১৭

 ছবি আঁকা শিখতে কদিন লাগে? বেশি দিন না, ছ-মাস, আমি শিখিয়েছিও তাই। ছ-মাসে আমি আর্টিস্ট তৈরি করে দিয়েছি। এর বেশি সময় লাগা উচিত নয়। এরই মধ্যে যাদের হবার হয়ে যায়—আর যাদের হবে না তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত; হ্যাঁ, মানি যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে একটা নির্ধারিত সময় লাগে—তার পরে, ব্যস, উড়ে যাও, হাঁসের বাচ্চা হও তো, জলে ভাস। ছবি আঁকবে তুমি নিজে, মাস্টারমশায় তার ভুল ঠিক করে দেবেন কি? তুমি যে রকম গাছের ডাল দেখেছ তাই এঁকেছ। মাস্টার মশায়ের মতন ডাল আঁকতে যাবে কেন? তরকারিতে নুন বেশি হয়, ফেলে দিয়ে আবার রান্না কর; পায়েসে মিষ্টি কম হয়, মিষ্টি আরো দাও। ছবিতেও ভুল হয়,—ফেলে দিয়ে আবার নতুন ছবি আঁক। বারে বারে একই বিষয় নিয়ে আঁক। আমি হলে তো তাই করতুম। ছবিতে আবার ভুল শুধরে দিয়ে জোড়াতাড়া দেওয়া, ও কিরকম শেখানো? দরকার হয়, আর একটু নুন দিতে পার। দরকার হয় একটু চিনি, তাও দিতে পার। কিন্তু গাছের ডালটা এমনি হবে, পা-টা এমনি করে আঁকতে হবে, এ রকম করে শেখাবার আমি মোটেই পক্ষপাতী নই। আমি নন্দলালদের অমনি করেই শিখিয়েছি। তবে ছাত্রকে সাহস দিতে হয়। তাদের বলতে হয়, এঁকে যাও, কিছু এদিক ওদিক হয় তো আমি আছি।

 এই কথাই বলেছিলেন রবিকাকা আমার লেখার বেলায়। একদিন আমায় উনি বললেন, ‘তুমি লেখো না, যেমন করে তুমি মুখে গল্প কর তেমনি করেই লেখো।’ আমি ভাবলুম, বাপ রে লেখা—সে আমার দ্বারা কস্মিন্‌ কালেও হবে না। উনি বললেন, ‘তুমি লেখোই না; ভাষায় কিছু দোষ হয় আমিই তো আছি।’ সেই কথাতেই মনে জোর পেলুম। একদিন সাহস করে বসে গেলুম লিখতে। লিখলাম এক ঝোঁকে একদম শকুন্তলা বইখানা। লিখে নিয়ে গেলুম রবিকাকার কাছে, পড়লেন আগাগোড়া বইখানা, ভালো করেই পড়লেন। শুধু একটি কথা ‘পল্বলের জল’, ওই একটিমাত্র কথা লিখেছিলেম সংস্কৃতে। কথাটা কাটতে গিয়ে ‘না থাক্‌’ বলে রেখে দিলেন। আমি ভাবলুম, যা। সেই প্রথম জানলুম, আমার বাংলা বই লেখবার ক্ষমতা আছে। এত যে অজ্ঞতার ভিতরে ছিলুম, তা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলুম। মনে বড় ফূর্তি হল, নিজের উপর মস্ত বিশ্বাস এল। তার পর পটাপট করে লিখে যেতে লাগলুম—ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী ইত্যাদি। সেই যে উনি সেদিন বলেছিলেন ‘ভয় কি আমিই তো আছি সেই জোরেই আমার গল্প লেখার দিকটা খুলে গেল।

 কিন্তু আমার ছবির বেলায় তা হয়নি—বিফলতার পর বিফলতা। তাই তো এদের বলি, শেখা জিনিসটা কি? কিছুই না, কেবলই মনে হবে, কিছুই হল না; আমার সেই দুঃখের কথাটাই বলি। শেখা, ওকি সহজ জিনিস? কি কষ্ট করে যে আমি ছবি আঁকা শিখেছি। তোমাদের মতন নয়, দিব্যি আরামের ঘর, কয়েক ঘণ্টা গিয়ে বসলুম, কিছু করলুম, মাস্টারমশায় এসে ভুলটুল শুধরে দিয়ে গেলেন। আর্টস্ট চিরদিনই শিখছে, আমার এখনো বছরের পর বছর শেখাই চলছে। যদিও ছেলেবেলা থেকেই আমার শিল্পীজীবনের শুরু, কিন্তু কি করে কি ভাবে তা এল আমি নিজেই জানিনে। দাদা সেণ্ট জেভিয়ারে রীতিমত ছবি আঁকা শিখতেন, ছবি এঁকে পুরস্কারও পেয়েছিলেন। সত্যদাদা হরিনারায়ণবাবুর কাছে বাড়িতে তেলরঙের ছবি আঁকতেন, দাদাকেও হরিবাবু শেখাতেন। মেজদা, নিরুদা, আমার পিসতুত ভাই, তাঁরও শখ ছিল ঘড়ি মেরামতের আর হাতির দাঁতের উপর কাজ করবার। একতলার ঘরে এসে তিনি হাতির দাঁতে ছবি আঁকতেন; এক দিল্লিওয়ালা আসত তাঁকে শেখাতে। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে উকিঝুঁকি দিতুম, ভারি ভালো লাগত। হিন্দু মেলায় যে দিল্লির মিনিয়েচার দেখেছিলুম এই লোকটিই দেখিয়েছিল তা। সেও চোখ ভুলিয়েছিল তখন। সেই সময়ে আঁকতে জানতুম না তো সেরকম কিছু, তবে রং নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতুম; ইচ্ছে করত, আমিও রং তুলি দিয়ে এটা ওটা আঁকি। আঁকার ইচ্ছে ছোটবেলা থেকেই জেগেছিল। এর বহুকাল পরে বড় হয়েছি, বিয়ে হয়েছে, বড় মেয়ে জন্মেছে, সেই সময় একদিন খেয়াল হল ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’টা চিত্রিত করা যাক। এর আগে ইস্কুলে পড়তেও কিছু কিছু আঁকা অভ্যেস ছিল। সংস্কৃত কলেজে অনুকূল আমায় লক্ষ্মী সরস্বতী আঁকা শিখিয়েছিল। বলতে গেলে সেই-ই আমার প্রথম শিল্পশিক্ষার মাস্টার, সূত্রপাত করিয়ে দিয়েছিল ছবি আঁকার।

 তা স্বপ্নপ্রয়াণের ছবি আঁকবার যখন খেয়াল হল, তখন আমি ছবি আঁকায় একটু একটু পেকেছি। কি করে যে পাকলুম মনে নেই, তবে নিজের ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা আরম্ভ হল স্বপ্নপ্রয়াণ থেকে। ‘স্বপন-রমণী আইল অমনি, নিঃশব্দে যেমন সন্ধ্যা করে পদার্পণ’ এমনি সব ছবি, তখন সত্যি যেন ‘খুলে দিল মনোমন্দিরের চাবি’। ছবিখানি ‘সাধনা’ কাগজে বেরিয়েছিল। যাই হোক, স্বপ্নপ্রয়াণটা তো অনেকখানি এঁকে ফেললুম। মেজমা আমাদের উৎসাহ দিতেন। ‘বালক’ কাগজের জন্য লিথোগ্রাফ প্রেস করে দিলেন তাঁর বাড়িতে। যার যা কিছু আঁকার শখ লেখার শখ ছিল, মায় রবিকাসুদ্ধ, সবাই তাঁর কাছে যেতুম। মেজমা আমার স্বপ্নপ্রয়াণের ছবিগুলো দেখে ধরে বসলেন, ‘অবন, তোমাকে রীতিমত ছবি আঁকা শিখতে হবে।’ উনিই ধরে বেঁধে শিল্পকাজে লাগিয়ে দিলেন।

 আমারও ইচ্ছে হল ছবি আঁকা শিখতে হবে। তখন ইউরোপীয়ান আর্ট ছাড়া গতি ছিল না। ভারতীয় শিল্পের নামও জানত না কেউ। গিলার্ডি আর্ট স্কুলের ভাইসপ্রিন্সিপাল, ইটালিয়ান আর্টিস্ট—মেজমা কুমুদ চৌধুরীকে বললেন, ‘তুমি অবনকে নিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও, আর শেখার বন্দোবস্তও কর।’ মাকে জিজ্ঞেস করলুম। মা বললেন, ‘কোনো কাজ তে করছিসনে, স্কুল ছেড়ে দিয়েছিস, তা শেখ্‌ না। একটা কিছু নিয়ে থাকবি ভালোই তো।’ ব্যবস্থা হল, এক-একটা lessonএর জন্যে কুড়ি টাকা দিতে হবে, মাসে তিন-চারটে পাঠ দিতেন তাঁর বাড়িতেই। খুব যত্ন করেই শেখাতেন আমায়। তাঁর কাছে গাছ ডালপাতা এই সব আঁকতে শিখলুম। প্যাস্টেলের কাজও তিনি যত্ন করে শেখালেন। তেলরঙের কাজ, প্রতিকৃতি আঁকা, এই পর্যন্ত উঠলুম সেখানে। ছবি শেখার হাতে খড়ি হল সেই ইটালিয়ান মাস্টারের কাছে। কিছুদিন যায়, দেখি, তাঁর কাছে হাতে খড়ির পর বিদ্যে আর এগোয় না। তেলরঙের কাজ যখন আরম্ভ করলুম, দেখি, ইটালিয়ান ধরনে আর চলে না। বাঁধা গতের মত তুলি দিয়ে ধীরে ধীরে আঁকা, সে আর পোষাল না। আগে গাছপালা আঁকার মধ্যে তবু কিছু আনন্দ পেতুম। কিন্তু ধরে ধরে আর্ট স্কুলের রীতিতে তুলি টানা আর রং মেলানো, তা আর কিছুতেই পেরে উঠলুম না। ছ-মাসের মধ্যেই স্টুডিয়োর সমস্ত শিক্ষা শেষ করে সরে পড়লুম।

 বিয়ে হয়েছে, রীতিমত ঘরসংসার আরম্ভ করেছি, কিন্তু ছবি আঁকার ঝোঁকটা কিছুতেই গেল না। তখন এই পর্যন্ত আমার বিদ্যে ছিল যে নর্থ লাইট মডেল না হলে ছবি আঁকা যায় না। আর স্টুডিয়ো না হলে আর্টিস্ট ছবি আঁকবে কোথায় বসে? উত্তর দিকের ঘর বেছে বাড়িতেই স্টুডিয়ো সাজালুম। নর্থ লাইট, সাউথ লাইট ঠিক করে নিয়ে পর্দা টানালুম জানালায় দরজায় স্কাই লাইটে। বসলুম পাকাপাকি স্টুডিয়ো ফেঁদে। রবিকা খুব উৎসাহ দিলেন। সেই স্টুডিয়োতেই সেই সময় রবিকা চিত্রাঙ্গদার ছবি আঁকতে আমায় নির্দেশ দিচ্ছেন ফটোতে দেখেছ তো? চিত্রাঙ্গদা তখন সবে লেখা হয়েছে। রবিকা বললেন, ছবি দিতে হবে। আমার তখন একটু সাহসও হয়েছে, বললুম, রাজি আছি। সেই সময় চিত্রাঙ্গদার সমস্ত ছবি নিজ হাতে এঁকেছি, ট্রেস করেছি। চিত্রাঙ্গদা প্রকাশিত হল। এখন অবশ্য সে সব ছবি দেখলে আমার হাসি পায়। কিন্তু এই হল রবিকার সঙ্গে আমার প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ। তার পর থেকে এতকাল রবিকার সঙ্গে বহুবার আর্টের ক্ষেত্রে যোগাযোগ হয়েছে, প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তার প্রেরণা। সেই সময়ে রবিকার চেহারা আমি অনেক এঁকেছি, ভালো করে শিখেছিলুম প্যাস্টেল ড্রইং। নিজের স্টুডিয়োতে যাকে পেতুম ধরে ধরে প্যাস্টেলে আঁকতুম। অক্ষয়বাবু, মতিবাবু, সবার ছবি করেছি, মহৰ্ষির পর্যন্ত। এই করে করে পোর্টেটে হাত পাকালুম। রবিকাকেও প্যাস্টেলে আঁকলুম, জগদীশবাবু সেটি নিয়ে নিলেন।

 সেই সময়ে রবিবৰ্মা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন আমি নতুন আর্টিস্ট—তিনি আমার স্টুডিয়োতে আমার কাজ দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ছবির দিকে এর ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। আমি কোথায় বেরিয়ে গিয়েছিলুম, বাড়িতে ছিলুম না, ফিরে এসে শুনলুম বাড়ির লোকের মুখে।

 প্যাস্টেলে হাত পাকল, মনও বেগড়াতে আরম্ভ করল, শুধু প্যাস্টেল আর ভালো লাগে না। ভাবলুম, অয়েলপেণ্টিং শিখতে হবে। ধরলুম এক ইংরেজ আর্টিস্টকে। নাম সি. এল. পামার। তাঁর কাছে যাই, পয়সা খরচ করে খাস বিলেতি গোরা মডেল আনি, মানুষ আঁকতে শিখি। একদিন এক গোরাকে নিয়ে এল আমার চাপরাসি স্টুডিয়োতে মডেল হবার জন্য। সে এসেই তড়বড় করে তার গায়ের জামা সব কটা খুলে এবারে প্যাণ্টও খুলতে যায়। চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘হাঁ হাঁ, কর কি। প্যাণ্ট তোমার আর খুলতে হবে না।’ প্যাণ্ট খুলবেই সে, বলে, ‘তা নইলে তোমরা আমাকে কম টাকা দেবে।’ পামারকে বললুম, ‘সাহেব, তুমি বুঝিয়ে বল, টাকা ঠিকই দেব। প্যাণ্ট যেন না খুলে ফেলে, ওর খালি গা’ই যথেষ্ট।’ সাহেব শেষে তাকে বুঝিয়ে শান্ত করে। আর একবার এক অ্যাংলোইণ্ডিয়ান মেম এল মডেল হতে, তার পোর্টেট আঁকলুম, মেম তা দেখে টাকার বদলে সেই ছবিখানাই চেয়ে বসলে; বললে, ‘আমি টাকা চাইনে, এই ছবিখানা আমাকে দিতেই হবে, নইলে নড়ব না এখান থেকে।’ আমি তো ভাবনায় পড়লুম, কি করি। সাহেব বললে, ‘তা বই কি, ছবি দিতে পারবে না ওকে।’ বলে দিলেন দুই ধমক লাগিয়ে; মেম তখন সুড় সুড় করে নেমে গেল নিচে। এই রকম আর কিছুদিনের মধ্যেই ওঁদের আর্টের তৈলচিত্রের করণ-কৌশলটা তো শিখলাম। তখন একদিন সাহেব মাস্টার একটা মডেলের কোমর পর্যন্ত আঁকতে দিলেন। বললেন, ‘এক সিটিঙে দু-ঘণ্টার মধ্যে ছবিখানা শেষ করতে হবে।’ দিলুম শেষ করে। সাহেব বললেন, ‘চমৎকার উতরে গেছে—passed with credit।’ আমি বললুম, ‘তা তো হল, এখন আমি করব কি?’ সাহেব বললেন, ‘আমার যা শেখাবার তা আমি তোমায় শিখিয়ে দিয়েছি। এবারে তোমার অ্যানাটমি স্টাডি করা দরকার।’ এই বলে একটি মড়ার মাথা আঁকতে দিলেন। সেটা দেখেই আমার মনে হল যেন কি একটা রোগের বীজ আমার দিকে হাওয়ায় ভেসে আসছে। সাহেবকে বললুম, ‘আমার যেন কি রকম মনে হচ্ছে।’ সাহেব বললেন, ‘No, you must do it—তোমাকে এটা করতেই হবে।’ সারাক্ষণ গা ঘিন ঘিন করতে লাগল। কোনোরকমে শেষ করে দিয়ে যখন ফিরলুম তখন ১০৬° ডিগ্রি জ্বর।

 সন্ধ্যেবেলা জ্ঞান হতে দেখি ঘরের বাতিগুলো নিবন্ত প্রদীপের মত মিটমিট করছে। মা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছিল। মাকে মড়ার মাথার ঘটনা বললুম। মা তখনকার মত ছবি আঁকা আমার বন্ধ করে দিলেন, বললেন, কাজ নেই আর ছবি আঁকায়। তখন আমার কিছুকালের জন্য ছবি আঁকা বন্ধ ছিল। তার পরে একজন ফ্রেঞ্চ পড়াবার মাস্টার এলেন আমাদের জন্য, নাম তার হ্যামারগ্রেন। রামমোহন রায়ের নাম শুনে তাঁর দেশ নরওয়ে থেকে হেঁটে এদেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর কাছে একটু একটু ফ্রেঞ্চ পড়তুম, তিনি খুব ভাল পড়াতেন। কিন্তু পড়ার সময়ে খাতার মার্জিনে তার নাক মুখের ছবিই আঁকতুম বসে বসে। তাই আর আমার ফ্রেঞ্চ পড়া এগল না। এদেশেই তিনি মারা যান। মারা যাবার পরে আমার খাতার সেই নোটগুলো দেখে পরে তাঁর ছবি আঁকি। বহুদিন পরে সেদিন রবিকাকা বললেন যে নরওয়েতে তাঁর মিউজিয়াম হচ্ছে, যদি তোমার কাছে তাঁর ছবি থাকে তবে তারা চাচ্ছে। তাঁর চেহার কারো কাছে ছিল না। আমি পুরাতন বাক্স খুঁজে সেই ছবি বের করে পাঠাই, তার আত্মীয়-স্বজন খুব খুশি হয়ে আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস তাঁর চেহারা নোট করে রেখেছিলুম।

 যাক ওকথা। তেলরঙ তো হল। এবার জলরঙের কাজ শেখবার ইচ্ছে। মাকে বলে আবার তাঁর কাছেই ভরতি হলুম। এখন ল্যাণ্ডস্কেপ আর্টিস্ট হয়ে, ঘাড়ে ‘ইজেল’ বগলে রঙের বাক্স নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। কিন্তু কতকাল চলবে আর এমনি করে? তবু মুঙ্গেরের ওদিকে ঘুরে ঘুরে অনেকগুলি দৃশ্য এঁকেছিলুম।

 কিছুদিন তো চলল এমনি করে, মন আর ভরে না। ছবি তো এঁকে যাচ্ছি, কিন্তু মন ভরছে কই? কি করি ভাবছি, রোজই ভাবি কি করা যায়। এদিকে স্টুডিয়ো হয়ে উঠল তামাক খাবার আর দিবানিদ্রার আড্ডা। এমন সময়ে এক ঘটনা। শুনতেম আমার ছোটদাদামশায়ের চেহারা অতি সুন্দর ছিল, কিন্তু আমাদের কাছে তার একখানাও ছবি ছিল না। আমি তাঁর ছবির জন্য খোঁজখবর করছিলুম নানা জায়গায়। তখন বিলেত থেকে এক মেম মিসেস মার্টিনডেল খবর পেয়ে লিখলেন, ‘তুমি তাঁরই নাতি? বড় খুশি হলুম। তাঁর সঙ্গে আমার বড় ভাব ছিল। তোমার বিয়েথাওয়া হয়েছে! তোমার মেয়ের জন্য আমি একটা পুতুল পাঠাচ্ছি।’ বলে প্রকাণ্ড একটা বিলিতি ডল নেলিকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তখন খুবই বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু কি রকম আশ্চর্য তাঁর মন ছিল; কোন্‌কালে আমার ছোটদাদামশায়ের সঙ্গে তাঁর ভাব ছিল, সেই সূত্রে আমাকে না দেখেও তিনি নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি বলেই স্নেহ করতে চাইতেন। তিনি বিলেত থেকে লিখলেন, ‘তোমার আর্টের দিকে ঝোঁক আছে,—আমিও একটু আধটু আঁকতে পারি। বলো তোমার জন্য আমি কিছু করতে পারি কিনা।’ তিনি আরো লিখলেন, ‘তুমি যদি কিছু দাও তো তার চারদিকে ইলুমিনেট করিয়ে দিতে পারি।’ বইয়ের লেখার চারদিকে নকশা আঁকা থাকে, খুব পুরোনো আর্ট ওঁদের, তাই একটা এঁকে পাঠাবেন। ভাবলুম, তা মন্দ নয় তো। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি গরিব, এজন্য কিছু দিতে হবে।’ পাঠিয়েছিলুম কিছু দশ কি বারো পাউণ্ড মনে নেই ঠিক। আইরিশ মেলডিজের কবিতা ছোটদাদামশায়ের বড় প্রিয় জিনিস ছিল। ভাবলুম, সেটাই যত্ন করে রাখবার বস্তু হয়ে আসুক। কিছুকাল বাদে তিনি পাঠিয়ে দিলেন দশ-বারোখানা বেশ বড় বড় ছবি—সে কি সুন্দর, কি বলব তোমায়। থ হয়ে গেলুম ছবি দেখে।

 আবার হবি তো হ সেই সময়ে আমার ভগ্নীপতি শেষেন্দ্র, প্রতিমার বাবা, একখানা পার্শিয়ান ছবির বই দিল্লির, আমাকে বকশিশ দিলেন। রবিকাকাও আবার সে সময়ে রবিবর্মার ছবির কতকগুলি ফোটো আমাকে দিলেন। তখন রবিবর্মার ছবিই ছিল কিনা ভারতীয় চিত্রের আদর্শ। যাই হোক তখন সেই আইরিশ মেলডির ছবি ও দিল্লির ইন্দ্রসভার নকশা যেন আমার চোখ খুলে দিলে। একদিকে আমার পুরাতন ইউরোপীয়ান আর্টের নিদর্শন ও আর একদিকে এদেশের পুরাতন চিত্রের নিদর্শন। দুই দিকের দুই পুরাতন চিত্রকলার গোড়াকার কথা একই। সে যে আমার কি আনন্দ, সেই সময়ে সাধনাতে আমার ওই ইন্দ্রসভার বইখানির বর্ণনা দিয়ে ‘দিল্লির চিত্রশালিকা’ ব’লে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবন্ধ লিখেছিলেন; চারদিকে তখন একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল।

 যাক, ভারতশিল্পের তো একটা উদ্দিশ পেলুম। এখন শুরু করা যাবে কি করে কাজ? তখন একতলার বড় ঘরটাতে একধারে চলেছে বিলিয়ার্ড খেলার হো হো, একধারে আমি বসেছি রং তুলি নিয়ে আঁকতে। দেশের শিল্পের রাস্তা তো পেয়ে গেছি, এখন আঁকব কি? রবিকাকা আমায় বললেন, বৈষ্ণব পদাবলী পড়ে ছবি আঁকতে। রবিকাকা আমাকে এই পর্যন্ত বাতলে দিলেন যে চণ্ডীদাস বিদ্যাপতির কবিতাকে রূপ দিতে হবে। লেগে গেলুম পদাবলী পড়তে। প্রথম ছবি করি ভারতীয় পদ্ধতিতে চণ্ডীদাসের দু-লাইন কবিতা—

পৌখলী রজনী পবন বহে মন্দ
চৌদিকে হিমকর, হিম করে ফন্দ।

এ ছবিটা এখনো আমার কাছেই বাক্সবন্ধ। সেই আমার প্রথম দেশী ধরনের ছবি ‘শুক্লাভিসার’। কিন্তু দেশী রাধিকা হল না, সে হল যেন মেমসাহেবকে শাড়ি পরিয়ে শীতের রাত্তিরে ছেড়ে দিয়েছি। বড় মুষড়ে গেলুম—নাঃ, ও হবে না, দেশী টেকনিক শিখতে হবে। তখন তারই দিকে ঝোঁক দিলুম। ছবিতে সোনাও লাগাতে হবে। তখনকার দিনে রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়িতে এক মিস্ত্রি ফ্রেমের কাজ করে। লোকটির নাম পবন, আমার নাম অবন। তাকে ডেকে বললুম, ‘ওহে সাঙাত, পবনে অবনে মিলে গেছে, শিখিয়ে দাও এবারে সোনা লাগায় কি করে।’ সে বললে, ‘সে কি বাবু, আপনি ও কাজ শিখে কি করবেন? আমাকে বলবেন আমি করে দেব।’ ‘না হে, আমার ছবিতে সোনা লাগাব; আমাকে শিখিয়ে দাও।’ শিখলাম তার কাছে কি করে সোনা লাগাতে হয়। সবরকম টেকনিক তো শেখ হল, তার পর আমাকে পায় কে? বৈষ্ণব পদাবলীর এক সেট ছবি সোনার রূপোর তবক ধরিয়ে এঁকে ফেললুম। তারপর ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ আঁকতে শুরু করলুম। সেই পদ্মাবতী পদ্মফুল নিয়ে বসে আছে, রাজপুত্তুর গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে; আর অন্যগুলিও। যাক রাস্তা পেলুম, চলতেও শিখলুম, এখন হু হু করে এগোতে হবে। তখন এক-একখানি করে বই ধরছি আর কুড়ি-পঁচিশখানা করে ছবি এঁকে যাচ্ছি। তাই যখন হল কিছুকাল গেল এমনি।

 তখন কি আর ছবির জন্য ভাবি, চোখ বুজলেই ছবি আমি দেখতে পাই—তার রূপ, তার রেখা, মায় প্রত্যেক রঙের শেড পর্যন্ত। তখন যে আমার কি অবস্থা বোঝাব কি তোমায়। ছবিতে আমার তখন মনপ্রাণ ভরপুর, হাত লাগাতেই এক-একখানা ছবি হয়ে যাচ্ছে।

 হু হু করে ছবি হতে লাগল। কৃষ্ণচরিত্র, বুদ্ধচরিত্র, বেতালপঞ্চবিংশতি ইত্যাদি। নিচের তলার দালানটাতে বসে মশগুল হয়ে ছবি আঁকতুম। আমি যখন কৃষ্ণের ছবি আঁকছি তখন শিশির ঘোষ মশায় ছিলেন পরম বৈষ্ণব। একদিন তিনি এলেন কৃষ্ণের ছবি দেখতে। আমি নিচের তলার ঘরটিতে বসে নিবিষ্টমনে ছবি আঁকছি, মুখ তুলে দেখি দরজার পাশে একটি অচেনা মুখ উঁকিঝুঁকি মারছে। আমি বললাম, ‘কে হে।’ তিনি বললেন, ‘আমি শিশির ঘোষ। তুমি কৃষ্ণের ছবি আঁকছ তাই শুনে দেখতে এলুম।’ আমি তাড়াতাড়ি উঠে ‘আসুন আসুন’ বলে তাঁকে ঘরে এনে ভাল করে বসিয়ে ছবিগুলি সব এক এক করে দেখাতে লাগলুম। তিনি সবগুলি দেখলেন, শেষে হেসে বললেন, “হুঁ, কি এঁকেছ তুমি? এ কি রাধাকৃষ্ণের ছবি? লম্বা লম্বা সরু সরু হাত পা যেন কাটখোট্টাই—এই কি গড়ন? রাধার হাত হবে নিটোল, নধর তাঁর শরীর। জান না তার রূপবর্ণনা?’ এই বলে তিনি চলে গেলেন। আমি খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইলুম কিন্তু তার কথায় মনে কোনো দাগ কাটল না। ছবি করে যেতে লাগলুম। তখন আমি বিলিতি ছবির কাগজ পড়িও না, দেখিও না, ভয় পাছে বিলিতি আর্টের ছোঁয়াচ লাগে। গানবাজনা আর ছবি নিয়ে মেতে ছিলুম। দিনরাত কেবল এসরাজ বাজাই, ছবি আঁকি।

 সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্‌পেক্‌শনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল। সেই প্লেগ লাগল আমারও মনে। ছবি আঁকার দিকে না ঘেঁষে আরো গানবাজনায় মন দিলুম। চারদিকে প্লেগ আর আমি বসে বাজনা বাজাই। হবি তো হ, সেই প্লেগ এসে ঢুকল আমারই ঘরে। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে গেল। ফুলের মতন মেয়েটি ছিল, বড় আদরের। আমার মা বলতেন, ‘এই মেয়েটিই অবনের সবচেয়ে সুন্দর।’ ন-দশ বছরের মেয়েটি আমার টুক করে চলে গেল; বুকটা ভেঙে গেল। কিছুতে আর মন যায় না। এ বাড়ি ছেড়ে—চৌরঙ্গিতে একটা বাড়িতে আমরা পালিয়ে গেলুম। সেখানে থাকি, একটা টিয়েপাখি কিনলুম, তাকে ছোলা ছাতু খাওয়াই, মেয়ের মাও খাওয়ায়। পাখিটাকে বুলি শেখাই। দুঃখ ভোলাবার সাথি হল পাখির ছানাটা; নাম দিলেম তার চঞ্চু, মায়ের কোলছাড়া টিয়াপাখির ছানা।

 সে সময়ে ঘুড়ি ওড়াবারও একটা নেশা চেপেছিল। পাশের বাড়ির মিসেস্ হায়ার বলে এক বুড়ি ইহুদী মেমসাহেবের সঙ্গে আলাপ হল। আমাকে খুব যত্ন করতেন, কতরকম রান্না করে খাওয়াতেন। তাঁর সুন্দর একটি বাগান ছিল; ছাগলের জন্য দিব্য বেড়া দিয়ে ঘেরা পাহাড়। খুব বড় ঘরের সেকেলে ইহুদী পরিবার। মায়ের সঙ্গে বুড়ি ইহুদী মেমের কথা হত; মাঝে মাঝে আমার জন্যে ভালো সুগন্ধি তামাকও পাঠাত। সেখানে তো এমনি করে আমার দিন যাচ্ছে। সে সময়ে মেজমার কাছে যাওয়া-আসাতে হ্যাভেল সাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়। একদিন মেজমা আমাকে ধরে বসলেন, ‘তোমাকে আর্ট স্কুলে যেতে হবে। হ্যাভেল তোমাকে ভাইসপ্রিন্সিপ্যাল করতে চান।’ আমার তখন কি কাজকর্ম করবার মত অবস্থা? আমি সাহেবকে বললুম সে কথা। তিনি আমার জ্যেষ্ঠের মতন ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি করছ কি? You do your work—your work is your only medicine, তুমি তোমার কাজ কর, কাজই তোমার ওষুধ।’ তাঁকে চিরকাল গুরু বলে শ্রদ্ধা করেছি, জ্যেষ্ঠের মত ভক্তি করেছি কি সাধে? তিনিও আমাকে collaborator সহকর্মী বলে ডাকতেন আদর করে; কখনো চেলাও বলেছেন। ছোট ভাইয়ের মত ভালোবাসতেন। আমি নন্দলালকে যতখানি ভালোবাসি তার বেশি তিনি আমাকে ভালোবাসতেন।

 সে তো গেল, কিন্তু আমি চাকরি করব কি? ঠিকসময়ে হাজিরা দিতে হবে; এদিকে দিনে সাতবার করে তামাক খাওয়া আমার অভ্যাস, তার উপরে শরীর তখন খারাপ। মাকে বললুম, ‘সে আমি পারব না মা, তুমি যা হয় বল সাহেবকে।’ সাহেব ইংরেজের বাচ্চা, নাছোড়বান্দা। বলে পাঠালেন মাকে, ‘তোমার ছেলের সব ভার আমার। তার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কোনো অভাব হবে না। দুপুরে আমি তার খাওয়ার ভার নিলাম, তামাক সে যতবার ইচ্ছে খাবে। আমি বলছি আমি তার শরীর ভালো করে দেব।’ কিছুতেই ছাড়ে না, আমাকে রাজি হতেই হল। কিন্তু ভয় হল আমি শেখাব কি? নিজেই বা কি জানি। সাহেব তাতেও বললেন, ‘সে আমি দেখব’খন। তোমার কিছু ভাবতে হবে না। তুমি শুধু নিজের কাজ করে যাবে। তুমি কত টাকা মাসে চাও বল।’ আমি বললুম, ‘সে আর আমি কি বলব সাহেব, সবই তো তুমি জানো, এও তুমিই জানবে। কি দেবে না-দেবে সেও তোমার ইচ্ছা, আমি চাইনে কিছুই।’ সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা, তোমাকে আমি ভাইসপ্রিন্সিপাল করে দিলাম। তুমি এখন মাসে তিনশো টাকা করে পাবে।’

 যেতে শুরু করে দিলাম সকাল সকাল চারটি ভাত খেয়ে। প্রথম দিন গিয়ে তো আপিসঘরে ঢুকে মুষড়ে গেলুম—আমি তো আপিসের কাজ বলতে কিছুই জানি না। সাহেব বললেন, ‘কে বলে তোমার ওসব কাজ করতে হবে? তার জন্যে হেডমাস্টার, হেডক্লার্ক আছে। তারা সব দেখবে আপিসের কাজ। তুমি তোমার কাজ করে যাও। চল, তোমাকে আর্ট গ্যালারি দেখিয়ে নিয়ে আসি।’ আমাকে নিয়ে গেলেন আর্ট গ্যালারি দেখাতে, আমি আর সাহেব চলেছি, আগে-পিছে চাপরাসি মস্ত হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতে করতে যাচ্ছে, বাদশাহী চালে চলেছি বড়সাহেবের আর্ট গ্যালারি দেখতে। সাহেব চাপরাসিকে বললেন পর্দা সরাতে। ভারি তো আর্ট গ্যালারি, তার আবার পর্দা সরাও—এখন ভাবলে হাসি পায়। দু-তিনখানা মোগল ছবি আর দু-একখানা পার্শিয়ান ছবি, এই খান চার-পাঁচ ছবি নিয়ে তখন আর্ট গ্যালারি। পর্দা তো সরানো হল। একটি বকপাখির ছবি, ছোটই ছবিখান, মন দিয়ে দেখছি, সাহেব পিছনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে। আমাকে বললেন, ‘এই নাও এটি দিয়ে দেখ।’ বলে বুকপকেট থেকে একটি আতসী কাঁচ বের করে দিলেন।

 সেই কাঁচটি পরে আর আমি হাতছাড়া করিনি। বহুকাল সেটি আমার জামার বুকপকেটে ঘুরেছে। আমি নন্দলালদের বলতুম, এটি আমার দিব্যচক্ষু। সেই কাঁচ চোখের কাছে ধরে বকের ছবিটি দেখতে লাগলুম। ওমা কি দেখি, এ তে সামান্য একটুখানি বকের ছবি নয়, এ যে আস্ত একটি জ্যান্ত বক এনে বসিয়ে দিয়েছে। কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখি, তার প্রতিটি পালকে কি কাজ। পায়ের কাছে কেমন খসখসে চামড়া, ধারালো নখ, তার গায়ের ছোট্ট ছোট্ট পালক—কি দেখি—আমি অবাক হয়ে গেলুম, মুখে কথাটি নেই। পিছনে সাহেব তেমনি ভাবে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, আমার অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসছেন, যেন উনি জানতেন যে আমি এমনি হয়ে যাব এ ছবি দেখে। তার পর আর দু-চারখানা ছবি যা ছিল দেখলুম। সবই ওই একই ব্যাপার। মাথা ঘুরে গেল। তবে তো আমাদের আর্টে এমন জিনিসও আছে, মিছে ভেবে মরছিলুম এতকাল। পুরাতন ছবিতে দেখলুম ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি, ঢেলে দিয়েছে সোনা রুপো সব। কিন্তু একটি জায়গায় ফাঁকা, তা হচ্ছে ভাব। সবই দিয়েছে ঐশ্বর্যে ভরে, কোথাও কোনো কার্পণ্য নেই কিন্তু ভাব দিতে পারেনি। মানুষ আঁকতে সবই যেন সাজিয়ে গুজিয়ে পুতুল বসিয়ে রেখেছে। আমি দেখলুম এইবারে আমার পালা। ঐশ্বর্য পেলুম, কি করে তার ব্যবহার তা জানলুম, এবারে ছবিতে ভাব দিতে হবে।

 বাড়ি এসে বসে গেলুম ছবি আঁকতে। আঁকলুম ‘শাজাহানের মৃত্যু’।

 এই ছবিটি এত ভালো হয়েছে কি সাধে? মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম। ‘শাজাহানের মৃত্যুপ্রতীক্ষা’তে যত আমার বুকের ব্যথা সব উজাড় করে ঢেলে দিলুম। যখন দিল্লির দরবার হয়, বড় বড় ও পুরাতন আর্টিস্টদের ছবির প্রদর্শনী সেখানে হবে, হ্যাভেল সাহেব আমার এই ছবিখানা আর তাজ নির্মাণের ছবি দিলেন পাঠিয়ে দিল্লি দরবারে। আমাকে দিলে বেশ বড় একটা রুপোর মেডেল, ওজনে ভারি ছিল মন্দ নয়। তার পরে যোগেশ কংগ্রেস ইণ্ডাস্ট্রিয়াল একজিবিশনে সেই ছবি পাঠিয়ে দিল, সেখানে দিল একটা সোনার মেডেল। এইরকম করে তিনচারটে মেডেল পেয়েছি, পরিনি কোনোদিন।

 শাজাহানের ছবির কথা থাক্‌—সেই পদ্মাবতীর ছবিখানার কথা বলি। হ্যাভেল সাহেব পদ্মাবতী ও বেতালপঞ্চবিংশতির আরো তিন-চারখানি ছবি স্কুলের প্রদর্শনীতে দিলেন। পদ্মাবতী ছবিখানার দাম কত দেওয়া যায়? সাহেব দিলেন আশি টাকা দাম ধরে। লর্ড কার্জন এলেন, পদ্মাবতী দেখে পছন্দ হল তাঁর, বললেন দাম কিছু কমিয়ে দিতে। ষাট টাকার মতন দিতে চাইলেন। আমি বলি, ‘সাহেব, দিয়ে দাও, টাকামাকা চাইনে কিছু। লর্ড কার্জন চেয়েছেন ছবিখানা, সেই তো খুব দাম।’ সাহেব বললেন, ‘তুমি চুপ করে থাকো, যা বলবার বোঝাবার আমি বলব বোঝাব।’ এই বলে তিনি তাকে কি সব বোঝালেন, ছবিখানার দাম কমালেন না, লর্ড কার্জনকেও দিলেন না। আমি শেষে কি করি, পদ্মাবতীর ছবিখানা ও অন্য ছবি যে দু-তিনখানা ছিল তা হ্যাভেলকে ধরে দিয়ে বললুম, ‘এই নাও সাহেব, আমার গুরুদক্ষিণা; এগুলি আমি তোমাকে দিলুম।’ সাহেব তো লুফে নিলেন। কি খুশি হলেন, বললেন, ‘আমি এ ছবি গ্যালারিতে রেখে দেব, যত্নে থাকবে চিরকাল।’

 এখন আমার মাস্টারি শুরু করার কথা বলি। সাহেব তো তার স্কুলে আমাকে নিয়ে বসালেন। সুরেন গাঙ্গুলী হল আমার প্রথম ছাত্র। সুরেনকে সাহেব তাঁত শেখাবার জন্য বেনারসে পাঠিয়েছিলেন। তাকে আবার ফিরিয়ে এনে আমাকে বললেন, ‘তুমি তোমার ক্লাস শুরু কর।’ সুরেন ও আর দু-চারটি ছেলেকে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। কিছুকাল বাদে সত্যেন বটব্যাল বলে এনগ্রেভিং ক্লাসের এক ছাত্র, একটি ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির, বললে, ‘একে আপনার নিতে হবে।’ তখন মাস্টার কিনা, গম্ভীর ভাবে মুখ তুলে তাকালুম, দেখি কালোপানা ছোট একটি ছেলে। বললুম, ‘লেখাপড়া শিখেছ কিছু।’ বললে, ‘ম্যাট্রিক, এফ-এ পর্যন্ত পড়েছি। আমি বললুম, ‘দেখি তোমার হাতের কাজ।’ একটি ছবি দেখালে—একটি মেয়ে, পাশে হরিণ, লতাপাতা গাছগাছড়া; শকুন্তলা এঁকেছিল। এই আজকালকার ছেলেদের মতন একটু জ্যেঠামি ছিল তাতে। বললুম, ‘এ হবে না, কাল একটি সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি এঁকে এনো।’ পরদিন নন্দলাল এল, একটি কাঠিতে ন্যাকড়া জড়ানো, সেই ন্যাকড়ার উপরে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি। বেশ এঁকেছিল প্রভাতভানুর বর্ণনা দিয়ে। বললুম ‘সাবাস’। সঙ্গে ওর শ্বশুর, দিব্যি চেহারা ছিল ওর শ্বশুরের, বললেন, ‘ছেলেটিকে আপনার হাতে দিলুম।’ আমি তাঁকে বললুম, ‘লেখাপড়া শেখালে বেশি রোজগার করতে পারবে।’ নন্দলাল জবাবে বললে, ‘লেখাপড়া শিখলে তো ত্রিশ টাকার বেশি রোজগার হবে না। এতে আমি তার বেশি রোজগার করতে পারব।’ আমি বললুম, ‘তা হলে আমার আর আপত্তি নেই।’ সেই থেকে নন্দলাল আমার কাছে রয়ে গেল। তখন একদিকে সুরেন গাঙ্গুলী এক দিকে নন্দলাল, মাঝখানে আমি বসে কাজ শুরু করে দিলুম।

 এখন এক পণ্ডিত এসে জুটে গেলেন—চাকরি চাই। আমি বললুম, ‘বেশ লেগে যান, রোজ আমাদের মহাভারত রামায়ণ পড়ে শোনাবেন। আমাদের বাল্যকালের পণ্ডিত মশায়, নাম রজনী পণ্ডিত। সেই পণ্ডিত রোজ এসে রামায়ণ মহাভারত শোনাতেন। আর তাই থেকে ছবি আঁকতুম।

 নন্দলাল বললে, ‘কি আঁকব?’ আমি বললুম, ‘আঁকো কর্ণের সূর্যস্তব’। ও বিষয়টা আমি চেষ্টা করেছিলুম, ঠিক হয়নি। নন্দলাল এঁকে নিয়ে এল। আমি তার উপর এই দু-তিনটে ওয়াশ দিয়ে দিলুম ছেড়ে—হাতে ধরে দেখিয়ে দেখিয়ে আমি কখনও ওকে শেখাইনি। ছবি করে নিয়ে আসত, আমি শুধু কয়েকটি ওয়াশ দিয়ে মোলায়েম করে দিতুম, কিংবা একটু আধটু রঙের টাচ্‌ দিয়ে দিতুম, যেমন ফুলের উপর সূর্যের আলো বুলিয়ে দেওয়া—সূর্য নয় ঠিক, আমি তো আর রবি নই, নানা রঙের মাটিরই প্রলেপ দিতেম। তখন আমাদের আঁকার কাজ তেজে চলেছে। নন্দলাল সূর্যের স্তব আঁকল তো সুরেন এদিকে রামচন্দ্রের সমুদ্রশাসন আঁকল, এই তীর ধনুক বাঁকিয়ে রামচন্দ্র উঠে রুখে দাঁড়িয়েছেন। নন্দলাল এঁকে আনল একটি মেয়ের ছবি, বেশ গড়নপিটন, টান টানা চোখ ভুরু। আমি বললুম ‘এ তো হল কৈকেয়ী, পিছনে মন্থরা বুড়ি এঁকে দাও।’ হয়ে গেল কৈকেয়ী-মন্থরা। ছবির পর ছবি বের হতে লাগল। চারদিকে তখন খুব সাড়া পড়ে গেল, ওরিয়েণ্টাল আর্ট সোসাইটি খুলে গেল, হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড। ইণ্ডিয়ান আর্ট শব্দ অভিধান ছেড়ে সেই প্রথম লোকের মুখে ফুটল।

 আমি নিজে যখন ছবি আঁকতুম কাউকে ঘরে ঢুকতে দিতুম না, আপন মনে ছবি আঁকতুম। মাঝে মাঝে হ্যাভেল সাহেব পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকতেন পিছন দিক দিয়ে দেখে যেতেন কি করছি। চৌকি ছেড়ে উঠতে গেলে ধমকে দিতেন। আমার ক্লাসেও সেই নিয়ম করেছিলুম। দরজায় লেখা ছিল, ‘তাজিম মাফ’। আমার ছবি আঁকার পদ্ধতি ছিল এমনি। বলতুম, তোমরা একে যাও, যদি লড়াইয়ে ফতে না করতে পার, তবে এই আমি আছি—ভয় কি?

 কেন বলি, যে আমার আর্টের বেলায় ক্রমাগত ব্যর্থতা? কি দুঃখ যে আমি পেয়েছি আমার ছবির জীবনে। যা ভেবেছি, যা চেয়েছি দিতে, তার কতটুকু আমি আমার ছবিতে দিতে পেরেছি? যে রঙ যে রূপ-রস মনে থাকত, চোখে ভাসত, যখন দেখতুম তার সিকি ভাগও দিতে পারলুম না তখনকার মনের অবস্থা, মনের বেদনা অবর্ণনীয়। চিরটাকাল এই দুঃখের সঙ্গে যুঝে এসেছি। ছবিতে আনন্দ আর কতটুকু পেয়েছি। শুধু দুবার আমার জীবনে আনন্দময় ভাব এসেছিল, দুবার আমি নিজেকে ভুলে বিভোর হয়ে গিয়েছিলুম, ছবিতে ও আমাতে কোনো তফাত ছিল না—আত্মহারা হয়ে ছবি এঁকেছি। একবার হয়েছিল আমার কৃষ্ণচরিত্রের ছবিগুলি যখন আঁকি। সারা মন-প্রাণ আমার কৃষ্ণের ছবিতে ভরে গিয়েছিল। চোখ বুজলেই চারিদিকে ছবি দেখি আর কাগজে হাত ছোঁয়ালেই ফস ফস করে ছবি বেরয়; কিছু ভাবতে হয় না, যা করছি তাই এক-একখানা ছবি হয়ে যাচ্ছে। তখন কৃষ্ণের সব বয়সের সব লীলার ছবি দেখতে পেতুম, প্রত্যেকটির খুঁটিনাটি রঙ সমেত। সেই ভাব আমার আর এল না।

 আর একবার এসেছিল কিন্তু ক্ষণিকের জন্য। সেবারে হচ্ছে আমার মার আবির্ভাব, মৃত্যুর পর। মার ছবি একটিও ছিল না। মার ছবি কি করে আঁকা যায় একদিন বসে বসে ভাবছি, এমন সময়ে যেন আমি পরিষ্কার আমার চোখের সামনে মাকে দেখতে পেলুম। মার মুখের প্রতিটি লাইন কি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, আমি তাড়াতাড়ি কাগজ পেনসিল নিয়ে মার মুখের ড্রইং করতে বসে গেলুম। কপাল থেকে যেই নাকের ওপর ভুরুর খাঁজ টুকতে গেছি—সে কি? মা কোথায় মিলিয়ে গেলেন। হঠাৎ যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। মনে হল কে যেন আলোর সুইচটা বন্ধ করে দিলে—সব অন্ধকার। আমি চমকে বললুম, ‘দাদা, এ কি হল?’ দাদা একটু দূরে বসে ছিলেন, মুখ টিপে হাসলেন, বললেন, ‘বড় তাড়া করতে গিয়েছিলে তুমি।’ মন খারাপ হয়ে গেল। চুপচাপ বসে রইলুম, আর মনে হতে লাগল, তাই তো, এ কি হল! মা এসে এমনি করে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ ওভাবে ছিলুম, এক সময়ে দেখি আবার মায়ের আবির্ভাব। এবারে আর তাড়াহুড়ো না—স্থির হয়ে বসে রইলুম। মেঘের ভিতর দিয়ে যেমন অস্তদিনের রং দেখা যায় তেমনিতরো মায়ের মুখখানি ফুটে উঠতে লাগল। দেখলুম মাকে, খুব ভালো করে মন—প্রাণ ভরে মাকে দেখে নিলুম। আস্তে আস্তে ছবি মিলিয়ে গেল, কাগজে রয়ে গেল মায়ের মূর্তি। এই যে মার ছবিখানা ওই অমনি করেই আঁকা। এত ভালো মুখের ছবি আমি আর আঁকিনি।

 আমার মুখের কথায় যদি সংশয় থাকে চাক্ষুষ প্রমাণ দেখলে তো সেদিন। সন্ধ্যের অন্ধকারে রবিকার মুখের ছবি আঁকতে বসলুম, ঝাপসা ঝাপসা অস্পষ্ট লাইন পড়ল কাগজে, তোমরাও দেখতে পাচ্ছিলে না পরিষ্কার চেহারা। আমি কিন্তু দেখলুম সুস্পষ্ট চেহারা পড়ে গেছে কাগজে, আর ভয় নেই। নির্ভয়ে রেখে দিলেম, সে রাতের মত ছবির কাজ বন্ধ। জানলেম ছবি হয়ে গেছে, নির্ভাবনায় ঘরে গেলুম। সকালে উঠে ছবিতে শুধু দু-চারটে রঙের টান দেবার অপেক্ষা রইল।

 এ রকম হয় শিল্পীর জীবনে, তবে সব ছবির বেলায় নয়।

 তাই তো বলি ছবির জীবনে দুঃখ অনেক, আমিও চিরকাল সেই দুঃখই পেয়ে এসেছি। প্রাণে কেবলই একটা অতৃপ্তি থেকে যায়। কিছুতেই মনে হয় না যে, এইবারে ঠিক হল যেমনটি চেয়েছিলুম। কিন্তু তাই বলে থেমে গেলে চলবে না নিরুৎসাহ হয়ে পড়লে চলবে না। কাজ করে যাওয়াই হচ্ছে আমাদের কাজ। আবার কিছুকাল যদি ছবি না আসে তা হলেও মন খারাপ কোরো না। ছবি হচ্ছে বসন্তের হাওয়ার মতন। যখন বইবে তখন কোনো কথা শুনবে না। তখন একধার থেকে ছবি হতে শুরু হবে। মন খারাপ কোরো না—আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখো।

 ছাত্রকে তার নিজের ছবি সম্বন্ধে মাস্টারের কিছু বাতলানো—এক-একসময়ে তার বিপদ বড়, আর তাতে মাস্টারেরও কি কম দায়িত্ব? একবার কি হয়েছিল বলি। নন্দলাল একখানা ছবি আঁকল ‘উমার তপস্যা’, বেশ বড় ছবিখানা। পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে উমা শিবের জন্য তপস্যা করছে, পিছনে মাথার উপরে সরু চাঁদের রেখা। ছবিখানিতে রঙ বলতে কিছুই নেই, আগাগোড়া ছবিখানায় গৈরিক রঙের অল্প অল্প আভাস। আমি বললুম, ‘নন্দলাল, ছবিতে একটু রঙ দিলে না? প্রাণটা যেন চড়বড় করে ছবিখানির দিকে তাকালে। আর কিছু না দাও অন্তত উমাকে একটু সাজিয়ে দাও। কপালে একটু চন্দন-টন্দন পরাও, অন্তত একটি জবাফুল।’ বাড়ি এলুম, রাত্রে আর ঘুম হয় না। মাথায় কেবলই ঘুরতে লাগল, ‘আমি কেন নন্দলালকে বলতে গেলুম ও-কথা? আমার মতন করে নন্দলাল হয়তো উমাকে দেখেনি। ও হয়তো দেখেছিল উমার সেই রূপ, পাথরের মত দৃঢ়, তপস্যা করে করে রঙ রস সব চলে গেছে। তাই তো উমার তপস্যা দেখে তো বুক ফেটে যাবারই কথা। তখন আর সে চন্দন পরবে কি?’ ঘুমতে পারলুম না, ছটফট করছি কখন সকাল হবে। সকাল হতেই ছুটলুম নন্দলালের কাছে। ভয় হচ্ছিল পাছে সে রাত্রেই ছবিখানাতে রঙ লাগিয়ে থাকে আমার কথা শুনে। গিয়ে দেখি নন্দলাল ছবিখানাকে সামনে নিয়ে বসে রঙ দেবার আগে আর একবার ভেবে নিচ্ছে।

 আমি বললুম, ‘কর কি নন্দলাল, থামো থামো, কি ভুলই আমি করতে যাচ্ছিলুম, তোমার উমা ঠিকই আছে। আর হাত লাগিয়ো না।’

 নন্দলাল বললে, ‘আপনি বলে গেলেন উমাকে সাজাতে। সারারাত আমিও সে কথা ভেবেছি, এখনো ভাবছিলাম রঙ দেব কি না।’

 কি সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলুম বল দেখি। আর একটু হলেই অত ভালো ছবিখানা নষ্ট করে দিয়েছিলুম আর কি। সেই থেকে খুব সাবধান হয়ে গেছি। আর এটা জেনেছি যে, ছবি যার যার নিজের নিজের সৃষ্টি, তাতে অন্য কেউ উপদেশ দেবে কি?

 যখন আমাদের ভারতশিল্পের জোর চর্চা হচ্ছে তখন ভাবলুম যে, শুধু ছবিতে নয়, সব দিকেই এর চর্চা করতে হবে। লাগলুম আসবাবের দিকে, ঘর সাজাতে, আশেপাশে চারদিকে ভারতশিল্পের আবহাওয়া আনতে। ঘরে যত পুরোনো আসবাব ছিল কর্তাদের আমলের, বিদেশ থেকে আমদানি দামী দামী জিনিসপত্তর, সব বিক্রি করে দিলুম। বললুম, ‘সব ঝেড়ে ফেল্‌, যা কিছু আছে বাইরে ফেলে দে।’ মাদ্রাজী মিস্ত্রি ধনকোটি আচারি, তাকে এনে লাগিয়ে দিলুম কাজে। নিজে নমুনা দিই, নকশা দিই, আর তাকে দিয়ে আসবাব করাই। সব সাদাসিধে আসবাব করাই। তাকে দিয়ে ঘর জুড়ে জাপানী গদি করালুম। এই যে আজকাল তোমরা খাটের পায়া দেখছ, এ কোত্থেকে নেওয়া জানো? মাটির প্রদীপের দেল্‌খো থেকে। খেটেছি কম? প্রথম ভারতীয় আসবাবের চলন তো এইখান থেকেই হল। একলা আমি আর দাদা, এই আমাদের সব দিক সামলে চলতে হয়েছে; এখন এরা সবাই একটি ধারা পেয়ে গেছে। এ থেকে একটু আধটু নতুন কিছু এদিক ওদিক করতে পারা সহজ। কিন্তু আমাদের যে তখন গোড়াসুদ্ধ গাছ উপড়ে ফেলে নতুন গাছ লাগাতে হয়েছিল নিজের হাতে। চারা লাগানো থেকে জল ঢালা থেকে সবই আমাদেরই করতে হয়েছে। তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি বলেই হয়তো তাতে একদিন ফুল ফোটাতে পারবে।