নাবিক-বধূ/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

মিঃ ডড্‌লে তাঁহার সামরিক পরিচ্ছদ কেপ টাউনে তাঁহার জাহাজে রাখিয়া আসিয়াছিলেন, তাঁহার সাধারণ পরিচ্ছদও মোজাম্বিকে কন্সলের বাড়ীতে তাঁহার ব্যাগের ভিতর আবদ্ধ ছিল। তিনি ছদ্মবেশে মাজাজিমা উপসাগরের কুলে আসিয়া দাঁড়াইলেন, তখন তাঁহাকে ইংরাজ বলিয়া কাহারও চিনিবার সাধ্য ছিল না। তাঁহার দেহে ফকিরের পরিচ্ছদ, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ কৃষ্ণবর্ণ। —তিনি উন্মত্ত ফকির সাজিয়া সমুদ্রকুলে আসিয়া দাঁড়াইলেন, সমুদ্রের অবিরাম জলকল্লোল তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতে লাগিল। কোন দিকে অন্য কোন শব্দ নাই, কোন দিকে জনপ্রাণীর সমাগম নাই। ডড্লের বোধ হইল, তিনি আনন্দ ও আলোকপূর্ণ সুখস্মৃতির আগারস্বরূপ পুরাতন জগতের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া কোনও এক অপরিজ্ঞাত, উদ্বেগ-আতঙ্ক-সমাকুল নূতন জগতের সিংহদ্বারে আসিয়া দণ্ডায়মান হইয়াছেন।—তিনি যতই সাহসী ও ধীর প্রকৃতির লোক হউন, সে সময় তাহার মন যে অত্যন্ত চঞ্চল ও উদ্বিগ্ন হষ্টয়া উঠিয়াছিল—এ কথার উল্লেখ বাহুল্যমাত্র। তাঁহার তখনকার মনের ভাব ভাষায় প্রকাশের চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। পাগলের অভিনয় করিতে উদ্যত হইয়া তিনি প্রায় পাশলের মতই হইয়াছিলেন,–কিন্তু এই সঙ্কটময় মুহূর্তেও মিস এরস্কাইনের মনোহারিণী মূর্ত্তি তিনি ভুলিতে পারিলেন না, তাঁহার মনে হইল, “মিস এরস্কাইন যদি এ সময় আমাকে দেখিতেন—তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই আতঙ্কে অভিভূত হইতেন। —যাহা হউক, জলে নামিলে আমার রঙ ধুইয়া যাইবে না-ইহাই আমার সৌভাগ্য, নতুবা বোটে উঠিয়াই আমাকে ধরা পডিতে হইত।”

 ‘ধাও'খানি প্রায় দুই শত গজ দূরে নোঙ্গর করিয়াছিল। মিঃ ডড্‌লে এসে ‘ধাও' লক্ষ্য করিয়া জলে সাঁতার দিতে লাগিলেন। তাঁহার ন্যায় সন্তরণ বলিষ্ঠ যুবকের পক্ষে দুই শত গজ সন্তরণ কিছুমাত্র কঠিন নহে, কিন্তু তাহাতে যথেষ্ট বিপদের আশঙ্কা ছিল, কারণ উপসাগরটি অসংখ্য হাঙ্গরে পূর্ণ, বিশেষতঃ রাত্রিকাল।—হাঙ্গরের উদরে প্রবেশ করিতে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না॥

 ডড্‌লে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সাঁতার দিয়া ‘ধাও’খানির পাশে উপস্থিত হইলেন। তিনি লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন, নোঙ্গরের কাছে পাহারার কোন বন্দোবস্ত নাই, ইহাতে তিনি অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্ত হইলেন, এবং অতি কষ্টে ধাও’র উপর আরোহণ করিলেন। অতঃপর তিনি সিক্তবস্ত্রে ধাওর এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া, কোথায় লুকাইবেন তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। ধাওখানি ক্ষুদ্র নহে, একখানি ছোট জাহাজ বলিলেই চলে, তাহা এক শত টন মাল বহিতে পারে। তাহার দুইটি মাস্তুল। উড়লে সাবধানে চারি পদ অগ্রসর হইলেন,কিন্তু মাঝি-মাল্লা একজনকেও দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি ধীরে ধীরে ডেকের উপর আসিলেন, সামওয়েলি কোথায়, এবং সে তাহার আগমন লক্ষ্য করিয়াছে কি না, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না। তিনি অত্যন্ত চঞ্চল হইলেন, বুঝিলেন, যদি দৈবাৎ ধরা পড়েন, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই। সামওয়েলির সহিত কোথায় কিরূপে তাহার সাক্ষাৎ হইবে, তাহা অনুমান করিতে না পারিয়া তাহার উৎকণ্ঠা বর্ধিত হইল।

 তখন আর রাত্রি ছিল না। নৈশ-অন্ধকার ক্রমে তরল হইতে লাগিল, এবং প্রভাতকল্পা সর্ব্বরীর পাণ্ডুর আভা ক্রমে হ্রাসপ্রাপ্ত হইয়া উষার আলোকে চতুর্দিক ধীরে-ধীরে আলোকিত হইতে লাগিল। আকাশে যে কয়েকটি শী প্রভ নক্ষত্র দেখা যাইতেছিল,তাহারা একে একে অদৃশ্য হইল, এবং পূর্বাকাশের বর্ণ প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তিত হইতে লাগিল। অবশেষে পূর্বগগন নানাবণে সুরকি করিয়া দিবাকরের হিরন্ময় কিরীটের উজ্জ্বল আভা দিগন্তে প্রসারিত লি। প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গে বাযুবেগ প্রবল হইল। বায়ুবেগে ধাওখানি, দুলিতে আরম্ভ করিল। তাহা লক্ষ্য করিয়া নীচের ডেক হইতে কে একজন সুপ্তোখিতের ন্যায় জডিতস্বরে—সেলিম, নুরবক্স, কেফাৎ—প্রভৃতি মাল্লাদের নাম। মিয়া ডাকাডাকি করিতে লাগিল।—তাহার আদেশে মাল্লারা একে একে

তাহার নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং তাহার ইঙ্গিতে সকলে পশ্চিমাস্য হইয়া নমাজে বসিল।

 মাঝি-মাল্লাদিগকে নমাজে প্রবৃত্ত দেখিয়া মিঃ ডড্‌লে মনে করিলেন, তাহাদের সম্মুখে হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করিবার ইহাই উৎকৃষ্ট অবসর। তাহারা নমাজ শেষ করিয়া উঠিবে—এমন সময় মিঃ ডড্‌লে জাহাজের উপরের ডেকে দণ্ডায়মান হইয়া মাল্লার মহিমাজ্ঞাপক একটি ‘বয়েৎ’ উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করিতে লাগিলেন; সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার উভয় হস্ত মাথার উপর সবেগে ঘুরিতে লাগিল!—মাঝি-মাল্লারা তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া ক্ষণকাল কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া বিহ্বলভাবে বসিয়া রহিল।—তাহার পর তাঁহাকে দেখিবার জন্য সেইদিকে মস্তক প্রসারিত করিল। তাহারা দেখিল, একটা পাগল ডেকের উপর দাঁড়াইয়া তারস্বরে কোরাণ-সরিফের ‘বয়েৎ’ আওড়াইতেছে!—লোকটা কিরূপে ‘ধাও’র উপর আসিল—তাহারা তাহা স্থির করিতে পারিল না—পাগলটার উদ্দেশ্য কি, তাহার আকস্মিক আবির্ভাবের কি ফল—এতৎসম্বন্ধে তাহারা তর্কবিতর্ক করিতেছে, এমন সময় একটি বৃদ্ধ একটা কামরা হইতে বাহির হইয়া তাহাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। বৃদ্ধ হইলেও লোকটা যে বেশ বলবান—তাহা বুঝিতে ডড্‌লের বিলম্ব হইল না। তাহার চক্ষু দু’টির দিকে চাহিয়াই তিনি বুঝিতে পরিলেন, লোকটা অত্যন্ত ক্রূরপ্রকৃতি ও চতুর।—এই ব্যক্তিই যে আমেদ বেন্-হাসেন, এ সম্বন্ধে তাঁহার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না—তিনি মাথার উপর হাত ঘুরাইতে ঘুরাইতে পুনর্ব্বার আর একটি ‘বয়েৎ’ তার স্বরে আবৃত্তি করিলেন। তাহার পর তিনি লাফাইতে লাফাইতে আমেদ বেন্-হাসেনের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাহার পদপ্রান্তে নিপতিত হইলেন। তিনি অভিনয়ের চরমোৎকর্ষ প্রদর্শন করিলেও তাহার বুকের মধ্যে কাঁপিতেছিল, কারণ তিনি বুঝিয়াছিলেন, যদি সেই ধূর্ত্ত আরব কোনরূপে তাঁহার প্রতারণা বুঝিতে পারে, তাহা হইলে মুহূর্ত্তমধ্যে তাঁহার প্রাণান্ত হইবে।—তিনি তৎক্ষণাৎ উঠিয়া বসিলেন, এবং সম্মুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া ঘন-ঘন শিরঃসঞ্চালন করিতে করিতে কোরাণের বয়েৎ আবৃত্তি করিতে লাগিলেন।

 আমেদ বেন্-হাসেন এই দৃশ্য দেখিয়া কিয়ৎকাল স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর ছদ্মবেশী ডড্‌লেকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুই কোথা হইতে আসিয়াছিস্? আমার এই ধাওর উপরেই বা কি করিয়া আসিলি?”

 পাগল বলিল, “কাহার হুকুমে লম্বা ঘাসের ভিতর দিয়া সন্-সন্ করিয়া বাতাস বহিয়া যায়? বোকা লোকের মুখ দিয়া কে জ্ঞানের কথা বাহির করেন?—খানা দেও সাহেব, বড় ভুক্ লাগিয়াছে। আল্লা তোমার মঙ্গল করিবেন; তুমি যেখানে যাইবে—তোমার নসিবে সোণা ফলিবে।”

 ডড্‌লে বুঝিলেন, সামওয়েলির কথা সত্য। তাঁহার কথা শুনিয়া আমেদ বেন্-হাসেনের মুখ প্রফুল্প হইল, সে বুঝিল, তাহার শুভযাত্রার নিদর্শন স্বরূপ আল্লাই এই পাগলাটাকে আসমান হইতে তাহার ধাওর উপর নামাইয়া দিয়াছেন!

 আমেদ বেন্-হাসেন ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া বলিল, “আমি তোমাকে খাইতে দিব, আশ্রয়ও দিব; আমার মনের বাসনা পূর্ণ হইলে তোমার সকল অভাব দূর করিব। কিন্তু যদি আমার অমঙ্গল হয়, যদি তোমার কথার খেলাপ হয়, তাহা হইলে আমি তোমাকে ‘জবে’ করিব।”

 ডড্‌লে তাহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া পূর্ব্ববৎ শিরঃসঞ্চালন পূর্ব্বক কোরাণের আর একটি ‘বয়েৎ’ আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। তিনি মনে মনে খুসী হইলেও তাঁহার মানসিক চাঞ্চল্য দূর হইল না। কার্য্যোদ্ধারের যে এখনও অনেক বিলম্ব!—ইতিমধ্যে কখন্‌ কি বিপদ ঘটিবে কে বলিতে পারে?

 বায়ুর বেগ ক্রমেই প্রবল হইতেছে দেখিয়া, আমেদ বেন্-হাসেন পাল তুলিয়া দিতে বলিল।—মাঝি-মাল্লারা নোঙ্গর তুলিয়া ‘ধাও’র পাল খাটাইয়া দিল। ধাওখানি হেলিয়া-দুলিয়া মুক্ত সমুদ্রের অভিমুখে অগ্রসর হইল। ডড্‌লে ধাওর গন্তব্য-পথ লক্ষ্য করিয়া বুঝিলেন, তাহা জাঞ্জিবারের দিকে চলিয়াছে। অনুকূল বায়ুপ্রবাহে ধাওখানি অতি দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল।

 ডড্‌লে যেখানে বসিয়া ছিলেন, সেখান হইতে উঠিলেন না; একইভাবে মাথা নাড়িয়া কখন উচ্চৈঃস্বরে কখন-বা বিড়্বিড়্ করিয়া ‘বয়েৎ’ আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। আমেদ বেনের আদেশানুসারে কতকগুলি খাদ্যদ্রব্য তাঁহার সম্মুখে আনীত হইল, কিন্তু তিনি তৎপ্রতি দৃষ্টিপাতও করিলেন না।—তিনি সামওয়েলির সহিত সাক্ষাতের আশায় কয়েকবার আড়চক্ষে ইতস্ততঃ চাহিলেন, কিন্তু তাহাকে একবারও দেখিতে পাইলেন না। মধ্যাহ্নে একবার মাত্র তিনি তাহাকে দেখিতে পাইয়াছিলেন। সে ছদ্মবেশে থাকিলেও তিনি তাহাকে চিনিতে পারিলেন, কিন্তু যে কারণেই হউক, সে তাঁহার সহিত কথা কহিল না। তাঁহাকে চিনিতে পারিয়াছে এরূপ ভাবও প্রকাশ করিল না। —তিনিও কোনরূপ আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না। সায়ংকালে ধাওখানি দীর্ঘপথ অতিক্রম করিয়া পম্বা উপসাগরে প্রবেশ করিল। ইহার দক্ষিণ কূলে ‘নিয়ামাজেজি’ নামক পল্লী। রাত্রির মত সেইস্থানে নোঙ্গর করা হইল। আমেদ বেন্-হাসেন ‘ধাও’ হইতে নামিয়া তীরে উঠিল। সে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘ধাও’য়ে ফিরিল না। এই অবসরে মিঃ ডড্‌লে সামওয়েলির সহিত সাক্ষাতের সুযোগ পাইলেন।—তিনি যেখানে বসিয়াছিলেন, সামওয়েলি ধীরে ধীরে সেই স্থানে আসিয়া দাঁড়াইল।

 মিঃ ডড্‌লে কোরাণের বয়েৎ আবৃত্তি করিতে-করিতে সামওয়েলির মুখের দিকে না চাহিয়াই নিম্নস্বরে বলিলেন, “আমেদ বেন্ আমাকে সন্দেহ করে নাই ত?”

 সামওয়েলি বলিল, “না, আপনার কোন চিন্তা নাই। কোন ইংরাজও ঠাহর করিতে পারিবে না যে, আপনি ইংরাজ।”

 মিঃ ডড্‌লে বলিলেন, “আমেদ বেন্-হাসেন কি ঠিক করিয়াছে, বল। বোট কখন নোঙ্গর তুলিবে? কোথায় বা জাহাজের সঙ্গে দেখা হইবে?”

 সামওয়েলি বলিল, “কাল সকালে নোঙ্গর তোলা হইবে। পরদিন সকালে কামোরো দ্বীপের উত্তরে রাস্‌বাকুতে সেই জাহাজের সঙ্গে আমাদের দেখা হইবে।”

 মিঃ ডড্‌লে বলিলেন, “পরশু? আচ্ছা, পিস্তলটা তোমার সঙ্গে আছে ত?”

 সামওয়েলি বলিল, “ঠিক আছে। আমি সুযোগ খুঁজিতেছি।—আমি এখন যাই, অধিক বিলম্ব হইলে সন্দেহ করিতে পারে। সেলাম।”

 ডড্‌লে বলিলেন, “সেলাম! আবার সুযোগমত দেখা করিও।”

 অল্পক্ষণ পরে আমেদ বেন্-হাসেন সেই স্থানে উপস্থিত হইল।—সে মুসলমান হইলেও মুসলমান ধর্ম্মের বিধি-নিষেধ পালন করিত না, সে মদ্যপান করিয়া টলিতে লাগিল। পা যে কোথায় পড়ে, তাহার স্থিরতা নাই।

 পরদিন প্রত্যুষে ধাওখানি নোঙ্গর তুলিয়া গন্তব্য পথে যাত্রা করিল। অদূরে কমোরো প্রদেশের তীরভূমি দুর্গম অরণ্যে সমাচ্ছন্ন। এই প্রদেশ ফরাসী গবর্মেণ্টের অধিকারভুক্ত হইলেও স্থানীয় সুলতানেরা স্বাধীন নরপতির ন্যায় রাজত্ব করিতেন। স্থানীয় লোকেরা নৌকা লইয়া জাঞ্জিবার হইতে মোজাম্বিকের উপকূল পর্যন্ত ভূভাগে বাণিজ্য করিত। বড় বড় জাহাজ এ অঞ্চলে মাসে একবার মাত্র আসিত, কিন্তু তাহা মেয়টা ভিন্ন অন্য কোন বন্দরে ভিড়িত না। রাস্‌বাকু কমোরো দ্বীপের উত্তরাংশে অবস্থিত। এই স্থানটি পর্ব্বতময়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আগ্নেয়গিরি সেখানে অনেক ছিল।

 সেইদিন সায়ংকালে নৈশ-ভোজন শেষ করিয়া আমেদ বেন্-হাসেন ছদ্মবেশী ডড্‌লেকে ডাকিয়া পাঠাইল।—তিনি আমেদ বেনের সহিত দেখা করিতে চলিলেন। তিনি মনে মনে বলিলেন, “আমি যদি আরবী ভাষায় ভাল করিয়া কথা কহিতে না পারি, তাহা হইলে এ বেটা আমাকে সন্দেহ করিবে, একটু সন্দেহ হইলেই ত সর্ব্বনাশ।—কাল রাত্রি পর্যন্ত উহার সহিত আমার দেখা না হইলেই ভাল ছিল।”

 ডড্‌লে আমেদ বেন্-হাসেনের কামরায় প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, সে একখানি গালিচার উপর বালিশে ঠেস দিয়া বসিয়া আছে। সে ডড্‌লেকে সাদরে আহ্বান করিয়া তাহার পাশে বসিতে বলিল।

 ডড্‌লে আরবীতে বলিলেন, “খোদাতালা আমেদ বেন্-হাসেনের মঙ্গল করুন। তাঁহার ছেলেমেয়েরা সুখে থাক, তাঁহার শত্রুরা উচ্ছন্ন যাউক, আর যাহারা—”

 আমেদ বেন্-হাসেন বলিল, “থাম্‌রে পাগ্‌লা, থাম।—আগে বল তুই কে, এখানে কোথা হইতেই বা আসিতেছিস্।”  কিন্তু ডড্‌লে কোন উত্তর দিলেন না, তিনি প্রথমে মনে করিয়াছিলেন, নিজের ও তাঁহার পিতার কল্পিত নাম বলিবেন, বাসস্থানও যেকোন একটা যায়গায় বলিবেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁহার মনে হইল, আমেদ বেন্ যদি সেই অঞ্চলের লোক হয়—তাহা হইলে পরিচয় লইয়া গোল বাধিতে পারে, সে জেরা আরম্ভ করিলেই সর্ব্বনাশ —সুতরাং তিনি পাগলামির ভাণ করিয়া প্রলাপ-বাক্য উচ্চারণ করাই সুসঙ্গত মনে করিলেন। আমেদ বেন্-হাসেন তাঁহাকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া কোন সদুত্তর পাইল না, তখন সে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে বিদায় করিয়া দিল।—তিনি স্বস্থানে উপস্থিত হইয়া অন্যের অলক্ষ্যে গোপনে কিছু আহার করিলেন।—সামওয়েলি তাঁহাকে গোপনে কিছু খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করিয়া দিয়াছিল।

 জাহাজের মাঝি-মাল্লারা জানিত, এই পাগলাটা কিছুই খায় না, কেবলই খোদার নাম কীর্ত্তন করে।—এজন্য তাঁহার প্রতি তাহাদের শ্রদ্ধা-ভক্তি শতগুণ বর্দ্ধিত হইয়াছিল। তাহাদের ধারণা হইয়াছিল, পাগলাটা নিশ্চয়ই কোন ছদ্মবেশী পীর। সুতরাং তাহাদের কেহই তাঁহাকে বিরক্ত করিতে সাহস করিল না।

 পরদিন মধ্যাহ্নকালে কমোরো দ্বীপের তীরভূমি পরিলক্ষিত হইল। —অবশেষে ধাওখানি রাস্‌বাকুর সন্নিহিত হইল। আমেদ বেন্-হাসেন গভীর জলে নোঙ্গর করিয়া তীরে উঠিল। সেই অবসরে সামওয়েলি ডড্‌লের সহিত পরামর্শ করিতে আসিল।

 মিঃ ডড্‌লে সামওয়েলিকে বলিলেন, “কাল সকালে ষ্টীমারখানি দেখা যাইবে। সেই ষ্টীমারের মালপত্র ‘ধাও’র উপর নামাইয়া লওয়া হইলে ষ্টীমার বন্দর ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে, তাহার পর আমাদের কায আরম্ভ করিতে হইবে। মধ্যাহ্নে যখন তাহারা খানায় বসিবে—সেই সময়ই উৎকৃষ্ট সুয়োগ। আমাদের ত সন্দেহ করে নাই, সুতরাং তাহার নিশ্চিন্তমনে বসিয়া গিলিবে।—তুমিও তাহাদের দলে থাকিবে, কিন্তু আমার ইঙ্গিতমাত্রই তুমি লাফাইয়া একেবারে হাতিয়ার বাহির করিবে; তাহাদিগকে বলিবে—নড়িয়াছিস্ কি মরিয়াছিস্।’—ইতিমধ্যে আমি আমেদ বেন্-হাসেনকে বন্দী করিব।—আমার কথা বুঝিয়াছ?”

 সামওয়েলি মাথা নাড়িয়া জানাইল, সে ঠিক বুঝিয়াছে। তাহার পর আরও দুই-চারিটি কথার পর সামওয়েলি প্রস্থান করিল। ডড্‌লে সেই অন্ধকার- কোণে একাকী বসিয়া চিন্তাকুলচিত্তে ঊর্দ্ধাকাশের অগণ্য নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার হৃদয় নানা চিন্তায় আন্দোলিত হইতে লাগিল।

 পদিন অতি প্রত্যুষে ‘ধাও’র মাঝি-মাল্লারা ব্যস্তভাবে চারিদিকে ঘুরিতে লাগিল,যেন তাহার কি একটা পরিবর্ত্তনের প্রত্যাশা করিতেছে।—আমেদ বেন্-হাসেন অত্যন্ত ব্যস্তভাবে ঘন-ঘন সমুদ্রের দিকে চাহিয়া দাড়ি চুল্‌কাইতে লাগিল,—কিন্তু তখনও নোঙ্গর উঠিল না।

 বেলা একটু অধিক হইলে সকলের আহার শেষ হইল। অনন্তর নোঙ্গর তুলিয়া ‘ধাও’খানি পুনর্ব্বার গন্তব্যপথে যাত্রা করিল। তখন আকাশ বেশ পরিষ্কার, সমুদ্র স্থির, সূর্য্যের উজ্জ্বল রশ্মিজাল সমুদ্রবক্ষে প্রতিফলিত হইতে- ছিল। অনুকূল বাযুপ্রবাহে ‘ধাও’ তীরবেগে ছুটিয়া চলিল।—হঠাৎ ‘ধাও’র উপর কে অস্ফুট আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে ‘ধপ্’করিয়া একটা শব্দ হইল। মিঃ ডড্‌লে বিপদের আশঙ্কা করিয়া একটু সরিয়া দাঁড়াইতে-না- দাঁড়াইতে হঠাৎ যেন তাঁহার মস্তকের পশ্চাৎভাগে হাতুড়ীর ঘা পডিল।— ব্যাপার কি বুঝিবার পূর্ব্বেই তিনি সেই স্থানে নিপতিত হইলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল।