তরুণের স্বপ্ন/জীবনের লক্ষ্য

ইনসিন জেল ৬ই মে, ১৯২৭

[জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র বসু মহাশয়ের নিকট লিখিত চিঠির বঙ্গানুবাদ]

দাদা,

দীর্ঘ পত্র লিখিবার সামর্থ্য আমার নাই; আবশ্যক শক্তি সংগ্রহ করিতে না পারা পর্য্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করিতে হইবে। গবর্ণমেণ্টের প্রস্তাব সম্বন্ধে বড়দাদার, সহিত আমার অনেক আলাপ হইয়াছে। আমার এই আলাপের সুযোগ দেওয়ায় আমি আন্তরিক আনন্দিত হইয়াছি। মান্যবার স্বরাষ্ট্র-সচিব মহোদয় যে সৌজন্য দেখাইয়াছেন তজ্জন্য আমি তাঁহাকে ধন্যবাদ জানাইতেছি। আমার সহিত এ পর্য্যস্ত যেরূপ ব্যবহার করা হইতে ছিল এই ব্যবহার তাহা হইতে পৃথক।

গবর্ণমেণ্টের উত্তর, বড়দাদা ২৭শে এপ্রিল তারিখে আমাকে জানাইয়াছিলেন। এই উত্তরে বিষয়টি উভয়ের পক্ষেই স্পষ্টতর হইয়াছে। ১১ই এপ্রিল তারিখে গবর্ণমেণ্টের সর্ত্তের আমি যে উত্তর দিয়াছিলাম, বর্ত্তমান অবস্থা পর্য্যালোচনা করিয়া আমি পুনরায় সেই উত্তরই ঠিক বলিয়া মনে করিতেছি।

আমার সিদ্ধান্ত—সহজ বিচারের ফল। ভাল করিয়া চিন্তা করিয়া দেখিলে ঐ সিদ্ধান্ত আরো দৃঢ়তর হয়। * * * জীবনকে সহজভাবে বিচার করিয়া আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি। ভাল ভাবে বিচার করিবার পর এই সিদ্ধান্ত আরো দৃঢ় হইয়াছে। কারাগারে আমার যতই দিন যাইতেছে ততই আমার মনে এই ধারণা দৃঢ়মূল হইতেছে যে, জীবন-সংগ্রামের মূলে রহিয়াছে মতবাদের সংঘর্ষ—সত্য এবং মিথ্যা ধারণার সংঘর্ষ। কেহ কেহ ইহাকে সত্যের বিভিন্ন স্তর বলিয়া থাকেন। মানুষের ধারণাই মানুষকে চালিত করিয়া থাকে। এই সমস্ত ধারণা নিষ্ক্রিয় নহে, ক্রিয়াশীল এবং সংঘর্ষাত্মক। হেগেলের Absolute Idea, হপম্যান ও সোপেনহারের Blind Will এবং হেনরি বার্গসঁর 'Iean Vital'-এর মতই এই সমস্ত ধারণা ক্রিয়াশীল। এই সমস্ত ধারণা নিজেদের পথ নিজেরা সৃষ্টি করিয়া লইবে। আমরা তো মাটির পুতুল মাত্র, ভগবানের তেজরাশির কয়েকটি স্ফুলিঙ্গ মাত্র আমাদের মধ্যে নিবদ্ধ। আমাদিগকে এই ধারণার নিকট আত্মোৎসর্গ করিতে হইবে।

ঐহিক এবং জড় দেহের সুখদুঃখকে অগ্রাহ্য করিয়া যে এইভাবে আত্মনিবেদন করিতে পারে জীবনে তাহার সফলতা অবশ্যম্ভাবী। আমার আদর্শ যে একদিন জয়ী হইবে সে সম্বন্ধে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে। সুতরাং আমার স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমি কোন চিন্তাই করি না।

গবর্ণমেণ্টের সর্ত্তের উত্তরে আমি যাহা লিখিয়াছি তাহাতে আমি আমার মত স্পষ্ট করিয়া ব্যক্ত করিয়াছি। আমি উৎকৃষ্টতর সর্ত্ত পাইবার জন্য পাটোয়ারী চাল দিতেছি বলিয়া কোন কোন সমালোচক মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদের নির্দ্দয়তায় আমি দুঃখিত। আমি দোকানদার নাহি, দর কষাকষি আমি করি না। কুট চালের পিচ্ছিল পথ আমি ঘৃণা করি। আমি একটা আদর্শ ধরিয়া দণ্ডায়মান। ব্যস্‌, এইখানেই শেষ। আমি জীবনকে এতটা প্রিয় মনে করি না যে, তাহা রক্ষার জন্য আমি চালাকির আশ্রয় লইব। মূল্য সম্বন্ধে আমার ধারণা বাজারের ধারণা অপেক্ষ স্বতন্ত্র। শারীরিক বা বৈষয়িক সুখের নিরিখে জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ণয় করা যায় বলিয়া আমি মনে করি না। আমাদের সংগ্রাম দৈহিক শক্তির নহে। বৈষয়িক লাভও আমাদের সংগ্রামের উদ্দেশ্য নহে। সেণ্ট পল বলিয়াছেন—

"আমরা রক্তমাংসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি। আমাদের সংগ্রাম তাহাদের বিরুদ্ধে, যাহারা পৃথিবীর অন্ধকারের নায়ক, আমাদের সংগ্রাম উচ্চপদাধিষ্ঠিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে।” স্বাধীনতা এবং সত্যই আমাদের আদর্শ, রাত্রির পর যেমন দিন আসে, আমাদের চেষ্টাও ঠিক তেমনি সত্য সত্য সফল হইবেই। আমাদের শরীর নষ্ট হইয়া যাইতে পারে, কিন্তু অটল বিশ্বাস এবং দুর্জ্জয় সঙ্কল্পের বলে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের চেষ্টার সফল পরিণতি দেখিবার মত সৌভাগ্য কাহার হইবে একমাত্র ভগবানই তাহার বিধান কর্ত্তা। আমার সম্বন্ধে আমি বলিতে পারি যে, আমি আমার কাজ করিয়া যাইব, তারপর যাহা হয় হইবে।

আর একটা কথা বলিয়াই আমি আমার বক্তব্য শেষ করিব। আমি সুইট্‌জারল্যাণ্ডে যাইব কি না বর্ত্তমানে তাহা আমি স্থির করিতে পারি না। বর্ত্তমানে শরীরের অবস্থার দিক হইতেই সুইট্‌জারল্যাণ্ড যাইবার ক্লেশ সহ্য করিতে আমি অক্ষম। বর্ত্তমানে প্রথমতঃ ভারতের কোন স্বাস্থ্য-নিবাসে অবস্থান করিয়া আমাকে স্বাস্থ্য লাভ করিতে হইবে। কতদিনে আমি সুইট্‌জারল্যাণ্ড যাইবার উপযুক্ত স্বাস্থ্য লাভ করিব তাহার কোন স্থিরতা নাই। যাহা হউক, চিকিৎসকদের অভিমত এই যে, আমি অন্ততঃ আরও অনেকটা সুস্থ হইবার পুর্ব্বে সুইট্‌জারল্যাণ্ড যাওয়ার কথা উঠিতেই পারে না। আবার আমি যদি ভারতের কোন স্বাস্থ্য-নিবাসে অবস্থান করিয়াই আশানুরূপ স্বাস্থ্য লাভ করিতে পারি তাহা হইলে এবং স্বেচ্ছানির্ব্বাসন বরণ করিয়া না লইলে সুইট্‌জারল্যাণ্ড যাইবার আবশ্যকতাই বা কি?

অতঃপর সুইট্‌জারল্যাণ্ড যাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ব্বে আমাকে আমার আর্থিক সমস্যা ও আর্থিক সংস্থান সম্বন্ধেও বিবেচনা করিতে হইবে। পরিবারবর্গের সহিত, বিশেষ ভাবে পিতামাতার সহিত, আলোচনা করিতে হইবে। কয়েক মাসের মধ্যেই বাঙ্গলার রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্ত্তন হইতে পারে এবং বাঙ্গলা সরকারের ধারণাও পরিবর্ত্তিত হইতে পারে। কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার পূর্ব্বে এ সমস্ত বিষয় ভাল করিয়া বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে। যাহা হউক, এ বিষয়ে কোনরূপ বাধ্যবাধকতার মধ্যে না যাইয়া আমি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে চাই, যদি সরকার আমার সুইট্‌জারল্যাণ্ডে বাস বাধ্যতামূলক বলিয়াই মনে করেন তাহা হইলে আপনারা কোনরূপ ইতস্ততঃ না করিয়াই কথাবার্ত্তা চালান বন্ধ করুন। ঈশ্বর মহান্‌—অন্ততঃ তাঁহার সৃষ্ট পদার্থ অপেক্ষা মহান্‌—আমরা তাঁহাতে যখন বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছি তখন আমাদের দুঃখ করিবার কারণ থাকিতে পারে না।

আমার প্রতি অনুরক্ত ও সহানুভূতিসম্পন্ন অনেকের মনঃপীড়ার কারণ হওয়ায় আমি বড়ই দুঃখিত, কিন্তু এই মনে করিয়া আমি সান্ত্বনা লাভ করিতেছি যে, যাঁহারা একই মাতৃভূমির প্রতি আস্থাসম্পন্ন তাঁহারা পরস্পরের সুখের ও দুঃখের অংশ সমানভাবে গ্রহণের অধিকারী। আশা করি আপনার ভাল আছেন। ইতি—

(ইংরাজী হইতে অনুদিত)