দ্বিতীয় চরিতাষ্টক/সর্ রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর
সর্ রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর। K. C. S. I.
ইনি, কলিকাতার সিমলা স্থিত মাতুলালয়ে ১১৯১ সালের (১৭৮৪খৃঃ) ১ চৈত্র জন্মগ্রহণ করেন। ইনি, সুবিখ্যাত রাজা নবকৃষ্ণের পৌত্র এবং রাজা গোপীমোহন দেবের পুত্র। গোপী মোহন, নবকৃষ্ণের পোষ্য পুত্র, তাঁহার ঔরস পুত্রের নাম রাজা রাজকৃষ্ণ। এই দুই ভ্রাতার স্বভাব চরিত্র সম্পূর্ণ বিভিন্ন ও কৌতুকাবহ, এই জন্য তাঁহাদের বিষয় কিছু বলা আবশ্যক।
গোপীমোহন জ্যেষ্ঠ, বিদ্বান্ ও বুদ্ধিমান ছিলেন। এই জন্য যাবতীয় কাজ কর্ম্ম তিনি করিতেন, সকল বিষয়ে প্রাধান্য করিতেন এবং প্রধান্য করিবার ক্ষমতাও তাঁহার ছিল। পারসী ও আরবী ভাষায় তাঁহার সম্যক্ জ্ঞান ছিল, অল্প সংস্কৃতও জানিতেন। রাজকৃষ্ণ পারসী ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন, ঐ ভাষায় কয়েক খানি পুস্তক লিখিয়াছিলেন এবং ঐ ভাষাতেই সর্ব্বদা কথোপকথন করিতেন, বাঙ্গালা প্রায় কহিতেননা। মুসলমান পণ্ডিতেরা তাঁহার সভাসদ্ ছিলেন, মুসলমান “ইয়ারেরা” তাঁহার মোসাহেব ছিলেন, মুসলমান পাচকে তাঁহার খাদ্য প্রস্তুত করিত। এতদ্ব্যতীত যে কোনরূপে মুসলমান আচার ব্যবহারের রক্ষা হইত তাহার অনুষ্ঠানে ক্রটি। ছিল না। “আমিরির” সীমা ছিল না, তিনি তৎ কালের এক জন প্রধান “ওমরাও” ছিলেন। পোপীমোহন পিতৃপিতামহের অনুসরণে সম্যক রূপে হিন্দু আচার ব্যবহার রক্ষা করিয়া চলিতেন। সংস্কৃত শাস্ত্রবিদ্ অধ্যাপকগণ সর্ব্বদা তাঁহার সভায় উপস্থিত হইতেন। তিনি তাঁহাদের শাস্ত্রালাপ শ্রবণ করিতেন। তাঁহাদের সহিত পদার্থ ও ন্যায়শাস্ত্রের বিচার করিতেন। তাঁহার ঐ দুই শাস্ত্র রীতিমত পড়া ছিল না, কিন্তু প্রতিভা দ্বারা উহা বুঝিতে ও তর্ক করিতে পারিতেন। ভূগোল ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে তাঁহার বিশেষ অনুরাগ ছিল। তিনি হিন্দু প্রণালীতে ভূগোলিক ও জ্যোতিষিক গ্লোব ও মানচিত্র অঙ্কিত করিয়াছিলেন। সুবিখ্যাত জয়পুরপতি মহারাজ জয়সিংহের পর হিন্দু বিজ্ঞানে উৎসাহ প্রকাশ করিতে এবং তাহা রক্ষার অনুষ্ঠানে যত্ন করিতে গোপীমোহনের ন্যায়, আর কেহই উৎসাহ প্রকাশ করেন নাই। তিনি এই মাত্র করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন না; বেতন দিয়া চীনদেশীয় শিল্পকরদিগকে নিকটে রাখিয়া বিবিধ, যন্ত্র নির্ম্মাণে প্রবৃত্ত হইয়া ছিলেন। কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। ইহাতেও তাঁহার অধ্যবসায় পরাহত হয় নাই। টানা পাখার কল নির্মাণের ভাব, প্রথমে তাঁহার মনেই উদিত হয়। তিনি ঘটিকা আদর্শ করিয়া ঐ যন্ত্র নির্ম্মাণ আরম্ভ করিয়াছিলেন। অনেক দূর সম্পন্নও হইয়াছিল; কিন্তু যন্ত্র বিজ্ঞানে সম্যক্ জ্ঞান না থাকায় তাহাতেও কৃত কার্য্য হইতে পারেন নাই। তিনি ইউরোপীয় বিজ্ঞান শাস্ত্র অধ্যয়নে বঞ্চিত হইয়াছিলেন বলিয়াই, তাঁহার তাদৃশী প্রভিভা ও তাদৃশ অধ্যবসায় হইতেও আশানুরূপ ফল প্রসূত হয় নাই, ইহা ভাবিলে মনে বড়ই দুঃখ হয়। কিন্তু সে দুঃখ করা বৃথা! বর্ত্তমান কালে অনেকে ইউরোপীয় বিজ্ঞানে সুশিক্ষিত হইতে ছেন, অনেকের প্রচুর অর্থ ও আছে; কই! তাহাদের ত এসকল বিষয়ে চেষ্টা হয়না! তাঁহারা চেষ্টা করিলে নিশ্চয়ই কৃত কার্য্য হইবেন,— বাঙ্গালীর কপাল ফিরিবে এই জন্যই বুঝি! তাঁহাদের চেষ্টা হয় না। সঙ্গীতেও তাঁহার অত্যন্ত অনুরাগ ছিল। তাঁহার যত্নে “হাপ্ আখ্ ড়াইয়ের” সৃষ্টি হয়। ফলতঃ বড় মানুষের যে সকল গুণ থাকা আবশ্যক, গোপীমোহনের সকলই ছিল। তিনি হিন্দু দলের দলপতি ছিলেন, সুতরাং যখন সতী-দাহনিবারণার্থ রাজা রামমোহনরায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি চেষ্টা করেন, তখন তিনি ধর্ম্মসভার অধ্যক্ষ হইয়া তাহার প্রতিবাদ করেন।
পূর্ব্বে উল্লেখ করা হইয়াছে, রাজকৃষ্ণ সম্পূর্ণরূপে মুসলমান আচার ব্যবহারের অনুষ্ঠান করিতেন। কিন্তু অন্যের সহিত শত্রুতা সাধন সময়ে প্রয়োজন হইলে “হিন্দুয়ানি” অবলম্বনেও পরাঙ্মুখ হইতেন না। যখন রামদুলাল সরকার কালীপ্রসাদ দত্তের উদ্ধার সাধনে প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছিলেন, তখন রাজকৃষ্ণ বিলক্ষণ। বিপক্ষতা করেন। বোধ হয়, প্রথমে পিতা ও জ্যেষ্ঠের প্রভাবে তিনি উভয় কুল বজায় রাখিতে পারিয়াছিলেন। কিন্তু শেষে তিনিও সমাজচ্যুত হন এবং নিজ পুত্রের বিবাহ কালে হিন্দু সমাজে প্রবিষ্ট হইবার জন্য সমন্বয় করিতে বাধিত হন। গীত বাদ্যে রাজকৃষ্ণের বিলক্ষণ অনুরাগ ছিল। তিনি নিজে গাইতে ও বাজাইতে পারিতেন। সঙ্গীত সাধনী-শক্তি অপেক্ষা সঙ্গীত বিজ্ঞানে তাঁহার অধিক পাণ্ডিত্য ছিল। এই জন্য ভাল ভাল মুসলমান সঙ্গীতবিৎ তাঁহার নিকট সর্ব্বদা থাকিত।
রাজকৃষ্ণ অকর্ম্মণ্য এবং আচার ভ্রষ্ট, অতএব সম্পত্তির সমাংশ পাওয়া তাহার পক্ষে কোন ক্রমেই সঙ্গত নহে। গোপীমোহন এই রূপ মনে করিতেন। রাজকৃষ্ণ মনে করিতেন, তিনি রাজানবকৃষ্ণের ঔরস পুত্র এবং গোপীমোহন পোষ্যপুত্র; অতএব তিনি কখনই তাঁহার সহিত তুল্যাংশ পাইতে পারেন না। পিতার মৃত্যুর পর উভয় ভ্রাতার মনের ভাব ঐ রূপ হইয়াছিল। গোপীমোহন সম্পত্তি বিভাগের জন্য দুইটা তালিকা প্রস্তুত করিলেন। একটাতে কলিকাতার নিকটবর্ত্তী ভাল ভাল যাবতীয় বাড়ী, বাগান, পুষ্করিণী, তালুক ইত্যাদি লিখিত হইল। অপরটিতে দূরবর্ত্তী অধিক লাভ জনক ভূসম্পত্তি সকল লিখিত হইল। ঐ তালিকা দুইটা এমন চতুরতা সহকারে প্রস্তুত হইয়াছিল যে, রাজকৃষ্ণ প্রথম তালিকানুযায়ী অংশ লইতেই প্রলোভিত হইলেন। কিন্তু বন্ধুগণের পরামর্শে শেষোক্ত তালিকানুরূপ সম্পত্তি লইবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গোপীমোহন, আপনার ফাঁদে আপনি পড়িয়া তাহাতে আপত্তি করিতে বাধিত হইলেন। পরিশেষে আদালতের সহায়তায় উভয়ে সমান অংশ প্রাপ্ত হন।
গোপীমোহন বদান্য ছিলেন। সঙ্গীত ও সাহিত্যের উন্নতি জন্য অনেক টাকা দান করিতেন। বাঙ্গালী ও ইংরাজ উভয় সম্প্রদায়েই তাঁহার সম্মান ছিল। লর্ড বেণ্টিঙ্ক্ বাহাদুরের সহিত, সতীদাহ নিবারণ বিষয়ে তাঁহার একবারমাত্র অনৈক্য হয়, তদ্ব্যতীত সর্ব্বত্রেই লর্ড বাহাদুর তাঁহার সম্মান করিতেন। ১২৪৩ সালে (১৮৩৬ খৃঃ) একমাত্র পুত্র রাধাকান্তকে রাখিয়া তিনি পরলোক গত হন। রাজা রাজকৃষ্ণ ১২৩১ সালে,দেহ ত্যাগ করেন।
রাধাকান্ত দেব অতি শিশু কালেই তৎকাল প্রচলিত রীত্যনুসারে গুরুমহাশয়ের পাঠশালে শিক্ষার্থ নিযুক্ত হন। ঐ পাঠশালে যে, সুশিক্ষার সুন্দর উপায় নাই, তাহা সকলেই অবগত আছেন। ঐ পাঠশালার প্রধান শিক্ষা অস্ক, রাধাকান্ত তাহা উত্তমরূপে শিখিয়াছিলেন। বাঙ্গালা ভাষার অবস্থা তখন ভাল ছিল না, উহা ভখন শিখিবার মত ভাষা ছিল না, উহাতে উৎকৃষ্ট পুস্তকাদি ছিল না। গুরু মহাশয়ের পাঠশালার অশুদ্ধ লিখন ও পঠনই বাঙ্গালার সর্বস্ব ছিল। ঐ সকল অশুদ্ধি নিবারণ ও সংস্কত শিক্ষার জন্য বাড়ীতে এক জন সংস্কতজ্ঞ অধ্যাপক নিযুক্ত ছিলেন। তদ্ব্যতীত একজন মুন্সী, পারসী ও আরবী পড়াইতেন। পারসীর উৎকৃষ্ট গ্রন্থ সকল পাঠ করায় বাল্যকালেই তিনি সুশীল, সুসভ্য ও বিনম্র হইয়া ছিলেন। তাঁহার শিখিবার শক্তি অসাধারণ ছিল! শীঘ্র শীঘ্র অনেক বিষয় শিখিয়া ফেলেন। সম বয়স্ক ও সতীর্থ যাবতীয় ছাত্রকে, তিনি অল্প দিনের মধ্যেই অতিক্রম করিলেন। সংস্কৃত আরবী ও পারসী এই তিন ভাযায়, শিশু কালেই একরূপ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। রাধাকান্তের তত অল্প বয়সে সেরূপ শিক্ষা নৈপুণ্য দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইতেন। যখন দেশ মধ্যে সভ্যতা কি সুশিক্ষার তত প্রচলন হয় নাই, সেই সময়েও তিনি অসাধারণ সুশিক্ষা লাভ করিয়া ছিলেন। তবু তখনও তাঁহার কিছু মাত্র ইংরাজী শিখা হয় নাই। রাজা নবকৃষ্ণ অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শনের দ্বারা জানিয়াছিলেন যে, তখন যেরূপ সময় আসিতে ছিল, তাহাতে ইংরাজী শিক্ষা নিতান্ত আবশ্যক। এই জন্য তিনি পৌত্র রাধাকান্ত দেবকে কামিং সাহেবের বউবাজারস্থ “কলিকাতা একাডমি’ নামক ইংরাজী বিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন। সেখানেও এত সত্বর ইংরাজী শিখিলেন যে, তৎকালে তিনি এক জন প্রধান ছাত্র বলিয়া বিখ্যাত হইয়া ছিলেন। তিনি যে, কেমন উৎকৃষ্টরূপে ইংরাজী শিখিয়াছিলেন, তাহার একটি প্রমাণ আছে। ১২৩১ সালে (১৮২৪ খৃঃ } বিসপ হবার আপনার প্রকাশিত কোন সামায়িক পত্রিকায় লিখিয়াছিলেন যে, “রাধাকান্ত উত্তমরূপে ইংরাজী কহিতে পারেন,—বিখ্যাত ইংরাজী লেখকগণের সমস্ত গ্রন্থই তিনি পাঠ করিয়াছেন; বিশেষতঃ ইতিহাস ও ভূগোল সম্বন্ধীয় কোন পুস্তকই তাঁহার পড়িতে বাকী নাই।” তাঁহার শিক্ষাতৃষা, কিছুতেই পরিতৃপ্ত হইত না; যেখানে যে কোনরূপ ভাল পুস্তক বা পত্রিকা পাইতেন, তাহাই পাঠ করিতেন। তিনি শিক্ষিত ও বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া প্রচলিত রাজনীতির পর্য্যালোচনায় মনোনিবেশ করেন। তাহাতেও কৃত কার্য্য হয়েন। উৎকৃষ্ট রাজনীতিজ্ঞ বলিয়া তাঁহার সুখ্যতি হইয়াছিল।
তিনি পিতৃ পিতামহের দৃষ্টান্তানুসারে সম্পূর্ণরূপে হিন্দু আচার ব্যবহার রক্ষা করিয়া চলিতেন। সাহেব বা মুসলমান হইতে পারেন নাই। এই জন্য নব্য সম্প্রদায়েরা তাঁহাকে প্রাচীনের দলে ফেলিয়া বিদ্রুপ করিতেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু আচার ব্যবহারশীল অনেকে আছেন, তাঁহাদিগের উপর কাহারই দৃষ্টি পড়ে না। রাধাকাস্তু সুশিক্ষিত নব্য সম্প্রদায়ের অনেকের অপেক্ষা অনেক অধিক লেখা পড়া শিখিয়াও যে, “হিন্দুয়ানি” রক্ষা করিয়া চলিতেন, এই জন্যই তাঁহাকে তরুণগণের উপহাসাস্পদ হইতে হইয়াছিল। কিন্তু আমাদের বিবেচনায়, এই ব্যবহারটাই, তাঁহার মহত্ত্বের সাক্ষ্য দিতেছে। যেটা ছোট, সেটা বড়র অনুকরণ করে। আপনারে, আপনার আচার ব্যবহার অথবা বিদ্যা বুদ্ধিকে, সামান্য জ্ঞান না হইলে আর অন্যের প্রতি মহৎ-বুদ্ধির উদয় হয় না। আমাদের অপেক্ষা, সাহেবদের সব ভাল, এরূপ জ্ঞান অর্থ হয়, পরে আমরা সাহেব হইবার চেষ্টা দেখি। যাহার একটুমাত্র আত্মগৌরব আছ সে সহজে পরের পোশাক পরিতে চাহে না। এরূপ হইতে পারে, আত্ম-গৌরবের অনুরোধে যাহার অনুকরণ করিলাম না, আমাপেক্ষা তাহার মহৎ গুণ আছে। তথাপি, এরূপ স্থলে, অস্তুতঃ অনুকরণের প্রলোভন ত্যাগ নিবন্ধন একাংশে আমার মহত্ত্ব স্বীকার করিতেই হইবে। সাহেবরা আমাদের দেশের রাজা, বিদ্যা ও ক্ষমতায় প্রধান; তাঁহাদের সহিত আনুগত্যে আমাদের লাভ আছে, যাঁহারা এভাবে বিলাতীয় বেশ গ্রহণের ক্লেশ স্বীকারে বাধিত হন, তাঁহাদের প্রতি আমাদের কোন কথা নাই। রাজা রাধাকান্ত দেব কি কারণে সাহেব হইতে পারেন নাই, তাহা 'আর এক বার পরিষ্কৃত রূপে বলা আবশ্যক। প্রথমতঃ তিনি আপনাকে এবং আপনাদের ধর্ম্ম ও আচার ব্যবহারকে সামান্য জ্ঞান করিতেন না। দ্বিতীয়তঃ অন্যে সাহেব হইয়া দেশের যে উপকার করেন, তাঁহার অমনিই তাহা করিবার ক্ষমতা ছিল। তৃতীয়তঃ তাঁহার পিতা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অদ্বিতীয় প্রাধান্য লাভ করিয়াছিলেন, পিতৃ পরলোকান্তে রাধাকান্তও সেই প্রাধান্য প্রাপ্ত হন। উহা তাঁহার পক্ষে অপরিহার্য্য হইয়াছিল।
পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে আমাদের দেশের কি অসাধারণ পরিবর্ত্তনই উপস্থিত হইয়াছে। এখন যে কাজ সহজ হইয়া উঠিয়াছে, ঐ সময়ে হা নিতান্ত কঠিন ছিল। যে ইংরাজী শিখিয়া বাঙ্গালার এত উন্নতি হইয়াছে, পূর্ব্বে সেই ইংরাজী শিখাতেই বা কত আপত্তি ছিল। ঐ সকল শুভ কার্য্যের বিপ্ন নষ্ট করিবার জন্য কত লোককে কত পরিশ্রম ও কত যত্নই করিতে হইয়াছে। আমরা পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি, হিন্দুছাত্র গণের শবব্যবচ্ছেদার্থ আপত্তি নিরাকরণ করিতে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে কতই যত্ন করিতে হইয়াছিল। হিন্দু কালেজ[১] ও স্কুলবুক্ সোসাইটি সম্বন্ধে রাধাকান্তকে তদপেক্ষাও যত্ন ও পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল। হিন্দু কলেজের স্থাপন বিষয়ে প্রধান উদ্যোক্তা সরহাইড্ ইষ্ট্ ডেবিড্ হেয়ার এবং ডাক্তার উইলসন্ সাহেবের সহিত রাধাকান্ত সমপরিমাণে শ্রম করিয়াছিলেন। তিনি ৩৪ বৎসর গবর্ণমেণ্টের প্রশংসার সহিত ঐ কার্য্যে প্রবৃত্ত ছিলেন। কয়েক বৎসর সংস্কৃত কলেজেরও সেক্রেটারি ছিলেন। বাঙ্গালার মধ্যে রাধাকান্তের ন্যায়, কেহই ঐ বিষয়ে যত্ন করেন নাই। কলেজের প্রথমাবস্থায় হিন্দুগণ বালক পাঠাইতে অসম্মত হইতে লাগিলেন। কারণ খৃষ্ট ধর্ম্ম প্রচারই কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য বলিয়া তাঁহারা বুঝিয়া ছিলেন। কলেজের বালকগণকে খৃষ্ট ধর্ম্মের উপদেশ দেওয়া হইবে না, রাধাকান্তকে হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিতে হইল। তিনিই সমস্ত ঝোঁক ঘাড়ে করিয়া লইলেন। হিন্দুগণের আর কোন আপত্তি রহিল না। পরে পাঠ্য পুস্তক লইয়া আর এক গোল উঠিল। তখনকার প্রচলিত যাবতীয় পুস্তকই প্রায় খৃষ্টীয় উপদেশ পূর্ণ ছিল। বিশেষতঃ একবার বাছিয়া ২ কেবল খৃষ্টীয় উপদেশ সংসৃষ্ট প্রস্তাব সকলই বালক গণের পাঠার্থ নির্ধ্বাচিত করা হয়। রাধাকান্ত এই সম্বাদ পাইবামাত্র কলেজের অধ্যক্ষকে পত্র লিখিলেন যে, এতাদৃশ পুস্তক কালেজের পাঠ্যরূপে গৃহীত হইলে, হিন্দুরা একটি বালকও পাঠার্থ পাঠাইবেন না। রাধাকান্তের পরামর্শে অধ্যক্ষ আপন প্রণালীর পরিবর্ত্তন করলেন। এইসকল সঙ্কট গেল, আবার অন্যবিধ সঙ্কট আসিয়া উপস্থিত হইল। উৎকৃষ্ট ইংরাজী ও বাঙ্গালা পুস্তক সকল সংগ্রহ ও প্রণয়নার্থ ঐসময়ে গবর্নমেণ্ট স্কুলবুক সোসাইটী স্থাপিত করিলেন। রাধাকান্ত উহার বাঙ্গালা বিভাগের সেকরেটারি হইলেন। বিবিধ পুস্তক সঙ্কলিত ও প্রণীত হইতে লাগিল। কিন্তু দেশে গোল উঠিল যে, ঐ সোসাইটীর দ্বারা প্রকাশিত পুস্তক পড়িলেই হিন্দু বালকেরা খৃষ্টান হইয়া যাইবে। এবারও রাধাকান্ত পূর্ব্ব রূপে হিন্দু সম্প্রদায়কে অভয় দান করলেন যে, ঐ সকল পুস্তক পাঠে খৃষ্টান হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। হিন্দু সম্প্রদায় নিরস্ত হইলেন। এখন এসকল কথা অনেকের পক্ষে উপহাসের বিষয় হইয়াছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু এককালে বাঙ্গালা এইরূপ ছিল। এস্থলে আর একটা কথা বলিয়া যাওয়া আবশ্যক। এদেশে ইংরাজী ও বাঙ্গালা শিক্ষা প্রচলিত হইবার প্রথমাবস্থায় যে সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছিল, বোধ হয়, তৎকালে তাহা নিবারণ করিতে একমাত্র রাধাকান্তই সক্ষম ছিলেন। তিনি হিন্দু ধর্ম্মে ও হিন্দু আচার ব্যবহারে আস্থাবান ছিলেন বলিয়াই তাঁহার ঐ ক্ষমতা ছিল। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ভাজন ছিলেন; এইজন্য তিনি যখন যাহা বলিলেন, তাহাতেই লোকে বিশ্বাস করিল। সুতরাং সহজে সকল গোল মিটিয়া গেল। বোধ হয়, এমন স্থলে হিন্দুর অপ্রিয় ব্যক্তিগণের কৃতকার্য্য হওয়া কঠিন হইত। যাঁহারা তৎকালে “হিন্দুয়ানি” রাখিতে লজ্জা বোধ করিতেন, তাঁহারা অবশ্যই দেখিয়াছেন এবং দেখিতেছেন যে, রাধাকান্তের “হিন্দুয়ানি” কত কাজে লাগিয়াছিল।
রাধাকান্তদেব সব প্রথমে ইংরাজী পুস্তকের অনুকরণে বাঙ্গালা বর্ণপরিচয় ও নীতিকথা নামক ক্ষুদ্র গ্রন্থ প্রচার করেন। তদ্ব্যতীত আরও কয়েকখান বাঙ্গালা পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছিলেন। ইংলণ্ডের “রয়াল এসিয়াটিক সোসাইটি” তাঁহার প্রথম বঙ্গালা পুস্তক সকলের প্রশংসা করিয়াছিলেন। ১২২৯ সালে তাঁহার সুবিখ্যাত শব্দকল্পদ্রুমের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। ঐ সুবিশাল অভিধান গ্রন্থের সঙ্কলনে তিনি সংস্কত সাহিত্যের কিরূপ শ্রীবৃদ্ধি করিয়া গিয়াছেন, কিরূপ অক্ষয় কীর্ত্তি পতাকা উডঙীন করিয়া গিয়াছেন, পৃথিবীর সর্ব্বত্র কিরূপ স্মৃতি-স্তম্ভ রাখিয়া গিয়াছেন, তাহার লক্ষ লক্ষ সাক্ষী বর্তমান রহিয়াছে; সুতরাং তৎসম্বন্ধে আমাদের কিছু না বলিলেও চলে। তথাপি যথাস্থানে এবিষয়ে আর কিছু বলা যাইবে।
স্কুলবুক্ সোসাইটির তৎকালীন প্রধান পণ্ডিত গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের সহযোগিতায় রাধাকান্ত দেব একখানি পুস্তক বাহির করেন। স্ত্রীগণকে লেখা পড়া শিখান অশাস্ত্রীয় নহে এবং পূর্ব্ব কালের স্ত্রীরা সুশিক্ষিত হইতেন, ঐ পুস্তিকায় তাহাই প্রতিপন্ন করা হয়। যেন দেশের মধ্যে স্ত্রী শিক্ষা সম্বন্ধে নানাপ্রকার কুসংস্কার প্রচলিত ছিল; স্ত্রী, লেখা পড়া শিখিলে স্বামীর মৃত্যু হয় এরূপ ভাবও, স্ত্রীগণের মন অধিকার করিয়া ছিল, তখন একজন হিন্দু-প্রধানের হাত হইতে ঐরূপ পুস্তক বাহির হওয়ায় হিন্দু সম্প্রদায় রাধাকান্তের প্রতি ক্রুদ্ধ হইলেন। রাধাকান্ত প্রথমে তাহাতে ভ্রুক্ষেপ করেন নাই এবং নিরুৎসাহী হন নাই। কিন্তু তাঁহার মনের ভাব বরাবর এরূপ ছিল না। যাহা হউক, আপনার অন্তঃপুরস্থা স্ত্রীগণের মধ্যে শিক্ষা দানের উপায় করিয়া দিলেন। নিজ গৃহস্থ গুরুমহাশয়ের পাঠশালে ছোট ছোট বালিকাদিগকে শিক্ষার্থে নিযুক্ত করিয়া দিলেন। স্কুল সোসাইটীর দ্বারা কতকগুলি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছিল, তাহার ছাত্রীদিগকে আপনার বাড়ী আনিয়া পারিতোষিক দিতে লাগিলেন। এইরূপে সর্ব্বতোভাবে স্ত্রী-শিক্ষায় উৎসাহ দিয়াছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয় দ্বারা স্ত্রী-শিক্ষা প্রচলিত করার মত, পরে ত্যাগ করিয়া ছিলেন। যখন বেথুন সাহেব বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের চেষ্টা করেন, রাধাকান্ত তাহাতে প্রতিবাদ করিয়া ছিলেন। সাহেব অনেক চেষ্টা করিয়াও তাঁহাকে আপন মতে আনিতে পারেন নাই।
কিন্তু তিনি সম্ভ্রান্ত মহিলাগণের অন্তঃপুর-শিক্ষায় এবং ছোট ছোট বালিকাদিগকে আপন আপন গৃহস্থ পাঠশালে শিখাইতে বাধা দিতেন না। ইহাতে অনেকে অনুমান করেন, স্কুল সোসাইটির বালিকা-বিদ্যালয় সকলের মন্দ ফল দেখিয়া তিনি এরূপ মত পরিবর্ত্তন করিয়াছিলেন। একবার কলিকাতার সহকারী বিশপ্ করি সাহেব রাধাকান্তের বাড়ীতে বালক বালিকাগণের পরীক্ষা করিতে আসিয়াছিলেন। তিনি রাজার সহিত আলাপ করিয়া এবং তাঁহার অসাধারণ গুণের কথা শুনিয়া এত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন যে, রেবরেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট তাঁহাকে রাজাসম্বন্ধীয় মনের ভাব ব্যক্ত করিতে হইয়াছিল।
রাধাকান্তের কার্য্যক্ষমতা, দেশহিতৈষা প্রভৃতি অনেক দিন হইতেই গবর্ণমেণ্টের গোচর হইয়াছিল। ১২৪২সালে। (১৮৩৫খৃঃ)গবর্ণমেণ্টের দ্বারা রাধাকান্তের ঐ সকল গুণের পুরস্কার হয়। ঐ সালে তিনি কলিকাতার জষ্টিস্ অব দি পিস্ এবং অবৈতনিক মাজিষ্টরের পদ পান। এখন এদেশের অনেকে ঐ সকল পদ পাইয়াছেন, কিন্তু সে সময়ে উহা বাঙ্গালীর পক্ষে বিশেষ মম্মানের বিষয় ছিল। পর বৎসর তাঁহার পিতার মৃত্যু হইলে গবর্ণমেণ্ট তাঁহাকে রাজা বাহাদুর উপাধি দিলেন। ঐ উপাধির সঙ্গে তাঁহাকে রাজোচিত পরিচ্ছদ, রত্নহার এবং অসিচর্ম্ম পারিতোষিক দেওয়া হয়। ১২৪৯ সালে তিনি গয়ায় যান। তথায় টিকারির রাজার সহিত সাক্ষাৎ হয় এবং উভয়ে উভয়কে উপহার প্রদান করেন। যাইবার সময় মুরসিদাবাদের নবাব নাজিমের “দরবার” দেখিয়া যান। নবাব, রাজা বাহাদুরকে অনেক মূল্যবান্ উপহার দিয়াছিলেন।
রাজা বাহাদুরের সময়ে টাকির বৈকুণ্ঠনাথ মুন্সী অতিশয় দুষ্টতা ও দুর্ব্বৃত্তা ও নিবন্ধন বিখ্যাত ছিলেন। তাঁহার অনেক পত্তনি তালুক ছিল। কিন্তু জমিদারকে প্রায়ই সে সকলের খাজানা দিতেন না। অথচ এমন চতুরতার সহিত ঐ কার্য্য সাধন করিতেন যে, তাঁহার পত্তনি তালুক সকল সরকারী নিলাম হইতেও রক্ষা পাইত। ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট ও কড়া আইনের চক্ষের উপর তিনি এইরূপ কাজ নিয়তই করিতেন। রাজ। রাধাকান্তের নিকটও তিনি পত্তনি রাখিতেন। কোন সময়ে তাঁহার সঙ্গে ও ঐরূপ ব্যবহার করেন। রাজা তাঁহার অত্যাচার নিবারণে কৃতসঙ্কল্প হয়েন। এই সুত্রে বৈকুণ্ঠের সহিত রাজার ঘোরতর বিবাদ হয়। রাজা ভাল মানুষ এবং বৈকুণ্ঠ বিখ্যাত দুষ্ট ও ক্ষমতাশালী। সুতরাং বৈকুণ্ঠের দ্বারা রাজা বাহাদুরকে যার পর নাই ক্লেশ পাইতে হইয়াছিল। সভাবাজারে বৈকুণ্ঠনাথের একটু ভূমি ছিল। বৈকুণ্ঠ সেই স্থানে নতুন বাজার করিয়া, রাজার উৎকৃষ্ট বাজার ভাঙ্গিয়া দিবার চেষ্টা করেন। ইহাতে অনেক “দাঙ্গা হেঙ্গাম” ও অনেক গোলযোগ হইয়াছিল। তজ্জন্য রাজা বাহাদুরকে অনেক কষ্ট ও অনেক ক্ষতি স্বীকার করিতে হয়। বৈকুণ্ঠের সহিত বিবাদ ইহাতেও শেষ হয় নাই। হুগলী জিলার অন্তর্গত মনোহরপুরে ১২৫৫ সালে উভয়ের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর দাঙ্গা হয়। দেশাধিকার প্রভৃতি গুরুতর কারণে রাজায় রাজায় যে রূপ যুদ্ধ হইয়া থাকে, ইহাকে সেইরূপ একটি ক্ষুদ্র যুদ্ধ বলিলেও নিতান্ত অত্যুক্তি হয় না। ঐ যুদ্ধে বৈকুণ্ঠের পরাজয় হয়। তাঁহার পক্ষে ২০ জন হত ও বহু সংখ্য লোক আহত হয়। রাজার ৩ জন হত ও কয়েক জন মাত্র আহত হইয়াছিল। এই বিবরণ তৎকালীন “ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়া” নামক ইংরাজী সম্বাদ পত্রে প্রকাশিত হয়। গবর্ণর বাহাদুর লর্ড ডাল হাউসী তৎপাঠে পুলিসের প্রতি সবিশেষ অনুসন্ধানের আদেশ দিলেন। অনুসন্ধান করা হইল। বৈকুণ্ঠনাথ চতুরতা সহকারে মোকর্দ্দমার বিলক্ষণ তদ্বির করিলেন। রাজা হুগলীর মাজিষ্ট্রেটের দ্বারা তিন বৎসর কারাবাসের অনুমতি পাইলেন। এই ঘটনায় তাঁহার, আত্মীয় স্বজনের এবং দেশের যে তাঁহাকে জানিত সকলের দুঃখের পরিসীমা ছিল না।
সদর আদালতে আপিল করা হইল। সদর হইতে হুগলীর সেসন্ জজের উপর বিচারের ভার দেওয়া হয়। দুইজন সেসন্ জজ এই গুরুতর মোকর্দ্দমা হাতে লইতে স্বীকার করেন নাই। এই বিচার শীঘ্র শেষ করিবার জন্য গবর্নমেণ্টও অল্প উৎসুক হন নাই। রবর্ট টরেন্স্ নামক এক জন অতিরিক্ত জজ্ ঐ বিচার করিবার জন্য নিযুক্ত হন। ১৯ অকটোবর আরম্ভ হইয়া ২৬ নবেম্বর পর্য্যন্ত ক্রমাগত ৩৭ দিনে বিচার শেষ হয়। ঐ বিচার দেখিবার জন্য হুগলীতে এত অধিক লোকের সমাগম হইয়াছিল যে, বাজারে এক টাকায় চারিখানি কলা পাত বিক্রয় হয়। ইহার পূর্ব্বে এমন গুরুতর বিচার আর কখন হয় নাই। যাহা হইক বিচারে রাজা নিস্কৃতি পাইলেন, দর্শকগণের জয়ধ্বনি ও আনন্দধ্বনিতে হুগলী পরিপূর্ণ হইল। সদর আদালতের বিচার পতি সররবট বার্লো সাহেবের আদেশে তিনি পূর্ব্বেই জামিন দিয়া কারামুক্ত হইয়াছিলেন। এক অন্ধকারময় অপরিস্কৃত কুঠরীতে তাঁহাকে তিন দিনমাত্র বাস করিতে হইয়াছিল। কিন্তু এই তিন দিনের দুঃখের সহিত তুলনা করিলে, তাঁহার সমস্ত জীবনের সুখও অল্প বোধ হয়।
রাজা রাধাকান্ত দেব তাঁহার শব্দকল্পদ্রুম সংগ্রহে জীবনের অনেক অংশ ও উৎকৃষ্টাংশ ব্যয় করিয়াছিলেন। ঐ কার্য্যে তিনি ৪০ বৎসয় শ্রম করেন। ইহা দ্বারা সংস্কৃত সাহিত্যের কিরূপ উপকার হইয়াছিল এবং স্বদেশ ও বিদেশস্থ জ্ঞানিগণ ইহাকে কিরূপ প্রধান কার্য্য বলিয়া গণ্য করিয়াছিলেন, তাহা নিম্ন লিখিত কয়েকটী বিবরণ দ্বারা সপ্রমাণ হইবে। ১২৬৬ সালে (১৮৫৯ খৃঃ) দেশস্থ সমস্ত প্রধান প্রধান লোক একত্র সমাগত হইয়া শব্দকল্পদ্রুম প্রণয়ন জন্য তাঁহাকে অভি নন্দন পত্র প্রদান করেন। মহারাণী কুইন ভিক্টরিয়া ঐ জন্য এক স্বর্ণ পদক উপহার দেন। এতদ্ব্যতীত সেণ্টপিটার্সবর্গ, বার্লিন, বিয়েনা, ব্রিটন, জরমানি, আমেরিকা, পারিস্ প্রভৃতি প্রধান প্রধান স্থানের রাজকীয় সাহিত্য সমাজ হইতে শব্দ কল্পদ্রুমের প্রশংসাবাদ প্রেরিত হইয়াছিল। ইউরোপের রাজপুত্রেরা তাঁহার বিদ্যা ও গ্রন্থের প্রশংসা করিয়া পত্র লেখেন। রুসিয়ার সম্রাট ও ডেন্ মার্কের রাজা সপ্তম ফেডরিক তাহার নিকট স্বর্ণ পদক উপহার পাঠাইয়া ছিলেন। চারি মহাদেশের যেখানে যত প্রধান প্রধান পুস্তকালয় আছে, শব্দকল্পদ্রুম সে সকলের মধ্যেই প্রবেশ করিয়াছে। মাদ্রাজের কোন প্রধান ব্যক্তি, তদ্দেশ প্রচলিত সংস্কৃত মুলক কোন ভাষায় (টেলুগ) শব্দকল্পদ্রুম অনুবাদ করিবার জন্য রেঃ কৃষ্ণ বন্দ্যের দ্বারা রাজার অনুমতি চাহিয়াছিলেন। যতদিন পৃথিবীতে সংস্কৃত শাস্ত্রের আলোচনা থাকিবে, ততদিন রাধাকান্তের নাম অনেকের মনে প্রস্তরাঙ্কিতের ন্যায় রহিবে।
তাঁহার সময়ে এ দেশে সাধারণের হিতকর যে কোন কার্য্যের অনুষ্ঠান হইত, প্রায় তৎ সমুদয়ের সঙ্গেই তাঁহার সংস্রব ছিল। কেবল মাত্র সংস্রব নহে, তিনি সর্ব্বত্র প্রধান ছিলেন। পূর্ব্বে তাহার কিছু কিছু উল্লেখ করা হইয়াছে। আর কয়েকটী নিম্নে সংঙ্কলিত হইল। এ দেশীয় স্কুল সকলের উন্নতি সাধন ও অভিনব স্কুল স্থাপনের জন্য “স্কুল সেসাইটী” বলিয়া একটা কমিটী ছিল। রাধাকান্ত ঐ কমিটির সেকরেটারি ছিলেন। এ দেশের কৃষি ও উদ্যানকার্য্যের উন্নতি করিবার জন্য। যে রাজকীয় সমাজ আছে, রাধাকান্ত তাহার সহকারী সভাপতি ছিলেন। ব্রিটিস্ ইণ্ডিয়ান এছোছিয়েসনের স্থাপনাবধি (১৮৫১ খৃঃ) তাঁহার জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এ সভার সভাপতি ছিলেন। নাখেরাজ বাজে আপ্ত করিবার আইনে প্রতিবাদ করিবার জন্য এদেশীয় ৮০০০ হাজার লোক একত্রিত হইয়া এক সভা করেন। রাজা রাধাকান্ত দেব তাহার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি নিয়মিত রূপে হেয়ার সাহেবের স্কুলের তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শন করিতেন। তিনি এদেশের স্ত্রী-শিক্ষার প্রথম পথ প্রদর্শক। যদি ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্ত্রী-শিক্ষার উল্লেখ হয়, তবে সে স্থলে অবশ্যই লিখিতে হইবে যে, বালিকাগণকে লেখা পড়া শিখিতে উৎসাহ দিবার জন্য রাধাকান্তদেবের বাটীতে প্রথম পারিতোষিক বিতরণ করা হয়।
তাঁহার অন্তঃকরণ উদার ও প্রশস্ত ছিল। তিনি ধর্ম্মান্ধ হিন্দুর ন্যায় অনিষ্টকর প্রথার অনুষ্ঠান বা প্রচলনে উৎসুক ছিলেন না। তাঁহার সময়ে এ দেশের এক জন প্রধান ক্ষমতাশালী লোক ইউরোপ দর্শন করিয়া প্রত্যাগত হন। কয়েক জন “ধার্ম্মিক” তাঁহাকে জাতিচ্যুত করিবার জন্য রাজার সহিত পরামর্শ করেন। রাজা তাঁহাদের পরামর্শ শুনেন নাই। বরং “যিনি ইউরোপ দর্শনে অভিজ্ঞ হইয়া আসিয়াছেন, তাঁহা দ্বারা এদেশের অনেক মঙ্গল হইবার সম্ভাবনা আছে। বিলাত গিয়া তিনি ঘৃণার পাত্র হন নাই, প্রত্যুত অধিকতর সম্মানের ভাজন হইয়াছেন।” ইত্যাদি উপদেশ দিয়া তাঁহাদিগকে তাদৃশী দুশ্চেষ্টা হইতে নিবৃত্ত করেন। অনেকে বলেন, তিনি কতকগুলি হিতানুষ্ঠানে বাধা দিয়াছিলেন। কিন্তু আমরা জানি তিনি প্রকৃত হিতানুষ্ঠানে কখনই বাধা দেন নাই। এ দেশের লোকদিগকে বিলাত পাঠাইবার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করিতেন। মেডিকেল্ কলেজের শবব্যবচ্ছেদে তিনি আপত্তি করেন নাই। তিনি ধর্ম্ম ও সাহিত্যের আলোচনায় জীবন যাপন করিয়াছিলেন। তিনি নিজে পর্য্যটক ছিলেন না। কিন্তু তাঁহার জ্ঞানোপার্জ্জ্বন বিষয়ক শ্রম, ধরামণ্ডলের সর্ব্বত্র পর্যটন করিয়াছিল।
১২৭৩ সালে (১৮৬৬ খৃঃ) মহারাণী, ভারতবর্ষের হিতৈষী প্রধান প্রধান ব্যক্তিদিগকে একটী উপাধি দিবার প্রস্তাব করেন। ঐ উপাধির নাম ভারত-নক্ষত্র (স্টারঅব্ ইণ্ডিয়া)। ঐ সালেরনবেম্বর মাসে আগরার মহা দরবারে গবর্ণর সরজন্ নরেন্স বাহাদুর দ্বারা রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর প্রথমে ঐ উপাধি প্রাপ্ত হন। এই উপাধি দ্বারা তৎকালে তাঁহাকে সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান বলিয়া স্বীকার করা হইয়াছিল। ঐ উপাধি এবং উহার আনুষঙ্গিক আরও কয়েকটী উপাধি তিনি প্রাপ্ত হন। তৎ সুচক ইংরাজী শব্দ ও বর্ণ সকল তাঁহার নামের পূর্ব্বে ও পরে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এ স্থলেতাহার সবিশেষ বর্ণন অনাবশ্যক।
রাজা রাধাকান্তদেব এইরূপে জীবন কার্য্য-মনুষ্য জীবনের উপযুক্ত কার্য্য শেষ করিয়া বৃদ্ধ বয়সে বিষয় চিন্তুা বিরহিত হইয়া বৃন্দাবনের পরম রমণীয় পবিত্র স্থানে গিয়া বাস করেন। প্রাচীন কালের ঈশ্বর পরায়ণ পবিত্র-চরিত্র ঋষিগণের ন্যায় তিনি ঈশ্বর চিন্তায় ও শাস্ত্র চিন্তায় অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলেন। এইরূপে পৃথিবীর শান্তি-সুখ অনুভব করিতে ২ ভক্তি ভাজন হিন্দ-হিতৈষী সররাজা রাধাকান্তদেব বাহাদুর ১২৭৪ সালে (১৮৬৭ খৃঃ ১৯ এপ্রিল শুক্রবার অপরাহ্ন দুইটার সময়ে) ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন। বৃন্দাবনে তাঁহার মৃত্যু হয়। ঐ সময়ে তাহার বয়স ৮৫ বৎসর হইয়াছিল। তাঁহার মৃত্যু বঙ্গদেশের এক সাধারণ শোকাবহ ঘটনা রূপে পরিগণিত হইয়াছিল। মৃত্যুতে শোক প্রকাশার্থ এবং তাঁহার ছিরস্থায়ী স্মরণ-চিহ্ন রক্ষা করিবার জন্য ঐ সালের ১৪ মে তারিখে ব্রিটিস ইণ্ডিয়ান্ এছোছিয়েসনের গৃহে এক সভা হয়। ঐ সভায় এ দেশের যাবতীয় বড় লোক এবং এ দেশস্থ ভিন্ন দেশীয় ব্যক্তিগণের প্রতিনিধি সকল উপস্থিত হইয়াছিলেন। এ দেশীয় কাহার মৃত্যু উপলক্ষে এমন সভা ও এমন উৎকৃষ্ট বক্তৃতা আর কখন হয় নাই।
তাঁহার গভীর বিদ্যা, নানাবিষয়িনী শিক্ষা, দেশের হিতানুষ্ঠানে অসাধারণ পরিশ্রম এসকল ব্যতীত তাঁহার উৎকৃষ্ট চরিত্র, হৃদয়হর স্বভাব ও পবিত্র ধর্ম্ম ভাবেরও অনেক প্রমাণ আছে। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সরলরেন্সপীল বলিয়াছিলেন,—“রাধাকান্ত ভদ্রতার সুস্পষ্ট চিত্রস্বরূপ, এবং তাঁহার আচার ব্যবহার, আমাদের সকলেরই অনুকরণীয় আদর্শ।” তাঁহার উচ্চ ও পবিত্র ধর্ম্মভাবের বিষয়ে অধিক বাক্যব্যয় না করিয়া, রেঃ ডল্সাহেবের সহিত তাঁহার একদিনকার কথোপকথন নিম্নে সঙ্কলন করিলাম। বোধ হয়, তাহাতেই তাঁহার ধর্ম্ম ভাবের বিশেষ পরিচয় দেওয়া হইবে। তাঁহাকে অনেকে পৌত্তলিক বলিয়াছেন এবং এখনও অনেকের ঐরূপ সংস্কার আছে। তাঁহার বাটীতে তন্নির্ম্মিত দেব মন্দির এবং তন্মধ্যস্থ নয়প্রকার ধাতু নির্ম্মিত কৃষ্ণমূর্ত্তি, তাঁহার পৌত্তলিকতার প্রমাণ স্বরূপে গৃহীত হইত। রেঃ ডল্ একদা তাঁহার বাটীতে যান এবং তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন,—
রাজা, আপনি পুতুল পূজা করেন?
রাজা কহিলেন, না, মানুষে কখন পুতুল পূজা করিতে পারে না। আমার বালক দিগের জন্য মন্দিরে পুত্তলিকা রাখিয়াছি।
আবার হাসিতে ২ কহিলেন, তোমরা কি তোমাদের বালকগণকে পুতুল দেও না?
ডল্।—খেলা করিবার জন্য দেই, পূজা করিবার জন্য দেইনা।
রাজা।—আমাদের বালকেরা পুত্তলিকার সাহায্য ব্যতীত প্রকৃত পূজায় যত দিন সমর্থ না হয়, আমরা ততদিন তাহাদিগকে পুত্তলিকা দিয়া থাকি।
ডল্।—যদি আপনি পুতুল পূজা না করেন, তবে কাহার পূজা করেন?
রাজা। আমি আমার ধর্ম্মের পূজা করি। আমার ধর্ম্ম— সালোক্য, সামীপ্য, সাযুজ্য এবং নির্ব্বাণ[২]। ঈশ্বরের সহিত একস্থানে বাস করা, ক্রমে ঈশ্বরের নিকটবর্ত্তী হওয়া, ঈশ্বরের সহিত আপনাকে অভিন্ন জ্ঞান করা এবং ইন্ধনশূন্য অনলের ন্যায় ক্রমশঃ ঈশ্বরে বিলীন হওয়া।
বিদ্যালয়ের ছাত্রগণ, বিশেষতঃ ধনী লোকের সন্তানেরা রাধাকান্তের ন্যায় এমন আদর্শ আর পাইবেন না। অধিকাংশ ধনী সন্তান এইরূপ মনে করিয়া থাকেন, জ্ঞানোপার্জ্জনের ক্লেশ স্বীকারের, তাঁহাদের তত প্রয়োজন নাই। এইজন্য অনেককে অল্পকাল মাত্র বিদ্যালয়ে দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহারা দেখুন, রাধাকান্ত যেরূপ কীর্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন এবং যেরূপ মনুষ্যত্ব দেখাইয়া গিয়াছেন, কেবল মাত্র ধনে তাহা হইতে পারে কিনা। একজন সুবিখ্যাত বিলাতীয় পণ্ডিত বলিয়াছেন, “উচ্চ পদ অনুবীক্ষণ স্বরূপ” ইহাতে ছোট বস্তু বড় দেখায়। যদিও রাধাকান্তের গুণ ও বিদ্যাকে অধিক করিয়া দেখিবার নিমিত্ত কোন যন্ত্রের সাহায্য প্রয়োজন হইত না, ভথাপি তিনি সামান্য দুঃখীর সন্তান হইলে, এত কৃতকার্য্য হইতে, এত মহত্ত্ব ও যশঃ লাভ করিতে পারিতেন কি না তদ্বিষয়ে সংশয় হয়। যাহা হউক, যাঁহাদের অন্নবস্ত্রের চিন্তায় শরীর মন খিন্ন করিতে না হয়, জ্ঞান ও ধর্ম্মালোচনার যথেষ্ট অবসর আছে, কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিলে কৃতকার্য্য হইবার সম্ভাবনা আছে; তাঁহারা উচ্চপদের সহায়তা ত্যাগ করিয়া বালিশের দুর্গে অবরুদ্ধ হইয়া কাল না কাটান ইহাই আমাদের প্রার্থনা।