —স্নানং! নমা-নমস্কার!

 ইতিমধ্যে ছাদের উপর চাকরের সাহায্যে দীপাবলী সাজিয়ে ঘরে এসে, মা-বাপকে ঘিরেবসা ছেলেমেয়েরা মায়ের ও বাপের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীর গায়ে জলসিঞ্চন করে নমস্কার করলে।

 তারপর গৃহিণী বল্লেন—লক্ষ্মী আয়ি! পুষ্পং! নমা!

 দেবী গৃহগতা! তিনি সাক্ষাতে বিরাজমানা! ছবিতে যেমন স্বামী বা পুত্র সাক্ষাতে বিরাজমান হন তেমনি এই পুতুলে লক্ষ্মী!

 সকলে তাঁকে পুষ্প প্রক্ষেপ করে নমস্কার করলেন।

 এবার—লক্ষ্মী আয়ি! ধূপং দীপং নমা!

 ধুপকাটি জ্বালিয়ে ঘোরান হল, দীপ দেখান হল।

 লক্ষ্মী আয়ি! নৈবেদ্যং! নমা।

 নৈবেদ্যের থালি তুলে লক্ষ্মীকে আহার্য নিবেদন করা হল, নমস্কার করা হল।

 তারপর গৃহপতি—

“ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনং
উর্বারকমিব বন্ধনান্‌ মৃত্যোর্মোক্ষয়েদামৃতাৎ। ওঁ”

মানে না জেনেই প্রাণপ্রতিষ্ঠার এই সংস্কৃত মন্ত্রটি বল্লেন। তাদের মন্ত্রচৈতন্য বা শব্দার্থ-বোধ অর্থাৎ সম্মুখস্থ লক্ষ্মী-মূর্তিকে অন্তরে অনুভব হয়ে গেছে এবং ভাবের গাঢ়তায় তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠাও করে ফেলেছেন তা জানেন না। শেষকালে সপরিবারে “জয় জগদীশ হরে” এই আরতির গানটি গেয়ে পূজা সমাপন হল। গৃহিণী নিজের মনে খানিকক্ষণ লক্ষ্মীকে ধ্যান করলেন। আসন ছেড়ে উঠবার আগে আমাকে ধরলেন—“একটি কিছু মন্ত্র আপনিও বলুন। আমার একটি জানা ছিল, আমি সেইটি বল্লুম ও মানে বুঝিয়ে দিলুম —

ওঁ ত্রৈলোক্যমাতরং হ্রীং শ্রীং স্বাহা!

 “যিনি ত্রিলোকের মা, ত্রিলোককে অন্ন দেন, বল দেন, পুষ্টি দেন— তাঁকে হ্রীংয়ে—অন্তরে হৃদয়ে অনুভবে এনেছি। তিনি বাইরে শ্রী হয়ে materialised হয়ে ধনে ধান্যে, সোনায় রূপায় অন্নসম্ভারে রূপ ধরে প্রকাশ হোন।”

 তারা ভারি খুসী হয়ে এই মন্ত্রটি লিখে নিলে, পর বৎসর থেকে তাদের পূজাবিধির অঙ্গীভূত হল।

 গৃহিণীটি প্রাক্তন আর্যসমাজভুক্ত স্বামীকে সনাতনী করে ফেলেছেন। বল্লেন—“প্রত্যেক গৃহস্থের দরকার লক্ষ্মীপূজা ও শক্তিপূজা। এ দুই ছাড়া সংসারে কার চলে?” ধর্মসংস্কারকদের তর্কবিতর্কের ভিতর তিনি নেই—তাঁর আছে সংসারী গৃহিণীর প্র্যাকটিক্যাল কমন সেন্স। গৃহপতি বললেন—“আর্যসমাজ ব্রাহ্মসমাজাদির ক্রিয়াক্রমে আর তাঁর আস্থা নেই। তাদের tenets হচ্ছে—negation of everything. positive কোন কিছুর আশ্রয় দেয় না গৃহস্থকে।”

 মহীশূরে ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য অত্যধিক। সেখানে পুরোহিতের মধ্যস্থতায় ছাড়া কোন পূজা হতে পারে—মেয়েরা নিজেই করতে পারেন, তার পরিচয় পাইনি। তাঁরা মন্দিরে যে পূজাদ্রব্য নিয়ে যেতেন তা পুরোহিতের দ্বারা নিবেদিত হত।

 প্রত্যেক উৎসবের দিন স্কুলের কোন-না-কোন বড় মেয়ে বা শিক্ষয়িত্রী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত, হাতে উৎসব-ভোজের কিছু না কিছু নিদর্শন নিয়ে আসত। মাঝে মাঝে তিন-চারজন একত্রে এসে, বীণা সঙ্গে করে এনে আমায় গান ও বাজনা শুনাত। তাদের বীণার ঝঙ্কারের সঙ্গে গাওয়া একটি গান আমার মনে পড়ে—সেটি তেলেগু নয়, হিন্দী—

“সত্যলোকসে নারদ আওয়ে!
নারদ বীণ বাজাওয়ে!
আরে আরে নারদ বীণ বাজাওয়ে!
আরে আরে নারদ বীণ বাজাওয়ে।”

 শুধু এই কটি কথা—কিন্তু ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে গেয়ে গেয়ে অফুরন্ত! সত্যলোক থেকে নারদ যে বীণা হাতে করে নামছেন—তাঁর বীণার ঝঙ্কার শুনা যাচ্ছে—একেবারে realistic!

 দুই একটি মেয়ে বেহালা বাজাতে পারত। আমিও লরেটোতে প্রফেসর মাঞ্জাতা বলে একজন ইতালীয়ান মাস্টারের কাছে বেহালা শিখতে আরম্ভ করেছিলুম—বি-এ পাসের পরে। ইন্দিরাও তাঁর কাছে শিখতেন, যদিও তিনি অনেক আগে থেকেই সোলাপুরে একজন সাহেবের কাছেই আরম্ভ করেছিলেন। সে য়ুরোপীয় বেহালা বাজানর ধরনে ও মহীশূরী বেহালা বাজানর ধরনে অনেক তফাৎ। য়ুরোপীয় বেহালায় হাত পাকতে সারাটা জীবন যায়। বেহালা যার অঙ্গের অঙ্গী না হয়, চারটে তারের উপর ছড়ি বুলিয়ে বেহালার কাঠখানার থেকে সঙ্গীতের দেবদেবীদের বাইরে বের করে আনা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কাটাছাঁটা ঠিক ঠিক স্বর বের করা যেতে পারে; কিন্তু প্রাণ থাকে তার বহু দূরে। কিন্তু মহীশূরী বেহালায় চারটি তারের স্বরগ্রাম সাজানর প্রভেদেই দেখলুম বাজনায় প্রাণ ফোটানতে সহজসাধ্যতা এসে পড়ে। আর মীড়ে মীড়ে হাত উঁচু-নীচু সরানতেই আমাদের রাগরাগিণীর রূপ একেবারে ফুটে ওঠে—বিলিতি ধরনে বাজানতে তাদের অঙ্গলাবণ্য যেন বিদেশী পোশাকে ঢাকা পড়ে থাকে। এদেশে এ যন্ত্রকে বেহালা বা violin বলে না, fiddle বলে। বোধহয় পর্তুগীজদের কাছে দক্ষিণীরা এ যন্ত্রটি প্রথম বাজাতে শিখে নিজেদের প্রয়োজনমত তারবাঁধার রকমটি বদলে নিয়েছে ও বীণার তারের মত এতে মীড় ফুটিয়েছে। এখানে মেয়েদের হাতে যখন বেহালা শুনতে থাকলুম একটা ব্যথা বাজতে লাগল কোথায়! এদেশের রুদ্রবীণায় পেলুম গাম্ভীর্য, বেহালায় পেলুম সকরুণতা।

 মেয়েরা আমার সঙ্গে কোন্‌ ভাষায় কথা কইত? ইংরেজীতে—আমি তেলেগু জানিনে, তারা হিন্দি জানে না। তাদের অবাধ ইংরেজী কথোপকথনও একটা বিস্ময় আনলে। শুনেছিলুম মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে সকলেই প্রায় ইংরেজী বলে—সে ছোটলোকী ইংরেজী—নাম তার ‘পিজিন ইংলিশ’। এদের শিক্ষিত ইংরেজী। কিন্তু এরই ভিতর মাঝে মাঝে হাস্যরসের সৃষ্টি হত। একদিন আমায় একটি স্কুলের মেয়ে জিজ্ঞেস করলে—আমায় যে uncle পৌঁছতে এসেছিলেন, তিনি matricide না patricide?