ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/প্রথম পরিচ্ছেদ

ডাক্তার বাবু বক্তা;—

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 “ইংরাজী ১৮৮৬ সাল হইতে ৬ বৎসরের জন্য আমি কয়েদী। ঐ বৎসরে কলিকাতা মহানগরীর মহামান্য সেসন আদালতে গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত হইয়া এই অসহনীয় কষ্ট ভোগ করিতেছি।

 কয়েদী অবস্থায় রাত্রিদিন জেলের মধ্যে থাকিতে হয়। বাহিরে যাইবার আমার অধিকার নাই, আমি ইচ্ছামত কোন কার্য্য করিতে পারি না। সমস্তদিন কঠিন পরিশ্রম করি, কিন্তু তাহাতেও যশ নাই, বরং পদে পদে গালি ও লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হয়।

 বিনাদোষে বেত্রাঘাতে শরীর ক্ষত বিক্ষত হইয়াছে,পায়ে বেড়ীর কড়া পড়িয়াছে, গলায় লোহার হাসুলির দাগ হইয়াছে।

 মনে সুখ নাই। সর্ব্বদাই অসুখে দিন যাপন করিতে হয়। পরিধানে বস্ত্র নাই—জাঙ্গিয়া পরিয়া থাকিতে হয়। উদরে অন্ন নাই—কুৎসিত মোটা চাউলের ভাত খাইতে হয়। পেট ভরিয়া যে কতদিন খাই নাই, তাহা মনে করিয়াও আনিতে পারি না। এক কথায়, আমার কষ্টের ও দুঃখের শেষ নাই। যাহারা আমার মত অবস্থায় অন্ততঃ দুইদিনও কাটাইয়াছে, তাহারাই আমার দুঃখ কতক বুঝিবে; ভদ্রলোক আমার দুঃখ বুঝিতে কখনই সমর্থ হইবেন না, কল্পনা করিয়াও আমার অবস্থা বুঝিতে পারিবেন না।

 আমার মনের ভিতর যে দুঃখ-রাশি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, তাহা যদি দেখাইবার হইত, তবে দেখাইতাম; বলিয়া কি করিব? যে দুঃখের আদি নাই, মধ্য নাই, অন্ত নাই—যাহা আজীবন বলিয়াও শেষ করিতে পারিব না; সেই অসীম অনন্ত দুঃখের কাহিনী বলিয়া লাভ কি?

 আপনারা কি আমার দুঃখ বুঝিবেন? আমার জীবনকাহিনী কি একবার পড়িবেন? ইহাতে আপনাদিগের মনে অনন্দ হইবে না, ইহা ভাল লাগিবে না। ইহা গল্প নহে, উপন্যাস নহে—ইহাতে রাজা বা রাজপুত্র নাই, সেনাপতি নাই, যুদ্ধ বিগ্রহ নাই, ঝড় বৃষ্টি—মেঘ গর্জ্জন নাই, বজ্রপাত নাই, সুন্দর বন বা উপবন নাই, দেবমন্দির নাই, যোগী ঋষি নাই, সরোবর নাই, পদ্ম নাই, সুন্দরী রমণী নাই, রূপবর্ণন নাই, নব-দম্পতির নব-প্রণয়-সম্ভাষণ প্রভৃতি কিছুই নাই। ইহাতে কেবলমাত্র এই হতভাগার জীবনের স্থূল স্থূল কয়েকটী প্রকৃত কথা আছে। কিরূপে আমার মন কলুষিত হইয়া ক্রমে ক্রমে দুষ্কর্ম্মের সোপানশ্রেণী উল্লঙ্ঘন করিয়াছে এবং পরিশেষে কিরূপেই বা আমার এরূপ দুর্গতি হইয়াছে, সেই সকল দুঃখের কাহিনী যতদুর বলিতে সমর্থ হইয়াছি, বলিতে চেষ্টা করিয়াছি; সমস্ত বলিবার ক্ষমতা নাই, মনেও নাই। যে দুঃখরাশি আমার অদৃষ্টে ঘটিয়াছে, এবং প্রতিদিন অন্যান্য অনেকের অদৃষ্টেও ঘটিতেছে, ইহাতে কেবলমাত্র তাহাই বর্ণিত হইয়াছে। যাঁহারা মানব-জীবন অধ্যয়ন করিতে চাহেন, তাঁহারা যদি অনুগ্রহ করিয়া আমার এই দুঃখ-কাহিনী একবার পাঠ করেন, তাহা হইলে বুঝিবেন যে, মনুষ্যগণ দুষ্ট লোকের কুচক্রে ও প্রলোভনে পতিত হইয়া, হিতাহিত জ্ঞানের মস্তকে পদাঘাত করিয়া, ক্রমে কি ভয়ানক অবস্থায় উপনীত হয়, এবং মানব-সমাজের ঘৃণার পাত্র হইয়া কিরূপ দুঃখ ও কষ্টের সহিত জীবনের অবশিষ্টাংশ যাপন করে।