নাবিক-বধূ/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আফ্রিকা মহাদেশের পূর্বতীরবর্তী মোজাম্বিক দ্বীপের প্রাকৃতিক দৃশ্য বড়ই মনোহর। কর্তৃপক্ষের আদেশে এই দ্বীপের কোনও অধিবাসী তাহার গৃহের বহির্ভাগে চূণকাম করিতে পারিত না। এখানকার লাট সাহেবের প্রাসাদ, ভজনালয়, ব্রিটীশ কন্সলের আবাস, বিসপের বাসগৃহ, নূতন কষ্টম আফিস প্রভৃতি অট্টালিকা দ্বীপের একাংশে অবস্থিত। অট্টালিকাগুলি দেখিতেও সুন্দর। প্রাচ্য মহাদেশের বৈচিত্র্যই ইহাদের বিশেষত্ব।কিন্তু অনেক বিষয়ে ইহা ইউরোপীয় দ্বীপের অনুরূপ
একদিন অপরাহ্ন কালে ডিউসি অফ আফিকা কোম্পানীর একখানি জাহাজ এই দ্বীপের সন্নিকটে উপস্থিত হইল। সেই সময় মিঃ ডড়লে জাহাজের ডেকের উপর একখানি আরামকেদারায় বসিয়া অপরাহ্নের শোভা নিরীক্ষণ করিতেছিলেন, তাহার পাশে একটি বৃদ্ধ পর্তুগীজ, পাদরী বসিয়াছিলেন। ডড্লে চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন বটে, কিন্তু তখন তাহার মন নানা চিন্তায় পূর্ণ। তিনি যে কার্য্যের ভার লইয়া এই দ্বীপে আসিতেছিলেন, তাহা সংসাধনের সম্ভাবনা কতটুকু, ধৃত্ত আমেদ হোসেনের বোটে তিনি উঠিতে পারিবেন কি না, তাহার শেষ ফল কি হইবে—ইত্যাদি বিষয় সম্বন্ধে তিনি চিন্তা করিতেছিলেন। প্রায় পনের মিনিট পরে জাহাজখানি নোঙ্গর করিলে ডড্লে তীরে অবতরণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। তিনি তার জিনিসপত্র গুছাইয়া লইয়া একখানি নৌকা ভাড়া করিলেন, এবং সেই নৌকায় লাট-প্রাসাদের অদূরস্থ জেঠিতে অবতরণ করিলেন। কে জাহাজ হইতে নামিতে দেখিয়া একদল দেশীয় কুলি কঁহার লট-বহর লইয়া টানাটানি আরম্ভ করিল।—তিনি তাহাদের ভিতর হইতে, একটি নিরীহ-প্রকৃতির লোক বাছিয়া লইয়া অন্য সকলকে বিদায় করিলেন। সেই কুলিটা তাঁহার আদেশে তাহার মাল-পত্র ঘাডে লইয়া ব্রিটীশ কন্সলের গৃহাভি মুখে অগ্রসর হইল।
মিঃ ডড্লে ব্রিটীশ কন্সলের সহিত সাক্ষাৎ করিলে কন্সল তাহাকে লিলেন, “মিঃ ডড্লে, তুমি কেমন আছ? তোমাকে হঠাৎ এখানে দেখিবার আশা করি নাই, কিন্তু তোমাকে দেখিয়া অত্যন্ত খুসী হইয়াছি। আমার বিশ্বাস ছিল—এখন তুমি কেপ টাউনেই থাকিবে।”
ডড্লে বলিলেন, “আমি আমাদের এডমিরাল রেডফর্ণের একখানি পত্র আপনার নিকট লইয়া আসিয়াছি। সেই পত্রখানি পাঠ করিলেই আপনি বুঝিতে পারিবেন আমি হঠাৎ এখানে কেন আসিয়াছি।” ডড্লে এডমিরাল-প্রদত্ত পত্রখানি পকেট হইতে বাহির করিয়া কন্সলের হস্তে প্রদান করিলেন। কন্সল মহাশয় পত্রখানি খুলিয়া দুই তিনবার অতি সাবধানে তাহা পাঠ করিলেন। তিনি পত্রের মম্ম অবগত হইয়া পত্রখানি তাহারা টেবিলের দেরাজে বন্ধ করিয়া রাখিলেন।
অনন্তর কন্সল গম্ভীরভাবে ডড্লেকে বলিলেন, “তুমি যে কাযের ভার লইয়া আসিয়াছ, তাহা যেমন কঠিন, সেইরূপ সঙ্কটজনক। সত্যই ইহা অত্যন্ত বিপদের কায॥
ডড্লে বলিলেন, “তাহা কি আর আমি বুঝিতে পারি নাই?—কিছু যতই বিপদের আশঙ্কা থাক—আমাকে সাবধানে এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেই হইবে। আপনি আমাকে যথাশক্তি সাহায্য করিলে অত্যন্ত বাধিত হইব। আমি এডমিরাল মহাশয়ের নিকট শুনিয়াছি আপনি এই কার্যে আমাকে সাহায্য করিবেন।
কন্সল পূর্ণ একমিনিট কাল নিস্তব্ধ ভাবে বসিয়া থাকিয়া বলিলেন, “তোমাকে সাহায্য করা আমার প্রধান কর্তব্য, এ বিষয়ে মতভেদ নাই, আমি যে যথাশক্তি তোমাকে সাহায্য করিব এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তুমি? কত বড় বিপদকে আলিঙ্গন করিতে যাইতেছ, তাহা বোধ হয় তোমাকে ঠিক বুঝাইতে পারি না। যে লোকটির সহিত তোমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে হইবে, সে অতি ভয়ঙ্কর লোক। সে জানে তাহার সঙ্কল্প-সিদ্ধির অধিক বিলম্ব নাই, এখন যদি সে আমাদের হাতে ধরা পড়ে, তাহা হইলে তাহার সকল আশা-ভরসা বিলুপ্ত হইবে। যদি সে কোন কৌশলে তোমাকে চিনিতে পারে, তাহা হইলে তোমার প্রাণরক্ষার আশা থাকিবে না।”
ডড্লে বলিলেন, “সে কথা আমার জানা আছে। বিপদের আশঙ্কা প্রবল বলিয়াই এই কার্য্য সাধনের জন্য আমার অধিকতর আগ্রহ ও উৎসাহ হইয়াছে। যেরূপে হউক তাহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য আমি কৃতসঙ্কল্প।”
কন্সল বলিলেন, “তাহা হইলে আমার আর কিছুই বলিবার নাই। অতঃপর কি করিতে হইবে, প্রথমে তাহার আলোচনা আবশ্যক। এডমিরালও লিখিয়াছেন—তেমন তাড়াতাডি করা সঙ্গত হইবে না, তাহাতে সকল চেষ্টা বিফল হইতে পারে। তোমাকে সাহায্য করিতে হইলে আমাকে অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কাযে হাত দিতে হবে। প্রথমে ত তোমাকে মিসেস্ স্পরফিল্ডের সহিত পরিচিত করি, তুমি বোধ হয় পূর্ব্বে তাঁহাকে দেখ নাই।”
কন্সলের স্ত্রী অন্য একটি কক্ষে বসিয়া সূচীকর্ম্ম করিতেছিলেন, কন্সল ডড্লেকে সঙ্গে লইয়া তাহার নিকট উপস্থিত হইলেন। এই রমণী যেরূপ সুন্দরী সেইরূপ গুণবতী, তাঁহার গুণের জন্য সে অঞ্চলের সকল লোকই তাহাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করিত। তিনি কতদিন বিপন্ন ব্যক্তিকে গোপনে অর্থসাহায্য করিয়াছেন, কত রোগারের সেবা শুশ্রুষা করিয়া তাহাদিগকে মৃত্যুকবল হইতে রক্ষা করিয়াছেন তাহার সংখ্যা নাই।
কন্সল তাঁহার স্ত্রীকে বলিলেন, “প্রিয়তমে, মিঃ ডড্লেকে তোমার সহিত পরিচিত করিবার জন্য আনিয়াছি। ইনি কেপ টাউন হইতে এইমাত্র এখানে আসিয়াছেন। আমার অনুরোধে ইনি কয়েকদিন এখানে থাকিতে সম্মত হইয়াছেন।”
ডড্লে মোজাম্বিকে কেন আসিয়াছেন, একথা জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা থাকিলেও স্বামীর ইঙ্গিত বুঝিয়া মিসেস্ স্পরফিল্ড ডুডলেকে সে সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করিলেন না। তিনি মধুর স্বরে ডড্লেকে বলিলেন, “আপমি দুয়া করিয়া কয়েকদিন আমাদের এখানে থাকিলে বড়ই সুখী হইব। আমাদের স্বদেশের কোন লোককে অতিথিরূপে পাওয়া আমি সৌভাগ্যের বিষয় মনে করি। আমাদের দেশের লোক কয়জনই বা এখানে আসেন? আপনি আজ অপরাহ্নে ‘ডিউসি অস্ আফ্রিকা 'কোম্পানীর জাহাজে এখানে আসিয়াছেন বুঝি?
ডড্লে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়া পূর্ব্ব-আফ্রিকা-সম্বন্ধে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করিলেন। দিবাকর অনেক পূর্বেই অস্তগমন করিয়াছিলেন, কন্সলের গৃহচুডা হইতে সান্ধ্যপ্রকৃতির সুন্দর শোভা নিরীক্ষণ করিয়া উড়লে মোহিত হইলেন। তিনি সেইস্থানে বসিয়া তালীকুঞ্জের অন্তরালবর্তী সুনীল সমুদ্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। কত বিভিন্ন আকারের নৌকা, জাহাজ তাহার দৃষ্টিপথে পতিত হইল।
ডড্লে আহারান্তে কন্সলের সহিত গৃহচুডায় প্রত্যাগমন করিলেন। গভীর রাত্রি পর্যন্ত তাঁহাদের গল্প চলিল। কন্সল-পত্নীও তাঁহাদের গল্পে যোগদান করিলেন। কয়েক ঘণ্টার পর কন্সল-পত্নী বুঝিলেন—তাহার স্বামীর সহিত ডড্লের গোপনীয় কথা থাকাই সম্ভব। সুতরা তিনি তাহাদের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন। তখন কন্সল তাহার চেয়ারখানি ডড্লের আরও নিকটে টানিয়া আনিয়া নিম্নস্বরে বলিলেন, “তুমি যে কার্যের ভার লইয়া এখানে আসিয়াছ, আমি ইতিমধ্যেই তাহাতে হস্তক্ষেপণ করিয়াছি।”
ডড্লে বলিলেন, “আপনি যথাসম্ভব ক্ষিপ্রতার সহিত কার্যারম্ভ করিয়াছেন শুনিয়া আশ্বস্ত হইলাম, এসকল গুরুতর কার্য্যে বিলম্ব না করাই ভাল, কিন্তু আপনি কতটুকু কি করিয়াছেন তাহা জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?”
কন্সল বলিলেন, “নিশ্চয়ই পার। একজন লোকের সন্ধান লওয়া সর্ব্বাগ্রে আবশ্যক বলিয়া, সে এখন কোথায় আছে আমি তাহারই খোঁজ লইয়াছি লোকটির সহায়তা গ্রহণ তোমার পক্ষে অপরিহার্য, অধিক কি, তোমার কার্যের জ্য যে সকল লোকের সহায়তা চাই, এই লোকটি তাহাদের মধ্যে সর্বপ্রধান।” ডড্লে বলিলেন, “আপনি ঠিক কাযই করিয়াছেন, কিন্তু এই লোকটি কে তাহা জানিবার জন্য আমার বড় আগ্রহ হইয়াছে।”
কন্সল বলিলেন, “তাহার নাম সামওয়েলি, সে জাতিতে নিগ্রো এবং সোয়াহিলী দেশের লোক, বিষয়-কর্ম্মানুসন্ধানে সে আক্কিার উপকূলে পরিভ্রমণ, করে। তাহার সাহায্য পাইলে তোমার যত উপকার হইবে—এরূপ আর কিছুতেই হইবে না। লোকটি বিশ্বাসী, বাধ্য, সাহসী এবং সাধুপ্রকৃতি, বিশেষতঃ সে আমেদ বে-হাসেনকে অত্যন্ত ঘৃণা করে। আমেদ বেন্ মুসলমান বলিয়া যে সে ঘণা করে এরূপ মনে করিও না, তাহার এই বদ্ধমূল ঘৃণার অন্য কারণ আছে। আমি সামওয়েলিকে ডাকাইয়া পাঠাইয়াছি, আজ রাত্রে তাহার এখানে আসিবার কথা আছে, বোধ হয় শীঘ্রই আসিবে। সে আসিলে আমি সকল ব্যবস্থা করিয়া দিব।”
প্রায় দশ মিনিট পরে পূর্বোক্ত নিগ্রো কন্সলের গৃহে উপস্থিত হইলে ভৃত্য আসিয়া তাহার আগমন-সংবাদ জ্ঞাপন করিল। কন্সল তাহাকে তাহার সম্মুখে উপস্থিত করিবার জন্ত আদেশ দিলেন। দুই মিনিটের মধ্যে সে কন্সলের সম্মুখে আসিয়া অভিবাদন করিল। ডড্লে সবিস্ময়ে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, লোকটা ছয় ফিট দীর্ঘ, চুলগুলি কেঁকডান-উর্ণার ন্যায়। মাথায় জাঞ্জিবারি টপ। শরীর যেন অসুরের শরীরের মত। সে হাসিয়া কন্সলকে অভিবাদন করিল। তাহার সেই হাসি শিশুর হাসির মত সরল।
কন্সল স্পরফিল্ড ডড্লেকে বলিলেন, “তুমি সোয়াহিলীদের ভাষা জানিতে ত?”
ডড্লে বলিলেন, হ্যাক, জানি এক রকম।
মিঃ স্পরফিল্ড বলিলেন, “ভাল কথা। আর না জানিলেও কোন ক্ষতি ছিল না, সামওয়েলি পৃথিবির নানা ভাষায় কথা কহিতে পারে—বিশেষতঃ ইংরাজী ভাষা সে অনর্গল বলিতে পারে। যাহা হউক, এখন কায আরম্ভ করা যাউক— সামওয়েলি, তুমি বোধ হয় আমেদ বেন্ হাসেনের নাম শুনিয়াছ?”
সামওয়েলির মুখমণ্ডল ঠাৎ ভীষণ ভাব ধারণ করিল, তাহার চক্ষু রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, ডড্লে বুঝিলেন, সে আমেদ বেন্কে কেবল চেনে না, তাকে হাতে পাইলে কাটিয়া টুকরা-টুকরা করে।
মিঃ স্পরফিল্ড বলিলেন, “সামওয়েলি, আমি সংবাদ পাইয়াছি, আমেদ বেন্ হাসেন কতকগুলি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা বারুদ লুকাইয়া হ্রদ-সন্নিহিত প্রদেশে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে। আমি তাহার এই চেষ্টা বিফল করিতে চাই,বুঝিয়াছ?”
সামওয়েলি অত্যন্ত খুসী হইয়া দাঁত বাহির করিয়া হাসিল, যেন কথাটা তাহার মনের মত হইয়াছে।
মিঃ স্পরফিল্ড বলিলেন,“আমেদ বেন্ একখানি বোট লইয়া কমোরো দ্বীপের সন্নিকটে একখানি জাহাজের নিকট যাইবে স্থির করিয়াছে। সে সেই জাহাজ হইতে কতকগুলি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদ তাহার নৌকায় তুলিয়া লইবে, তাহার পর নদীপথে তাহার আড্ডার দিকে অগ্রসর হইবে, কিন্তু তাহাকে ইহা করিতে দেওয়া হইবে না। যদি তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া তাহার অশস্ত্রগুলি কাড়িয়া লইতে পার—তাহা হইলে তুমি আশাতীত পুরস্কার পাইবে।—তাহার সেই বোটখানি এখন কোথায় এ সন্ধান জান কি?
সামওয়েলি বলিল, “না, তাহা জানি না হুজুর, কিন্তু এ বিষয়ের সন্ধান লওয়া তেমন কঠিন নহে।
মিঃ স্পরফিল্ড বলিলেন, “তবে যাও, অবিলম্বে এই সন্ধান লইয়া আমার সহিত দেখা করিবে।—কেবল তাহাই নহে, আমেদ বেনের কে কে সঙ্গী আছে, কোন্ সময়ে তাহারা জাহাজের কাছে যাইবে, তাহাও জানা চাই। আমার এই বন্ধুটি আমার স্বজাতি, ইনিও আমাদের দেশের রাণীর চাকরী করেন, ইনি আমেদ বেনের নৌকায় যাইবেন। তুমি অমেদ বেন্কে গ্রেপ্তার করিয়া তাহার নৌকা লইয়া জাঞ্জিবারে যাইবে। কিন্তু যদি আমেদ বেন্ কোন ক্রমে এই সকল ব্যাপারের সন্ধান পায়, তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই তোমাদিগকে হত্যা করিবে। তুমি এ সকল সংবাদ অতি গোপনে আমার নিকট লইয়া আসিবে। কার্য্যোদ্ধার করিতে পারিলে আমি তোমার পুরস্কার সম্বন্ধে বিশেষষ বিবেচনা করিব।—এখন যাও।”
নিগ্রো মিঃ স্পরফিল্ডকে অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলে মিঃ স্পরফিল্ড ডড্লেকে বলিলেন, “তুমি স্বেচ্ছায় যে কার্য্যের ভার লইয়াছ, আমি তাহা লইতে কখন সাহস করিতাম না। সুখের বিষয়, তোমার জন্য সংসারে কেহ শোক করিবার নাই, তোমার উপর নির্ভর করিতেও কেহ নাই। যদি তোমার স্ত্রী-পুত্রাদি থাকিত, তা হইলে এরূপ সঙ্কটজনক কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে সাহস করা সঙ্গত হইত না।—রাত্রি হইয়াছে, এখন শয়ন কর, পরের চিন্তা পরে করিও।”
মিঃ স্পরফিল্ড ডড্লেকে একটি শয়নকক্ষে লইয়া চলিলেন। মিঃ স্পরফিল্ড তাঁহার নিকট বিদায় লইলে তিনি শয়ন করিয়া নানা কথা চিন্তা করিতে লাগিলেন, জুয়ার আড্ডায় ডাক্তার ল্যাম্পিয়নেব যে সকল কথা শ্রবণ করিয়াছিলেন, তাঁহার এই অভিযানের সহিত তাহার কোন সম্বন্ধ আছে কি না তাহা তিনি বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। ক্রমে মিস্ এরস্কাইনের মোহিনীমূর্ত্তি তাঁহার চিত্রপটে সমুদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, কিন্তু চিন্তার বিরাম কোথায়? অবশেষে তিনি বিরক্ত হইয়া দীপ নির্ব্বাপিত করিয়া মশারি ফেলিলেন।
কতক্ষণ তিনি ঘুমাইয়াছিলেন বলা যায় না, হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গে তাঁহার বোধ হইল—কে তাঁহার মশারির ভিতর প্রবেশ করিয়া তাঁহার কণ্ঠ স্পর্শ করিতেছে। তিনি তৎক্ষণাৎ লাফাইয়া উঠিয়া উভয় হাতে তাহাকে আক্রমণ করিলেন। তখন তাঁহার আততায়ী তাঁহার বক্ষস্থল লক্ষ্য করিয়া ছুরিকা প্রয়োগ করিল। কিন্তু অন্ধকারে ছুরিকাখানি লক্ষ্যভ্রষ্ট হইল। মুহূর্ত্তমধ্যে ডড্লে তাঁহার আততায়ীকে চীৎ করিয়া ফেলিয়া তাহার বুকে বসিলেন, এবং তাহার হাত হইতে ছোরাখানি কাড়িয়া লইয়া তাহার কণ্ঠরোধের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। দুইজনে ধস্তাধ্বস্তি আরম্ভ হইল, শেষে উভয়েই খাটের উপর হইতে মেঝের উপর পড়িয়া লুটাপুটি ও ঝটাপটি। ডড্লের আততায়ী যে-ই হউক, লোকটি যে দীর্ঘদেহ, বলবান ও হৃষ্টপুষ্ট, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন। কিন্তু ডড্লে কাপুরুষ ছিলেন না, তাঁহার দেহেও অসুরের মত বল ছিল, তাহার উপর তিনি ব্যায়ামে সুদক্ষ ছিলেন। উভয়ে প্রাণপণে যুদ্ধ করিলেও তাহাতে কোন ঝপ শব্দ হয় নাই। কিছুকাল নিঃশব্দে যুদ্ধ করিবার পর একটি টেবিলে উভয়ের দেহের ধাক্কা লাগিল। সেই ধাক্কায় টেবিলখানি হুড়মুড়-শব্দে উল্টাইয়া পড়িল। ডড লের আততায়ী নীচে পডিল, ডড লে তাহার দেহের উপর চাপিয়া পড়িলেন, এবং তাহার বক্ষস্থলে উপবেশন পূর্ব্বক উভয় পার্শ্বে তাহার হাত দুইখানি এরূপ দৃঢ়রূপে ধরিয়া রাখিলেন যে,সে হাত নড়াইতেও পারিল না। —টেবিল পতনের শব্দে গৃহবাসিগণের নিদ্রাভঙ্গ হইল, কন্সল মহাশয় একটি বাতি লইয়া, ব্যাপার কি দেখিবার জন্য ব্যগ্রভাবে সেই কক্ষে প্রবেশ করিলেন।
কন্সল উভয়কে তদবস্থ দেখিয়া মিঃ ডড্লেকে সভয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি কাণ্ড। কাহার সহিত যুদ্ধ করিতেছ?”
ডড্লে বলিলেন, “কি জানি মহাশয়! আমি ঘুমাইতেছিলাম, হঠাৎ জাগিয়া দেখি এই লোকটা আমাকে আক্রমণ করিয়াছে, বোধ হয় আমাকে খুন করিতেই আসিয়াছিল। আমি দুর্ব্বল হইলে এতক্ষণ বোধ করি আমাকে জীবিত দেখিতে পাইতেন না। আপনি শীঘ্র দুইজন ভৃত্যকে আমার সাহায্যের জন্য পাঠাইলে ভাল হয়, নতুবা এই শয়তানটা আমাকে ঠেলিয়া উঠিয়া পলাইবে। তেল মাখিয়া আসিয়াছে না কি? রাস্কেলটার শরীর কি পিচ্ছিল।—বেটা যেন পাঁকাল মাছ!”
কন্সল সাহেব তৎক্ষণাৎ সেই কক্ষের বাহিরে গিয়া দুইজন ভৃত্যকে আহ্বান করিবামাত্র তাহারা তাঁহার সহিত সেই কক্ষে প্রবেশ করিল। তাহাদের সাহায্যে ডড্লে তাঁহার আক্রমণকারীকে ভূমিশয্যা হইতে টানিয়া তুলিলেন। সে দণ্ডায়মান হইলেও আলোকের অল্পতা বশতঃ কন্সল বা তাঁহার ভৃত্যেরা তাহাকে চিনিতে পারিল না, তখন আরও কয়েকটি প্রজ্বলিত বর্ত্তিকা আনীত হইল। সেই আলোকে তাহারা আততায়ীকে পরীক্ষা করিয়া দেখিল,—সে একটা জোয়ান আরব, তাহার মুখখানি অত্যন্ত কুৎসিত।
আরবটা অবিলম্বে দৃঢ়রূপে রজ্জুবদ্ধ হইল। অনন্তর কন্সল সাহেব বলিলেন, “ডড্লে ব্যাপার কি আমায় খুলিয়া বল।”
ডড্লে বলিলেন, “আমার বিশেষ কিছুই বলিবার নাই, কারণ আপনারা যাহা দেখিতেছেন তদতিরিক্ত কিছুই আমি জানি না। প্রায় দশমিনিট পূর্ব্বে হঠাৎ আমার নিদ্রাভঙ্গ হয়, এই রাস্কেলটা তৎপূর্ব্বেই আমাকে আক্রমণ করিয়াছিল। উহার হাতে ঐ তীক্ষধার ক্রিচ্খানি ছিল, কিন্তু আমি আহত হই নাই, কারণ, আমি চক্ষুর নিমিষে উহাকে আক্রমণ করিয়া উহার বুকে চাপিয়া বসি। তাহার পর উভয়ে ধস্তাধ্বস্তি করিতে করিতে খাটের উপর হইতে মাটীতে পড়ি। আমাদের শরীরের ধাক্কায় টেবিলখানি হুড়মুড করিয়া পড়িয়া যায়, সেই শব্দে আপনারা এই কক্ষে উপস্থিত হইয়াছেন।”
কন্সল সাহেব বলিলেন, “তোমার প্রাণরক্ষা হইয়াছে এজন্য পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ করিতেছি। তুমি এ যাত্রা বড়ই বাঁচিয়া গিয়াছ।”
ডড্লে হাসিয়া বলিলেন, “বোধ হয় পরমায়ু ছিল-তাই বাঁচিয়াছি, নতুবা ঐ ছুরি যদি বুকে বিঁধিত, তাহা হইলে বাঁচিবার কোনও আশা ছিল না, যাহা হউক-এই লোকটা কে,কেনই বা আমাকে হত্যা করিতে আসিয়াছিল, তাহা উহাকে জিজ্ঞাসা করিলে ভাল হয়।”
কন্সল সাহেব আরবা ভাষায় আরবটাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই কে? কি জন্যই বা এই ভদ্রলোকটিকে খুন করিতে আসিয়াছিলি?”
কিন্তু আরবটা মিঃ স্পরফিল্ডের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ক্রোধে ক্ষোভে তাহার গোল গোল ভাঁটার মত চক্ষু হইতে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইতেছিল।—যাহা হউক, বিস্তর পীড়াপীড়ির পর আরবটা মাথা নাডিয়া বুঝাইয়া দিল, সে তাহার কথা বুঝিতে পারিতেছে না। কিন্তু কোন্ ভাষায় প্রশ্ন করিলে এই দুর্বত্ত তাহা বুঝিতে পারিবে—মিঃ স্পরফিল্ড তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। অতঃপর তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্ফল বুঝিয়া তিনি ডড্লেকে বলিলেন, “আমার বোধ হয় এই এই হতভাগাটা চুরি করিবার উদ্দেশ্যেই এই ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল। প্রথম তোমাকে সাবাড় করিয়া পরে নির্বিঘ্নে চুরি করিবে—এই মতলবেই সম্ভবতঃ তোমাকে আক্রমণ করিয়াছিল,তোমার কিরূপ ধারণা?
ডড্লে বলিলেন, “আপনার অনুমান সত্য কি না আমি তাহা বুঝিতে পারিতেছি না, কিন্তু যদি চুরী করাই উহার উদ্দেশ্য হইত, তাহা হইলে কি আমার জিনিসপত্র লইয়া সরিয়া না পড়িয়া প্রথমেই আমাকে আক্রমণ করিত? আমি ঘুমাইতেছিলাম, সেই সুযোগে চুরী করিয়া চম্পট না দিয়া প্রথমেই আমাকে আক্রমণ করিল কেন?—আমার কোন জিনিস-পত্র চুরী যায় নাই।
মিঃ স্পরফিল্ড বলিলেন, “অদ্ভুত ব্যাপার বটে। আমি এ বাড়ীতে আসিবার পর এরূপ ঘটনা আর কখন ঘটে নাই। আমি অবিলম্বে উহাকে পুলিশের হস্তে সমর্পণ করিব। তাহার পর কাল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তদন্ত করিব। আমার বাড়ীতে চোর। আশ্চর্য ব্যাপার নহে? আমার বাড়ীতে আসিয়া তোমাকে এই প্রকার বিপন্ন হইতে হইল—ইহা অত্যন্ত ক্ষোভের বিষয়। তোমার শান্তিভঙ্গের জন্য আমিই কতকটা দায়ী।”
ডড্লে বলিলেন “না, না, আপনি এ-রকম কথা বলিবেন না। আমার বিপদের জন্য আপনি বিন্দুমাত্র দায়ী নহেন। যাহা হউক, লোকটা শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া যে আপনাকে আক্রমণ করে নাই, ইহাই সুখের বিষয়। আপনার শয়নকক্ষে এই ব্যাপার ঘটিলে মিসেস্ স্পরফিল্ডের আতঙ্কের সীমা থাকিত না। আপনি আমার জন্য ভাবিবেন না, আমি আহত হই নাই, আমার শরীরে দুই একটা সামান্য ছড় গিয়াছে মাত্র। আপনি এখন শয়ন করিতে যান।
মিঃ স্পরফিল্ড সেই কক্ষ ত্যাগ করিলে ডড্লে পূনর্ব্বার, শয়ন করিলেন। অন্য কোন লোকের এরূপ বিপদ ঘটিলে সেই রাত্রে পুনর্ব্বার তাহার নিদ্রাকর্ষণ হইত কি না সন্দেহ, কিন্তু ডড্লে এরূপ অনন্যসাধারণ মানসিক বলের অধিকারী ছিলেন যে, শয়ন করিবার পর দশ মিনিটের মধ্যেই তাঁহার নিদ্রাকর্ষণ হইল। মিঃ স্পরফিল্ড আরব আততায়ীকে পুলিশে চালান দেওয়ার জন্য লইয়া চলিলেন।
ডড্লে নিদ্রিত হইলেও সে-রাত্রে তাঁহার সুনিদ্রা হইল না, রাত্রি-শেষে তিনি এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখিলেন। তাঁহার মনে হইল, তিনি একখানি দেশীয় বোটের উপর আমেদ বেন্-হাসেনের সহিত মল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। তাঁহাদের ‘ফ্ল্যাগ সিপের’র একখানি ছোট ষ্টীমার অদূরে দাঁড়াইয়া ধূম্রোদ্গিরণ করিতেছে, এবং সেই ষ্টীমারখানির ডেকের উপর আধ ডজন খালাসী কয়লা ভাঙ্গিবার হাতুড়ী ও জ্বলন্ত কয়লা সরাইবার হাতা লইয়া দাঁড়াইয়া আছে, যেন সুযোগ পাইলেই তাহারা তাঁহাকে আক্রমণ করিবে।—এইভাবে উভয়ের যুদ্ধ চলিতে লাগিল, বোটখানিও মোজাম্বিক প্রণালীর অভিমুখে অগ্রসর হইল। হাঙ্গরগুলা জল হইতে মুখ তুলিয়া নির্ণিমেষ নেত্রে উভয়ের দিকে চাহিয়া রহিল, যেন উভয়ে যুদ্ধ করিতে-করিতে জলে পড়িলেই তাহাদের ফলার। তিনি আরও দেখিলেন, তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বীর হস্তে এক্ষানি তীক্ষ্ণধার ছুরিকা দীপ্ত সূর্য্য-রশ্মিতে ঝক্-মক্ করিতেছে, অথচ একখানি হাতপাখা ভিন্ন আত্মরক্ষার কোন সম্বল তাঁহার নিকট নাই।—তাঁহার মনে পড়িল—তিনি মিস্ এরস কাইনের হাতে সেই পাখাখানি দেখিয়াছিলেন। লাট সাহেবের বাড়ীতে নাচের দিন সেই পাখা তাঁহার হাতে ছিল।—পাখার হাতল সোণা-বাঁধা, তাহার উপর মিস্ এরস কাইনের নাম খোদিত। হঠাৎ সেই আরবটা বামহস্তে তাঁহার কণ্ঠনালি দৃঢ়রূপে আঁকড়াইয়া ধরিয়া দক্ষিণ হস্ত ঊর্দ্ধে তুলিল,এবং তাহার হস্তস্থিত ছুরিকাখানি তাঁহার কণ্ঠের নিম্নভাগে আমূল প্রোথিত করিল।—সঙ্গে সঙ্গে ডড্লের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি দেখিলেন, ঘর্ম্মধারায় বালিশ ভিজিয়া গিয়াছে।
আবার তিনি চক্ষু মুদিত করিলেন, এবার তন্দ্রা আসিতে-না-আসিতে আর এক উৎকট স্বপ্ন দেখিলেন। তিনি দেখিলেন দিগন্তব্যাপী অকূল সমুদ্রে এক খানি বোট ভাসিতেছে। বোটখানি কোনও জাহাজের ডীঙ্গী। যতদূর দৃষ্টি যায় কোনদিকে কূল-কিনারা দেখা যাইতেছে না। কোনদিকে একখানিও জাহাজ নাই। তিনি প্রথমে সেই বোটে কোন লোক দেখিতে পাইলেন না; কিন্তু কিছুক্ষণ ঠাহর করিয়া দেখিবার পর—বোধ হইল, বোটের উপর একজন মানুষ রহিয়াছে। তিনি কৌতূহলের বশবর্ত্তী হইয়া বোটের আরও নিকটে উপস্থিত হইলেন, তখন তিনি বুঝিতে পারিলেন, লোকটি জীবিত নাই, মরিয়া গিয়াছে। —তিনি বোটে উঠিয়া সেই মৃতদেহটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন, কিন্তু তাহার মুখখানি দেখিবামাত্র চীৎকার করিয়া উঠিলেন। তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি স্বপ্নে মৃত ব্যক্তির যে মুখ দেখিয়াছিলেন, সে মুখ যেন তাঁহারই মুখ। অকুল সমুদ্রে জনসমাগমশূন্য বোটে তাঁহার মৃতদেহ। তাঁহার মৃতদেহ বক্ষে ধরিয়া—বোটখানি অসীম সমুদ্রপথে নিরুদ্দেশষাত্রা করিয়াছে —নিদ্রাভঙ্গেও ডড্লে প্রকৃতিস্থ হইতে পারিলেন না, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গে ঘর্ম্মের ধারা বহিতে লাগিল। তিনি উঠিয়া বসিয়া উভয় হস্তে চক্ষু মার্জ্জনা করিলেন, তাহার পর উৎকণ্ঠিতচিত্তে একবার চতুর্দ্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, দেখিলেন, প্রভাত হইয়াছে, বাতায়ন-পথে প্রভাতের আলোক কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিতেছে।
নিদ্রাভঙ্গে তিনি প্রফুল্ল হইবার জন্য প্রচুর চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা হইল, তাঁহার চক্ষু হইতে উৎকণ্ঠা ও ভীতি-বিহ্বল ভাব বিদূরিত হইল না। যাহা হউক, তিনি প্রভাতেই শীতল জলে স্নান করিলেন। স্নানান্তে তাঁহার শরীর অপেক্ষাকৃত সুস্থ ছইল, মনের ভারও অনেকটা লঘু হইল।
ঘণ্টাখানেক পরে মিঃ স্পরফিল্ড ডড্লেকে লইয়া তাঁহার আফিসে গিয়া বসিলেন। দুইখানি চেয়ারে মুখোমুখী হইয়া বসিয়া কন্সল সাহেব ডড লেকে বলিলেন, “আমি গত রাত্রির দুর্ঘটনাটার কথাই ভাবিতেছিলাম, কিন্তু কোন ও সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি নাই। উহাকে তোমার জিনিস-পত্র চুরি করিতে দেখিলে যদি প্রথমে তুমিই আক্রমণ করিতে, তাহা হইলে এই কাণ্ডের একটা সঙ্গত কারণ স্থির করিতে পারিতাম, কিন্তু ঘটনাটা যে উল্টা রকমের হইয়াছিল। সে যখন তোমাকে আক্রমণ করে—তখন তুমি নিদ্রিত, চুরি করিবার মতলব থাকিলে সে গৃহবাসী নিদ্রিত লোককে কেন আক্রমণ করিবে? এইখানেই বুঝিবার গোল হইতেছে। যাহা হউক, পুলিশ কি রহস্যভেদ করে তাহা জানিবার জন্য বড়ই উৎসুক হইয়াছি, লোকটার পরিচয়ও তাহাদের জানা থাকিতে পারে। আমার বাড়ীতে এ রকম কাণ্ড —বড়ই লজ্জার কথা।”
মিঃ ডড্লে বলিলেন, “ইহাতে আর লজ্জা কি?—ইহা আরবটার দুঃসাহসেরই নিদর্শন। আমাকে অত্যন্ত সাবধানে থাকিতে হইবে, আত্মগোপন করা বড়ই আবশ্যক হইয়াছে। আমেদ বেল্-হাসেন্ যদি আমার উদ্দেশ্য ঘূণাক্ষরেও জানিতে পারে—তাহা হইলে তাহাকে গ্রেপ্তার করা অসম্ভব হইবে।—এবার সে পলাইতে পারিলে, আমরা আর কখন তাহাকে হাতে পাইব না।”
কন্সল সাহেব আড়ষ্ট ভাবে বলিলেন, “সে কথা বড় মিথ্যা নহে, দেখা যাউক, কোথাকার জল কোথায় গিয়া দাঁড়ায়।”
এক ঘণ্টা পরে কন্সল সাহেব ডড্লেকে সঙ্গে লইয়া লাট-প্রাসাদে উপস্থিত হইলেন, লাট সাহেব তাঁহাদিগকে জানাইলেন, শীঘ্রই এই ব্যাপারে যথাযোগ্য তদন্ত হইবে। মিঃ স্পরফিল্ডের নিকট ডড্লের পরিচয় পাইয়া লাট সাহেব সুখী হইলেন। কন্সলের গৃহে তাঁহার ন্যায় সম্মানিত অতিথি লাঞ্ছিত হওয়ায়, লাট সাহেব তাঁহার নিকট অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করিলেন, তাহার পর তিনি ডড লেকে বলিলেন,“এই দুর্ব্বত্তকে যে যথাযোগ্য দণ্ড প্রদান করা হইবে, -এ কথা আপনাকে বলাই বাহুল্য। আমি স্বয়ং উৎপীড়িত হইলেও এতদূর মর্ম্মাহত হইতাম না। আমার শাসনাধীন রাজ্যে—ব্রিটীশ কন্সলের গৃহে আবব হস্তে আপনার লাঞ্ছনা।—এ অত্যাচার অসহ্য। ডোমিঙ্গো, আমার আদেশ পালন করিয়াছ?”
ডোমিঙ্গো লাট সাহেবের এডি-কং।—সে বলিল, “হাঁ, আপনার আদেশ পালিত হইয়াছে।”
লাট সাহেব বলিলেন, “তাহা হইলে আসামীকে অবিলম্বে আমার সম্মুখে হাজির কর। মহাশয়, আপনারা একটু কফি পান করিয়া আমাকে পরিতৃপ্ত করুন, আর একটা চুকট?”
কন্সল লাট সাহেব-প্রদত্ত কদলীবৎ স্থূল চুরুটটি মুখে গুঁজিয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিলেন, তাহার পর তাঁহার মুখ-গহ্বর হইতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুদগম আরম্ভ হইল। কয়েক মিনিট পরে বন্দী আরবটা সেই স্থানে আনীত হইল। তাহার বিকট চেহারা দেখিলে অত্যন্ত সাহসী ইউরোপীয় বীর পুরুষেরও বুক কাঁপিয়া উঠে। তাহার মুখখানি ডালকুত্তার মুখের মত। তাহার চক্ষুদু’টি সাপের চক্ষুর মত পিট্-পিট্ করিতেছিল, তাহার দৃষ্টি ক্রূরতা খলতাপূর্ণ। সে যে আরব—এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। গবর্ণর সাহেব তাহাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু সে একটি কথারও উত্তর দিল না, তালগাছের মত সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া তাঁহার মুখের দিকে মিট্-মিট্ করিয়া চাহিতে লাগিল।—সেই দৃষ্টিতে ভয়ের চিহ্নমাত্র ছিল না, বরং স্পর্ধা ও অবজ্ঞা প্রকাশ পাইতেছিল। তাহাকে নির্ব্বাক দেখিয়া পর্টুগীজ্ গবর্ণরের ক্রোধসিন্ধু উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। তিনি গর্জ্জন করিয়া বলিলেন, “তুই কি মতলবে রাত্রিকালে কন্সল সাহেবের ঘরে ঢুকিয়া এই ভদ্রলোকটিকে আক্রমণ করিয়াছিলি, তোর দলে কোন্ কোন্ লোক আছে,—এ কথা না বলিলে ছুরি দিয়া তোর যকৃত খণ্ড-খণ্ড করাইয়া ফেলিব।”—রাগে তাঁহার মোটা কাল গোঁফজোড়াটা ফুলিয়া উঠিল।
কিন্তু আরবটা খাতির-নদারৎ।—ভয় প্রদর্শনে কোনও ফল হইল না। তাহার মুখ হইতে একটা কথাও বাহির করিতে পারা গেল না। তখন গবর্ণর সাহেব বলিলেন, “এখন উহাকে লইয়া যাও, হতভাগা এখন কথা কহিতেছে না, কিন্তু চাবুকের চোটে উহার মুখে কথা ফুটিবে। পিঠে শপাশপ্ চাবুক পড়িবে, আর মুখে কথার খৈ ফুটিবে।—তাহার পর উহার কি শাস্তি হয়—তাহা আপনাৱা শুনিতেই পাইবেন।”
অনন্তর ডড্লে কন্সলের সহিত তাঁহার গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। অপরাহ্নকালে তিনি তাঁহার কক্ষে বসিয়া চিঠি-পত্র লিখিতে লাগিলেন। কিছুকাল পরে মিঃ স্পরফিল্ড হাঁপাইতে হাঁপাইতে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “বড়ই অদ্ভুত কাণ্ড হইয়া গিয়াছে। আসামীকে আজ সকালে জেলখানায় লইয়া যাইবার সময় সে পলাইয়াছে।—এ কথা শুনিলে লাট সাহেব চটিয়া আগুণ হইবেন, কিন্তু,—”
ডড্লে বলিলেন, “সব বুঝিয়াছি।—যাহাদের ত্রুটিতে আসামী পলাইয়াছে— তিনি তাহাদের ফাঁসি দিবেন, আসামীকে ধরিতে পারিলে তাহাকে জীবন্ত গোরে পুঁতিবেন,—সব হইবে,কিন্তু তাহাকে ধরিবার জন্য তিনি আন্তরিক চেষ্ট করিবেন কি? আসামী পলাইয়াছে, সুতরাং এই ব্যাপার কি দুর্ভেদ্য রহস্য-সমাচ্ছন্ন—তাহা আর জানিবার উপায় রহিল না।
মিঃ স্পরফিল্ড বলিলেন, “এই রহস্যজাল ভেদ করা বোধ হয় অসম্ভব হইবে। আমি গবর্ণরকে জানাইয়াছি, তিনি আসামীকে গ্রেপ্তার করিবার ব্যবস্থা করুন।—আমার একটা বড় ভুল হইয়াছে, সামওয়েলি এখানে আসিলে আরবটাকে পুলিশের হাতে দিলেই ভাল হইত। সামওমেলি নিশ্চয়ই তাহাকে চিনিতে পারি, তাহার সম্বন্ধে দুই-চারিটি কথা বলিতেও পারিত।”
ডড্লে বলিলেন, “সামওয়েলির সহিত কি আমাদের শীঘ্র দেখা হইবার আশা আছে? ক্রমেই বিলম্ব হইয়া যাইতেছে, আমেদ বেন হোসেন আমাদের চক্ষুতে ধূলা দিয়া ইতিমধ্যে পলাইতে না পারে।”
মিঃ স্পরফিল্ড বলিলেন, “এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাক, সামওয়েলি নিশ্চয়ই তাহার উপর দৃষ্টি রাখিয়াছে।”
তাঁহারা বাতায়ন-সন্নিকটে বসিয়া গল্প করিতেছিলেন, হঠাৎ রাজপথে একটি ফেরিওয়ালার আবির্ভাব হইল। তাহার কাঁধে একটি প্রকাণ্ড বোঁচকা, সেই বোঁচকায় নানা প্রকার পণ্যদ্রব্য ছিল। সে মিঃ স্পরফিল্ড ও ডড্লেকে গল্প করিতে দেখিয়া তাহাদের জিজ্ঞাসা করিল,—“হুজুর, কিছু সওদা করিবেন? আমার কাছে নানা রকম মনোহারী জিনিস আছে।”
মিঃ স্পরফিল্ড বলিলেন, “না, আমার কিছু কিনিবার আবশ্যক নাই।”
ডড্লে ফেরিওয়ালার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া মিঃ স্পরফিল্ডকে নিম্নম্বরে বলিলেন, “উহাকে ভিতরে ডাকুন, আমরা উহার জিনিসগুলি কিনিব।”
মিঃ স্পরফিল্ড সবিস্ময়ে ডড্লের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “হঠাৎ তোমার এ সখ হইল কেন?
মিঃ ডড্লে বলিলেন, “লোকটাকে চিনিতে পারিলেন না? এযে আপনারই সামওয়েলি।