দ্বিতীয় চরিতাষ্টক/রামগোপাল ঘোষ

বিখ্যাতবাগ্মী রামগোপাল ঘোষ।

 কলিকাতা নগরে ১২২১ সালের আশ্বিন মাসে (১৮১৫ খৃঃ) রামগোপাল জম্ম গ্রহণ করেন। ইনি জাতিতে কায়স্থ। পিতার নাম গোবিন্দচন্দ্র ঘোষ। গোবিন্দের অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। কথিত আছে, তিনি কলকাতার কোন সওদাগরি আফিসে সামান্য কর্ম্ম করিতেন এবং কোচবেহারের রাজার মোক্তার ছিলেন। রামগোপাল সিরবোরন্ সাহেবের ইংরাজী স্কুলে প্রথম শিক্ষা প্রাপ্ত হন। রামগোপালের জন্ম গ্রহণের পর বৎসরেই এদেশীয় ও বিদেশীয় প্রধান ২ লোকের যত্নে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। বোধ হয়, যেন, রামগোপালকে ভাল করিয়া ইংরাজী শিখাইবার জন্যই তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু কলেজের অধিষ্ঠান হইয়াছিল। যখন তাঁহার ৯ বৎসর বয়স, তৎকাল-সংঘটিত একটা যৎসামান্য ঘটনা, তাঁহাকে যাবতীয় ভবিষ্যৎ উন্নতির পথ দেখাইয়া দেয়।

 একদিন তাঁহার নিজ বাটাতে একটা বিবাহের সভা হইয়াছিল। প্রচলিত রীত্যনুসারে বালকেরা বর ও তৎপক্ষীয় ব্যক্তিগণের সহিত কৌতুক করিতে ছিল। রামগোপালও তাহাদের সঙ্গে মিলিয়া বরকে মিথ্যা ইংরাজীতে বিদ্রুপ করিতেছিলেন। যদিও সে ইংরাজীর কোন অর্থ ছিল না, কিন্তু তাহার উচ্চারণ ও স্বর-সাঙ্গত্যে সভাস্থ সকলেই বিস্মিত হইলেন। তাঁহারা রামগোপালকে পরামর্শ দিলেন যে, তিনি যদি ভাল করিয়া ইংরাজী শিক্ষা করেন, ইংরাজী ভাষায় উৎকৃষ্ট বক্তা হইতে পারিবেন। এই উপদেশ রামগোপালের হৃদয়ে প্রবেশ করিল। আপনাকে হিন্দু কলেজে নিযুক্ত করাইবার জন্য পিতার নিকট প্রার্থনা জানাইলেন। তখন হিন্দু কলেজের প্রতি ছাত্রের বেতন পাঁচ টাকারও অধিক ছিল। যদিও রামগোপালের পিতার তত তাধিক বেতন দিবার সঙ্গতি ছিল না, তথাপি পুত্রের আগ্রহ দেখিয়া তাঁহাকে হিন্দকালেজে নিযুক্ত করিয়া দিলেন।

 রামগোপাল যথোচিত যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে শিক্ষা করিতে লাগিলেন। তাঁহার শিক্ষা শক্তি দেখিয়া তাঁহার উপর শিক্ষক ও অধ্যক্ষগণের দৃষ্টি পড়ল। ডেবিড্ হেয়ার সাহেব তাঁহাকে অতিশয় স্নেহ করতেন। রামগোপালের পিতা কালেজের বেতন দিয়া উঠিতে পারেন না দেখিয়া উক্ত সাহেব তাঁহাকে অবৈতনিক ছাত্রগণের মধ্যে গণ্য করিয়া লইলেন। রামগোপাল ইহাতে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইয়া দ্বিগুণ উৎসাহে শিক্ষা করিতে লাগিলেন। তিনি কখনই অলস ছিলেন না, বিশেষতঃ পিতার অবস্থা মন্দ দেখিয়া তিনি শীঘ্র শীঘ্র কালেজের পড়া সারিয়া কাজের লোক হইবার এবং পরিবার পোষণ বিষয়ে পিতার সাহায্য করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। এই জন্য যত্ন ও শ্রমের সীমা ছিল না। চৌদ্দ বৎসর বয়স হইতে না হইতেই তিনি কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠিলেন। যখন যে শ্রেণীতে শিক্ষা করিতেন, সকল ছাত্রের প্রধান হইয়া থাকিতেন। এই সময়ে হেনরি লুইস বিবিয়ান্ ডিরোজিও নামক এক জন সাহেব কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষক নিযুক্ত হয়েন। তিনি অতিশয় চিন্তাশীল ও তার্কিক ছিলেন। ইউরোপীয় প্রাচীন ও মধ্যকালের দার্শনিকগণের অনেক গ্রন্থ তাঁহার পড়া ছিল। নিজেও গ্রন্থ কার ছিলেন। তৎকালে সকলেই তাঁহাকে এক জন প্রধান বিদ্বান্ বলিয়া জানিতেন। শ্রেণীর নির্দিষ্ট শিক্ষাদান করিয়া এতাদৃশ ব্যক্তির কখনই তৃপ্তি হইতে পারে না। তিনি কালেজ হইতে বাছিয়া বাছিয়া কতকগুলি বয়ঃপ্রাপ্ত ও বুদ্ধিমান, ছাত্র লইয়া একটা দলবদ্ধ করিলেন। কলেজের ছুটির পর তাহাদিগকে লইয়া উচ্চধরণের শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, মাধবচন্দ্র মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি এই দলের প্রধান ছিলেন। ডিরোজিও, লক্, রিড, স্ট‌ুয়ার্ট প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থকর্ত্তাদিগের পুস্তক অবলম্বনে তাঁহাদিগকে উপদেশ দিতে লাগিলেন। তাঁহার শিক্ষা প্রণালী অতি চমৎকার ছিল। ঐসকল দুরূহ গ্রন্থের ভাব, তিনি অতি সহজে তাঁহাদিগের হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দেন। তিনি নীতিবিজ্ঞান ও তর্কশাস্ত্রেরই অধিক উপদেশ দিতেন। এইরূপে ডিরোজিওর শিক্ষায় একদিকে যেমন তাঁহাদিগের ইংরাজীতে ব্যুৎপত্তি, এবং স্বাধীন চিন্তা ও তর্কশক্তির স্ফ‌ুর্ত্তি হইতে লাগিল, অন্যদিকে তেমনি জাতীয় ধর্ম্ম ও আচার ব্যবহারের বন্ধন শিথিল হইতে লাগিল। এই দল হইতেই বিলাতীয় খাদ্য ও বিলাতীয় সুরার প্রচলন আরম্ভ হয়। ক্রমে তাঁহারা এত বাড়াবাড়ি করিতে লাগিলেন যে, কালেজের দেশীয় অধ্যক্ষগণ তদ্দর্শনে ভীত হইলেন। রামগোপাল সকলের অপেক্ষা অধিক সাহসী ও অধিক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন; আবার সকলের অপেক্ষা দুরদর্শন ও আত্ম-সংযমের ক্ষমতা তাঁহার অধিক ছিল। তিনি ডিরোজিওর উপদেশ বুঝিতে যত যত্ন করিতেন, নিষিদ্ধ খাদ্যাদির ব্যবহার দ্বারা জ্ঞানের পরিচয় দিতে তত ব্যগ্র হইতেন না। এই জন্য তিনি লক্ পড়িতে পড়িতে এক দিন এমন একটি সুন্দর অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া ছিলেন, যাহা শুনিয়া ডিরোজিও বিস্মিত হন। রামগোপাল বলেন,—“লক, বুদ্ধি বৃত্তির বিবরণটী প্রাচীনের মস্তক ও বালকের ভাষার দ্বারা রচনা করিয়াছেন।” ইহার তাৎপর্য্য এই, বুদ্ধি বৃত্তি বিষয়ক সুকঠিন ভাব সকল এমন সহজ ভাষায় ব্যক্ত করিয়াছেন যে, তাহা বালকেও বুঝিতে পারে। যাহা হউক, ডিরোজিওর শিক্ষায় তাঁহদের আচার ব্যবহার যতই ভ্রষ্ট হউক, সেই শিক্ষায় যে, তাঁহারা মানুষ হইয়াছিলেন এবং ভবিষ্যতে অন্যাপেক্ষা অধিক উন্নতি করতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহাতে সংশয় নাই।

 রামগোপালের শিক্ষা বিবরণ অধুনাতন ইংরাজী শিক্ষার্থি-বালকগণের অনুকরণীয়। কিন্ত‌ু এখনকার শিক্ষা ও পরীক্ষা প্রণালী সেরূপ অনুকরণের প্রতিবন্ধক। রামগোপালের সময়ে কালেজে এখনকার মত রাশীকৃত পুস্তক পড়ান হইত না। লক্ ও ষ্টুয়ার্টের দর্শন শাস্ত্র, সেক‍্স্ পিয়ারের নাটক, রাসেলের ইউরোপ বৃত্তান্ত এবং পদার্থ বিদ্যার উপক্রমণিকা এইমাত্র রামগোপাল প্রধান রূপে শিক্ষা করিয়াছিলেন। এবং ডিরোজিও প্রতিষ্ঠিত তর্কসভায় নানা বিষয়ের বিচার ও কথোপকথন করিতেন। ডিরোজিও উন্নত ও প্রশস্ত ভাব সকল তাঁহার হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দিতেন। এই সকল উপায়ে এবং এইরূপ সুপ্রণালীতে তিনি কিরূপ লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন এবং বরযাত্রি-গণের ভবিষ্যৎ বাণী কিরূপ সফল করিয়াছিলেন, তাহ। অনেকেই অবগত আছেন। অল্পে অল্পে ইন্ধন প্রদান করিলে অল্প আগুনও প্রবল ও প্রজ্জ্বলি হইয়া উঠে। এককালে অধিক কাঠ চাপাইলে প্রবল আগুনও নিবিয়া যায়। রামগোপাল ইহার প্রথমটীর সুন্দর প্রমাণ দেখাইয়া গিয়াছেন। এবং এখনকার শিক্ষা বিভাগে দ্বিতীয়টীর প্রমাণ দেখা যাইতেছে। এখনকার বালকেরা স্বভাবতঃ যে বুদ্ধি, উৎসাহ ও শ্রমশক্তি লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন, শিক্ষা প্রণালীর দোযে; সে সকলের স্ফ‌ুর্ত্তি হওয়া দূরে থাকুক, অনেককে তাহা সমূলে হারাইয়া আসিতে হয়। ইহা অল্প আক্ষেপের বিষয় নহে। একজন বঙ্গ কবি, প্রচলিত প্রণালীতে শিক্ষিত ব্যক্তিগণ সম্বন্ধে একটী সুন্দুর ভাব প্রকাশ করিয়াছেন। তিনি বলেন, “কোন কোন বিলাতী দেসলাই যেমন আপন বাক‍্সের পার্শ্ব ভিন্ন অন্য স্থানে ঘষলে জ্বলে না, সেই রূপ এখন কার শিক্ষিতগণের বুদ্ধি, পঠিত পুস্তক তিন্ন অন্যত্র দীপ্তি পায় না।” যাহা হউক, ডিরোজিওর শিক্ষায় হিন্দু ছাত্রের আচার ভ্রষ্ট ও নীতিভ্রষট হইয়াছে বলিয়া। দেশীয় অধ্যক্ষের উক্ত শিক্ষককে পদচ্যুত করিবার জন্য উপরিতন কর্ত্ত‌ৃপক্ষের নিকট অনুরোধ করিলেন। যেসকল ছাত্রের দোষ প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাদিগকেও তাড়াইয়া দিবার প্রস্তাব করা হইল! ডিরোজিও, উত্তমরূপে আত্ম-পক্ষ সমর্থন করিলেও পদচ্যুত হইলেন। তাঁহার পদচ্যুতিতে উচ্চ শ্রেণীস্থ ছাত্রগণ অত্যন্ত ভগ্নোৎসহ হইলেন। ইহা পূর্ব্বক অনেকে কলেজ ছাড়িলেন। রামগোপালেরও কলেজ ছাড়িয়া কাজ কর্ম্ম করিবার ইচ্ছা হইল। এই সময়ে জোজেফ্ নামক এক জন ইহুদি জাতীয় বণিক, কলভিন কুটীর অধ্যক্ষ আণ্ডার সন্ সাহেবের নিকট একজন ভাল বাঙ্গালী কর্ম্মচারী প্রার্থনা করেন। আণ্ডারসন্, ডেবিড্ হেয়ারকে হিন্দু কলেজের এক জন উৎকৃষ্ট ছাত্র পাঠাইতে বলেন। কালেজে প্রবিষ্ট হওয়া অবধি রামগোপালের উপর ডেবিডের দৃষ্টি ছিল। তিনি সকলের অপেক্ষা রামগোপালকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও প্রত্যুৎপন্ন মতি বলিয়া জানিতেন। কর্ম্মক্ষেত্রে ভাগ্য পরীক্ষার্থ তিনি রামগোপালকেই জোজেফের নিকট পাঠাইলেন। রামগোপাল যখন জোজেফের অফিসে কর্ম্ম করিতে গেলেন তখন তার বয়স ১৭ বৎসর মাত্র। জাজেফ্ যেরূপ লোক চাহিয়াছিলেন, সেই রূপ পাইলেন। রামগোপালের বিদ্যা, কার্য্য দক্ষতা ও নিরালস্য দেখিয়া তিনি ক্রমে ক্রমে তাঁহার উপর সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। বিশেষতঃ রামগোপাল একবার তাঁহার প্রভুর আদেশে এদেশের উৎপন্ন ও শিল্পজাত দ্রব্য সকলের রপ্তানি বিষয়ে এমন একখানি সুন্দর রিপোর্ট লিখিয়াছিলেন, এবং তাহাতে এত অনুসন্ধান ও পরিশ্রমের পরিচয় দিয়াছিলেন যে, তদ্দর্শন তাঁহার প্রভু যারপর নাই সন্তুষ্ট হন এবং তাহা হইতে তিনি অনেক প্রয়োজনীয় বিষয়ের সন্ধান পান। রামগোপাল বণিকদিগের কুটীর কাজে প্রথম প্রবিষ্ট, এই জন্য উক্ত কার্য্যে তাঁহার সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা না থাকায় হরিমোহন সরকার ঐ কুটীর মুছদ্দি হন এবং রামগোপাল তাঁহার সহকারী নিযুক্ত হন। রামগোপাল পরিশ্রম ও মনোযোগ সহকারে প্রভু কার্য্য সম্পাদনে নিযুক্ত থাকিলেও মানসিক উৎকৃষ্ট বৃত্তি সকলের উন্নতি সাধনে নিবৃত্ত হন নাই। তিনি ইতিহাস, কাব্য ও পরিণামবাদ শাস্ত্রের নিয়তই আলোচনা করিতেন। সেকস্ পিয়ারের নাটক তাঁহার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। তিনি নিজ বাটীতে বন্ধুগণের সহিত মিলিয়া ঐ কাব্যের গুণ ও সৌন্দর্য্য বিষয়ে তর্ক বিতর্ক করিতেন। প্রতি শনিবার অপরাহ্নে হিন্দু কলেজে গিয়া উচ্চ শ্রেণীস্থ ছাত্রগণের সহিত ইংরাজী সাহিত্যের আলোচনা করিতেন। তখন স্পীড্ নামক এক জন সাহেব কালেজের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি বালকগণের বর্ণাশুদ্ধি শোধন বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। রামগোপাল বলিতেন, একটা মাত্র বর্ণাশুদ্ধি দ্বারা বড় বড় বিদ্বানেরও সাহিত্য জ্ঞান বিষয়িনী সুখ্যাতি নষ্ট হয়। এই জন্য তিনি স্পীড্ সাহেবের উপদেশানুসারে শ্রুত লিখন বিষয়েও বিশেষ মনোযোগ করিতেন। এতদ্ব্যতীত মাণিক তলার শ্রী কৃষ্ণ মল্লিকের বাগানে একটী সাহিত্যালোচনার সভা ছিল, রামগোপাল নিয়মিতরূপে ঐ সভাতেও উপস্থিত হইতেন। কারণ তাঁহার পূর্ব্বোপদেষ্টা ও পরম বন্ধু ডিরোজিও সাহেব ঐ সভার সভাপতি ছিলেন। তিনি যে বাগ্মীতা নিবন্ধন দেশ বিদেশে সুখ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন, যে বাক্ শক্তির বলে দেশের অনেক উপকার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, এই সভায় তাহার সূত্রপাত হয়। তিনি বাক্ পটুতা লাভের জন্য নিয়মিতরূপে বক্তৃতা করিতেন। এই সভার এমন নাম বাহির হইয়াছিল যে, লর্ড উলিয়ম বেণ্টিঙ্ক বাহাদুর আপনার কার্য্যাধ্যক্ষ দ্বারা উহার তত্ত্বাবধান করিতেন।

 এই সময়ে তাঁহার সহধ্যায়ী রসিককৃষ্ণ মল্লিক “জ্ঞানান্বেষণ” নামক একখানি সম্বাদ পত্র প্রচার করিতে ছিলেন। রামগোপাল তাহাতে নিয়মিত রূপে লিখিতেন। তিনি দেশীয় বাণিজ্য ও রাজনীতি বিষয়েই অধিক প্রস্তাব লিখিতেন। আমদানী দ্রব্যের উপর শুল্ক থাকিবে কি উঠিয়া যাইবে, গবর্ণমেণ্টেে যখন এইরূপ আন্দোলন হইতে ছিল, তখন রামগোপাল উক্ত কাগজে ঐ বিষয়ে “সিভিস্” স্বাক্ষরিত কতকগুলি পত্র লিখিয়া ছিলেন। অনেকে বিশ্বাস করেন, ঐ অনিষ্টকর শুল্ক রহিত বিষয়ে রামগোপালের পত্র সকল বিশেষ সহায়তা করিয়াছিল। “জ্ঞানান্বেষণ’ বন্ধ হইলে, কিশোরীচাঁদ মিত্রের সম্পাদিত “বঙ্গ দর্শক” পত্রে সময়ে ২ লিখিতে লাগিলেন। এখন তিনি আপনার কাজে এত অধিক ব্যস্ত হইয়াছিলেন যে, ইচ্ছানুরূপ প্রস্তাব লিখিতে অবসর পাইতেন না।

 জোজেফ্ রামগোপালের কাজে এত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে এত অধিক বিশ্বাস করিতেন যে, কয়েক বৎসর পরে তিনি যখন বিলাত যান, তাঁহার কুটীর যাবতীয় কার্য্যভার রামগোপালের উপর অর্পণ করিয়া গিয়াছিলেন। রামগোপালও সেই বিশ্বাসের উপযুক্ত কার্য্য করেন। জোজেফ্ প্রত্যাগত হইয়া দেখিলেন, রামগোপালের কর্ত্তৃত্বে তাঁহার কার্য্যের অধিকতর উন্নতি হইয়াছে এবং আশাতীত লাভ দাঁড়াইয়াছে। ইহাতে রামগোপালের উপর তাঁহার সন্তোষ ও বিশ্বাসের ইয়ত্তা রহিল না। কিছুদিন পরে কেল‍্সল্ নামক একজন সাহেব, জোজেফের অংশী হইলেন। ঐসময়ে রামগোপাল ঐ কুঠির মুচ্ছদ্দি হইলেন। তাঁহার অধীনে বিলক্ষণ উন্নতির সহিত কুঠির কাজ চলিতেছে, মনোবাদ হওয়ায় এমন সময়ে দুই সাহেব পৃথক হইয়া কাজ চালাইতে লাগিলেন। রামগোপাল তাঁহার পূর্ব্ব সহায় আণ্ডারসন্ সাহেবের সহিত পরামর্শ করিয়া কেল‍্সলের দিকে রহিলেন। বুদ্ধি, বিজ্ঞতা, পরিশ্রম ও ন্যায়পরতা দ্বারা পূর্ব্ব প্রভুর ন্যায় অভিনব প্রভুরও প্রিয় ও বিশ্বাস ভাজন হইলেন। কয়েক বৎসর পরেই তিনি ঐ কুঠির অংশী হইলেন এবং ঐ কুঠির নাম “কেল‍্সল্, ঘোষ এণ্ড কোঃ” হইল।

 এইরূপে তিনি ইংরাজ বণিকগণের সহযোগী হইয়া বহু সম্মান ও বহু সম্পত্তির অধিকারী হইয়া উঠিলেন। ১২৫৭ সালে বণিক্ সভার মেম্বর হইলেন। স্বভাব পূর্ব্ববৎ রহিল। এখনও তিনি পূর্ব্ব বন্ধুগণের সহিত সমান বন্ধুত্ব করিতেন। যাঁহারা তাঁহার পূর্ব্বে কার্য্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াছিলেন, তিনি তাঁহাদের অপেক্ষা অধিক উন্নত হইয়াও তাঁহাদের দ্বেষ বা হিংসার ভাজন হন নাই। তাঁহার যেমন প্রচুর অর্থাগম হইতে লাগিল, তিনি তেমনিই বাবুগিরি করিতে লাগিলেন। তিনি খরচ পত্র বিষয়ে অতিশয় মুক্ত হস্ত ছিলেন, কোনরূপ ব্যয়ে কিছুমাত্র কুণ্ঠতা প্রকাশ করিতেন না। তিনি কামরহাটা নামক স্থানে একটা উৎকৃষ্ট বাগান ভাড়া লইয়াছিলেন, তথায় “রাজারহালে” বাস করিতেন। বন্ধু বর্গকে নিয়তই ভোজ দিতেন। এ ছাড়া তিনি আপনার ব্যবস্থার জন্য ভাগীরথীতে এক খানি ষ্টিমার রাখিয়াছিলেন, শারীরিক স্বাস্থ্য বর্দ্ধনার্থ বন্ধু বান্ধব লইয়া মধ্যে মধ্যে জল বেড়াইতে যাইতেন। “লোটাস্” ঐ ষ্টিমারের নাম রাখিয়াছিলেন। মনুষ্য জীবনের উপভোগ্য কি তিনি জানতেন এবং প্রকৃতরূপে তাহা ভোগ করিয়া ছিলেন। আপনার কাজ ও আপনার সছন্দতা ছাড়া মানুষের অধিকতর তুষ্টিকর আরও একটা কাজ আছে, ইহা সর্ব্বদাই তাঁহার মনে জাগিত। কিরূপে দেশের লোকের প্রকৃত শিক্ষা হইবে, কিরূপে গবর্ণমেণ্টের সুশাসন বৃদ্ধি হইবে, কিরূপে জিতগণের উপর জেতৃগণের অত্যাচার নিবারিত হইবে, কিরূপে সুশিক্ষিত দেশীয়গণ লাভজনক ও গুরুভারবহ রাজকর্ম্ম সকল প্রাপ্ত হইবে,—সৌভাগ্য ও আমোদ সম্ভোগে, তাঁহাকে এ সকল ভুলাইতে পারে নাই।

 রামগোপাল যে সময়ে খবরের কাগজে হিতকর প্রস্তাব সকল লিখিতেন, সেই সময়েই সর্ব্বপ্রকার জ্ঞনোপার্জ্জনের জন্য তিনি আর একটী সভা স্থাপন করেন। তিনিই ঐ সভার প্রধান ছিলেন। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রভৃতি প্রধান প্রধান লোকেরা তাঁহার সহযোগী ছিলেন। রামগোপালের কার্য্য বাহুল্য প্রযুক্ত তারাচাঁদ বাবুই ক্রমে তাহার প্রধান হইয়া উঠেন। বাকপটুতা ও রাজনীতির আলোচনায় যে সকল ব্যক্তি তৎকালে কৃতকার্য্যতা লাভ করিয়াছিলেন, এই সভাই তাঁহাদের পাঠশালা। অক‍্স্ ফোর্ড কলেজের ছাত্র-সভা, বিলাতী বাগ্মীগণের যেরূপ সাহায্য করিয়াছিল, এই সভা এদেশীয় বক্তাদিগের সেইরূপ সাহায্য করে। প্রথমে হিন্দু কলেজের “ছলে” এই সভার অধিবেশন হইত, পরে কোন ভদ্র লোকের বাটী, সভার স্থান রূপে নির্দ্দিষ্ট হয়। যাহাহউক, যখন তাঁহার প্রাগুক্ত বিষয় সকলে তাঁহাদের নবোপার্জ্জিতা বাক্ পটুতা সহকারে বক্ত‌ৃতা করিয়া সভাগৃহ প্রতিধ্বনিত করিতেছিলেন, সেই সময়ে দ্বারকানাথ ঠাকুর, পার্লিয়ামেণ্টের পূর্ধ্বতন সভ্য বিখ্যাত বাগ্মী জর্জটম্সন্ নামক একজন সাহেবকে সঙ্গে লইয়া বিলাত হইতে প্রত্যাগত ইলেন। ঐ সভার নূতন ভাব ও নূতন চিন্তার বক্তৃতা শুনিয়া এদেশের প্রধান প্রধান রাজনীতিজ্ঞ সাহেবেরও চককিয়া উঠিতেন। জর্জটম‍্সনের আগমন বার্ত্তা শুনিয়া রামগোপাল অত্যন্ত আহলাদিত হইলেন। “যে যাহা চায় সে তাহা পায়।” এই প্রবাদ সার্থক মনে করিলেন। রাজনীতি বিষয়িণী বক্ত‌ৃতা করিতে ও শুনিতেই তাঁহার অন্তর নিয়ত উৎসুক ছিল। জর্জটম্সন‍্কে প্রত্যুদগমন করিয়া সভায় আনিলেন। সাহেব তাঁহাদের উদ্দেশ্য অবগত হইয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং একটী বক্ত‌ৃতা দ্বারা তাঁহাদিগকে উপদেশ দেন। বিলাতের পার্লিয়ামেণ্ট মহাসভায় সচরাচর যেরূপ বক্ত‌ৃতা হইয়া থাকে, টম্সনের বক্ত‌ৃতা সেই জাতীয়। ইহার পূর্ব্বে ভারতবাসি-গণ এমন বক্ত‌ৃতা আর কখন শুনেন নাই। এই বক্ত‌ৃতার পর রামগোপালের সভার প্রকৃতি ও নাম পরিবর্ত্তিত হইল। শেষে উহার “বেঙ্গল ব্রিটিস ইণ্ডিয়া সোসাইটি” এই নাম হইয়াছিল।

 একদিন “লোটাসে” জল বেড়াইতে ছিলেন। পূর্ব্বোক্ত স্পীড্ জর্জটম‍্সন্ এবং অন্যান্য অনেকগুলি দেশীয় বন্ধুর সহিত আমোদ করিতেছিলেন। স্পীড সাহেবও বক্তৃতা করিতে পারিতেন, কিন্তু তাঁহার বক্তৃতায় শ্রোতৃগণের ধৈর্য্য থাকিত না, বরং তাঁহারা বিরক্ত হইয়া উঠিতেন। বক্তৃতা, গল্প, কথোপকথনে খুব আমেদ হইতেছে, “লোটাস্” ধীরে ধীরে জাহ্নবীর মৃদু স্রোতের সঙ্গে দক্ষিণ দিকে চলিতেছে, এমন সময়ে অন্যান্য নৌকা হইতে “বান ডাকিবার” গোল উঠিল। তৎকালে বান অত্যন্ত প্রবল হইত। ভয়ে সকলে উদ্বিগ্ন হইলেন, তীরে যাইবার জন্য রামগোপালকে পরামর্শ দিলেন। রামগোপাল হাসিতে হাসিতে বিদ্রুপ করিয়া বলিলেন,—“রোরে[১] আমার ভয় হওয়া অসম্ভব, কারণ আমি বহুক্ষণ ধরিয়া স্পীড্ সাহেবের বক্তৃতা শুনিয়াছি।” এস্থলে কথার মিষ্টতা ছাড়া রামগোপালের সাহস ও স্পষ্টবাদিতাও প্রকাশ হইয়াছিল।

 তিনি, অল্প বুদ্ধি-ক্ষমতা বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের সর্ব্বদাই সাহায্য করিতেন। তাঁহার পর যে সকল ব্যক্তি বিলাতী কুটীর অংশী বা মুচ্ছদ্দি হইয়াছিলেন, তম্মধ্যে রামগোপালের সাহায্যই অনেকের প্রধান সম্বল ছিল। তিনি এদেশীয় ব্যক্তিগণের লেখা পড়া শিক্ষা বিষয়ে অনেক উৎসাহ দিয়াগিয়াছেন। তিনি একবার কোন নির্দ্দিষ্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রগণকে এক হাজার টাকা পারিতোষিক দিয়াছিলেন। আর একবার, মার্সমান সাহেবের ভারত ইতিহাসের একশত খণ্ড নিজ ব্যয়ে ক্রয় করিয়া পারিতোষিক দিয়াছিলেন। হিন্দু কলেজের ভাল ২ ছাত্রদিগকে তিনি বর্ষে ২ বহু সংখ্য সোনা রুপার পদক পারিতোষিক দিতেন।

 রামগোপাল কেল‍্সাল্ সাহেবের সঙ্গে ১২৫৩ সাল (১৮৪৬ খৃঃ) পর্য্যন্ত নির্ব্বিঘ্নে কাজ করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার এই নির্ব্বিঘ্নতা বরাবর ছিল না। পর বৎসর ইংরাজদিগের কুটির কাজের বড় ব্যাঘাত উপস্থিত ইইয়াছিল। দেউলিয়া হইয়া অনেক বণিককে কুটির কাজ বন্ধ করিতে হইয়াছিল। রামগোপালও এই গোলযোগে বিপদে পড়িয়াছিলেন। তিনি সেই সময়ে পাওনা টাকার বিল, বিলাতের বণিকদিগের নিকট পাঠাইয়া ছিলেন। এদেশে বাণিজ্যের অসুবিধা হওয়ায় তিনি সেই সকল টাকা পাইবেন কিনা তাহাতে সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল। সে টাকা না পাইলে তাঁহাকে এক কালে নিঃস্ব হইয়া পড়িতে হইত। এই সময়ে তাঁহার বিষয় সকল “বেনামি” করিতে অনেকে পরামর্শ দিয়াছিলেন। বিষয় “বেনামি করিয়া পাওনাদারকে ফাকি দেওয়া, এদেশের অনেকের অভাব ছিল এবং অদ্যাপি আছে। কিন্তু রামগোপাল ঐ প্রস্তাবে ঘৃণা প্রকাশ করিয়া, “যদি দেনা পরিশোধ করিতে পরিধেয় বস্ত্রও বিক্রয় করিতে হয়, তাহাও করিব।” এই কথা বলিয়া ছিলেন। যাহা হউক, সৌভাগ্য বশতঃ তিনি বিলাত। হইতে বিলশোধ টাকা পাইয়া ছিলেন, এদেশীয় মহাজনদিগের ঋণ পরিশোধ করিবার জন্য তাঁহাকে এক পয়সাও লোকসান্ দিতে হয় নাই। ইহার কিছু কাল পরে অংশী সাহেবের সঙ্গে কিঞ্চিৎ মনোবাদ হওয়ায় তাঁহারা উভয়ে পৃথক্ হইলেন। এই সময়ে তিনি আপন লাভ স্বরূপ দুই লক্ষ টাকা পাইয়াছিলেন। কিন্তু তৎসদৃশ “সাখরচে” লোকের পক্ষে দুই লক্ষ টাকা যথেষ্ট নহে। কিছু কাল কর্ম্ম কাজ শূন্য হইয়া রহিলেন। তাঁহার পূর্ব্ব সহায় আণ্ডারসন্ সাহেব তখন বিলাতে ছিলেন। তিনি কাজ কর্ম্মের কোন সুবিধা করিয়া দিতে পারেন কিনা জিজ্ঞাসা করিয়া রামগোপাল পত্র লিখিলেন।

 এই পত্রের উত্তর আসিবার পূর্ব্বে, বাঙ্গালা গবর্নমেণ্ট তাঁহাকে কলিকাতার ছোট আদালতের বিচারপতি নিযুক্ত করিতে চাহেন। তিনি কখনই ইষ্ট‌্ইণ্ডিয়া কোম্পানির লুন খান নাই, এই জন্য অনেক বিবেচনার পর ঐ পদ গ্রহণে অস্বীকার করিলেন। ইতি মধ্যে বিলাত হইতে পত্রের উত্তর আইল। আণ্ডার‍্সন্ সাহেব রামগোপালকে স্বয়ং কুটী করিতে পরামর্শ দিয়াছিলেন এবং আপনার ভ্রাতুস্পুত্রের নামে, রামগোপালের কুটির সহিত সংসৃষ্ট একটী কুটি বিলাতে স্থাপন করিলেন। রামগোপালের কুটির “আর্, জি, ঘোষ এণ্ড কোঃ” এই নাম হইল। রামগোপাল বেশ সুবিধার সহিত কাজ চালাইতে লাগিলেন। তিনি এই সঙ্গে আকায়েবে আরাকান দেশেৎপন্ন চাউলের কারবার আরম্ভ করিলেন। ইহাতে বিলক্ষণ লাভ হইতে লাগিল। তিনি অন্য নিরপেক্ষ হইয়া স্বয়ং কারবার আরম্ভ করিয়া সম্পূর্ণ কৃতকার্য্য হইলেন। তাঁহার ন্যায়পরতা ও সত্যনিষ্ঠাই এত উন্নতির কারণ। তিনি ঋণ পরিশোধ বিষয়ে অত্যন্ত বাঙ‍্নিষ্ঠ ছিলেন। মহাজনেরা তাঁহার কথার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিত। কথিত আছে, কোন সময়ে এক জন ধনী কোন খত্ বা বন্ধক না লইয়া তাঁহাকে এক লক্ষ টাকা কর্জ্জ দিয়াছিলেন। ইহাতে ধনীর আত্মীয়েরা তাঁহাকে নির্ব্বোধ বলিয়া তিরস্কার করেন। ধনী, তাহার এই মাত্র উত্তর করেন যে, “পূর্ব্বের সূর্য্য পশ্চিমে উদিত হইলেও রামগোপাল আমাকে ঠকাইবে না।” এই রূপে রামগোপাল আপন কাজের যেরূপ উন্নতি করিয়াছিলেন, তাহা সবিশেষ লিখিয়া উঠা যায় না।

 জর্জটম‍্সনের যত্নে ও বক্তৃতায় রামগোপালের রাজনৈতিক সভার অধিকতর উন্নতি হইয়াছিল; কিন্তু তিনি হঠাৎ এদেশ ত্যাগ করায় সভা ভাঙ্গা পড়িয়া গেল। বোধ হয়, যেন আবার পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক শক্তির সহিত গাত্রোত্থান করিবার জন্যই সভার অবনতি হইয়াছিল। রামগোপালের দ্বিগুণ যত্নে ও পরিশ্রমে সভার কাজ আবার উত্তমরূপে চলিতে লাগিল। এই সময়ে ফৌজদারী বালাখানায় সভার অধিবেশন হইত। কিছু দিন পূর্ব্ব হইতেই সাহেব ও সুশিক্ষিত বাঙ্গালিদিগের মধ্যে মনোবাদ চলিয়া আসিতে ছিল। সাহেবদের বিবেচনায় তখনকার সুশিক্ষিতগণ অত্যন্ত অবিনয়ী হইয়া উঠিয়াছিলেন। যে হেতু তাঁহারা প্রাচীন বাঙ্গালিদিগের ন্যায় সাহেবদের সম্মান করেন না, এবং জেতৃগণের সঙ্গে রাজনৈতিক সমান স্বত্ব ভোগ করিতে চান। রামগোপালের সভার বক্তৃতা দ্বারা সুশিক্ষিতগণের মত সমর্থিত হইত। এই জন্য এই সময়ে ঐ মনোবাদ আরও বর্দ্ধিত হইয়াছিল। বিশেষতঃ ঐ সময়ে গবর্ণমেণ্টে একটী ফৌজদারী আইনের পাণ্ড‌ুলিপির বিচার হইতে ছিল। তাহাতে সাহেব ও বাঙ্গালিদিগকে একবিধ শাসনের অধীন করা প্রস্তাবিত হইয়াছিল। রামগোপালের সভা উহার পক্ষতা করিয়াছিলেন। সাহেবরা ইহা জানিতে পারিয়া “তেলে বেগুনে জ্বলিয়া গেলেন” রামগোপালই, “অসমান ব্যক্তিগণের মধ্যে সমতা স্থাপনের মূল,” ইহা স্থির করিয়া তাঁহার উপর বিদ্বেষ প্রকাশ ও তাঁহার দুর্নাম রটনা করিতে লাগিলেন। ইহাতে রামগোপাল আত্ম-পক্ষ সমর্থন ও সাহেবদিগের অনৈসর্গিক বাসনার বর্ণন করিয়া চল্লিশ পৃষ্ঠা পরিমিত একখানি পুস্তিকা বাহির করেন। তাহা দেশ বিদেশ সর্ব্বত্র সমাদৃত হইয়াছিল। বাঙ্গালীর অনুকূলে উপরি উক্ত আইনটী প্রস্তাবিত হইয়াছিল বলিয়া, সাহেবরা উহাকে “ব্ল্যাক একট্” বলিতেন। এই নাম এখনও জনসমাজে পরিচিত।

 তিনি এদেশের শিক্ষোন্নতি সম্বন্ধে অনেক পরিশ্রম করিয়া গিয়াছেন। তিনি, শিক্ষা বিভাগের প্রধান কর্মচারী ড্রিঙ্ক‌্ ওয়াটার বেথুন্ সাহেবের দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। শিক্ষা সম্বন্ধে যেখানে যে কিছু হিতকর অনুষ্ঠান হইত, রামগোপাল সর্ব্বত্রেই প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। হুগলী কলেজের উন্নতি পক্ষে তিনি অনেক চেষ্টা করিয়াছেন। বিশেষ কোন কার্য্যোপলক্ষে তিনি হেলিডে, বিডন, গ্রাণ্ট, ডালহৌসী, ম্যাডক্ প্রভৃতি মহামান্য সাহেবদিগের পার্শ্বে উপবিষ্ট হইয়া সহযোগিতা করিতেন। এতদ্ব্যতীত যেখানে যত, কি রাজনৈতিক, কি সামাজিক সভা ছিল, কিম্বা হিতকর কার্য্যের অনুষ্ঠান বা অনিষ্টকর নিয়মাদির পরিবর্ত্তন অন্য সময়ে সময়ে যেসকল সভাধিবেশন হইত, সর্ব্বত্রেই রামগোপালের কার্য ক্ষমতা প্রকাশ পাইত। একবার শিক্ষা বিভাগ হইতে এইরূপ একটা নিয়ম হয় যে, তৎকালীন যাবতীয় বাঙ্গালী স্কুলমাস্টারদিগকে বাঙ্গালা ভাষায় একটা নির্দ্দি ষ্ট পরীক্ষা দিতে হইবে, উত্তীর্ণ হইতে না পারিলে চাকরী যাইবে। রামগোপাল প্রতিবাদ করিয়া এই নিয়ম রহিত করিয়া দেন। তাঁহার প্রতিবাদের মূল যুক্তি এই, যাঁহারা বালককাল হইতে কেবল মাত্র ইংরাজী ভাষার আলোচনা করিয়াছেন, ভাল করিয়া বাঙ্গালা শিখেন নাই, হঠাৎ তাঁহাদিগকে বাঙ্গালা পরীক্ষার অধীন করিয়া বিপদে ফেলা অন্যায়। কলিকাতাস্থ গবর্ণমেণ্ট হাউসের দক্ষিণে গড়ের মাঠে পূর্ব্বতন গবর্ণর হার্ডিঞ্জ সাহেবের যে প্রস্তরময়ী প্রতিমূর্ত্তি অশ্ব পৃষ্ঠে দৃষ্ট হয়, তাহা রামগোপালের মনঃসম্ভূত। কয়েক জন ক্ষমতাশালী বক্তা ঐ রূপ মূর্ত্তি নির্মাণের প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। কিন্তু রামগোপাল তাঁহাদিগকে নিরস্ত করিয়া আপনার মত বজায় রাখিতে অসমর্থ হন নাই। কোন বিষয়ের তত্ত্বাবধান বা অনুসন্ধান করিবার জন্য গবর্ণমেণ্ট সময়ে সময়ে যে কমিটী নিযুক্ত করিতেন। তাহার কোনটাই রামগোপালকে ছাড়িয়া হইত না। ১২৫৫ সালে তিনি কলিকাতার ডিস‍্ট্রিক‍্ট দাতব্য চিকিৎসালয়ের মেম্বার হন।

 যখন ১২৬০ সালে (১৮৫৩ খৃঃ) কোম্পানির সনন্দ পরিবর্ত্তনের এবং ভারতবর্ষীয় শাসনপ্রণালী সংশোধনের প্রস্তাব পার্লিয়ামেণ্ট মহাসভায় উত্থাপিত হইয়াছিল, তখন রামগোপাল মনে করিয়াছিলেন যে, এখন তাঁহার অলস হইয়া বসিয়া থাকিবার সময় নয়। তিনি টাউন্-হলে একটী সভা আহ্বান করিলেন। ঐ সভায় দেশীয় সকল শ্রেণীর লোকই উপস্থিত হইয়াছিলেন। উহাতে প্রায় দশহাজার লোকের সমাগম হয়। রামগোপাল একখানি চেয়ারের উপর দণ্ডায়মান হইয়া উচ্চ ও স্পষ্ট স্বরে বক্তৃতা করেন। তাঁহার বক্তৃতার প্রধান বিষয় এই ছিল যে, ভারতবর্ষীয় সুশিক্ষিতগণের “সিবিল-সরবিসে” প্রবেশাধিকার পাওয়া উচিত। হ্যালিডে সাহেব “দেশীয়গণকে উক্ত কার্য্যে নিযুক্ত করা উচিত নহে।” বলিয়া পার্লিয়ামেণ্টে তাহার এই যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছিলেন যে, দেশীয় সুশিক্ষিতগণকে উক্তবিধ উচ্চপদ দিলে তাহাদের শত্রু বৃদ্ধি করা হইবে। রামগোপাল প্রথমে বিশেষরূপে এই যুক্তির খণ্ডন করিলেন। পরে, দেশীয়গণকে উচ্চ শিক্ষা প্রদান করিয়া, উচ্চপদলাভে বঞ্চিত রাখার যে রাজনীতি তাহার সম্যক্ দোষ প্রদর্শন করিলেন। রামগোপাল সুদীর্ঘ ও সুফল দায়িনী বক্তৃতা শেষ করিলে প্রশংসা বাদে সভাগৃহ প্রতিধ্বনিত হইল। সর্ রাজা রাধাকান্তদেব এই সভার সভাপতি ছিলেন। তিনি রামগোপালকে বলিলেন, “ঈশ্বর তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন, তুমি এইরূপে চিরকাল স্বদেশের হিতসাধন কর। তুমিই আমাদের সকলের মুখপাত, তুমিই আমাদের জাতির আভরণ।” রামগোপাল ইহার উত্তরে বিনীতভাবে বলিলেন—“আমি বক্তৃতায় কৃতকার্য্য হইয়াছি একথা আপনার মুখে শুনিয়া আমার মনে গর্ব্ব উপস্থিত হইতেছে। স্বদেশ আপনার কাছে অধিক ঋণী, কারণ আমাপেক্ষা আপনার অধিক উপকারের ক্ষমতা আছে।” বক্ত‌ৃতা পুস্তকারে মুদ্রিত হইয়া দেশ বিদেশে প্রেরিত হইল। ইহা ইংলণ্ডস্থ ব্যক্তিগণেরও হৃদয় ভেদ করিল। অনেক পত্রিকা সম্পাদক, সুবিখ্যাত বার্ক ও সেরিডেনের বক্ত‌ৃতার সহিত ইহার তুলনা করিতে লাগিলেন। ঐ বক্ত‌ৃতা পাঠ করিয়া ইংলণ্ডের রাজমন্ত্রীরা ভারতবর্ষের বিষয় সবিশেষ রূপে জানিতে উৎসুক হইয়াছিলেন। ভারতবর্ষের যে সকল ইংরাজ কর্ম্মচারি কর্ম্মত্যাগ করিয়া তৎকালে স্বদেশে বাস করিতেছিলেন, রাজমন্ত্রীরা তাঁহাদের নিকট ভারতবর্ষের সন্ধান লইতেন।

 তাঁহার আর দুইটী প্রধান কীর্ত্তির বিষয়; এই স্থলেই লিখিত হইবে। তাহা এদেশের ইতর সাধারণ সকলেই অবগত আছেন। কলিকাতার মিউনিসিপ্যাল্ কমিটী, নিমতলার শবদাহ ঘাট স্থানান্তর করিবার প্রস্তাব করেন। এবং তাঁহারা যে স্থানে ঐ ঘাট নির্দ্দিষ্ট করিয়াছিলেন, তাহা সহর হইতে অনেক দূর,—দক্ষিণ দিগ্বর্ত্তী। সে স্থানে ঐ ঘাট হইলে, যথা সময়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনে সহরস্থ লোকের যারপর নাই ক্লেশ ও অসুবিধা হইবে, কমিটী তাহা বিবেচনা করেন নাই। দেশের অনেক লোকে এই বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য রামগোপালকে ধরিলেন। হিন্দুরা, যথাবিহিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যাঘাতে ধর্ম্ম হানিরও শঙ্কা করিয়াছিলেন। রামগোপাল নিজে ইহার জন্য ভীত হয়েন নাই। মৃত্যুর পর তাঁহার শব সমাহিতই হউক কিম্বা দগ্ধই হউক, তিনি তাহা কিছু ভাবিতেন না। কিন্তু দেশস্থ ব্যক্তিগণের জন্য দুঃখিত হইলেন। তিনি বাক্-পটুতরূপ সুতীক্ষ অস্ত্রে সজ্জিত হইয়া এযুদ্ধেও জয়লাভ করিলেন। নিমতলার ঘাট, নিমতলায়ই রহিল।

 ইহার পর হইতে রামগোপালের স্বাস্থ্যভঙ্গ হইতে লাগিল। তিনি সর্ব্ব প্রকার চিন্তা ও কাজ কর্ম্মের গোল যোগ ত্যাগ করিয়া নির্জ্জন বাসে উৎসুক হইলেন। ক্রমে অত্যন্ত পীড়িত হইয়া পড়িলেন। এই সময়ে সম্বাদ পাইলেন যে, ১২৭৩ সালের দুর্ভিক্ষে যে সকল অনাথ বালক বালিকা গবর্নমেণ্টের হস্তে পতিত হইয়াছিল, তাহাদিগকে খৃষ্টান মিসনরিগণের শিক্ষাধীনে সমর্পণ করিবার প্রস্তাব হইতেছে। তিনি পার্শ্ববর্ত্তী বন্ধুগণকে কহিলেন, “এই প্রস্তাবের একাংশে উত্তম উদ্দেশ্য থাকিলেও ইহার মূল অবিশুদ্ধ। অতএব তোমরা আমাকে, যেখানে এই প্রস্তাবের আন্দোলন হইতেছে সেইখানে লইয়া চল। আমি হয়ত এ নিয়ম রহিত করিতে পারিব।” এখন তাঁহার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ, এজন্য বন্ধুগণ ও চিকিৎসকেরা তাদৃশ সাংঘাতিক সময়ে তঁহাকে সেরূপ চেষ্টা ও সেরূপ চিন্তা হইতে বিরত করিলেন। ইহার অল্পকাল পরেই তিনি সম্বাদ পাইলেন, তাঁহার একমাত্র অবশিষ্ট ও প্রিয়তমা কন্যার মৃত্যু হইয়াছে। এই সম্বাদ পাইয়া তিনি জীবনাশা এককালে পরিত্যাগ করিয়া আপনাকে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করিলেন। তিনি যে পর্যন্ত পীড়িত শয্যায় শয়ান ছিলেন, তাঁহাকে একদিনের নিমিত্তও কেই মৃত্যু ভয়ে ভীত বা চঞ্চল দেখে নাই। কখন একটা দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ ও কষ্টসূচক কোন শব্দ উচ্চারণ করেন নাই। মুমূর্ষু রামগোপাল যখন মৃত্যুর শেষ যাতনা ভোগ করিতেছিলেন, তখন একজন বন্ধু মনের ভাব চাপিতে না পারিয়া রোদন করিতে আরম্ভ করেন। কিন্তু রামগোপাল বন্ধুর রোদন দেখিয়া তৎকালীন মানসিক বল নষ্ট করিতে ইচ্ছুক ছিলেন না, এইজন্য মিষ্টভাষায় তাঁহাকে গৃহত্যাগ করিতে বলেন। তিনি বন্ধুগণকে বলিলেন,—“আমি মরিতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়াছি, সে জন্য আমার কিছুমাত্র ভয় নাই।” যে দিন ১২৭৫ সালে) তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল, সেই দিন প্রাতে তাঁহার দুই বাহু দেহ পার্শ্বে বিসারিত ছিল, যেন আপন মনে অস্ফুটস্বরে কি বলিতে ছিলেন,—বিকম্পিত অধরৌষ্ঠ, তাহা প্রকাশ করিতেছিল। ক্রমশঃ উভয় পার্শ্ব হইতে হস্তদ্বয় বক্ষে আনিলেন,—পুটদ্বয় সংযুক্ত করিলেন। ইহা তাঁহার শেষ প্রার্থনা, অবস্থাই তাহার পরিচয় দিতে ছিল। কিয়ৎক্ষণ এই ভাবে থাকিয়া,—এই ভাবেই প্রাণত্যাগ করিলেন। এই, সেই গৌরবান্বিত পুরুষের গৌরবান্বিত মৃত্যু!

 মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব্বে তিনি আপন সম্পত্তি সম্বন্ধে এইরূপ ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ঐ সম্পত্তির পরিমাণ তিনলক্ষ টাকারও অধিক। একলক্ষ টাকা তাঁহার বিধবা পত্নীও অন্যান্য পরিবারদিগকে দেন। ২০,০০০ হাজার টাকা ডিসট্রিক‍্ট্ দাতব্য চিকিৎসালয়ে দেন। এবং ৪০,০০০ হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। বন্ধুগণকে প্রায় ৪০,০০০ হাজার টাকা ধার দেওয়া ছিল, তাহা ছাড়িয়া দেন। তিনি অত্যন্ত মাতৃভক্ত ছিলেন। তাঁহার মাতা আপনার পূজা ও ব্রতাদি জন্য যখন যত টাকা চাহিতেন, তখন তাহাই দিতেন। মাতকে অসন্তুষ্ট করিবার জন্য আপন মতের বিরুদ্ধ কোন কাজ করিতেই পরাঙ্মুখ হইতেন না। তিনি নিষিদ্ধ দ্রব্য ভোজন করিয়াছেন বলিয়া, ব্রাহ্মণেরা একবার তাঁহার মাতার নৈবেদ্য ফিরাইয়া দেন। জননী ইহাতে যারপর নাই, মনে ব্যথা পান। রামগোপাল তাহা জানিতে পারিয়া প্রত্যেক নৈবেদ্যের উপর যোলটী করিয়া টাকা দিলেন। তখন, রামগোপালকে বারম্বার আশীর্ব্বাদ করিয়া ব্রাহ্মণ ঠাকুরেরা নৈবেদ্য লইলেন। রামগোপালের জননী সন্তুষ্ট হইলেন।

 রামগোপালের জীবন-চরিত সংক্ষেপে একরূপ বর্ণিত হইল। এখন তাঁহার জীবনী সম্বন্ধে সাধারণতঃ কয়টী কথার উল্লেখ করিব। রামগোপাল লোক হিতৈষী বিচারক্ষম, বহুদর্শী, শিক্ষানুরাগী, ন্যায়পরায়ণ, কুসংস্কার বিহীন, দয়ালু, ক্ষমাশীল, স্বাধীন প্রকৃতি, মিত্রানুরাগী ও সত্যবাদী ছিলেন। এতদ্ব্যতীত তাঁহার মনুষ্যোচিত আরও অনেক গুণ ছিল। তিনি পল্লবগ্রাহী পণ্ডিত ছিলেন না, ইংরাজী ভাষায় তাঁহার গভীর জ্ঞান ছিল। বিখ্যাত মাউএয়েট সাহেব বলিতেন,—“রামগোপালের পরবর্ত্তী বাঙ্গালীদিগের রামগোপালের অনুকরণ করা উচিত।” কখন তাঁহার উদ্দেশ্যের অসাধুতা প্রকাশ পায় নাই। কাহার সহিত ব্যবহারে কখন তিনি আপন ক্ষমতার অপব্যবহার করেন নাই। তিনি অন্তরের সহিত স্বদেশকে ভাল বাসিতেন। লোক হিতকর কার্য্যের অনুষ্ঠানই, তাঁহার ধর্ম্মবুদ্ধির প্রধান কর্তব্য ছিল। তিনি বালক কালে সতীর্থগণের সঙ্গে খেলা। করিতে করিতে একটী ভগ্ন স্তম্ভকে লক্ষ্য করিয়া বলেন, “তুমি আমাকে ভাঙ্গিতে পরিবে, কিন্তু নোয়তে পারিবে না।” তিনি যাবজ্জীবন যত কার্য্য করিয়া ছিলেন, সকলের উপরই এই ভাবের ছায়া দৃষ্ট হইয়াছিল। এদেশে রেলওয়ে প্রচলিত করিবার জন্য তিনি তাহার অনুষ্ঠাতৃগণের সহিত সবিশেষ সহযোগিতা করিয়াছিলেন। মনুষ্যত্ব পুরস্কারে সকলেরই সমান স্বত্ব, ইহা দেখাইবার জন্য তিনি বিস্তর শ্রম করিয়া গিয়াছেন। স্বমতের পোষকতাহেতু তাঁহার নিকট সমাগত ব্যক্তিগণের সহিত একাসনে বসতেন। স্বয়ং গমন করিয়া দূরস্থ বন্ধুগণের তত্ত্বাবধান করিতেন। বিখ্যাত মিউটিনির সময়ে বাঙ্গালীদিগের উপর গবর্ণমেণ্টের যে কুসংস্কার, হইয়াছিল, তাহার দূরীকরণে রামগোপাল অনেক পরিশ্রম করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুতে বেঙ্গল গবর্ণমেণ্ট দুঃখ প্রকাশ করিয়া প্যারিচাঁদ মিত্রকে পত্র লিখিয়া ছিলেন। এতদ্বতীত তিনি, গবর্ণমেণ্টের যে যে সভা ও সমাজের নির্দ্দিষ্ট মেম্বর ছিলেন, সকলেই তাঁহার মৃত্যু জন্য শোক, সভার পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেন।

 বিদ্যালয়ের বালকগণ,—“স্বনাম পুরুষোধন্যঃ” এই প্রাচীন বাক্যের স্মরণ করিয়া রামগোপাল ঘোষকে ধন্যগদ দেও।


  1. “রোর’ শব্দের দুইটী অর্থ; বান এবং যে ব্যক্তি এক রূপ শব্দ ও ভাব বারম্বার প্রকাশ করিয়া বিরক্ত করে।