ডিটেক্টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
“এই কলিকাতা নগরীতে আমার জন্মস্থান। আমার পিতা কায়স্থ-মণ্ডলীর মধ্যে একজন গণ্য মান্য লোক। তিনি প্রকৃত বড় মানুষ না হইলেও, তাঁহাকে দরিদ্র অবস্থাপন্ন বলা যায় না। নিজের, যেমন হউক, বড়গোছের একটী বাসোপযোগী ও কয়েকখানি ভাড়াটিয়া বাড়ী আছে। মুহূর্ত্তের নিমিত্ত দিনপাতের ভাবনা ভাবিতে হয় না।
আমরা তিন সহোদর, তাহার মধ্যে আমি সকলের জ্যেষ্ঠ। মধ্যমটী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি প্রাপ্ত হইয়া কেবলমাত্র সংসারক্ষেত্রে উপস্থিত। কনিষ্ঠের যেরূপ শোচনীয় অবস্থা আমা কর্ত্তৃক ঘটিয়াছে, তাহা পাঠকগণ ক্রমে জানিতে পারিবেন।
কলিকাতায় আমি অনেকের নিকট সুপরিচিত। এখনও আমার পিতা ও ভ্রাতা সভ্য-সমাজে স্থান পাইয়া থাকেন বলিয়া, আমি বাধ্য হইয়া জন-সমাজে আমার নাম পরিচিত করিতে বিরত রহিলাম। একে আমি আমাদের কুল কলঙ্কিত করিয়াছি, তাহাতে আবার সকলের নিকট প্রকাশ হওয়া অতীব লজ্জার বিষয়। পাঠকগণের মধ্যে যাঁহারা আমার অবস্থা বিশেষরূপে অবগত আছেন, তাঁহাদিগের নিকট আমার করযোড়ে ও বিনীতভাবে নিবেদন যে, তাঁহারা যেন অন্যের নিকট আমার পরিচয় প্রদান না করেন। আমিও প্রকৃত নাম গোপন করিয়া আমার সর্ব্বজনবিদিত “ডাক্তার” বা “ডাক্তার বাবু” নামেই পরিচিত হইলাম।
অতি শৈশবকাল হইতে পিতা মাতা আমাকে অতি যত্নের সহিত লালন পালন করেন ও পঞ্চম বর্ষ বয়ঃক্রম হইতে না হইতে একটী সুশিক্ষিত ও সদ্বংশজাত শিক্ষক নিযুক্ত করিয়া দেন। তিনি দিবা রাত্রি আমাদের বাটীতে থাকিতেন এবং অনবরত আমাকে তাঁহার সঙ্গে রাখিয়া নানাপ্রকার সদুপদেশ ও শিক্ষা প্রদান করিতেন। তিনি আমার চরিত্র, পাঠে মনঃ-সংযোগ ও অধ্যবসায় প্রভৃতি দেখিয়া আমার পিতার নিকট সর্ব্বদা বলিতেন যে, এরূপ বুদ্ধিমান বালক সহস্রের মধ্যে একটীও পাওয়া যায় কি না সন্দেহ। সপ্তম বর্ষ বয়ঃক্রমের সময় এক শুভদিন দেখিয়া পিতা আমাকে কলিকাতার একটি প্রধান বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট করিয়া দিলেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ দুই তিন দিবসের মধ্যেই আমার বুদ্ধির সবিশেষ পরিচয় পাইয়া আমাকে অতিশয় ভালবাসিতে লাগিলেন। এক দিবস শিক্ষাবিভাগের একজন কর্ম্মচারী আমাদিগের পরীক্ষা লইলেন, এবং যাইবার সময় আমার প্রতি লক্ষ্য করিয়া শিক্ষক মহাশয়কে বলিয়া গেলেন, ‘আমি যতদিন শিক্ষাবিভাগে কর্ম্ম করিতেছি, তাহার মধ্যে এরূপ বুদ্ধিমান বালক আমার নয়নগোচর হয় নাই। যদি ইহার চরিত্র কলুষিত না হয়, তাহা হইলে এই বালকটী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটী উজ্জ্বল রত্ন হইবে।’
আমি এই কথাগুলি শুনিলাম; শুনিয়া আমার মনে কেমন এক প্রকার আনন্দ হইল—নূতন ভাবের আবির্ভাব হইল। কিন্তু সেই ভাব মনে গোপন রাখিতে পারিলাম না। বাটীতে যাইবামাত্র প্রথমে মা, তৎপরে শিক্ষককে সবিশেষ বলিলাম। তাঁহারা সকলেই শুনিলেন, কিন্তু কেহই কিছু বলিলেন না।
পূর্ব্বে আমার হৃদয়ে যে ভাবের ছায়া পড়িয়াছিল, ক্রমে তাহা আরও স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ হইতে লাগিল। মনে মনে সর্ব্বদা ভাবিতে লাগিলাম, আমার মত বুদ্ধিমান বালক আর নাই। আমি যেরূপ লেখা পড়া শিখিতেছি, সেরূপ অন্যের অসাধ্য।
এইরূপে বৎসর বৎসর সুখ্যাতির সহিত পারিতোষিক পাইয়া প্রথম শ্রেণীতে উত্থিত হইলাম। তখন আমার বয়ঃক্রম চতুর্দ্দশ বৎসর, কিন্তু ১৬ বৎসর বয়ঃক্রম না হইলে সেই সময়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিবার অধিকার ছিল না; সুতরাং সেই শ্রেণীতে তিন বৎসর কাল থাকিতে হইল। সেই সময় আমার শিক্ষক—যিনি আমাদের বাটীতে থাকিয়া নিয়ত আমার উন্নতি চেষ্টা করিতেন—যাঁহার যত্ন ও পরিশ্রমের গুণে সকলেই আমাকে ভাল বাসিতেন, তিনি—হঠাৎ কাল-কবলে পতিত হইলেন। পিতা আমাকে একজন অধ্যবসায়-শালী বিদ্যার্থী জানিয়া আর অন্য শিক্ষক নিযুক্ত করা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন না। আমিও ক্রমে ক্রমে আমার সম্পূর্ণ ইচ্ছার বশবর্ত্তী হইয়া চলিতে লাগিলাম।